তৃষ্ণা পর্ব ১৩

0
1227

তৃষ্ণা
পর্ব ১৩
মিশু মনি
.
অংশীর খুব জ্বর। বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। শরীরে এতটুকুও বল পাচ্ছে না অংশী। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে। কিছুক্ষণ পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে আবার ছেড়েও যাচ্ছে। মাহিব সকাল থেকে অংশীকে দেখেনি। মনে খটকা লাগলো ওর। মা আবার বকাঝকা করেননি তো? এসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যাবেলা অংশীর খোঁজে একবার ওদের ঘরে এলো মাহিব। এসে দেখে অংশী বিছানায় শুয়ে। মা পাশে বসে আছেন আর অংশীকে ইচ্ছামত বকে চলেছেন।।

মাহিব মনেমনে ভাবলো, ‘যা ভেবেছিলাম তাই। তারপর বললো, ‘চাচী আসবো?’

অংশীর মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাহিবের দিকে মুখ তুলে তাকালেন, ‘আসেন। মাইয়াটার মেলা জ্বর। কাল থাইকা গা কাঁইপ্যা কাঁইপ্যা জ্বর আইতাছে।’

কথাটা শুনে আতংকিত হলো মাহিব। ও কাছে এগিয়ে গেলো অংশীর। কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। ও কয়েকবার অংশীর নাম ধরে ডাকলো, ‘অংশী.. চোখ মেলো তো।’

অনেক্ষণ কেটে গেলো কিন্তু চোখ মেললো না অংশী। মাহিব অংশীর পালস দেখে আবারও ডাকলো। এবার চোখ মেলে তাকালো অংশী। মাহিব জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হইছে অংশী?’

কয়েকবার চোখ মিটমিট করে অংশী বললো, ‘খালি জ্বর আহে। এইহানে খামচি দিয়া ধইরা আছে।’

অংশী তলপেট দেখিয়ে দিলো। এ তো ম্যালেরিয়ার লক্ষণ। গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু এখানে হাসপাতাল আছে তো!

মাহিব কোনোকিছু না ভেবেই অংশীকে কোলে তুলে ওর মাকে বললো, ‘আমি হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি টেনশন করবেন না। ওর ম্যালেরিয়া হয়েছে।’

ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেলো অংশীর মায়ের। তারপরও অংশীকে কোলে তুলে নিয়ে যাওয়ায় বাঁধা দিচ্ছিলেন উনি। মাহিব বাঁধা শোনার মানুষ নয়। ও দ্রুত অংশীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। অংশীর মায়ের গলায় চেঁচামেচি শুনে বাইরে এলো প্রীতম। এ অবস্থা দেখে ও অবাক হয়ে মাহিবের সাথে সাথে ছুটলো। কোলে নিয়েই বাজার পর্যন্ত এলো মাহিব। অংশী জ্বরের ঘোরে বিভোর হয়ে আছে। বাজারেই একটা ক্লিনিক আছে। সেখানে নিয়ে এসে প্রীতম ছোটাছুটি করে ডাক্তার খুঁজতে লাগলো।

হাসপাতাল পাওয়া গেলেও ডাক্তার খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গেলো। দিনের বেলায় হলে তবুও পাওয়া যেত। রাত নেমেছে বলে কোনো ডাক্তারও নেই। মাহিব চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করে ফেললো। ডাক্তার রোগী নেই বলে বাসায় চলে গিয়েছে। ম্যানেজারকে দিয়ে আবারও ধরিয়ে আনা হলো ডাক্তারকে।

ডাক্তার রোগী দেখলেন ঠিকই কিন্তু হাসপাতালে মশার উপদ্রব আরো বেশি। এই মশার সাথে থাকলে মাহিবেরও ম্যালেরিয়া হয়ে যাবে নির্ঘাত। মাহিব উপায় না পেয়ে ওষুধ লিখে নিয়ে অংশীকে আবারও বাড়িতে নিয়ে এলো। ওষুধ গুলো খাইয়ে দিয়ে খেয়াল রাখতে বললো ওর বাবা মাকে।

অংশীর পাশে বসে থাকার ইচ্ছাটাকে দমাতে চেষ্টা করছিলো মাহিব। গ্রামের লোকজন, এই মুহুর্তে ওর পাশে থাকতে দেখলে অন্যকিছু ভেবে বসবে। তাই বারবার প্রীতমকে পাঠিয়ে অংশীকে দেখে আসতে বলছিলো মাহিব। মাঝরাতে নিজেও একবার খোঁজ নিতে এলো এখন কেমন আছে অংশী।

মাহিবের কথামত অংশীর গা মুছে দিচ্ছেন মা। পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। মাহিবের এই উদারতায় ছেলেটার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো স্বামী স্ত্রী উভয়েরই।

পরদিন সকালে একটা গাড়ি এসে হাজির অংশীদের বাড়ির সামনে। মাহিব ওর ভাইয়াকে বলেছিলো গাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ভাইয়া যে থানায় কর্মরত আছেন, সেখানে গেলে কিছুটা হলেও ভালো সেবা পাওয়া যাবে। সেই আশায় অংশীকে নিয়ে এসে গাড়িতে তুললো মাহিব। অংশীর মা ও মেয়ের সাথে যাওয়ার জন্য গাড়িতে এসে বসলেন।

অল্প সময়ের মধ্যেই পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি সদরে এসে পৌঁছলো। বেলা তখন এগারোটা। অংশীর জ্বর ছেড়ে গেছে কিন্তু শরীর দূর্বল। ও চোখ মেলে মাহিবকে দেখছে। মাহিব ওকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এসে বেডে শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন নার্স এসে সেবা যত্ন শুরু করে দিলো অংশীর।

সময় যেন যেতেই চায় না। অংশীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে মাহিব চলে এলো নিজের কাজে। শুটিং একদিন বাদ দিয়ে দিলেই সমস্যা হয়ে যাবে। কাজে মন বসতে চাইছিলো না মাহিবের। তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করলো কাজটা সম্পন্ন করার। বারবার অংশীর রুগ্ন চেহারাটা ভেসে উঠতে লাগলো মাহিবের চোখের সামনে।

১৪
পরদিন শুটিংয়ের দায়িত্ব প্রীতমকে বুঝিয়ে দিয়ে মাহিব অংশীর কাছে এলো। অংশীর মায়ের জন্য নাস্তা আনতে ভোলে নি ও। নাস্তা খাওয়ার পর মাহিব বললো, ‘চাচী, আমি কাল যে ছেলেটাকে রেখে গিয়েছিলাম ওকে নিয়ে আপনি বাসায় চলে যান। আমি আজকে এখানে থাকি।’

মায়ের মন তাতে মানতে চাইছিলো না। উনি বারবার বললেন, আপনে চইলা যান। কিন্তু মাহিব একরকম জোর করেই ওনাকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। এই খারাপ সময়ে অংশীর পাশে থাকতে না পারলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে মাহিবের। সবাই বেরিয়ে গেলে অংশীর বিছানার কাছে এসে বসলো মাহিব।

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই অংশী চোখ মেলে তাকালো। মাহিব হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘কেমন আছে আমার পাগলীটা?’

অংশীর চোখে জল চলে এসেছে। ওর চোখ মুছে দিয়ে মাহিব বললো, ‘কাঁদছো কেন? একদম কাঁদবে না। আজকে আমি তোমাকে পাহারা দেবো।’

অংশী মাহিবের হাত শক্ত করে ধরতে ধরতে ভেজা গলায় বললো, ‘আপনে আমারে এত ভালাবাসেন ক্যান?’

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো অংশী। মাহিব ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘পাগলী আমার। এখন কি কান্নার সময় বলো? এই যে আমি তোমার পাশে আছি, আর কেউ নেই। একাই আমি তোমার সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। এমন ক্ষণে কি কান্না করতে হয় তুমিই বলো?’

অংশী একহাতে গাল মুছে বললো, ‘আচ্ছা আর কাঁনমু না। আপনে কাম রাইখ্যা আইছেন ক্যান?’
– ‘আমার মনটা যে তোমার কাছেই পড়ে আছে। তোমাকে অসুস্থ অবস্থায় হসপিটালে ফেলে রেখে আমি বুঝি কাজে মন দিতে পারি?’
– ‘এই জন্যিই আমি কাঁনতেছি। আল্লাহ আমার কপালে এত সুখ ক্যান দিলেন!’
– ‘তুমি এই সুখটুকু পাওয়ার যোগ্য তাই।’
– ‘আমি যোগ্য?’
– ‘নয়ত এই মাহিব তোমাকে ভালোবাসতে পারে?’

প্রশ্নটা শুনেই অংশীর অন্যরকম আনন্দ হতে লাগলো। ও মাহিবকে শক্ত করে চেপে ধরে বললো, ‘আপনে আইছেন, অহন আমি সুস্থ হইয়া যামু।’
– ‘হুম। তোমাকে আমি এই নোংরা হসপিটালে ফেলে রাখতে চাই না। এখানে আমার ভাইয়ার বাসা আছে। আমরা আজকেই সেখানে চলে যাবো। ডাক্তার সেখানে গিয়ে তোমাকে দেখে আসবে। সুস্থ হয়ে গেলে তারপর বাড়ি যাবো।’
– ‘ওমা! আপনের ভাইয়া কিছু মনে করবো না?’
– ‘কি মনে করবে আবার? ভাইয়া খুব ভালো মানুষ।’
– ‘আপনের ভাইয়া এইখানে থাকে ক্যান?’
– ‘বুদ্ধু, আমার ভাইয়া এখানকার থানায় ইন্সপেক্টর।’

হা হয়ে গেলো অংশীর মুখ। ও অনেক্ষণ হা বন্ধ করতে পারলো না। মাহিব অংশীর জন্য নিয়ে আসা ফলমূল গুলো ধুয়ে অংশীকে খাইয়ে দিতে উদ্যত হলো। এই প্রথম মাহিবের হাতে কিছু খাচ্ছে অংশী। আপেলে কামড় দেয়ার সময় অংশী হাসছিলো।

মাহিব বললো, ‘তবে একটা কথা বলে রাখি। আমার কিন্তু নিজের ভাই নেই। এই ভাইয়া আমার কাজিন। প্রীতমকে দেখেছো না? প্রীতমও আমার মেজো চাচার ছেলে। প্রীতমের বড় ভাই এখানে কাজ করে। আর আমি এক বাবার এক ছেলে।’
– ‘ওমা!’

অবাক হয়ে মাহিবের দিকে তাকিয়ে রইলো অংশী। মাহিব হাসতে হাসতে অংশীকে আপেল খাইয়ে দিচ্ছিলো। অংশী বললো, ‘আপনের বাড়িতে আর কে আছে?’
– ‘আমার দুটো বোন, মিষ্টি আর মিঠি।’
– ‘ওমা! কি সুন্দর নাম।’
– ‘হুম। আব্বু আম্মু আর আমরা তিন ভাইবোন একসাথে থাকি। আমার বোন দুটো ঠিক যেন আমার কলিজা। তোমাকে পেলে ওরা যে কি খুশি হবে!’
– ‘সত্য কইতাছেন!’
– ‘হু। বেশি খুশি হবে আম্মু। আম্মু তো সারাক্ষণ বলেই থাকে অনেক বড় হইলি এবার একটা বউ আন, বউ আন। বউ বউ করে মাথা খারাপ করে দেয়।’

অংশী খিলখিল করে হেসে উঠলো। মাহিব অংশীর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘এবার মাকে গিয়ে বলবো খুব শীঘ্রই বউ আনবো মা, লাল টুকটুকে একটা বউ।’

শিহরিত হয়ে উঠলো অংশী। জ্বরের ঘোরে সমস্তকিছু ওর কাছে স্বপ্ন হয়ে ধরা দিতে লাগলো। এই স্বপ্ন কখনো যেন না ভাঙে।

ভাইয়ের বাসায় এনে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অংশীর সেবা করে যেতে লাগলো মাহিব। গা মুছে দেয়া, মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়া, খাবার খাইয়ে দেয়া, ওষুধ খাইয়ে দেয়া। অংশী যেন স্বর্গে ভাসছিলো। একদিনের যত্নেই বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠলো অংশী।

মাহিব বললো, ‘এবার তাহলে বাসায় ফেরা যাক। আজকে তো বিকেল হয়েই এসেছে, আমরা বরং কাল যাই।’

অংশী মাহিবের চোখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়, ‘আমার তো সারাজীবন থাইকা যাইতে মন চাইতেছে।’
– ‘হা হা। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো। ঢাকায় গিয়ে সবকিছু গোছাতে যা সময় লাগে। তারপর সারাজীবনের জন্য তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।’
– ‘আমার মনে হইতাছে আমি যেন ঘুমাইতেছি। ঘুমের মইদ্যে স্বপ্ন দেখতেছি।’

বলেই হেসে উঠলো অংশী। তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মাহিব অংশীর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে অংশীকে। অংশীর কাঁধে মাথা রেখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজনে।

সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। তারই রৌদ্রচ্ছটা এসে পড়েছে অংশীর চুলে। মাহিব অংশীর চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলে, ‘পাগল করা গন্ধ তোমার চুলে। শহরের মেয়েদের মাঝে একটা কৃত্তিমত্তা মেশানো, পারফিউমের কড়া গন্ধ। কিন্তু তোমার শরীর থেকে একটা আবেগ মেশানো মাদকতাময় গন্ধ পাই আমি।’

অংশী বললো, ‘তাই!’
মাহিব উত্তরে বলে, ‘হুম তাই। তুমি যে কি অপূর্ব নিজেও জানো না অংশী। আমার তোমাকে কাছে পেলেই মাথা ঠিক থাকে না জানো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেই। পাছে কোনো কেলেংকারী হয়ে যায়।’
– ‘কি কেলেংকারী হবে?’

মাহিব দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বলে, ‘জানো না বুঝি?’
অংশী মাহিবের বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ করে নেয় আর বলে, ‘উহু জানিনা। কেলেংকারী ক্যাম্নে হয় আমারে একটু জানাইবেন?’

অংশীর চোখেও দুষ্টুমি হাসি। মাহিব মুখটা কাছে এগিয়ে এনে বলে, ‘দেখো এভাবে নিজেকে সঁপে দিতে চেয়ো না। আমি কিন্তু হরণ করে নেবো বলে দিলাম।’
– ‘মানে বুঝি নাই।’
– ‘বোঝাবো?’
– ‘না না না। আবার কেলেংকারী হইয়া যাইবো।’

হেসে উঠে দুজনেই। মাহিব অংশীকে বুকে জড়িয়ে রাখে। কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই দুজনের মনে আরো কাছে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা জেগে ওঠে। অংশী জানে না এর নাম কি, জানে না কেন এমন হয়। শুধু জানে মাহিবকে ওর খুব বেশী প্রয়োজন। সবসময় মাহিবের বাহুডোরে নিজেকে বন্দি রাখতে ইচ্ছে করে। নিজেকে হারাতে ইচ্ছে করে। এসব ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো অংশী।

মাহিব অংশীর চুল স্পর্শ করে বলে, ‘বালিকার চুলে কলমি ফুলের চাষ, হৃদয়ে প্রেমের বর্ষণ।’

অংশী মাহিবের চোখের দিকে তাকায়। তারপর হেসে ওঠে লাজুক ভঙ্গিতে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here