জীবন সাথী💜 পর্ব-৯

0
1204

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৯.
~
মাগরিবের আজানের ধ্বনি কানে যেতেই চোখ খুলে অনু।মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কখন যে তার চোখ লেগে গিয়েছে সেটা সে টেরই পায়নি।অনু তাকিয়ে দেখলো তার মা গভীর ঘুমে মগ্ন।তাই সে ধীর পায়ে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলো।
.
নিজের অফিস রুমের চেয়ারে চোখ বন্ধ ওরে হেলান দিয়ে বসে আছে আনোয়ার মোহাম্মদ।চোখে মুখে তার চিন্তার ছাপ।তখনি তার ফোনটা বেজে উঠলো;তিনি তড়িগড়ি করে সেটা রিসিভ করতে ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

”স্যার আপনার কথা মতো কাজ হয়ে গিয়েছে।”

কথাটা শুনে আনোয়ার সাহেব তার চেয়ারটায় আবার হেলান দিয়ে বসে ফোনের ওপাশের লোকটাকে বললেন ,

”হুম গুড।এখন একে এমন ভাবে লুকিয়ে রাখো যেন কাক পক্ষীও টের না পায় যে কোথায় আছে সে!আর একটা কথা খবরদার যদি এইসব কোনো কথা আরাফের কানে যায় তো তোমাদের একটাকেও আমি আর আস্ত রাখবো না।বুঝতে পেরেছো?”

ওপাশে থাকা লোকটা ভীত কণ্ঠে বলে ,

”জ্বি স্যার বুঝতে পেরেছে”

”ঠিক আছে রাখো!”

কথাটা বলে উনি কলটা কেটে দিলেন।তারপর একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললেন,

”তুই কি ভেবেছিলি তুই মুক্ত হয়ে গেছিস এখন আর কেউ তোর কিছু করতে পারবে না।একদম ভুল ভেবেছিস;তুই আমার কথা পুলিশকে বলবি তাই না;আগে তো আমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দেখা তারপরই না অন্য কিছু!”
.
কথাগুলো নিজের সাথে বলে জোরে জোরে হাসতে আরাম্ভ করে আনোয়ার মোহাম্মদ।আর এইদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তার সব কথা শুনেছে আরাফ।পারভেজ সাহেবকে নামিয়ে দিয়ে সে দ্রুত তার বাবার অফিসে এসেছিলো তার কাছে জানতে চাওয়ার জন্য যে কেন তিনি তাকে দিয়ে এসব করিয়েছেন?কেন বলেননি এই লোকটাই তার পি.এ?আর কিসের শত্রুতা তার পি.এর সাথে?এইসব কিছুর জবাবদিহি নেয়ার জন্যই আরাফ তার বাবার অফিসে ছুটে এসেছিলো কিন্তু কেবিনে ঢুকতেই সে এসব শুনতে পায়।যার ফলে সে আর কেবিনে না ঢুকে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে পারভেজ সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে।
.
নামাজ পরে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো অনু।তার এই একলা জীবনের সঙ্গী এই বই।ভীষণ ভালোবাসে সে বই পড়তে।আর হুমায়ুন আহমেদ স্যার তার প্রিয় লেখক;এই মুহূর্তে সে স্যারের লেখা হিমু বইটা পড়ছে।এই নিয়ে যে সে এটা কত বার পড়েছে তা তার হিসাব নেয়।তবুও যেন এই বইটার নেশা কাটিয়ে উঠতে পারে না অনু।যখনি বইটা পড়তে শুরু করে তখনি এর মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দেয়;পড়তে পড়তে বইটা তার বুকের উপর রেখে সেটাকে জড়িয়ে ধরে অনু মনে মনে ভাবে;তার লাইফেও যদি একটা হিমু আসতো তাহলে কি খুব খারাপ হতো!পরোক্ষনে আবার ভাবে;না খারাপ হবে কেন বরং ভালোই হতো।সেও তার হিমুর রুপা হতে পারতো।তবে তার মধ্যে কি রুপার মতো সেই ধৈর্য শক্তি আর ভালোবাসাটা আছে যে তার প্রিয় মানুষটার জন্য যুগের পর যুগ অপেক্ষার প্রহর গুনে কাটিয়ে দিতে পারবে!কি জানি এর উত্তর তার জানা নেয়।তবে সে এইটুকু জানে আল্লাহ যেই মানুষটার বাম পাঁজরের হাড় থেকে তাকে বানিয়েছে সেই মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবাসবে।
.
অনু যখন সম্পূর্ণ তার ভাবনা নিয়ে ব্যাস্ত তখনি তাদের বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠে।হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে অনু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে;এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখটা নিচু করে বুকে থু থু করে।তারপর আস্থে আস্থে উঠে দরজারটা খুলে;দরজার সামনের মানুষটিকে দেখে অনুর এতো বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছে যে আর একটু হলেই তার চোখ বেরিয়ে আসবে।
.
দরজা খুলার পর আরাফ দরজার সামনে অনুকে দেখে হকচকিয়ে উঠে।সে মনে মনে ভাবে অনু এখানে কি করছে?আর ঐদিকে অনুও ভাবছে আরাফ কেন ওদের বাসায় এসেছে।দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে একি কথা ভাবছে।হঠাৎ আরাফ অনুকে বলে ,

”তুমি এখানে?”

আরাফের কথায় অনু বেশ বিরক্ত হয়।তার বাড়ি সে থাকবে না তো কি অন্য কেউ থাকবে!যত সব আজাইরা প্রশ্ন।বিরক্ত ঠেলে দিয়ে অনু বলে উঠে ,

”স্যার এটা তো আমার বাসা।আমি এখানেই থাকি।কিন্তু স্যার আপনি এখানে কেন?”

অনুর কথায় যেন আরাফ হ্যাং হয়ে গেছে।অনুর বাসা মানে সে এখানে থাকে।আর পি.এ ও এখানে থাকে তারমানে অন্য কেউ না অনুই তার পি.এর মেয়ে?কথা গুলো ভাবতেই আরাফ খুব অবাক হয়;তারপর সে কাঁপা কাঁপা গলায় অনুকে বলে ,

”তুমি কি পারভেজ আহমেদের মেয়ে?”

অনু অবাক চোখে তাকায়;আরাফ তার বাবার নাম জানলো কিভাবে?আরাফাকী তার বাবাকে কোনোভাবে চিনে?কিছুক্ষন ভাবার পর অনু বলে ,

”জ্বি স্যার আমি পারভেজ আহমেদের মেয়ে।স্যার আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?”
.
অনুর কথা শুনে আরাফের নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।কি করলো সে না চাইতেও অনুকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেললো ।অনু যদি জানতে পারে যে এই এক বছর যাবৎ আরাফই তার বাবাকে আটকে রেখেছিলো তাহলে সে কোনো দিনও আরাফকে মাফ করবে না।কথাগুলো ভাবতেই আরাফের মনে অনুকে হারিয়ে ফেলার ভয় ঢুকে যায়।সে মনে মনে ভাবছে ;তার এই ভুলের জন্য সে অনুকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে না তো?
.
এইদিকে অনু আরাফকে দেখছে যে কিনা খুব অস্থির অস্থির করছে।অনু কিছুই বুঝতে পারছে না যে আরাফের কি হয়েছে কেন সে এমন করছে!তার এই বাড়িতে আসার কারণটাও অনু বুঝতে পারছে না।তাই সে আরাফকে জিজ্ঞেস করে ,

”স্যার কি হয়েছে?আপনাকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন?আর আপনি ভেতরে আসুন।বাইরে কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবেন?”

অনুর কথায় আরাফ তার দিকে তাকায়।তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে অনুকে বলে ,

”তোমার বাবা বাসায় আছেন না?”

আরাফের এই প্রশ্নে অনুর মন খারাপ হয়ে যায়।সে মাথা নিচু করে মন খারাপ করে বলে,

”না স্যার”

অনুর কথায় আরাফ তার দিকে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে

”তাহলে কোথায়?”

অনু এবার চোখ তুলে তাকায়।তারপর আরাফকে বিষন্ন গলায় বলে,

”স্যার আমার বাবা ১ বছর ধরে মিসিং।এখনো তাকে আমরা কেউ খুঁজে পাইনি।”
.
অনুর কথায় আরাফের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।এসব কি বলছে অনু!কিছুক্ষন আগে না আরাফ নিজে তাকে এই বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো।তাহলে পি.এ এখন বাড়িতে নেয় মানে কি।তার তো এখানেই থাকার কথা।আরাফ অবাক হয়ে অনুকে জিজ্ঞেস করে ,

”বাসায় আন্টি মানে তোমার আম্মু আছেন না?”

”জ্বি স্যার আছেন।তবে তিনি অসুস্থ।বাবার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াটা আম্মু মেনে নিতে না পেরে মাইন্ড স্ট্রোক করে।তারপর থেকেই মা ভীষণ দুর্বল হয়ে পরে;মা শুধু একটা কথায় ভাবে যে বাবা বাজার করতে গিয়েছে বাবা আবার বাজার থেকে ফিরে আসবে।মার মস্তিষ্ক এই এক কথা ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবে না।সবসময় এক কথায় বলে বাবা বাজারে গিয়েছে।তিনি বাজার শেষ করে বাসায় ফিরবেন।কিন্তু এখনো ফেরেনি।তবে আজ আমি রিহানের জন্য খাবার নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম সেখান থেকে এসে দেখি মা সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে।মাকে এভাবে দেখে আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম।তারপর সেন্স আসার পর থেকেই উনি শুধু বলছেন বাবাকে নাকি কারা তুলে নিয়ে গিয়েছে?এই এক বছরে মা এই কথা আর কখনো বলেনি কিন্তু আজ কেন উনি বার বার এই কথাটায় বলছেন বুঝতে পারছি না,আমি যখন বাসায় ছিলাম না তখনি বা কি হয়েছিলো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
.
অনুর কথা শুনে আরাফের কাছে সবটা ক্লিয়ার হয়েছে।অনুর বাবা বাসায় এসেছিলো ঠিকি;কিন্তু বেশিক্ষন থাকতে পারেননি এর আগেই কেউ ওনাকে কিডনাপ করে;আর সে আর কেউ না আরাফের বাবা আনোয়ার মোহাম্মদ।আর যেহেতু অনু হসপিটালে ছিল তাই এইসব কিছু অনু না দেখলেও তার মা দেখেছে।
.
আরাফের সারা শরীর রাগে কাঁপছে ।সে বুঝতে পারছে না কেন তার বাবা এমন করছে!কি চান উনি?আর পি.এ বা তার বাবার সম্পর্কে কি এমন পুলিশকে বলার ভয় দেখিয়েছে !কি করেছে তার বাবা?আরাফের মাথায় কিছুই আসছে না।তবে এইটুকু বুঝতে পারছে একটু আগে তার বাবা যে লোকটাকে লুকানোর কথা বলছিলেন সেটা আর কেউ না অনুর বাবাই।আরাফের তার বাবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।রাগে সে তার হাত দুটো মুষ্ঠি বদ্ধ করে।কপাল চুয়ে ঘাম পড়ছে তার;বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে সেই ঘামটা ঝেড়ে ফেলে সেখান থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায় আরাফ।
.
আর এতক্ষন যাবৎ ঘটে যাওয়া সব কিছুই অনুর মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে।আরাফ কেন এসেছিলো;আরাফ তার বাবাকে কিভাবে চিনে;এইভাবে হুট করে আরাফ রেগে গেলো কেন?এইরকম নানা প্রশ্ন অনুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।সে ব্রু কুঁচকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে।বসে বসে আরাফের কথায় ভাবছে সে;আজ আরাফকে অন্যরকম লাগছিলো।ভার্সিটিতে গেলে যেমন টিপটপ ভাবটা আরাফের মধ্যে থাকে আজ সেই ভাবটা আরাফের মধ্যে দেখেনি সে।চুলগুলো উস্কখুস্ক হয়েছিল।চেহারাটাও বেশ মলিন হয়েছিল।যে মানুষটা সব সময় খুব পরিপাটি হয়ে থাকে আজ সেই মানুষটাকে বেশ অগুছালো লাগছিলো অনুর কাছে।গলার টাইটা লুস করে গলায় ঝুলে ছিল;শার্ট এর প্রথম দুটো বোতাম খোলা;শার্টার এক পাশ পেন্টে গুজা তো অন্য পাশ বের করা ।হাতা দুটোও ঠিক ছিল না।একটা হাত কুনুই অবধি ফোল্ড করা ছিল;আর অন্য হাতটা কব্জি অবধি ঝুলে ছিল।
.
আরাফের চোখ মুখ বার বার জানান দিচ্ছিলি যে সে খুব টেনশনে আছে।যেন কোনোকিছুতেই সে শান্তি পাচ্ছিলো না।খুব অস্থির অস্থির লাগছিলো তাকে।কি এমন হয়েছে আরাফের যার জন্যে হঠাৎ করেই তার এই হাল হয়ে গিয়েছে।কোন ব্যাপার নিয়ে তিনি এতো টেন্স?
.
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ব্রু কুঁচকে কথা গুলো ভাবছে অনু।তখনি তার চোখ যায় তার বারান্দার সামনে সোডিয়াম আলো ঘেরা রাস্তাটার দিকে সেখানে দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখতে পাচ্ছে সে।বোধ হয় সন্ধ্যার হাটা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তারা।অনু অবাক চোখে তাদের দেখছে।বার্ধককের ভারে দুজনেই নুয়ে আছে;কচ্ছপের মতো ধীর পায়ে এগুচ্ছে দুজন।কিছুটা পথ যেয়ে থেমে যান দুজনে তারপর কিছুক্ষন জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে আবার হাটা শুরু করে।তবে সব চেয়ে ভাল লাগার বিষয়টা হলো তারা দুজনদুজনের হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।অনু মুচকি হেসে বলে’এই বয়সে তো এই দুজনই দুজনের সঙ্গী;তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে;’সত্যি বাবা ঠিকি বলতো;সত্যিকারের ভালোবাসা গুলো বয়স আর সময়ের সাথে সাথে কমে যায় না বরং বৃদ্ধি পায়।”

চলবে,,,
(আল্লাহকে ভয় করো,পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)

{ইনশাল্লাহ আর দু এক পর্বে সকল ধুয়াশা কেটে যাবে।}

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here