টিট ফর ট্যাট পর্ব-১১

0
3024

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১১

লাজুক লাজুক হাসছি। আয়নায় আমার লাল টুকটুকে প্রতিবিম্ব। গত রাতে নীরব নিজ হাতেই নাকফুল পরিয়ে দিয়েছে। বুকে অন্য রকম একটা শান্তি লেগেছে। স্বামীর হাতে নাকফুল পরিয়ে নেওয়ার সুযোগ ক’জন পায়? ভাবতে ভাবতে আরো একটা স্মৃতি মনে দুলে উঠলো। ইশ! এটা আরো ভয়াবহ স্মৃতি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এতো প্রশান্তি কেন? গতরাতে যখন আমি নীরবকে বেহায়ার মতো জানিয়েছিলাম তার ঠোঁট মারাত্মক সুন্দর তখন এক কল্পনাতীত আচরণ করে বসে সে। আমার কথায় প্রথমে সে প্রচন্ড বিরক্তিতে যেন কথা বলাই ছেড়ে দিলো। আমি তখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে ভাবছিলাম পালাতে হবে। যেই না উঠবো ঠিক তখনই সে খপ করে হাতটা ধরে বলল

— কতবার বললা এই এক কথা?

আমি কাচুমাচু মুখে প্লাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেছিলাম

— কতবার?

— জানো না?

কথাটা বলেই সে ক্ষণিক তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমিও পলক ফেলতে যেন ভুলে গেছিলাম। আচমকা আমার এই অপ্রস্তুত ভাব ঠেলে ঠুকে তুঙ্গে উঠিয়ে সে টুপ করে পর পর তিনটা চুমু দিলো আমার ঠোঁটে। চোখের পলকে যেন এমন লাজুক মুহূর্ত উড়ে এলো। আমি পাথর হয়ে গেছিলাম। কোন দিকে তাকিয়ে ছিলাম তাও জানি না। শুধু সাড়াশব্দ হীন থম মেরে বসে ছিলাম। নীরব তখন কানে কানে বলেছিল

— ভুল করে আরো কয়েকবার বলতে এারো বউ। আমার চুমু খাওয়ার সুযোগ হবে। যে কয়বার বলবা সে কয়বার চুমু খেতে পরবো।

তার কথায় আমি সত্যিই যেন মারাত্মক, বেঢপ পরিস্থিতিতে পিছলে গেলাম।

ইশ! কি লজ্জা! ভাবনা ছেড়ে বর্তমানে বিরাজ করতেই ডুবে গেলাম লজ্জার সাগড়ে। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক আওয়াতে মাতোয়ারা। আজ তার সাদা ওড়নার সাথে মিলিয়ে সাদা গোল জামা পরেছি। আয়নায় অনাড়ি চোখে তাকিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলাম। গত রাতে নীরবের বর্ণনা মতো দু হাত ভর্তি চুড়ি, চোখে হালকা কাজল আর চুলগুলো উন্মুক্ত করে দিলাম। আয়নায় তাকাতেই লাজে খিলখিল করে হেসে দিলাম। অতি প্রশান্তিতে হাত পায়ে মৃদু কাঁপন ধরেছে। আয়নায় আপন চোখে চোখ রেখে বললাম

— এখন থেকে, আমি নীরব রাজার রাণী
শুনুন স্বামী, আপনার বুকের ভেতর বাহিরটা লিখে দেন আমার করে চিরস্থায়ী।

— কি বললে?

খেয়ালী মনে কথাগুলো বলে ওড়নার একাংশ কামড় দিয়ে ধরেছিলাম। এমন অসময়ে নীরবের কন্ঠ। আমি আৎকে উঠে পেছন ফিরে চাইলাম। নীরব মাত্র এপ্রোনের কলার ছুঁয়েছে। হয়তো খুলে ফেলতো। অধিক নয় হালকা লাল ফর্সা মুখটায় যেন রক্ত জমে গেছে গরমে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে একাকার। নীরব চিবুকের ঘাম মুছলো রুমাল দিয়ে। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল

— কি বললে আবার একটু বলো? ভীষণ সুন্দর শোনালো।

আমি লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে গেলাম। এ মানুষটার শুধু অসময়ে আগমন ঘটে। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে আসতে আসতে বললাম

— কিছু না।

কথাটা বলে যেই না দৌড়ে পালাবো ঠিক সেই সময়েই টান পরলো ওড়নায়। আমি খপ করে পরতে পরতে বেঁচে যাওয়া ওড়নাটা আগলে নিলাম। সে আমার সামনে চলে এসে পথ রোধ করে পুনরায় মিনতি করলো

— বলো না শুনি।

শুনুন স্বামী, আপনার বুকের ভেতর বাহিরটা… তারপর?

— লিখে দেন আমার করে চিরস্থায়ী।

কথাটা বলে লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুজলাম। কিন্তু পেলাম না। হতাশ হয়ে নিজ হাতে মুখ ঢেকে নিলাম। নীরবের অভিব্যাক্তি কি?

— এমন কথা কোনো বউ যদি স্বামীকে বলে সে নির্ঘাত ভালোলাগায় বেহুঁশ হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তোমার স্বামী হতে পারছে না। ডাক্তারদের আবেগ একটু কম বুচ্ছো?

কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার মনটা ভেঙে গেলো। মৃদু মন খারাপ জায়গা করে নিলো। মুখ থেকে হাত সরিয়ে আহত নয়নে চাইলাম মেঝেতে। হঠাৎ আবার আমার মন খারাপ উবে দিয়ে স্বামী আমার টুপ করে একটা চুমু দিয়ে দিলো কপালে। মুখে আফসোসের সুরে বলল

— থাক বাবু রাগ করে না। চকলেট এনে দেবো। আমি জ্ঞান হারালে তোমায় এখন ঘুরতে নিয়ে যাবে কে? যাও সুন্দর করে বোরকা হিজাব পরে রেডি হও। ঘুরতে যাবো। এই জন্যই এই ভর দুপুরে ক্লিনিক থেকে চলে আসছি। বউ নিয়ে ঘোরার শখ হয়েছে।

কথাটা বলে চরম উৎফুল্ল মনে নীরব ওয়াশ রুমে চলে গেলো। মুখে বিরবির করে বলছে

— কবাবের হাড্ডি করোনার যখন তখন জন্য বউ টউও জরায় ধরা যায় না।

আমি হেসে উঠলাম। হিহি! কি বেদনা ডাক্তারদের!

.
অনেকক্ষণ যুদ্ধ বিগ্রহ করে অতঃপর সফল হয়েছি হিজাব পরতে। আমি কখনো হিজাব পরিনি। ইউটিউব দেখে আজ তুমুল চেষ্টায় জয়ী হলাম। সবসময় চুল ছেড়ে এখানে ওখানে যেখানে সেখানে যাওয়া হয়েছে। চুলগুলো আমার বেশি বড় না। কোমর অবধি হবে। স্বইচ্ছায় এমন করে ছোট রাখি। তবে আজ নীরব বলে দিলো চুল কাটা নিষেধ আমার জন্য।

উত্তপ্ত গরমে রাস্তায় দাড়িয়ে আছি একটা রিকশার আশায়। যানজট আর মানুষের চলাফেরায় রাস্তায়ও বেশ ভীর। চট্টগ্রামটাও ধীরে ধীরে ঢাকা হয়ে যাচ্ছে।

— খুব গরম পরেছে তাই না?

নীরবের কথায় আমি গরমে হাশফাশ করতে করতে বললাম

— হ্যা। তার উপর অনেক ভীর। এতো ভীর কেন?

— ঈদ যে সামনে। আর সাতদিন পরেই তো ঈদ।

— হুম। আমরা এখন কোথায় যাবো?

— প্রথমে শপিং করতে।

— ঈদের জন্য? কিন্তু আমার কোনো জামা লাগবে না। ক’দিন আগেই তো শপিং করা হলো।

আমার অস্থিরতায় নীরব নিশ্চুপ হাসলো। খুব সুন্দর হাসি। গাড় সবুজ রঙের শার্টের কলারটা ঠেলে একটু পেছনে দিলো। চোখে তার সানগ্লাস। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম তাকে। হঠাৎ আমি কি যেন ভেবে আশপাশ পরখ করতে লাগলাম। উনার দিকে মেয়েরা কেমন করে তাকায় দেখি? কত মেয়ে তাকায়? ওনার ঠোঁটে র দিকে কি তাকিয়ে থাকে? ভাবতে ভাবতে আশপাশ দেখছি। ইতি মধ্যেই পাশ থেকে কোনো এক মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো কানে

— দেখ দেখ ছেলেটার নাকটা জোস ভাই। ঠোঁট দুইটাও কি সুন্দর!

আমি যেন থ মেরে গেলাম এমন বেহায়া কথা শুনে। ঝট করে পেছন ফিরে হা হয়ে তাকিয়ে দেখলাম দুইটা মেয়ে নীরবের দিকে তাকিয়ে এমন উক্তি বলে গেলো। আমার কি হিংসা হওয়া উচিত? আমার স্বামীর দিকে ওরা নজর দিচ্ছে? আচ্ছা নীরবের নাকও সুন্দর? কই দেখি তো। কল্পনার মাঝে নীরবের নাকে দৃষ্টি ফেললাম। ভালো করে দেখার সুযোগ হতে না হতেই রিকশা দাড় করিয়ে নীরব আমায় রিকশায় তুলল। তার পাশাপাশি বসে ভাবছি মেয়েগুলো চরম বেয়াদব! আমার মন খুঁত খুঁত করছে ওদের অশোভন উক্তিতে। আমার কি হলো জানি না। আমি খপ করে নীরবের হাতটা ধরলাম। মানুষের বোঝা উচিত এই সুন্দর নাক, ঠোঁট ওয়ালা ছেলেটা বিবাহিত।

.
প্রথলে শপিং মলে নামার কথা বললেও নীরব রিকশা এনে থামালো একটা ধানের চাতালে। বিশাল বড় ইট সিমেন্টে নির্মিত মেঝে। তাতে ছড়ানো আছে অনেক ধান। জানি না কেন এমন রাশি রাশি ধান দেখে আমার মনে আনন্দ উথলে উঠলো৷ ছোট বেলায় যখন গ্রামে যেতাম তখন অনেক ধান দেখতাম। পাশের বাড়ির চাচিরা ধান শুকাতো। আমি দৌড়ে ধান পা দিতে লেগে পরতাম। এটা করতে আমার খেয়ালী মন আনন্দ পায়। যদিও পায়ে ধানের খোঁচা লেগে ব্যাথা পেতাম।

— নিলীমা এদিকে দেখো।

নীরবের কন্ঠে ভাবনা থেকে বেরিয়ে তার ইশারা অনুসরণ করলাম। কি আনন্দের দৃশ্য! ঝাক ঝাক সাদা কবুতর। ছড়ানো ছিটানো ধান খাচ্ছে। আমি যেন এক শুভ্র চাদর দেখছি। এত্তো সুন্দর লাগছে এই শান্তির প্রতীকদের দেখতে! আমি নীরবের দিকে তাকিয়ে ঝরে পরা আনন্দ নিয়ে বললাম

— চলুন ওদিকে যাই।

নীরব আগে হেঁটে সম্মতি জানালো। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। কবুতরগুলোর কাছে যেতেই ঝাঁকে ঝাঁকে কিছু কবুতর উড়াল দিলো উর্ধ্বে। এ দৃশ্য দেখে আপনা আপনি মুখে হাসি চলে আসে। যে নিজ চোখে দেখেছে তাদের এই খেলা সেই জানে একেমন শান্তির অনুভূতি জন্মায়। আমি নীরবকে ফেলে একাই আরো একটু সামনে অগ্রসর হালাম। আরো এক দল আবারও উড়াল দিলো আকাশে। আমি এবার ফন্দি করলাম একটা হাতে আটকাবো। হাত বাড়িয়ে উবু হলাম। কিন্তু চার চার বার ধরতে গিয়ে বিফল হালাম। হতাশ দুখানা নয়ন নিয়ে চাইলাম নীরবের দিকে। নীরব হেসে উঠলো অদূরে দাড়িয়ে। এগিয়ে এলো আমার দিকে। সে হঠাৎই খপ করে একটা কবুতর ধরে ফেলল। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ভীষণ মধুময় কন্ঠে বলল

— উপরে খোলা আকাশ, নিচে শন্তির প্রতীক কবুতর। এদের সাক্ষী রেখে আমি আজ আমার বেগমকে আমার বুকটা লিখে দিলাম চিরতরে।

আমি লজ্জা পেয়েও আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। এই প্রথম লজ্জা, দ্বিধা এমনকি কোন বাঁধা ছুতে পারলো না আমায়। স্বামীর কবুতর রাখা হাতের উপর হাত রেখে বললাম

— আমি আমার নবাবের বুকে আজীবন মাথা রেখে ঘুমোতে চাই। একমাত্র তাকে নিয়েই ভাবতে চাই। তার ভিতর ঘরে শুধু আমিই বাস করতে চাই।

চলবে……

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here