তৃষ্ণা পর্ব ১১

0
1268

তৃষ্ণা
পর্ব ১১
মিশু মনি
.
অংশীর মনে চাপা কষ্ট। মাহিব কি কিছুই বোঝে না, নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছে। অংশীর মনে ওর প্রতি যে ভালোলাগার জন্ম হয়েছে, তা ক্রমশ মায়ায় রূপ নিচ্ছে। এই মায়া কাটিয়ে ওঠা অংশীর পক্ষে কঠিন। অংশী নিজেও তা জানে কিন্তু চাইলেও বেরিয়ে আসতে পারে না। বারবার মাহিবকে দেখার জন্য মন আনচান করতে থাকে। মনে এতটুকুও শান্তি নেই অংশীর। যতক্ষণ মাহিব সামনে থাকে ততক্ষণ ওর নিজেকে স্বর্গবাসী মনে হয়। আর মাহিবের সাথে মনোক্ষুণ্ণ হলেই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের মানুষে পরিণত হয় অংশী।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না। অংশী এ ছটফটানি সহ্য করতে পারছে না। মাহিবের কাছে যাওয়ার জন্য মনের ভেতর যে ঝড় শুরু হয়েছে, তা কিছুতেই থামবে না। বাধ্য হয়ে উঠে পড়লো অংশী।

মাহিবের ঘরের পাশে এসে দাঁড়ালো। অনুমান করে মাহিব যে ঘরে থাকে তার পাশে এসে শব্দ করতে লাগলো। যেন শব্দ শুনে বাইরে আসে মাহিব। মাহিব সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই অংশী ছুটে গিয়ে ঘর থেকে নূপুর নিয়ে এসে বারবার রিনরিনে শব্দ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর ছনের ঘরের দরজায় একটা ছায়া দেখতে পেয়ে অংশী শিউরে উঠলো। পা টিপে টিপে হাঁটতে লাগলো সেই ছায়ার দিকে। মাথা নিচু করে রেখেছে অংশী। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলো এটা মাহিব নয়, প্রীতম।

অংশীর মুখ লজ্জায় কালো হয়ে গেলো। প্রীতম অবাক হয়ে বললো, ‘এত রাতে তুমি বাইরে হাঁটছো?’

লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছে অংশী। কথা বলতে পারলো না। প্রীতম আবারও বললো, ‘অংশী, কি হইছে তোমার?’

অন্য সময়ে এক ছুটে ঘরে চলে যেতো অংশী। কিন্তু আজ যেন পায়ের নিচে শেকর গজিয়েছে। পা উঠতেই চাইছে না। অংশীর মুখ দেখে প্রীতম কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে বোধহয়। ও বললো, ‘ভাইয়াকে খুঁজছো?’

চমকে উঠে মাথাটা দুদিকে নাড়ালো অংশী। প্রীতম মুচকি হেসে বললো, ‘মিথ্যে বলছো কেন? ভাইয়াকে খুঁজতে এসেছো তাই না?’
– ‘না।’
– ‘তাহলে? আমি ইঙ্গিত দেখেই ব্যাপারটা বুঝতে পারি মিস অংশী।’
– ‘আসলে..’
– ‘আসলে কি? সমস্যা কি বলো তো?’

প্রীতমের গলায় রাগ মেশানো। অংশী প্রীতমের দিকে চোখ তুলে তাকালো। প্রীতম বললো, ‘তোমাদের মত মেয়েদের সমস্যা কোথায় আমি ঠিক বুঝতে পারি না।’
– ‘মানে!’
– ‘আসো আমার সাথে।’

প্রীতম অংশীকে নিয়ে এলো বাড়ির পিছন দিকের জংগলের কাছে। তারপর বললো, ‘তুমি নিজের জায়গাটা বোঝো না? মাহিব তোমাকে পছন্দ করে বা ভালোবাসে বলে তুমি ভাবছো? এই ক্ষণিকের ভালোলাগাকে প্রশ্র‍য় দিও না। ভুল করবে ভুল।’

স্তব্ধ হয়ে গেলো অংশী। প্রীতম কেন এসব বলছে! কান্না আসছে ওর।

প্রীতম বললো, ‘মাহিবকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। ও শুরুতে যে মেয়েকে দেখে তার প্রতি ই আকৃষ্ট হয়ে যায়। মেয়েদের প্রতি সহজাত আকর্ষণ কাজ করে ওর। সেখানে তুমি রূপে অনন্যা। তোমাকে দেখলে যেকোনো যুবক ছেলের মাথা ঘুরে যাবে। যেমন আমিও তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। মাহিবকে বিশ্বাস কোরো না অংশী। এই ক্ষণিকের ভালোলাগাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের জীবনকে শেষ কোরো না। তোমার এখন উঠতি বয়স। এ বয়সের আবেগ জোয়ারের মত। বাড়তেই থাকে। আর একবার ধাক্কা খেলে একেবারে ফুলে ফেঁলে উঠে। ভুল কোরো না।’

অংশীর চোখ ভিজে আসলো। ও এই কঠিন সত্যগুলোকে কখনো ভেবে দেখেনি। কখনো মাথাতেই আসেনি ওর৷ ও কেবল মাহিবের গুণ, সৌন্দর্য সবকিছুকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে। তাতে অপরাধ তো হয়নি। কিন্তু কথাগুলো বড্ড কঠিন মনে হয়।

প্রীতম বললো, ‘মাহিব এমন একটা জিনিস, যাকে সহজে ধরা যায় না৷ ওর পিছনে শত শত মেয়ে লাইন ধরে আছে। এমনও নায়িকা আছে যারা মাহিবের সিনেমায় অভিনয় করার জন্য মাহিবের বিছানায় যেতেও রাজি। এরকম হাজারো প্রস্তাব প্রতিনিয়ত পায় ও। মাহিবের প্রেমে পড়ো না। সাবধান করে দিলাম। যতদূর মনে কল্পনা জেগেছে, এখানেই সমাপ্ত করে দাও। তুমিও ভালো থাকবে, সবাই ভালো থাকবে।’

মাহিবের নামে এই কথাগুলো শুনতে একটুও ভালো লাগলো না অংশীর। যদিও কথাগুলো বাস্তব। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই নির্মম সত্যি। কিন্তু অংশীর মন যে তবুও মানছে না। মাহিবকে একবার না দেখে ঘুমাতে চায় না ও। ঘুম আসবেই না। এত কথা শোনার পরও অংশীর ইচ্ছে করছে মাহিবকে একটি পলক দেখতে। মাহিবের ঘরের দিকে তাকালো অংশী।

প্রীতম বললো, ‘আমার দায়িত্ব তোমাকে ভালো করে বোঝানোর। আমি বলে দিলাম। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। তবে নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মেরো না। এ সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যত থাকবে না অংশী। মাহিব একটা আকাশ কুসুম কল্পনা। ওকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখাই ভালো। কষ্ট দিয়ে থাকলে আমাকে মাফ কোরো। ঘরে যাও এখন।’

প্রীতম হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। অংশী মাথা নিচু করে রেখেছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক। গাল বেয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। অংশী নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছে। ওর ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে কাঁদতে। প্রীতম ঘরে চলে গেলেও অনেক্ষণ নড়তে পারলো না অংশী। জংগলের ভিতরে ঢুকে একটা গাছে হেলান দিয়ে কাঁদতে লাগলো। গাছের ডালে লেগে হাতের চামড়া ছিলে গেছে অংশীর। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ও কেঁদেই চলেছে। কি পরিমাণ কষ্ট যে হচ্ছে তার কোনো শেষ নেই।

১২
আজকের দিনটা রোদ ঝলমলে। রোদের আলোয় গাছের পাতা ঝিকমিক করছে। আয়না বুলবুল হাঁক পাড়ছে অনেক্ষণ ধরে। কর্মচারীরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেটের লোকজন শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহিবের ঘরের বাইরে ইট দিয়ে যে চুলা বানানো হয়েছে তাতে খিচুড়ি রান্না করছে দুজন। মাহিব টংয়ের উপর রোদের আলোয় বসে স্ক্রিপ্ট পড়ছে।

মায়ের কথা শুনে আয়না বুলবুল কে খাবার দিতে গাছের নিচে এলো অংশী। সামান্য দূরেই মাহিব বসে স্ক্রিপ্ট পড়ছে। অংশী একবার ফিরেও তাকালো না। সারা রাত জংগলে বসেই কেঁদে কাটিয়ে দিয়েছে ও। ভোরবেলা ঘরে ফিরেছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাহিবকে মন থেকে একেবারেই মুছে ফেলবে। এই সম্পর্ক শুধুমাত্র পরিচয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকাই ভালো। মাহিবকে ছোঁয়ার তৃষ্ণা, আজীবন তৃষ্ণাই থেকে যাক। তাতেই উভয়ের কল্যাণ।

আয়না বুলবুলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলো অংশী। দূর থেকে মাহিব দেখছে ওকে। একবার নাম ধরে ডাকলো, ‘এই অংশী..’

অংশী শুনেও না শোনার ভান করে রইলো। মাহিব আবার ডাকলো, ‘অংশী..’

অংশী এবার মুখ তুলে তাকালো। অংশীর মুখটা মলিন। চোখেমুখে কান্নার ছাপ। দূর থেকে দেখেও কেমন মায়া লাগলো মাহিবের। ও বললো, ‘এখানে এসো।’

অংশী ঠায় বসে রইলো। ওখানে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। মাহিব আবার ডাকলো, ‘এসো…’

অংশী তবুও উঠলো না। আয়না বুলবুলের পাশেই বসে রইলো। এমন সময় অংশী বাবার গলা শুনতে পেলো- ‘অংশী মা, বেয়াদবি করতাছো ক্যান? সাহেব ডাকতাছে শুনো না?’

বাবার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো অংশী। মাহিবের টংয়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। মাহিব অংশীর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। ও বললো, ‘বসো।’

অংশী নির্বাক ভঙ্গিতে বসে পড়লো। মাহিব জোরে চেঁচিয়ে একটা ছেলেকে বললো তিন কাপ চা দিয়ে যেতে। অংশীর বাবাও দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশে। উনি চায়ের কথা শুনে বললেন, ‘আমি খামু না। কামে যাই। আপনের কোনো দরকার হইলে আমারে একটা কল কইরেন।’

দ্রুত চলে গেলেন অংশীর বাবা। মাহিব অংশীকে বললো, ‘কি হয়েছে তোমার?’

অংশী কোনো কথা বললো না। এখনো মুখটা মলিন।
মাহিব বললো, ‘আরে মেয়ে বলো না কি হয়েছে? এমন চুপচাপ হয়ে আছো কেন? তোমাকে চুপচাপ থাকলে মানায় না।’
– ‘আমি ঘরে যাই।’
– ‘কেন? আগে বলো কি হয়েছে? আম্মা বকা দিয়েছে?’

অংশী নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো, ‘আমার কথা ছাড়েন। আমি যাই, আপনে চা খান।’
– ‘চুপ করো। চুপচাপ বসো এখানে।’

মাহিবের ধমক খেয়ে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো অংশীর। ও মাহিবের চোখের দিকে তাকালো। অংশীর চোখে যে মায়া দেখতে পেলো মাহিব, তাতে নিজেকে ওর খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো। মনটা কেমন যেন হয়ে গেলো। বললো, ‘কি হইছে অংশী?’
– ‘কিছু হয় নাই। ভালা আছি।’
– ‘এভাবে কথা বলছো কেন? কিছু তো একটা হয়েছে। আমার কাছে লুকাচ্ছো?’
– ‘লুকাইলে আগেই লুকাইতাম। আগে যখন লুকাইনাই, এখন কিছু লুকানির বাকি আছে?..’

কথাটা শুনে খটকা লাগলো মাহিবের। ও অবাক হয়ে জানতে চাইলো, ‘মানে!’

অংশী উত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মাহিব হঠাৎ অংশীর হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। হাতটা অনেক খানি ছিলে গেছে। ও ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘একি! হাতে আবার কি হয়েছে? অংশী, সত্যি করে বলো তো কি হয়েছে?’

মাহিব চেঁচিয়ে একজনকে বললো ওর ব্যাগ থেকে মলম নিয়ে আসতে। ছেলেটা দৌড়ে এসে মলম দিয়ে গেলো। মাহিব খুব যত্ন করে অংশীর হাতে লাগিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘কি যে করো বুঝি না। দেখেশুনে চলবে না? এটা বিদেশী মলম। ঠিক হয়ে যাবে।’
– ‘যেইটা দেখা যায় সেইটা ঠিক কইরা দিলেন। যেইটা দেখা যায় না, ওইটা?’

মায়াভরা চোখে মাহিবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো অংশী। মাহিব চোখের পলক ফেলতে পারলো না অনেক্ষণ। অংশী এভাবে বলছে সেটা যেন বিশ্বাসই হতে চাইলো না ওর। অংশী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জলভরা চোখে বললো, ‘আপনে আমারে আর কক্ষনো ডাইকবেন না। আপনে আপনের মত থাইকেন, আমারেও থাকতে দেন। ভালা থাইকেন।’

কথাটা বলেই একটা ছুট দিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলো অংশী। মাহিব বসে রইলো স্তব্ধ হয়ে। অংশীর মনে কি চলছে তা কিছুটা বুঝতে পেরেছে মাহিব। নিজেরও কেমন যেন লাগতে শুরু করেছে। মাহিবের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। ঘুম থেকে ওঠার পর স্বপ্নকে ভেবে যেমন লাগে, মাহিবও ঠিক তেমন অনুভব করছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here