জীবন সাথী💜 পর্ব-১৮

0
940

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৮.
~
ড্রয়িং রুমে বসে আছে ৪ জন মানুষ।পারভেজ সাহেব আর আরাফ একপাশে চেয়ারে বসেছেন আর অন্য পাশে সোফাতে বসেছেন দুজন পুলিশ অফিসার।তাদের কাঁধের ব্যাচ দেখে আরাফ বুঝতে পারে এখানে একজন থানার ইনচার্জ আর অন্য জন এস.আই।অনুর মা রাহেলা বেগম ৪ কাপ চা আর কিছু ফলফলাদি তাদের সামনে রেখে আবার রান্না ঘরে চলে গেলেন।পারভেজ সাহেব চায়ের কাপ গুলো তাদের দিতে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,

”নিন অফিসের চা খান আর কথা বলুন।”

দুই জন অফিসের হাত বাড়িয়ে চার কাপ নিলো।ইনচার্জ চায়ের কাপে হালকা চুমুক দিয়ে সেটা পাশে রাখলেন তারপর তিনি আরাফ আর পারভেজ সাহেবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,
”তো এবার আপনারা বলুন যে সেদিন ঠিক কি কি হয়েছিল?আর হ্যাঁ অবশ্যই সবটা সত্যি যেন হয়।”

পারভেজ সাহেব কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরাফ বলে উঠে,
”আমি বলছি অফিসার।আর আমি সবটা সত্যিই বলবো।”

আরাফের কথা শুনে পারভেজ সাহেব বিচলিত হয়ে পড়লেন।তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আরাফকে বললেন,
”আরাফ তোর কিছু বলতে হবে না।আমি বলছি তো সব কিছু।”

আরাফ পি.এর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,
”তুমি কি করে সবটা বলবে;যেখানে সব কিছু করেছি আমি সেখানে সবটা আমারই বলা উচিত।”

আরাফের কথায় পারভেজ সাহেবের মনে অজানা ভয় ঢুকে পড়ে।তিনি খুব ভালো করে জানেন আরাফ সব সত্যি বলে দিবে।কিন্তু এমনটা হলে যে আরাফের জেলও হতে পারে।চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ে তার;কিন্তু আরাফ সেদিকে খেয়াল না করে অফিসারদের সবটা সত্যি বলতে শুরু করে,

”আসলে অফিসার সেদিন বিল্ডিংয়ে আগুনটা আমি লাগিয়েছিলাম।আমার পি.এ মানে পারভেজ আহমেদকে কিছু খারাপ লোক আটকে রেখেছিলো।তারা উনাকে আর আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে তখন আমি পি.একে বাঁচানোর জন্য কোনো উপায় না পেয়ে বিলডিংয়ের গ্রাউন্ট ফ্লোরের শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুন লাগিয়ে দেই।আমি জানি আমার এই আগুনের কারণে কয়েকজন মানুষ মারাও গেছে।কিন্তু তাতে আমার কোনো আফসোস নেয়।আমি আমার পি.একে বাঁচাতে পেরেছি সেটাই যথেষ্ট।আমার কাজটা যে আইনের চোখে অপরাধ সেটাও আমি জানি;এখন আপনারা চাইলে আমাকে গ্রেফতার করতে পারেন।”

কথাটা বলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে আরাফ।তার সামনে বসে থাকা অফিসার গুলো একজন অন্য জনের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
”দেখুন মি.আরাফ আপনি যা করেছেন সেটাও একটা অপরাধ।যদিও আপনি নিজেকে আর পারভেজ আহমেদকে বাঁচানোর জন্য এমনটা করেছেন;তবে আপনার এই কাজের জন্য কিছু মানুষ মারা গিয়েছে।কিন্তু যেহেতু আপনি নিজেকে রক্ষা করার জন্য এমনটা করেছেন তাই আমার মনে হয় কোর্ট আপনাকে মুক্তি দিলেও দিয়ে দিতে পারে।কিন্তু এখন আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে;আর কাল এই কেইসটা কোর্টে উঠবে।তখন কোর্টই বিচার করবে যে আপনি শাস্তি পাবেন কি পাবেন না।এর আগে একদিনের জন্য হলেও আপনাকে থানায় থাকতে হবে।”

অফিসারের কথা শুনে পারভেজ সাহেব ক্ষেপে যান।তিনি রেগে গিয়ে বলে উঠে,
”মানে কি অফিসার!আরাফ তো আর ইচ্ছে করে সবটা করেনি।ও যদি আজকে ওই বিল্ডিংয়ে আগুন না লাগতো তাহলে আমাকে আর ও কে দুজনকেই মেরে ফেলা হতো।ও যা করেছে শুধু মাত্র আমার কথা ভেবে করেছে।আসল অপরাধী তো তারা যারা আমাকে আর আরাফকে আটকে রেখেছিলো আপনি তাদের না এরেস্ট করে আরাফকে এরেস্ট করার কথা কেন বলছেন?”

”আসল অপরাধী কে বা করা তা আমরা তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করবো।চিন্তা করবেন না অপরাধীরা কেউই ছাড় পাবে না।সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।তবে এখানে মি.আরাফের করা কাজটাও একটা অপরাধ।তাই ডিউটি অনুযায়ী আমাদের উনাকে গ্রেফতার করতে হবে।আর কাল যেহেতু কেইসটা কোর্টে উঠছে তাই আজই আপনি একজন ভালো এডভুকেট খুঁজে নিন।কাল যেন তিনি উনার হয়ে কোর্টে কথা বলতে পারেন।”
.
পারভেজ সাহেবের মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায়।চোখের কোণে পানি জমে তার।আরাফকে যে আর এতো কষ্টে দেখতে পারছেন না তিনি।আরাফ বুঝতে পারছে তার পি.এ তার জন্য মন খারাপ করছে।তাই সে পি.এর হাত দুটোকে তার হাতের মাঝে নিয়ে মিহি কন্ঠে বলে,

”পি.এ মন খারাপ করছো কেন?তুমি মন খারাপ করলে আমারও তো মন খারাপ হয় তাই না।আর এতো ভেবো না আমি কালই আমার ছাড়া পেয়ে যাবো দেখো।তোমার দোয়া আছে না আমার সাথে;কিচ্ছু হবে না আমার।আর তুমিতো জানো পি.এ আমার মিথ্যে পছন্দ না।সত্যি বলে যদি শাস্তিও পেতে হয় তবু ও আমি রাজি তাও আমি মিথ্যে বলবো না।আমি যা করেছি তোমাকে ভালোবেসে করেছি।আমার কৃতকর্মের জন্য আমার বিন্দু মাত্র আফসোস নেয়।যে মানুষ গুলো মারা গেছে ওই মানুষ গুলো বেঁচে থাকলে দেশের আর দশের বিপদ তাই এদের মতো মানুষের বেঁচে থেকে কি লাভ!আর তুমিও ভয় পেয়ো না;আল্লাহ যা চাইবে তাই তো হবে তুমি আমি আমরা কেউই আমাদের ভাগ্য বদলাতে পারবো না।তাই মন খারাপ না করে যা ভাগ্যে আছে তাই মেনে নেয়া উচিত।”

কথা গুলো বলা শেষ করে আরাফ পুলিশ অফিসারদের উদ্দেশে বলে,
”চলুন অফিসার।”
.
আরাফকে নিয়ে চলে গেলেন তারা।পারভেজ সাহেব এখনো সেখানে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।আরাফ বেরিয়ে যেতেই রাহেলা বেগম একপ্রকার দৌড়ে পারভেজ সাহেবের কাছে এসে চিন্তিত মুখে তাকে প্রশ্ন করে,
”ওই পুলিশ গুলো আরাফকে কেন ধরে নিয়ে গেলো।আরাফ তো ভালো ছেলে ও তো কিছু করেনি।”

পারভেজ সাহেব একবার শান্ত দৃষ্টিতে রাহেলা বেগমের দিকে তাকান;তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে তাকে সবটা বলেন।সব কিছু শুনে রাহেলা বেগম পারভেজ সাজাবের পাশে বসে তার হাতের উপর হাত রেখে বলেন,

”চিন্তা করো না।কিছু হবে না আরাফের।ছেলেটা বড্ডো সহজ সরল।নয়তো আজ কাল এমন ছেলে কয়টা হয় বলতো যে কিনা বিনা দ্বিধায় সব সত্যি বলতে পারে।এমন একটা ভালো ছেলের সাথে আল্লাহ কখনো কিছু খারাপ হতে দেবে না দেখো।আর তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড় তাহলে আরাফের পাশে কে দাঁড়াবে বলতো?এই মুহূর্তে যে ওর তোমাকে খুব প্রয়োজন।তাই তোমার এখন এভাবে ভেঙে না পড়ে কিভাবে আরাফকে বাঁচানো যায় সেটাই ভাবতে হবে।”
.
রাহেলা বেগমের কথায় পারভেজ সাহেব উপলব্ধি করতে পারে যে;এখন মন খারাপ করে চুপ চাপ বসে থাকলে চলবে না।কিছু একটা করতে হবে।তাকে বাঁচাতে গিয়েই তো একটার পর একটা বিপদে পড়ছে আরাফ।তাই এখন তাকেই কিছু একটা করতে হবে।
কথাগুলো ভেবে পারভেজ সাহেব রাহেলা বেগমকে বলে কোথাও একটা বেরিয়ে গেলেন।
.
ভার্সিটি থেকে এসে সোজা নিজের রুমে চলে যায় অনু।ফ্রেশ হয়ে এসে সে আরাফের রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।দরজাটা হালকা চাপানো।অনু দরজার ফাক দিয়ে একটু উঁকি ঝুঁকি মারছে আরাফকে দেখার জন্য।কিন্তু বেশকিছুক্ষন যাবৎ এতো উঁকি ঝুকু মেরেও সে আরাফকে দেখতে না পেয়ে আস্থে করে দরজাটা খুলে।তারপর দরজার ভেতর মাথাটা এগিয়ে রুমটা ভালো করে দেখে।না আরাফ রুমের কোথাও নেয়।আরাফকে দেখতে না পেয়ে অনুর ব্রু যুগল কুঁচকে আসে।তারপর ধীরে ধীরে সে আরাফের ওয়াশরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।কিন্তু ওয়াশরুমের দরজা ও তো বাইরে দিয়ে লাগানো তার মানে ভেতরে কেউ নেয়।অনু এবার বিরক্ত নিয়ে বারান্দার দিকে তাকায় ।কিন্তু না আরাফ সেখানেও নেয়।অনু মনে মনে ভাবছে আরাফ কোথায় গেলো!কিছু একটা ভেবে অনু তার বাবার রুমে যায়;

”বাবা আসবো?”

”হ্যাঁ মা আয়।”
.
অনু রুমে এসে দেখে তার বাবা মোবাইলে কি একটা যেন দেখছে।আর তার মা আলমারির সামনের দাঁড়িয়ে কাপড় ভাঁজ করছে।অনু তার বাবার পাশে গিয়ে বসে;তারপর আমতা আমতা করে বলে,
”বা বাবা আরাফ স্যার কোথায়?উনি কি বাইরে গিয়েছেন?”

আরাফের কথায় চোখ তুলে অনুর দিকে তাকান তিনি।চোখ থেকে চশমাটা খুলে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
”আরাফকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।”

অনু তার বাবার কথা শুনা মাত্র একপ্রকার চিৎকার দিয়ে বলে,
”কিহ!!পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মানে?কেন নিয়ে গেছে?স্যার কি করেছে?”

মেয়ের অস্থিরতা দেখে পারভেজ সাহেব আর রাহেলা বেগম একজন আরেকজনের মুখের দিকের তাকান।তাদের মুখেও বিষন্ন ভাবটা ফুটে উঠে;পারভেজ সাহেব শান্ত কণ্ঠে বলেন,

”সেদিন ওই বিল্ডিংয়ে আরাফই আগুন লাগিয়েছিল;আর সেটা শুধুমাত্র আমাকে বাঁচানোর জন্য।কিন্তু ওই আগুনে তো কিছু লোক মারা গিয়েছিলো আবার কয়েকজন হসপিটালের আই.সি.ইউতে ভর্তি।আর আইনের দৃষ্টিতে এটা নাকি অপরাধ;আর সেই অপরাধের অপরাধী আরাফ।তাই পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গেছে।”

বাবার কথায় ছলছল নয়নে তার দিকে তাকায় অনু।তারপর সে ভাঙা গলায় বলে,
”কিন্তু বাবা আরাফ স্যার যা করছে তোমাকে বাঁচানোর জন্য করেছে।তাহলে উনি কেন শাস্তি ভাবে?শাস্তি তো পাবে ওই লোকেরা যারা তোমাকে আটকে রেখেছিলো।আরাফ স্যার তো নির্দোষ তুমি বলোনি ওদেরকে?”

”বলেছিরে মা কিন্তু উনারা আমার কোনো কথায় শুনেননি।বলেছেন কাল কেইসটা কোর্টে উঠবে ;তখন যেন আরাফের পক্ষে একটা উকিল নিয়ে সেখানে হাজির হই।”

”তুমি কি কোনো উকিলের সাথে কথা বলেছো?”

”হুম বলেছি।আর তিনি আরাফের হয়ে কেইসটা লড়তে রাজি হয়েছেন।এখন আল্লাহ সহায় থাকলেই হয়।কালই যেন আমরা আরাফকে ছাড়িয়ে আনতে পারি সেই দোয়ায় করছি।”

”হুম বাবা।স্যার কিছু করেনি।তাই স্যারের কোনো শাস্তি ও হবে না।আমরা সবাই স্যারের পাশে দাঁড়াব কিচ্ছু হতে দেব না স্যারের।”

অনুর কথা শুনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় পারভেজ সাহেব।আর মনে মনে আরাফের মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন।
.
সারাদিন যেমন তেমন করে কেটে গেলেও রাতে যেন অনুর অস্থিরতাটা আরো বেড়ে গিয়েছে।আজ সারাদিন আরাফকে ভীষণ মিস করেছে সে। বার বার আরাফের রুমে গিয়েছে;আলমারি খুলে আরাফের শার্ট গুলোতে হাত বুলিয়েছে।জানে না কেন সে এমন করছে;আরাফের কথা ভীষণ রকম মনে পড়ছে তার।এমনিতেই আরাফ অসুস্থ তারওপর থানার মধ্যে কিভাবে ওকে রাখা হয় কে জানে?ভীষণ মায়া হচ্ছে তার আরাফের জন্য।
.
আরাফের কথা ভাবছে আর পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে অনু।হাত দুটোকে কচলাতে কচলাতে আধ মরা বানিয়ে ফেলেছে।তবুও যেন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে।আরাফকে ছাড়া যেন অনুর মনে কেমন শূন্যতা অনুভব করছে।তাহলে কি সে আরাফের মায়ায় পড়ে গেলো।পরোক্ষনে সে আবার ভাবে ‘এটা কি শুধু মাত্র তার মায়া নাকি অন্য কিছু।’যায় হোক তার এই মুহূর্তে আরাফকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।আরাফের সেই মিষ্টি হাসিটাকে অনুর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।নিজের মনের এতো এতো ইচ্ছা কি করে পূরণ করবে সে।আরাফ যে তার সামনে নেয়।চাইলেই যে সে তাকে দেখতে পারবে না।কথা গুলো ভেবে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় অনু।সারাদিন আরাফকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার মাথাটা এখন ভার হয়ে গিয়েছে।ক্লান্তও লাগছে খুব।তাই ঘুমগুলো তার চোখের পাতায় ভর করতে বেশি দেরি করেনি।

চলবে..
(আল্লাহকে ভয় করো;পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)

{পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত😥}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here