তৃষ্ণা পর্ব ১৪

0
1211

তৃষ্ণা
পর্ব ১৪
মিশু মনি
.
১৫
মাহিব দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলো অংশী। মাহিবের হাতে একটা প্যাকেট। অংশীকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহিব কাছে এসে একবার ওকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর প্যাকেট টা দিয়ে বললো, “এগুলো তোমার জন্য”।

অংশী এক রাশ বিস্ময় নিয়ে প্যাকেট টা খুলে আরো একটা প্যাকেট বের করলো। সেটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা আকাশী রঙের তাঁতের শাড়ি। সাথে দুটো জামাও এনেছে। অংশী বিস্ময় লুকাতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে মাহিবের দিকে চেয়ে রইলো। বড় প্যাকেট খুলে একটা পেডিকোট আর ব্লাউজও পেয়ে গেলো। এবার লজ্জা পেলো অংশী। দুই ডজন আকাশী রঙের চুড়ি, একটা টিপের পাতা, একটা কাজল, চিরুনী, আয়না সবই নিয়ে এসেছে মাহিব। অংশী অবাক হয়ে মাহিবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো, ” এগুনা ক্যান আনছেন?”
“উহু। বলো, এগুলো কেন এনেছেন?”

অংশী চেষ্টা করলো, “এগুলোও কেনো এনেসেন?”
“উহু হয়নি। আবার চেষ্টা করো?”
“এগুলো কেনো এনেছেন?”
“হা হা। এবার হয়েছে। এগুলো এনেছি তোমার জন্য। তোমাকে শাড়ি পড়া রূপে দেখার বড্ড সাধ আমার। আজ একটু বউ সাজবে আমার জন্য?”

লজ্জা পেলো অংশী। লজ্জায় মাহিবের বুকে মুখ লুকিয়ে রইলো। মাহিব ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো দ্রুত গোসল সেরে আসার কথা। অংশী মাহিবের কথামত তারাতাড়ি গোসল সেরে আসলো।

এরপর মাহিব নিজে যত্ন করে শাড়ি পড়িয়ে দিলো অংশীকে। শাড়ির কুঁচি মাহিব নিজে গুঁজে দিয়েছে। অংশী এরপর অনেক্ষণ চোখ মেলতে পারলো না।

শাড়ি পরানো হয়ে গেলে মাহিব অংশীকে সাজগোজ করিয়ে দিতে বসে গেলো। মনের মত করে সাজিয়ে দিলো অংশীকে। আয়না দেখে অংশী যেন নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলো না। শুধু বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মাহিব অংশীকে বুকের উপর টেনে নিয়ে বললো, “আমার বউ টা..”

অংশী লজ্জায় মুখ লুকোনোর জায়গা পাচ্ছে না। কেবল মাহিবের বুকে মাথা এদিক ওদিক করছে। মাহিব অংশীর নাক টেনে ধরে আদুরে গলায় বললো, “আমার লক্ষীটা, আমার পাখিটা, আমার টুনিটা..”
“আমারে আপনে এত ভালাবাসেন ক্যান?”
“হয়নি। বলো, আমাকে আপনি এত ভালোবাসেন কেন?”
“আমাকে আপনি এত ভালোবাসেন কেনো?”
“গুড। তুমি শুধু আমার, তাই আমি তোমাকে এত ভালোবাসি।”
“আপনিও শুধু আমার।”

অংশী মাহিবের বুকে নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করছে। আনন্দে, সুখে, বিজয়ে চোখে জল এসে যাচ্ছে ওর। সুখের অন্যরকম আলাপনে ভেসে চলেছে দুজনে। অংশীকে কোলের উপর বসিয়ে রেখে মাহিব ওর চুলে হাত বুলাচ্ছে, গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর অংশী মাহিবের গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এই সুখের মুহুর্ত যেন আর কখনো আসেনি দুজনের জীবনে। অংশী ক্রমশ ঘোরের মাঝে ডুবে যাচ্ছে। মাহিবকে জাপটে ধরে বুকের উপর টেনে নিলো অংশী। মাহিব অংশীর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।

দুটো দিন এখানে কাটিয়ে সুস্থ হবার পরও অংশীর বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই। বাড়ি ফিরে হবেটা কি? মাহিব কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এদিকে অংশীকে কাছে পেয়ে মাহিবেরও কাজের প্রতি আর মন টানছে না। ইচ্ছে করছে আরো কয়েকটা দিন এখানে আরামে কাটিয়ে যেতে। কোনো বাঁধা নেই, কোনো মানুষ নেই, কোনো শব্দ নেই। শুধুই দুজনের একনিষ্ঠ প্রেম। কিন্তু অংশীর পরিবার আছে, মাহিবের টিমের লোকরা সবাই অপেক্ষা করছে। সুখে থাকলেও, এই সুখের মোহ কাটিয়ে বাসায় ফিরতেই হবে।

অবশেষে অংশীদের বাড়িতে ফিরে এলো দুজনে। আসার পথেও গাড়িতে পুরোটা সময় অংশী মাহিবের বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছিলো আর মাহিব অংশীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। খুব তারাতাড়ি যেন অংশীকে মাহিব ঢাকায় নিয়ে যায়, এই বলে অনেক আকুতি মিনতি করছিলো অংশী। মাহিব কথা দিলো যত দ্রুত সম্ভব অংশীকে সে ঢাকায় তার কাছে সারাজীবনের জন্য নিয়ে যাবে।

১৬
গ্রাম্য অংশীর প্রেমে মাহিব যে মাধুর্য খুঁজে পেয়েছে, তার মোহে ডুবে গেলো একেবারে। একদিকে মনের মত কাজ এগোচ্ছে, অন্যদিকে অংশীর আদুরে আলাপন। সবমিলিয়ে মাহিবের এখন সুখের শেষ নেই। প্রেম আরো গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগলো। আর দ্রুত গতিতে কাজও এগিয়ে চললো।

মাহিবের শুটিংয়ের সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেলো। সবাই সবকিছু গুটিয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। অংশীর মুখে আষাঢ়ে মেঘের ছাপ পড়েছে যেন। মাহিবকে কিছুদিনের জন্য ছেড়ে থাকার কষ্টও মেনে নিতে পারবে না ও। ইচ্ছে করছে এখনই মাহিবের সাথে চলে যায়। যদি তা সম্ভব হতো!

মাহিব রাত্রিবেলা অংশীকে জংগলে দেখা করতে বললো। জংগলে এসেই মাহিবের বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো অংশী। মাহিব ওকে স্বান্তনা দিয়ে বললো, “পাগলী আমার এভাবে কাঁদলে কি আমি চলে যেতে পারবো? আমি কাল যাওয়ার সময় তোমাকে একটা মোবাইল দিয়ে যাবো। তুমি আমাকে কল দিয়ে কথা বলবে”

এত করে বোঝানোর পরও অংশীর মন মানছে না। ও কেঁদেই চলেছে।
মাহিব বললো, “আমি কয়েকদিনের মাঝেই তোমাকে নিয়ে যাবো তো”
“আমারে ছুঁইয়া কথা দেন?”
“কথা দিলাম। বেশিদিন সময় নেবো না। আগে সবকিছু গুছিয়ে নেই, তারপর তোমাকে নিয়ে যাবো। আমি নিজেও কি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো তুমি বলো?”

অংশী মাহিবের গালে, কপালে, ঠোঁটে পাগলের মত চুমু খেলো। মাহিবের চুল দুহাতে টেনে নিজের অভিমান কমাতে চেষ্টা করলো। মাহিব অংশীকে জাপটে ধরে বললো, “প্লিজ এমন করে না। মাত্র কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো প্লিজ?”
“আমারে ছাইড়া যাইবেন না তো?”
“না রে পাগলী”
“আমারে সবসময় এইরকম কইরাই ভালাবাসবেন কন?”
“বাসবো”
“খুব খারাপ সময় আইলেও আমার হাত ছাইড়া দিবেন না কন?”
“দিবো না”

অংশীর কপালে চুমু দিয়ে মাহিব বললো, “এবার তাহলে ঘরে যাও। কেউ যেন কিছু টের না পায়।”
“পাইবো না। আপনারে রাইখা ঘরে ঘুম আসে না আমার”
“আমার কি আসে? তবুও তো ঘরে যেতে হবে তাইনা?”
“আপনারে নিয়া যাইতে পারতাম যদি..”

খিলখিল করে হেসে উঠলো অংশী। মাহিব বললো, “আজ রাতে আর আমাদের দেখা হবে না। কাল একবারে বিদায়ের ক্ষণে দেখা হবে প্রিয়..”

অংশী মাহিবের সমস্ত আদর বুকে নিয়ে ঘুমাতে গেলো। রাতে ভালো ঘুম হলো না। মাহিবের জন্য বারবার শুধু ছটফট করতে লাগলো অংশী। মাহিব ওকে পাগলের মত টানছে। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে মাহিবের ঘরে চলে যায়। মাহিব যেন কখনো ওকে ছেড়ে না যায়। তাহলে পাগল হয়ে যাবে ও, একেবারে শেষ হয়ে যাবে।

পরদিন মাহিব বিদায় নিয়ে চলে গেলো। অংশী কারো সামনে কাঁদতে পারলো না ঠিকই কিন্তু ঘরে এসে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেললো। যাওয়ার আগে একটা মোবাইল ফোন অংশীকে দিয়ে গেছে মাহিব। সেই ফোনটা দিয়ে তৎক্ষনাৎ মাহিবকে কল দিলো অংশী।

মাহিব অংশীকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য অনেক কিছুই বললো। অংশী মাহিবের কণ্ঠস্বর শোনার পর কিছুটা শান্ত হলো। ফোনটা বুকে জড়িয়ে রইলো পাগল মেয়েটা।

রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে ফোনে কথা বললে পাশের ঘর থেকে সব শুনে ফেলবে বাবা মা। তাই অংশী ফোন কানে ধরে চুপ করে থাকে আর মাহিব একাই কথা বলে। মাহিবের কথা শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে যায় অংশী।

এভাবেই চলছিলো প্রেম। অংশীর দিন যেন কাটেই না। বাড়ির কাজ কর্ম করার পরও মন ব্যকুল হয়ে থাকে মাহিবের জন্য। ফোনটা যখনই কেঁপে ওঠে, দৌড়ে জংগলে চলে যায় অংশী। তারপর মাহিবের সাথে মনের সুখে কথা বলতে থাকে। একসময় ফোন রাখে মাহিব। কিন্তু অংশীর অশান্ত মন তবুও শান্ত হয় না। কবে যে মাহিব ওকে নিয়ে যাবে..

দিন কাটতে লাগলো অপেক্ষায়। অপেক্ষাও মধুর হয়ে উঠেছে যেন। ফোনে কথা বলতে যে এত বেশি ভালোলাগে তা আগে জানতো না অংশী। আজকাল টানা এক ঘন্টা রাত্রিবেলা মাহিবের কণ্ঠ শুনলে বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে অংশীর। মাহিবের নিশ্বাসের শব্দেই ও পাগল হয়ে ওঠে। প্রেমের এই সময়গুলো ওর কাছে স্বপ্নের মত লাগছে।

গত দুদিন ধরে অংশীর শরীর ভালো যাচ্ছে না। খাবার খেতে পারে না একেবারেই। মাহিবকে বলতেই ও বললো দ্রুত মাকে বলো ডাক্তার দেখাতে। অংশী মায়ের কাছে গিয়ে বললো, “মা, আমার শরীরটা ভালো নাই গো। ডাক্তার দেখাতি হবে”
“তোর কি হইছে ক দেখি? জ্বর ও তো নাই। জন্ডিস টন্ডিস হইলো না কি..”

অংশী মায়ের কানের এসে ফিসফিস করে বললো, “মা, আমার ক্যান জানি দুই মাস থাইকা শরীর খারাপ হয় না”

মায়ের চোখ জ্বলে উঠলো, “কি? শরীর খারাপ হয় না ক্যান?”

অংশী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। আজকাল অংশী খাবার খেতে পারে না, খেতে বসলেই বমি করে ফেলে দেয়। আবার নাকি শরীর খারাপ হয় না, মায়ের চোখে আগুন জ্বলে উঠলো!

অংশীকে ঘরে টেনে নিয়ে উনি বললেন, “তুই সত্যি কইরা একটা কথা ক তো অংশী। এতগুলা পুরুষ মানুষ যে আসছিল, কেউ তোর গায়ে হাত দেয় নাই তো?”

অংশী চমকে উঠলো। গায়ে হাত দেয়ার সাথে শরীর খারাপ হওয়া বা না হওয়ার কি সম্পর্ক। কিন্তু লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো অংশী। মায়ের সন্দেহ আরো বেড়ে গেলো। উনি চোখেমুখে আগুন ঝরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “অংশী। কথা কস না ক্যান? কেউ তোর গায়ে হাত দিছে? রাইতে কেউ তোর ঘরে ঢুকছে না তো?”

অংশী কেঁপে উঠলো। মা কিসের কথা বুঝাতে চাইছে তা বুঝে গেছে অংশী। কিন্তু এ কথা কি করে মাকে বলবে ও? শহরে মাহিবের ভাইয়ের বাসায় থাকা অবস্থায়ই মাহিবের সাথে অন্তরঙ্গ হয়েছিলো ও। একবার না, পরপর কয়েকবার মাহিব ওকে গভীরভাবে আদর করে দিয়েছে। অংশী সে সুখের একটুকুও ছাড় দিতে চায় নি। বাড়িতে ফিরেও কখনো মাহিব ছুটে গেছে অংশীর ঘরে, কখনো অংশীকে ডেকে নিয়েছে নিজের ঘরে। কত শত বার যে দুজনে মিলিত হয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে। কিন্তু মা এ কথা বুঝলো কি করে!

অংশীকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে মায়ের কিছু বোঝার বাকি রইলো না। উনি রাগত চিৎকার দিয়ে অংশীর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দুই গালে ইচ্ছেমতো থাপ্পড় লাগালেন। তারপর বাইরে থেকে একটা পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙে এনে সেই শক্ত ডাল দিয়ে মেয়েকে মারতে মারতে অবস্থা খারাপ করে দিয়ে বললেন, “মাগী, পেটে বাচ্চা নিয়া পাড়ায় মুখ দেখাবি ক্যামন কইরা? তুই মর, মর গিয়া..”

অংশী বললো, “আমি মাহিবরে ভালাবাসি মা। সেও আমারে ভালোবাসে। আমি তার কাছে চইলা যামু..”

মা আরো রেগে বললেন, “চাকমা পাড়ায় জানাজানি হইলে মান সম্মান সব শ্যাষ হইয়া যাইবো। তোর বাপে জানলে তোরে কাইটা নদীতে ভাসাইয়া দিবো। তুই বাড়ি থাইকা চইলা যা, চইলা যা….”

মায়ের শেষ কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো অংশীর। শুনতে শুনতেই অংশী জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here