জীবন সাথী💜 পর্ব-৩০

0
941

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩০.
~
এই নিয়ে অনেক বার অনুর মা অনুকে রাতের খাবারের জন্য ডেকে গিয়েছে।কিন্তু প্রতিবারই অনু সাফ মানা করে দিয়েছে যে সে খাবেনা।অনুর মা মন খারাপ করে ডাইনিং টেবিলে বসে পারভেজ সাহেবকে বলে,
”মেয়েটার আবার কি হলো বলোতো?খেতে আসছে না কেন?”

অনুর মার কথায় পারভেজ সাহেবও টেনশনে পড়ে যান।কপালে তার চিন্তার ভাঁজ পড়ে।তিনি চিন্তিত গলায় বললেন,
”সেটাই তো বুঝতে পারছি না।মেয়েটার যে হঠাৎ হঠাৎ কি হয়;এক আল্লাহই জানে।”

আরাফ ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে অনুর বাবা মার কথা শুনছে।সে মনে মনে কিছু একটা ভেবে তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,
”পি.এ আন্টি আমার মনে হয় কি আগে আমরা খাবারটা খেয়েনি তারপর না হয় আমরা সবাই মিলে অনুর সাথে কথা বললাম।ওর কি হয়েছে না হয়েছে সব কিছু নিয়ে ওর সাথে সামনা সামনি কথা বলাটাই বেটার হবে।”

আরাফের কথা শুনে পি.এ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে,
”হুম ঠিক বলেছিস বাবা।আগে খাওয়াটা শেষ হয়েনেক তারপর আমরা অনুর সাথে কথা বলবো।”
.
রাতের খাবার শেষ হতেই আরাফ অনুর দরজায় কয়েকবার নক করে।কিন্তু ভেতর থেকে অনু কোনো শব্দ করে না।অনুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরাফ অনেকটা জোরেই দরজায় ধাক্কা দেয়।এবার অনু কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,
”মা আমি ঘুমাচ্ছি তো।প্লিজ আমায় ডিস্টার্ব করো না।”

”অনু আমি জানি তুমি ঘুমাচ্ছো না।অযথা মিথ্যে না বলে দরজা খোলো।”

আরাফের কড়া গলার কথা শুনে অনু কিছুটা চিৎকার করে বলে,
”স্যার আমি দরজা খুলবো না।আমার ঘুম আসছে আমি ঘুমাবো।আপনিও আপনার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকুন।গুড নাইট”

”অনু এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে।দরজাটা খোল।তোর বাবা আর আমি তোর সাথে কথা বলবো।”

অনুর মা অনুকে ধমকের সুরে কথাটা বলে উঠে।কিন্তু অনুর তাতেও কোনো হেলফেল হলো না দেখে অনুর বাবা এবার তাকে জোরে ধমক দিয়ে বলে,
”অনু দরজা খুলবে নাকি আমরা দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করবো।”

বাবার ধমক শুনে অনু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।অনু বুঝতে পারে তার বাবা এই মুহূর্তে খুব রেগে গিয়েছে।কারণ তিনি যখন অনুর উপর খুব রেগে যান তখনি তিনি অনুকে তুমি বলে সম্বোধন করে।অনু তাই আর দেরি না করে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভালো করে চোখ মুখ মুছে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়।অনু দরজা খুলতেই অনুর বাবা মা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।অনু তার বাবা মার দিকে হালকা একটু তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলে।পারভেজ সাহেব কিছুক্ষন তার মেয়ের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে থেকে তার রুমের ভেতর প্রবেশ করে;তারপর অনুর পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টেনে সেখানে বসে পড়ে; তিনি অনুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন,

”অনু বাবার সামনে এসে বসো।”

অনুও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নিচু করে বিছানায় উপর তার বাবার মুখোমুখি বসে।অনু বসতেই অনুর মাও তার পাশে বসে;আর আরাফ দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অনুকে দেখছে।অনুর ফোলা ফোলা চোখ মুখ গুলোই বলে দিচ্ছে সে এতক্ষন খুব কেঁদেছিলো।আর তার কান্নার কারণটা আরাফ জানে;কিন্তু আরাফের কাছে এই মুহূর্তে অনুকে খুব বিরক্ত লাগছে।সবটা না শুনে না বুঝে এইভাবে কান্নাকাটি করার কোনো মানে আছে!বোকা মেয়ে একটা।কথা গুলো ভেবে নিজের মনেই ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাফ।
.
”অনু কি হয়েছে তোমার?”

অনুর বাবার সেই গম্ভীর গলার প্রশ্ন শুনে অনু ভয়ে ছোট্ট একটা ঢোক গিলে।তারপর জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁটজোড়া হালকা ভিজিয়ে তার বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিনয়ের স্বরে বলে,
”বাবা আসলে আমার খিদে ছিল না।আর খুব ঘুম ও আসছিলো তাই আরকি খেতে ইচ্ছে করছিলো না বলে শুয়ে পড়েছিলাম।”

আরাফ অবাক চোখে অনুকে দেখছে।কি নিদারুন মিথ্যে কথা বলে মেয়েটা!
অনুর কথা শুনে পারভেজ সাহেব তার সুচের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অনুর উপর নিক্ষেপ করে বলে,
”সত্যি কি তাই?নাকি অন্য কিছু?”

বাবার কথায় অনু হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,
”একদম তাই বাবা!আর কোনো কিছু না।”

”হুম।তুমি নিশ্চই শুনেছ আরাফের বিয়ের কথা চলছে।তা মেয়েকে তো আমরা সবাই দেখেছি কিন্তু তুমি দেখোনি।তা তুমি কি দেখতে চাও মেয়েটাকে?”

বাবার এমন সোজা সাপ্টা কথাটাও অনুর বুকে তীরের মতো বিধলো।তার চোখে আবারও নোনা জল এসে ভিড় করলো।কি করে দেখবে সে ওই মেয়েটাকে যে তার ভালোবাসাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে।তবুও সে দেখতে চায় ;কার এতো সুভাগ্য যে সে আরাফের মতো একজনকে তার জীবন সাথী হিসেবে পাচ্ছে।কথা গুলো ভেবে অনু নিজেকে শক্ত করে তার বাবাকে বললো,
”হ্যা বাবা অবশ্যই।আমার স্যারের হবু বউকে আমি দেখতে চাইবো না!কই দেখি তার ছবিটা দেখাও আমাকে।আমিও দেখি সে কতটা সুন্দরী।”
.
কথাটা বলে অনু চোখ মুখ শক্ত করে আরাফের দিকে তাকায়।যেন তার এই রক্তিম চোখ গুলো দিয়ে সে এক্ষনি আরাফকে ভস্ম করে দিবে।আরাফও এক দৃষ্টিতে অনুকে দেখছে।ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলানো।আরাফের এই ছোট্ট হাসিটাই অনুকে ক্রোদের আগুনে দগ্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
.
অনুর বাবা পকেট থেকে সেই মেয়েটার ছবি বের করে অনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে হাস্যজ্জল মুখে অনুকে বললো,
”নে মা দেখতো আমরা আরাফের জন্য সঠিক পাত্রী খুঁজে বের করতে পেরেছি কিনা?”

অনু কাঁপাকাঁপা হাতে ছবিটা নিলো।তার পুরো শরীর ঘেমে উঠছে;মনে হচ্ছে এক্ষনি সে জ্ঞান হারাবে।ছবিতে নিজেকে দেখে অনু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
”বাবা তুমি আমার ছবি কেন দিলে?ঐ মেয়েটার ছবি দাও।”

অনুর বোকা বোকা কথা শুনে অনুর বাবা মা দুজনেই জোরে জোরে হাসতে আরাম্ভ করে।আর আরাফ দরজার পাশ থেকে অসহায় দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে;’এই বোকা মেয়েটাকে নিয়ে সে কি করে সারাজীবন সংসার করবে!’
.
অনুর বেকুব হয়ে তার বাবা মার দিকে তাকিয়ে আছে।সে কিছুই বুঝতে পারছে না যে এখানে কি হচ্ছে!অনুর বাবা হাসি থামিয়ে অনুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
”কেনোরে মা ছবির মেয়েটা কি পাত্রী হিসেবে খুব খারাপ।আরাফের সাথে কি এই মেয়েটার বিয়ে দেওয়া যায় না?”

বাবার কথা শুনে এতক্ষনে তার মস্তিষ্ক কাজ করছে।তার মানে সে নিজেই আরাফের পাত্রী।অনু বড় বড় চোখ করে নিজের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।তার বাবা আরাফের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে।ব্যাপারটা যেন অনু ভাবতেই পারছেনা।অনুর মন থেকে সমস্ত কষ্ট আর অভিমান গুলোকে সরিয়ে এখন সেখানে কারি কারি লজ্জা এসে জমছে।এমনিতেই তো কেঁদে কেটে মুখটা লাল হয়ে আছে তারউপর এই লজ্জার দরুন অনুর গাল গুলো ব্লাশ করছে।অনুর এই লজ্জামাখা মুখ দেখেই অনুর বাবা মা বুঝে যান যে অনুও রাজি।তাদের মুখেও হাসি ফুটে উঠে।তারা দুজনেই অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে অনু আর আরাফকে আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান।উনারা চলে যেতেই আরাফ অনুর সামনে এসে দাঁড়ায়;বুকের উপর হাত দুটো ভাঁজ করে অনুর পড়ার টেবিলটার সাথে হেলান দিয়ে কোমল দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকায়;অনু তখনো মাথা নিচু করে তার ছবিটা দেখে যাচ্ছে।দুজনের মধ্যেই নিরবতা কাজ করছে।অনুর এই লাল লাল চোখ মুখে অনুকে আরো বেশি মায়াবী লাগছে।আরাফ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।আজ যেন অনুকে অন্যরকম লাগছে।যেন কোনো মায়াপরি তার মায়ার জালে আরাফকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেছে।আরাফ এইভাবেই কিছুক্ষন অনুর দিকে তাকিয়ে থেকে অনুর কিছুটা কাছে গিয়ে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে;অনু এবার আলতো চোখে আরাফের দিকে তাকায়।আরাফের চোখে এখনো এক অন্যরকম নেশা কাজ করছে।আরাফ মিহি কণ্ঠে অনুকে বলে উঠে,

”ইশ!কাঁদতে কাঁদতে মুখটা পুরো লাল টমেটো বানিয়ে ফেলেছে।ইচ্ছেতো করছে এক্ষনি খেয়ে ফেলি।”

আরাফের এমন লাগামহীন কথায় অনুর লজ্জা যেমন আরো দ্বিগুন হারে বেড়ে গিয়েছে।বেচারি লজ্জায় আরাফের চোখের সাথে চোখ মিলাতে পারছে না।আরাফ ঠোঁটে দুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে বলে,
”কি মিস.টমেটো আমাকে হারানোর ভয়ে এত কেঁদেছো?এত ভালোবাসো আমায়?হুম!”

আরাফের কথা শুনে অনু অভিমানের সুরে বলে,
”উহু একটুও ভালোবাসি না আপনাকে।আর আমার চোখের পানিকি এত সস্তা নাকি যে আপনার জন্য কেঁদে কেটে শেষ করবো!”

আরাফ তার ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হাসে।তারপর ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলে বলে,
”জানো অনু তোমার চোখ মুখ আমাকে আজ চিৎকার করে বলছে তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।তোমার মুখে বলতে হবে না;তোমার নীরবতাই আমাকে তোমার ভালোবাসার কথা বলে দিচ্ছে।পাগলী একটা কিছু না শুনে না বুঝেই কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে গিয়েছে।তো এবার বলো আমার পাত্রীকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?”

উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে উঠে আরাফ।আরাফের কথা শুনে অনুর তার দিকে তাকায়;অনুর চোখ মুখ ও খুশিতে চিকচিক করছে।অনু হাসি মুখে বলে,
”হুম খুব পছন্দ হয়েছে।আপনার সাথে এই মেয়েটাকে খুব মানাবে।এক্কেবারে রাজযোটক।”
.
অনুর চোখে মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে।আরাফ কিছুটা এগিয়ে এসে অনুর কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়;তারপর সে অনুকে বলে,
”হুম এবার ঘুমিয়ে পড়ুন মিস.টমেটো।কালকে থেকে কিন্তু পুরোপুরি বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যাবে তখন কিন্তু আর ভালো ভাবে ঘুম হবে না তাই আজ ভালো ভাবে ঘুমিয়ে নিন কেমন!গুড নাইট!”
.
কথাটা বলে আরাফ আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে অনুর রুম থেকে বেরিয়ে যায়;আর অনু বড় বড় চোখ করে আরাফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর কি ভেবে কপালের যেই জায়গায় আরাফ তাকে ভালোবাসার পরশ দিয়েছে সেখানে নিজের ডান হাতটা আলতো করে রেখে আনমনেই বলে উঠে;”ভালোবাসি আরাফ স্যার!”
.
সকালে রাহেলা বেগমের কর্কশ কণ্ঠে ঘুম ভাঙে অনুর।সে ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে।তারপর বড় একটা হাই তুলে তার মাকে বলে,
”কি হয়েছে মা?সকাল সকাল এমন ৭ই মার্চের ভাষণ দিচ্ছ কেন?”

অনুর কথা শুনে তার মা রেগে গিয়ে বলে,
”কি আমি ৭ই মার্চের ভাষণ দিচ্ছি!দিবো এক থাপ্পড়।যার বিয়ের তার খবর নাই পাড়া পড়শীর ঘুম নাই এমন একটা অবস্থা হয়েছে আরকি।উনার বিয়ে আর উনি এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছে আবার বলে আমি নাকি ৭ই মার্চের ভাষণ দিচ্ছি।”

অনু তার মার কথা শুনে বিরক্তি নিয়ে বলে,
”উফফ মা তুমি এমন ভাবে বলছো যেন বিয়েটা আজকেই হয়ে হচ্ছে।”

”না আজ না পরশু তোমার বিয়ে!”

”কি পরশু….”

এই বলে চিৎকার দেয় অনু।অনুর চিৎকারে তার মা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
”এই চুপ এইভাবে চিল্লানোর কি আছে?শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায় ততই ভালো।তোর বাবা আরাফের সাথে কথা বলেছে এই ব্যাপারে;আরাফেরও কোনো অসুবিধা নেয়।তাই তুইও একদম কোনো ন্যাকামি করবি না।তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেনে তারপর শপিং এ যেতে হবে।”

কথাটা বলে রাহেলা বেগম চলে যেতে নিলেই আবার কিছু একটা মনে করে অনুর সামনে এসে বলে,
”শোন আরাফ ওর ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছে।সেখান থেকে ওর কিছু আত্মীয়স্বজন ওর বিয়ের ব্যবস্থা করবে।তুই ঘুমাচ্ছিলি বলে তোকে না বলেই চলে গিয়েছে।এখন উঠ জলদি ফ্রেশ হয়ে আয়;আমি টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি।”

রাহেলা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে যায়;আর অনু মুখ ফুলিয়ে বলে,
”আমাকে না বলেই চলে গেলো আরাফ স্যার।একবার দেখতেও পারলাম না ধুরর!”

কথাটা বলে বিরক্ত নিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে যায় সে।

চলবে,,
(আল্লাহকে ভয় করো,পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here