তৃষ্ণা পর্ব ১২

0
1257

তৃষ্ণা
পর্ব ১২
মিশু মনি
.
১৩
দুদিন হয়ে গেলো অংশীর সাথে কোনো দেখা বা কথা নেই মাহিবের। অংশী কেমন আছে তাও জানে না মাহিব। কাজের ব্যস্ততায় থাকার পরও মাহিবের মনটা অংশীর দিকে ছুটে যায়। বারবার অংশীকে দেখতে ইচ্ছে করে। অংশীর সাথে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে দমাতে পারছে না মাহিব। অংশী যেভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিলো তাই যেন বাস্তবতা। কিন্তু এতটুকুও ভালো লাগছে না মাহিবের। অংশীর সঙ্গ ছাড়া নিজেও কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে সবসময় অংশী পাশে থাকুক, কথা বলুক, ওর দিকে তাকিয়ে থাকুক। এতে অনুপ্রাণিত হবে মাহিব।

মাহিব শেষ অব্দি অংশীর খোঁজে ওদের দরজায় এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। অংশী ঘরেই ছিলো। চমকে উঠলো ও। মাহিবের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলো না। চোখাচোখি হতেই দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে ফেললো নিজেকে। মাহিব ই আগে কথা বললো, ‘অংশী, দুদিন তোমার দেখা নেই। কেন?’

অংশী কোনো উত্তর দিলো না। মাহিব কাছে এসে বললো, ‘তোমার সাথে অনেক কথা আছে। আসো আমার সাথে।’

অংশী প্রথমে যেতে আপত্তি করছিলো। কিন্তু মাহিব ডাকছে আর ও না গিয়ে থাকতে পারবে এমন তো হতে পারে না। অংশী ধীরপদে অনুসরণ করলো মাহিবকে।

মাহিব অংশীকে ওর সেই পছন্দের জায়গাটায় নিয়ে এলো। অংশী যখন বললো, ‘এইখানে আনলেন ক্যান?’

মাহিব অংশীর কোমরে হাত রেখে হেচকা টানে বুকে টেনে নিলো অংশীকে। কি ঘটছে বুঝতে সময় লাগলো অংশীর। ও কাঁপা কাঁপা চেহারায় মাহিবের দিকে তাকালো। মাহিবের চোখের দৃষ্টি বদলে গেছে। অংশী রীতিমতো কাঁপছে। চোখ মেলে থাকতে পারছে না ও।

মাহিব বললো, ‘আমার থেকে নিজেকে পালিয়ে বেড়ানোর সাহস কোথ থেকে হলো তোমার? সবকিছু ভুলে আমার সাথে থাকতে হবে তোমায়। আমার কাজে তোমাকে পাশে না পেলে আমি কাজে মন দিতে পারবো না।’

এই দু লাইনের কথাতেই অংশী কি যে পেলো নিজেও জানে না। চোখ ছলছল করে উঠলো। জল গড়াতে লাগলো দুচোখ বেয়ে। মাহিব অংশীর মুখটা ধরে বললো, ‘প্লিজ অংশী। আমাকে ভুল বুঝো না। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকবো, কথা দিলাম। আমার পাশে থাকো, তোমার চোখে আমি পৃথিবী দেখতে চাই। এইটুকু সুযোগ আমাকে দিতেই পারো তাই না?’

অংশী কোনো কথা বলতে পারলো না। নিরবে কেঁদে যেতে লাগলো। মাহিব মুছে দিলো ওর চোখের জল। অংশীর গালে আঙুল ছুঁইয়ে জল মোছার ছলে অংশীকেই যেন আপনার করে নিলো মাহিব।

প্রেমের গল্পটা শুরু এখান থেকেই। অংশী সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মাহিবকেই ধ্যান জ্ঞান ও একমাত্র জীবনের আলো ভাবতে শুরু করলো। সেদিনের সূর্যকে সাক্ষী রেখে দুজনের যে ভালোবাসার সূচনা হলো, তা ক্রমাগত এগিয়ে যেতে লাগলো হাতে হাত রেখে। রোজ কাজের ফাঁকে মাহিব অংশীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নৌকা নিয়ে বিলে যায়, পুরো বিল নৌকায় ঘুরে বেড়ায় দুজনে। মাহিব শাপলা ফুল তুলে অংশীর হাতে দেয়। নৌকায় বসেই বেণী করে দেয় অংশীর চুলে। তারপর বেণীর নিচে শাপলা ফুল গুঁজে দেয়। অংশী খিলখিল করে হাসে। মাহিবের পায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে মাহিবকে অনুভব করে অংশী। এই ছেলেটাকে ছাড়া জীবনটাই চলবে না ওর।

বিলের মাঝখানে শাপলা ফুল তুলতে তুলতে দুজনে প্রাণখুলে হাসছিলো। সময়টা যেন ঘড়ির কাটায় থমকে গেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না, কেউ নড়াচড়া করছে না। শুধু চোখ বুজে একে অপরকে অনুভব করছে আর ভাবছে, মানুষটা কি সুন্দর!

হঠাৎ ই অংশী বললো, ‘এই সুখ আমার কপালে সইবো তো সাহেব?’

মাহিব চোখ তুলে তাকায়, ‘কেন এ কথা বলছো?’
– ‘শুটিং শ্যাষ হইলে গেলেই তো আপনে চইলা যাইবেন। আজীবনের মত ভুইলা যাইবেন আমারে। আমার কথা কি আর আপনের মনে থাকবো?’

অংশীর গলা ধরে এসেছে। মাহিব কি করে স্বান্তনা দেবে বুঝতে না পেরে রৌদ্রজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওই আকাশকে সাক্ষী রেখে বলছি। আমি তোমাকে কক্ষনো ভুলবো না।’
– ‘ভুলতে তো কেউই পারে না। খালি সম্পর্কটা শ্যাষ কইরা দেয়।’
– ‘তোমার সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিলে আমি নিজেও তো শেষ হয়ে যাবো অংশী।’

অংশী মাহিবের চোখের দিকে তাকায়। চোখ ছলছল করছে অংশীর। মাহিবের দিকে তাকিয়ে যেন ভরসা পায়। মাহিব ওর হাতের উপর হাত রেখে বলে, অংশী, প্লিজ মন খারাপ করো না। এসব কেন ভাবছো?

অংশী আজ নিজের অধিকার আদায়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েই ছাড়বে এমন একটা পণ করেছে। এই সম্পর্কের পরিণতি কি হবে সেটা জেনে নিতে হবে ওর।

মাহিব প্রশ্ন শুনে অবাক হলো। আজ অংশী কেনই বা এসব ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। অংশীর কষ্ট হলে ওর ও যে ভালো লাগে না।

মাহিব অংশীর হাতে হাত রেখে বললো, ‘তোমাকে আমি আমার কাছে নিয়ে যাবো। কয়েকটা দিন যেতে দাও। শহরে গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে আমি নিয়ে যাবো তোমায়।’
– ‘কিন্তু আমার বাপ মায়?’
– ‘তারা আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করে অংশী। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই, এমন বললে ওনারা না করতে পারবে না।’
– ‘সত্যি কইতাছেন?’
– ‘এই যে তোমাকে ছুঁয়ে বললাম। আমি আজীবন তোমার সাথে আছি অংশী। আমাকে এইটুকু বিশ্বাস তুমি করতে পারছো না?’

অংশী মাহিবের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। বলে, ‘আমি তো বিশ্বাস করি। মেলা বিশ্বাস করি। কিন্তু আমার ডর লাগে। আপনারে হারাইবার শোক আমি নিতে পারমু না সাহেব।’

মাহিব অংশীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘প্লিজ লক্ষিটি আমার। এসব নিয়ে টেনশন কোরো না। আমি তোমার জন্য এমন কিছু করবো যে তুমি নিজেই তাক লেগে যাবে। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হবে সেটা।’

অংশী মনে মনে খুশি হয়ে উঠলো। মাহিবকে ভীষণ ভরসা করে ও। মাহিবকে শক্ত করে চেপে ধরে মাহিবের বুকের শব্দ শুনতে লাগলো ও। মাহিব বললো, ‘পাগলী, কেউ দেখে ফেললে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দেবে, ওঠো ওঠো।’
– ‘বিয়ে দিলেই ত ভালা। ডরান ক্যান?’

হেসে উঠলো অংশী। মাহিব বললো, ‘এভাবে? আমি একটা কাজে এসে কেলেংকারী করে যাবো? আমাদের বিয়ে হবে অনেক ধুমধাম আয়োজন করে। তার আগে আমি তোমাকে আমার উপযুক্ত করে গড়ে তুলবো। পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে দেখবে তোমাকে। বুঝেছো কচি খুকিটা?’
– ‘কচি কইবেন না, আমার শরম লাগে।’
– ‘তাহলে কি বুড়ি বললে ভাল্লাগবে?’
– ‘আমি তো যুবতী।’

মাহিব হা হয়ে গেলো। তারপর হাসতে হাসতে বললো, ‘ওরে আমার যুবতী রে। কত্ত বড় হয়ে গেছে আমার টুনিটা! বাপরে।’
– ‘হ বিয়ার উপযুক্ত হইছি।’
– ‘উহুম অংশী, কলেজ পড়তে হবে। ভার্সিটি পড়তে হবে। ভালো চাকরি করতে হবে। নয়তো সাহেব বিয়ে করতে পারবে না।’
– ‘এইগুলা আমি ক্যাম্নে পারুম? আমার আব্বায় আমারে তার আগেই বিয়া দিয়া দিবো না?’
– ‘দেবে না রে পাগলী। আমি আছি কি জন্য? আমি কয়েকদিন পরেই তোমাকে নিয়ে যাবো। আমার কাছাকাছি থেকে পড়াশোনা করবে তুমি।’

অংশী হেসে আবারও জাপটে ধরলো মাহিবকে। মাহিব অংশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

১৩

শুটিং চলছে দ্রুতগতিতে। নায়িকার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে অংশীর। নায়িকা এতটা ভালো মনের মানুষ হবে ভাবতেই পারেনি অংশী। ও শুরুতে মেয়েটাকে দেখে ভেবেছিল অনেক দেমাগ, অনেক ভাব। কিন্তু মেয়েটিই আগে অংশীর সাথে পরিচিত হতে চাইলো। অংশী তো বেজায় খুশি।

যতক্ষণ শুটিং চলে, অংশী পাশেই বসে থাকে মাহিবের। মাহিব কাজ শুরু করলে একজন অন্য মানুষ হয়ে যায়। কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন। আর কাউকে যেন চেনে না। কাজ নিয়ে মাহিবের ছোটাছুটি দেখতে ভীষণ ভালো লাগে অংশীর।

শুটিংয়ের ফাঁকে মাহিব অংশীকে বলে কফি নিয়ে আসতে। ইতিমধ্যেই কফি বানানো শিখে গেছে অংশী। কফি অর্ধেক কাপ খেয়ে বাকি অর্ধেক মাহিব অংশীকে দেয়। অংশী কাপ হাতে বসে থাকে। মাহিব যে জায়গাটায় চুমুক দিয়েছিলো তাতে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বারবার সেখানে তাকিয়ে থাকে আর মাহিবের ঠোঁটের দিকে তাকায়। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে অংশী।

বিকেলে মাহিবের শুট ছিলো না। ও অংশীকে নিয়ে প্রতিদিনকার মতোই ঘুরতে বেরিয়েছে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কত কথাই না বলছিলো। মাহিবের কথায় নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখে গেলো অংশী। মাহিবকে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছে ও। এরচেয়ে সুখের সময় কক্ষনও আসেনি অংশীর জীবনে।

জংগলে হাঁটার সময় মাহিব আচমকা অংশীকে গাছে ঠেস দিয়ে চেপে ধরে বললো, ‘তখন আমার কফির কাপে ওভাবে চুমুক দেয়া হচ্ছিল কেন শুনি?’

অংশী লজ্জায় লাল হয়ে বললো, ‘কখন!’
– ‘বুঝি না ভেবেছো? ফাজিল। আমার ঠোঁট ছোঁয়ানো অংশে কিভাবে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিলে আমি বুঝি দেখিনি?’

অংশী লজ্জায় তাকাতে পারছিলো না। মাহিব অংশীর চিবুকে হাত রেখে বললো, ‘এত ইচ্ছে করে ঠোঁটের স্পর্শ পাবার?’

শিহরিত হয়ে উঠলো অংশী। তারপর একটা দীর্ঘ চুম্বন। যে স্পর্শ কোনোদিনো পায় নি অংশী। নিজেকে ওর কেবলই মনে হচ্ছিলো স্বর্গে আছে ও। মাহিবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে অংশী৷ কিন্তু এই পরম সুখের আবেশে ডুবে গিয়ে অংশী যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেললো।

রাতে খাবার খেতে ভুলে গেলো। শুধু সেই সুখের আস্বাদনকে ভেবে ভেবে কেমন উদাস হয়ে রইলো অংশী। ঘুমাতে গিয়ে ছটফট করতে করতে ভোরের পাখির কলকাকলী শোনা গেলো। অংশীর চোখে তবু ঘুম নেই। মাহিবকে ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না অংশী। কেবল মাহিবের জন্য ও নিজের জীবনটা দিয়ে দিতেও যেন কুণ্ঠিতবোধ করবে না। মাহিবকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না ও।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here