টিট ফর ট্যাট পর্ব-১২

0
2911

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_১২

আমার বলে উঠা ছন্দময় কথায় নীরব মুচকি হাসলো। আমি মুগ্ধ হলাম তার ঠোঁটের অভিব্যাক্তিতে। কবুতরটা নিজ হাতের মুঠোয় নিলাম। নীরব সম্মুখ হতে সরে আমার পাশ ঘেঁষে দাড়িয়ে গেলো। হঠাৎ তার বদনে নেমে এলো সুস্থিরতা। চোখ উন্মুক্ত। তাতে সানগ্লাসটা নেই। ওই চোখে কেন আমি বুকের দগ্ধ ব্যাথা দেখতে পাচ্ছি? বুকটা আমার হু হু করে উঠলো আচমকা। এমন ক্ষণে নীরব আকাশ পানে দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো

— দু বছরের ভালোবাসা ছিল। আজ তিন বছর হয় ব্রেকআপ হয়েছে ওর সাথে। সম্পর্কে আমরা খালাতো ভাই বোন। কোনো ভাবে আাসা যাওয়া করতে করতে ফেঁসে গেছিলাম। খুব ভালোবেসেছিলাম তাকে নীলিমা! কিন্তু সে কদর করতে জানলো না। আমি শুধু বলেছিলাম হারাম থেকে বেরিয়ে আসি আমরা। তাকে বলেছিলাম চলো বিয়ে করি। কিন্তু তখন আমার লাইফ সেটেল্ড ছিলো না। মেডিকেলে পড়ুয়া আমি। তাই সে… আমাকে ছেড়ে আমারই মেডিকেলের একটা বড় ভাইয়ার সাথে রিলেশনে যায়। আমি নাকি ক্ষ্যাত। নিউ লাইফস্টাইল আমার জানা নেই তাই।

কথাগুলো বলে নীরব থামলো। তার চোখ শুষ্ক। শুধু তপ্ত নিশ্বাস পরেছে বুকের গভীর হতে। কিন্তু আমার চোখ ভিজে উঠেছে। মনে হচ্ছে কলিজায় ধারালো কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করলো কেউ। চিনচিন ব্যাথায় বুক কাতর।নীরব ঘুরে দাড়ালো আমার দিকে। আমার ছলছল নয়ন দেখে সে মুচকি হাসলো। ডান হাতে চোখের পানি মুছে নিয়ে আমায় নিরুত্তর বুকে চেপে নিলো। এক হাতে জরিয়ে নিয়ে বলল

— আমার আর তার জন্য কোনো অনুভূতি নেই নীলিমা। তুমি ভয় পেও না। তিন বছরে পুড়ে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে।

আমি নীরবের বুকে মাথা রেখেই এক হাতে চোখ মুছে নিলাম। নিশ্চুপে দাড়িয়ে রইলাম। কি দরকার ছিল এই মুহূর্তে এমন কথা বলে মুডটা নষ্ট করার? স্ক্রু ঢিলা ডাক্তার একটুও ভালো না। আমার কি মন পুড়ে না স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনলে? ভাবতে গিয়ে আবার ফুপিয়ে উঠলাম। নীরব বুঝি বেশ বিরক্ত হলো। তার পক্ষ হতে শুনতে পেলাম

— কি জ্বালা! নীলিমা, এতে কান্না করার কি আছে? …….. এই জন্যই বিশ প্লাস মেয়েদের বিয়ে করা ভালো। আঠারো প্লাস মেয়েরা এমনিই কাঁদে। বাজে মুডের মেয়ে। লাইসেন্স নেই এদের মুডের। হুটহাট চেঞ্জ হয়।

নীরবের কথায় এবার আমি হুট করে রেগে গেলাম। ঝটপট মাথা তুলে মেজাজ নিয়ে বললাম

— ভালো। তো একটা বুড়ি মানুষ বিয়ে করলেই পারতেন। নানি দাদি টাইপ।

— ঠিকই বলেছো তোমাকে রেখে তোমার দাদিকে বিয়ে করলেই ভালো হতো। পাশে বসে আমার সব দুঃখ শুনতো। নো কান্নাকাটি। নো নাক টানাটানি। নো এই অবস্থা

কথাটা বলেই নীরব মুখ বাকিয়ে হাতের আঙ্গুলে ইশারা করলো তার শার্টের দিকে। আমি সরু চোখে চাইলাম। অকল্পনীয় দৃশ্যটা চোখ এড়ালো না। আমি লজ্জা পেলাম বেশ করে। মুহূর্তেই সব রাগ পানি হয়ে গেলো।

— বুকের মধ্যিখানে বউ নাকের পানি মুছে দিয়েছে। জার্ম লেগে গেলো ছিহ! বুকটা আজ লিখে দেওয়াই ভুল হয়ে গেছে।

চোখ মুখ খিঁচে টিস্যু দিয়ে শার্ট মুছতে মুছতে বলল নীরব। আমি হঠাৎ তার কথায় ফিক করে হেসে দিলাম। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার সত্ত্বা তার মধ্যে জাগ্রত। নীরব আমার হাসির শব্দে চোখ গরম করে চাইলো আমার দিকে। আমি আরো একবার বত্রিশ পাটি দাঁত দেখানোর প্রচেষ্টায় হেসে দিলাম। তারপর ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলাম প্রাণতুল্য স্বামীর নিকট। আমাদের মাঝে দু ইঞ্চির ব্যাবধান। বিড়াল চোখ জোরা আমার চাঞ্চল্যতায় ছেয়ে গেলো। ঠোঁট টিপে হাসছি আমি। পলকহীন তার মুখের দিকে সেকেন্ড দশেক তাকিয়ে থেকে হুট করে তার গলায় নাক ছুড়ে ভো দৌড় আমি। খিলখিল করে হাসতে হাসতে বেশ দূরে চলে এলাম। হাতে কবুর এখনো আছে। নাক মোছার কিছু পাইনি তখন তাই তো তার শার্টে নাক ঘষেছিলাম। সুরসুর করছিলো যে! কিন্তু সে ডাক্তারি ভাব দেখালো কেন? এখন দেখি জীবাণু কিভাবে দূর করে। শরীর লাগিয়ে দিয়েছি।

.
মাথার উপর নিশ্বব্দে অবিরাম ক্লান্তহীন ভো ভো করে ঘুরে যাচ্ছে তিন পাখার ফ্যানটা। আমি যেন ক্রমশ ফ্যানের সাথেই পাল্লা দিয়ে ঘামছি। ইতিমধ্যে শাড়ির আচল দিয়ে পাঁচ বার মুখ মুছেছি। নীরবের সাথে মধুময় মুহূর্ত গুলো পার করে বাসায় এসে বিষাক্ত পরিস্থিতিতে পরেছি। আমি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে আমি একটুও নীরবকে নিয়ে বাসায় আসতাম না। কিছুতেই না। আমি এই মুহূর্তে বসে আছি নীরবের পাশে। আমাদের ঠিক সম্মুখেই বসে আছে জেরিন আপু সাথে শাশুড়ি মা। বুকটা আমার ভয়ে আশঙ্কায় ঢিপঢিপ করছে। গলা শুকে উঠছে বারংবার। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালাম নীরবের দিকে। নীরব অত্যন্ত শান্ত, স্বাভাবিক এবং অবিচল গতিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। হৃদের বিয়ের কর্ড, আয়োজন সব কিছুর প্রোগ্রাম করছে সে জেরিনের সাথে। মাঝে মাঝে খুব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নীরব তাকাচ্ছেও কথার ফাঁদে জেরিনের দিকে। স্বামীর প্রাক্তন আমার সামনে। এ নিয়ে আমার যতটা না ভয় তার চেয়েও বেশি অভিশঙ্কা আমার নীরবের কানে কিছু কথা ফাঁস হওয়ার। উনি যে জেরিন আমি তা জানতাম না। এই মেয়েকে নিয়ে হৃদের সাথে আমার একসময় তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। হৃদ তাকে বাইকে করে কোথাও নিয়ে গিয়েছিল এটা আমার সহ্য হয়নি। তখন মান অভিমান চলেছিল হৃদের সাথে। এই মান অভিমানের অবসান করতে হৃদ প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ করায় জেরিন আপুর সাথে। আমার আতঙ্ক এখানেই। মেয়েটা একটা কথা বললে দু’বারই দেখছে আমাকে। তার দৃষ্টিতে আমার বুকে ধ্বক করে উঠে। নীরবকে কিছু বলে দেবে না তো? আমি আমার শেষ সম্বল হারাতে কিছুতেই রাজি না। না! আমার নীরবকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবো না।

— আমার খারাপ লাগছে।

থমকানো গলায় নীরবের হাতটা চেপে ধরে বলে উঠলাম। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। ছটফট লাগছে বুকের ভেতরটা। অতিরিক্ত চিন্তায় কি শ্বাসকষ্ট জাগছে?

— শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? ঠোঁট নীল হয়ে আসছে। নীলিমা? খুব কষ্ট হচ্ছে?

আমার হাতের উপর হাতটা রেখে বিচলিত হয়ে বলে উঠলো নীরব। আমার চোখ ইতিমধ্যে পানির ধারা নামিয়েছে। আমি নীরবের কথায় মাথা ঝাঁকালম। মন চাইছে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে কান্না করি। নীরবের গলা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলি

— আপনি আমাকে ছেড়ে দিয়েন না ডাক্তার। আপনার বুকে মাথা রাখলে আমি শান্তি পাই। আল্লাহর পর আপনি আমার বড় ভরসা। প্লিজ ডাক্তার যা কিছুই হয়ে যাক ছাড়বেন না আমাকে।

— আমাকে শক্ত করে ধরো নীলিমা।

বসা থেকে তুলে আমায় বলল নীরব। জাপ্টে নিলো একহাতে। আমার শ্বাসকষ্ট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নীরব মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল

— আম্মু নীলিমা কে নিয়ে আমি ঘরে গেলাম।

শাশুড়ি মাও উাঠে দাড়িয়েছেন। আমার এক হাত ধরে বললেন

— চল আমিও যাই। মা তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে? শ্বাসকষ্ট হলে কি যেন দেয় ওটা আছে তো ঘরে?

শেষকথাটা নীরবের দিকে তাকিয়ে বললেন মা। নীরব মাথা ঝাঁকিয়ে সাই জানালো। মা ছেলে কথা বলতে বলতে আমায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের দিকে। আমার বুক ক্রমশ ভেঙে আসছে এসব ভালোবাসা দেখে। জেরিন মেয়েটা কি সব বলে দেবে আমার নীরবকে? আমার ডাক্তার কি আমাকে ছেড়ে দেবে? শাশুড়ি মা তো আর আমাকে আদর করবে না। আমার নীরব আর আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে না। বড় বাচ্চা বলে কেউ ডাকবে না। কথাগুলো মনে উঠে কান্নার বেগ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট। আমি ঘাড় ফিরিয়ে চাইলাম পেছনে ফেলে আসা জেরিন মেয়েটার দিকে। এখন আর তাকে আপু ডাকতে ইচ্ছে করছে না। নীরবদের আত্নীয় দের মধ্যে অন্য কেউ বড় হলে কি তো? এই মেয়েকেই কেন আসতে হবে এ বাড়িতে। বউ সাজানোর দায়িত্ব, বউয়ের কেনাকাটা কেন ওর নিতে হবে?

চলবে…….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here