তৃষ্ণা পর্ব ২৬

0
1152

তৃষ্ণা
পর্ব ২৬
মিশু মনি
.
২৮

রাত্রিবেলা ঘুমাতে গিয়ে স্মরণিকার নাম্বারে কল দেয় মাহিব। স্মরণিকা ফোন কানে ধরে বলে, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’

– ‘মাহিব আহসান বলছি।’

স্মরণিকার কণ্ঠে উল্লাস ফুটে ওঠে। ও হেসে বলে, ‘বলুন না। সরি, নাম্বারটা সেভ করা ছিলো না।’

মাহিব বললো, ‘কোনো ব্যাপার না। রাত হয়ে গেছে বেশি? আসলে কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেলো।’

– ‘ইটস ওকে। আমার তো কেবল সন্ধ্যা। বলুন না।’

– ‘আমি একটা অংক করেছি। কোন খাতে কত টাকা যাচ্ছে আপনি চাইলে সব হিসেব দেখতে পারেন। কাল যদি একবার অফিসে আসেন সেটা বেশি ভালো হয় না?’

– ‘আচ্ছা আসবো। গল্পের ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?’

– ‘আপনার কাছে কোনো গল্প আছে?’

 

স্মরণিকা একটা গল্প বলতে শুরু করলো। যতক্ষণ গল্প বলে গেলো মুগ্ধ হয়ে শুনলো মাহিব। শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো মাহিব সেখানে উপস্থিত আছে। স্মরণিকার গল্প বলার ধরণটা ভীষণ সুন্দর। গল্প শেষ করে স্মরণিকা যখন বললো, ‘কথা বলছেন না যে?’

মাহিব চমকে উঠে বলে, ‘আসলে গল্পের মাঝে ডুবে গিয়েছিলাম। এত সুন্দর আপনার গল্প বলার ধরণ, এত মায়াবী একটা কণ্ঠ। ইচ্ছে করছিলো শুনতেই থাকি, বিলিভ মি।’

স্মরণিকা হেসে উঠলো। মাহিব নিজেও হাসছে। স্মরণিকা এবার জানতে চাইলো গল্পটা কেমন লেগেছে? গল্পটা যেমনই হোক, স্মরণিকার গল্প বলার ধরণের কাছে এর সৌন্দর্য কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এখন যদি মাহিব গল্পটাকে সুন্দরভাবে ভিডিওতে ধারণ করতে পারে তবে নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার শর্ট ফিল্ম হবে এটি। আর ট্রেইলারটাও অসাধারণ হবে। ব্যবসায়ীক আলাপ আলোচনা শেষ করে ফোন রেখে দিতে হলো। ফোন রাখার পরও অনেক্ষণ ভর মাহিবের কানে বাজতে লাগলো স্মরণিকার কণ্ঠস্বর। কত মিষ্টি করে কথা বলে একটা মেয়ে। শুনলেই মনে একটা শীতল অনুভূতি আসে।

 

 

২৯

সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল একটা দিনের সূচনা। বেলা কত হয়েছে কে জানে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মাহিব। মাহিবের বাবা এসে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন ছেলেকে। মাহিব চোখ পিটপিট করে বললো, ‘বাবা তুমি! এত সকালে ডাকছো কেন?’

– ‘ব্যাটা এগারোটা বাজে। তোর অফিস থেকে কল এসেছিলো। কার সাথে নাকি মিটিং আছে?’

মাহিব অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না কার সাথে মিটিং আছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্মরণিকার নাম্বার থেকে দুবার কল। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো আজ স্মরণিকাকে আসতে বলা হয়েছিলো। বিছানার উপর উঠে বসে মাহিব। কল দেয় স্মরণিকাকে।

 

স্মরণিকা রিসিভ করে বলে, ‘সরি ঘুম ভাঙালাম বোধহয়?’

– ‘না না ঠিক আছে। বেলা অনেক হয়েছে।’

– ‘একচুয়েলি আজ বিকেলে আমার একটা কাজ আছে তাই সকাল সকাল চলে এলাম। কিন্তু আপনি নেই।’

মাহিব অনুশোচনা করে বললো, ‘আমি রাতে দেরিতে ঘুমাই তো তাই সকালে উঠতে পারি না।’

– ‘দেরিতে তো আমিও ঘুমাই। সবকিছু হচ্ছে অভ্যাস বুঝেছেন?’

– ‘হুম বুঝলাম। আমাকেও তবে অভ্যাস গড়ে নিতে হবে।’

স্মরণিকা বলতে লাগলো সকালে ঘুম থেকে উঠলে কি কি সুফল আছে। মাহিব শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। কথা বলা থামাতেই মাহিব বললো, ‘আপনি কষ্ট না হলে একটা কাজ করতে পারবেন?’

– ‘শিওর। বলুন না।’

– ‘আপনি এদিকে চলে আসুন নাহয়। কোথাও কফিশপে বসলাম।’

– ‘তা ভালো বলেছেন। আমি তবে আসি, আপনি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ুন।’

ফোন রেখে দিয়ে মাহিব আপনমনে হাসলো। কতগুলো দিন হয়ে গেলো কারো প্রেমে পড়া হয় না। এই ললনার প্রেমে পড়বে কি না ভাবতে ভাবতে হাসছিলো। প্রেমে পড়াই যায়। মুগ্ধ হওয়ার মত তার অনেক কিছুই উপস্থিত। বুদ্ধিমতী, সুন্দরী, স্মার্ট, মায়াবতী। শুধু ভালোবাসাটা কেমন ঢালতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। অংশীর প্রেমে আবেগ ছিলো বেশি। কুমারী মেয়েদের সাথে প্রেম করতে আনন্দটাও সবচেয়ে বেশি। অংশীর প্রেমে পুরো মত্ত হয়ে উঠেছিলো মাহিব। কিন্তু স্মরণিকার বয়স অনেক। ম্যাচিউর মেয়ে। অবশ্য ম্যাচিউর মেয়ের সাথে প্রেমের আরেক মজা। হেসে উঠলো মাহিব।

স্মরণিকা মাহিবকে দেখে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো। মুখোমুখি বসে মাহিব বললো, ‘অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম?’

– ‘স্পেশাল মানুষদের সাথে দেখা করার জন্য একটু আধটু কষ্ট তো করতেই হবে।’

– ‘বা রে, এত স্পেশাল হয়ে গেলাম?’

– ‘অবশ্যই। কত প্রতিভাবান আপনি!’

– ‘ও ভালো কথা মনে পড়েছে। আপনার একটা বই আমাকে দিলে তো পড়ে রিভিউ দিতে পারি। আমি বই পড়তে ভালোবাসি।’

স্মরণিকা লজ্জায় লাল হয়ে বললো, ‘আপনি পড়বেন আমার বই!’

ওর বিস্ময় কাটছিলো না। মাহিব গিয়ে খাবার অর্ডার করে আসলো। দুজনে বসে শর্টফিল্ম নিয়ে কথা বললো, চা কফি, অভ্যাস, সবকিছু নিয়েই আড্ডা চললো। আড্ডার সঙ্গী হিসেবে স্মরণিকাকে দশে দশ দেয়া যেতে পারে। চমৎকার মেয়ে। মাহিবের মুগ্ধতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

স্মরণিকা বললো, ‘আচ্ছা আমি কি ফিল্মের শুটিংয়ের সময় উপস্থিত থাকতে পারি? আমার অনেক ইচ্ছা শুটিং স্পটে নিজে শ্যুট করা দেখবো।’

মাহিব তাতে খুশি হয়ে বললো, ‘অবশ্যই দেখবেন।’

তিনদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেলো স্মরণিকার ফিল্মের শুটিং। সে নিজে এলো শুটিং স্পটে। মাহিবের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলো মনোযোগ দিয়ে। কাজের সময় ভীষণ সিরিয়াস হয়ে ওঠে মাহিব। মাহিব যেন আর মাহিবের মাঝে থাকে না। হয়ে ওঠে অন্যকেউ। এই বৈশিষ্ট্যটা বেশ ভালো লেগে গেলো স্মরণিকার। মানুষকে হতে হয় এমন কর্মঠ, অধ্যবসায়ী। নিজের কাজকে প্রচুর ভালোবাসতে হয়। এই গুণগুলো মাহিবের আছে। মুগ্ধ হতেই হয় মাহিবকে দেখে।

শ্যুট শেষে বরারবরের মতই বসে কফি আড্ডায় বসে গেলো দুজনে। প্রীতম এসে স্মরণিকার চোখে কটাক্ষপাত করলো। প্রীতম চলে যেতেই স্মরণিকা মাহিবকে বললো, ‘উনি আমার দিকে এভাবে তাকালেন কেন?’

মাহিব একবার প্রীতমকে দেখে নিয়ে বললো, ‘কি জানি কেন। ওসবে মনোযোগ দিও না। আজকের শ্যুট কেমন লাগলো?’

স্মরণিকা মৃদু স্বরে বললো, ‘ভালো।’

 

কথায়, আড্ডায়, কাজে দুজনের এতই মিল যে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বন্ধুত্ব হয়ে গেলো মাহিব ও স্মরণিকার মাঝে। দুজনের দৃষ্টিভঙ্গী, বোঝাপড়া সবকিছুতেই ভীষণ সাদৃশ্য। একজন একটি কথা বোঝাতে চাইলে অপরজন চোখ দেখেই তা বুঝে যায়। বন্ধুত্ব হতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।

সেদিন বেলাশেষে দুজনে পাশাপাশি বসে ছিলো। মাহিব স্মরণিকার চুল নিয়ে খেলা করতে গিয়ে চুলের ঘ্রাণ শুঁকে বললো, ‘উফফ পাগল হয়ে যাবো।’

স্মরণিকা লাজুক স্বরে বলে, ‘আমার চুলের এত তেজ জানতাম না তো।’

– ‘তেজ তো অবশ্যই আছে। ধীরেধীরে কোথাও একটা কিছু গলছে। টের পাচ্ছো না?’

স্মরণিকা হাসতে থাকে। আড্ডা শেষ করে বাসায় ফেরার সময় মাহিব ওকে এগিয়ে দিয়ে আসে।

 

এক বিকেলে একসাথে মুভি দেখার প্রস্তাব টা মাহিবই আগে দেয়। স্মরণিকা এই প্রস্তাবে ভীষণ উৎফুল্ল। সিনেমা হলে বসে একই চিপসের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে দুজনের কাড়াকাড়ি, দুষ্টুমি করে চিপস খাইয়ে দেয়া, চোখে চোখ রাখা। কোনোটাই বাদ গেলো না। রাতে বাড়ি ফেরার সময় দুজনের মনেই ছিলো সারাদিনের ভালোলাগার ধূয়া।

রাতে মাহিব স্মরণিকাকে অনুভব করে। শুনতে ইচ্ছে করে স্মরণিকার কণ্ঠস্বর কিন্তু ফোন দিতে সংকোচ লাগে। স্মরণিকারও একই অবস্থা। মাহিবের সাথে কথা বলার লোভটাকে সংবরণ করাই যাচ্ছে না। তবুও ফোন না দিয়ে নিজেকে সামলে দেয়। তবে ফোন বেজে ওঠে ঠিকই। মাহিব কল দিয়েছে।

 

কোনো কারণ নেই, কোনো প্রয়োজন নেই, তবুও কথা হয় অনেক্ষণভর। কি কথা হয় কেবল দুজনের মনই জানে। এলোমেলো, অগোছালো যত রাজ্যের কথা। সময় ফুরিয়ে যায় তবুও কথা ফুরোতে চায় না। দুজনে উচ্ছ্বসিত হয়, পুলকিত হয়, যেন প্রথমবার প্রেমে পড়ছে। প্রতিটা রাত কথার অতলে হারিয়ে যায় দুজনে। রাত যত বাড়তে থাকে, কথামালা তত গভীর হতে থাকে।

 

 

২৯

চুলে শ্যাম্পু করে চুল শুকিয়ে আয়নায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে নিজেকে দেখছিলো অংশী। কখনো চুলে ডান দিকে সিঁথি করে, কখনো বাম দিকে। এলোমেলো চুলে মাথা দুলে দুলে হাসছিলো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকলে দেখতে যে এমনিতেই ভালো লাগে এটা জানা ছিলো না আগে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।

অংশী দরজা খুলে দেখে প্রীতম দাঁড়িয়ে। প্রীতম অংশীকে দেখে ভিড়মি খেয়ে গেলো। মোটে তো ছয় দিন আসে নি সে। এই সাতদিনেই অংশীর কি অদ্ভুত পরিবর্তন। নিশ্চয় খাওয়াদাওয়া আর ঘুমটা ঠিকমতো করছে। অনেক সতেজ দেখাচ্ছিলো অংশীকে। প্রীতম মুগ্ধ হয়ে অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না।

অংশী বললো, ‘আসেন। কেমন আছেন আপনি?’

কথায় আঞ্চলিকতার টান থাকলেও এইযে অংশী শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারছে, এটাও মুগ্ধ করলো প্রীতমকে। ও হাতের ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে ব্যাগ থেকে কিছু বই বের করলো। আরেকটা ব্যাগে বাজার করে এনেছে, সেটা মেঝের উপর রাখলো। অংশী পড়াশোনায় এসএসসি পাশ করেছে, গল্পের বই সে অনায়াসে পড়তে পারবে। সহজ ভাষায় কয়েকটা গল্পের বই, আত্মউন্নয়ন মূলক কিছু বই প্রীতম অংশীকে দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘এগুলা দ্রুত পড়ে শেষ করে ফেলবে। পড়ার সাথে সাথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। আগে আত্মউন্নয়ন মূলক বইগুলা পড়বে। না বুঝলে আমাকে ফোন করবে।’

অংশী হেসে বললো, ‘আমার কয়েকটা বন্ধু হইছে। ওদের থিকা জাইনা নিবো।’

– ‘বন্ধু মানে!’

ভয় পেয়ে গেলো প্রীতম। অংশী ছন্দা ও তার বন্ধুদের কথা প্রীতমকে বললো। প্রীতম হেসে বললো, ‘তাহলে তো ভালোই হলো। ওরা তোমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে পারবে। তোমার নিজেকে বদলানো দরকার অংশী। এই সময়টাতে শরীরের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক পরিবর্তন হবে। তুমি ভেঙে না পড়ে বরং এখনই শক্ত হয়ে হাল ধরো।’

অংশীকে আগের তুলনায় ভীষণ হাসিখুশি প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। শ্যাম্পু করা চুলগুলো পিঠের উপর বিস্তৃত হয়ে আছে। প্রীতমের ভালো লাগছে দেখে। ও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, ‘আজ তবে আসি। নিজের যত্ন নিও।’

অংশীর ইচ্ছে করলো প্রীতমকে কিছুক্ষণ বসতে বলে। কিন্তু প্রীতম কি ভাবে সেই ভেবে আর বললো না। নিজের মাঝে এতটুকু ম্যাচিউরিটি আসায় অংশীর নিজেরও গর্ব হচ্ছে।

প্রীতম চলে গেলে বই খুলে বসলো অংশী। বইয়ের প্রথম পাতা ওল্টাতেই কিছু টাকা পেয়ে চমকে উঠলো। প্রীতম অংশীর জন্য টাকা রেখেছে বইয়ের ভেতর। প্রত্যেকটা সমস্যা নিজের মত করে দেখছে। এত খেয়াল রাখতে জানে মানুষটা। মুচকি হাসি ফুটল অংশীর মুখে। এরকম বন্ধু যেন আর হয় না।

অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়ার পর নিজেকে আগের চেয়েও বেশ সমৃদ্ধ মনে হলো অংশীর। প্রথম প্রথম বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও পড়ে যেতে লাগলো। আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে হালকা হালকা। অংশীর মানসিক পরিবর্তনে এসবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মনেমনে প্রতিজ্ঞা করছে, আজ থেকে কাজের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হবো। আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ শিখবো।

 

অংশীর দ্রুততার সাথে কাজ শেখার ক্ষমতা আছে। সারাদিন যা শেখে, বাসায় এসে সেটা আবার মনে করতে থাকে। এমনকি শুয়ে শুয়েও চিন্তা করতে থাকে আরো কিভাবে কাজটা যেতে পারে? নিজের শরীরের যত্ন নিয়মিত নিতে শিখে গেছে। ছন্দা অংশীকে একটা ফেস পাউডার, লোশন ও লিপস্টিক দিয়েছে। গোসলের পর সতেজ শরীরে লোশন মেখে মুখে পাউডার ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায় অংশী। চুল আঁচড়ে পরিপাটি হয়ে থাকে। বন্ধুরা ওকে দেখলে উৎসাহ দেয়। ওদেরও ভালো লাগে অংশীর পরিবর্তন দেখে।

একদিন বুদ্ধি করে কয়েক গজ কাপড় কিনে ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যায় অংশী। মনের মাধুরি মিশিয়ে নিজের হাতে কিছু কাপড় ডিজাইন করে, একজন বড় আপুর থেকে কিছু ডিজাইন করে নেয়। তারপর টেইলার্সে দিয়ে আসে জামা বানাতে।

 

অনেকদিন পর যখন প্রীতম অংশীকে দেখতে আসে, নতুন জামায়, নতুন সাজে অংশীকে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করে প্রীতম। অংশীর মাঝে নিজেকে পরিবর্তনের প্রবল ইচ্ছা আছে। আর যাদের মাঝে এই অদ্ভুত ইচ্ছা থাকে, তারা সত্যিই নিজেকে বদলাতে পারে।

অংশী চুল বাঁধতেও শিখে গেছে। প্রীতম হাসতে হাসতে বললো, ‘দারুণ বদলে গেছো তুমি। আমার অবদান এতে সামান্যই। যা করেছো, নিজের প্রচেষ্টায় করেছো। সত্যিই বাস্তবতা মানুষকে কত সুন্দরভাবে পাল্টে দেয়। স্রোতটাকে যে যেদিকে ঘুরিয়ে নিতে পারে, তার জীবন সে রূপেই আগায়। আমি শুধু সাহায্য করেছি মাত্র।’

অংশী কৃতজ্ঞতা জানায় প্রীতমের প্রতি। প্রীতম আজকেও কিছু বই নিয়ে এসেছে অংশীর জন্য। অংশী বইগুলো দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘এইগুলা সব আমার জন্যে? আমার যে বই পড়তে কি ভালো লাগে গো…’

প্রীতম হাসলো অংশীর আনন্দ দেখে। অংশী বইগুলোর পাতা উল্টে উল্টে দেখতে লাগলো। চোখেমুখে আনন্দের উজ্জ্বলতা।

প্রীতম বললো, ‘মাহিব আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়েছে। মেয়েটার নাম স্মরণিকা।’

হঠাৎ ধাক্কা খাওয়ার মত ভড়কে গেলো অংশী। মুখ তুলে প্রীতমের দিকে তাকালো। বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো বহুদিন পর। মাহিবের জন্য আর আগের মত কষ্ট হয় না অংশীর। খারাপ টুকু বাদ দিয়ে মাহিবের ভালোটুকুই মনে রেখেছে ও। কিন্তু আজ এতদিন পর হঠাৎ এ কথা শুনে কেমন যেন কষ্টে ছেয়ে গেলো বুকটা।

প্রীতম বললো, ‘কষ্ট পেও না। এই মেয়েটার সাথেও সম্পর্ক বেশিদিন টিকবে না দেখো। মেয়েটা তোমার মত বোকা নয়। তবুও ও তোমার মত ভুলটা করবে।’

– ‘মাহিব এই মেয়েরে বিয়ে করবে?’

– ‘ধুর। মাহিবকে আজ অব্দি এত মেয়ের কাছে ঘেঁষতে দেখেছি। এদের শেষ পরিণতি কি হয় জানো? এরা ধুকে ধুকে মরে। শেষে কারো ভালোবাসাই পায় না।’

– ‘সত্যিই? আমি চাইনা মাহিবের এমন হোক। ও ভালো থাকুক, অনেক ভালো।’

– ‘ওর ভালোর কথা ভেবেই তো এতকিছু করলে। তুমি ভালো থাকলেই হয়।’

অংশী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমি ভালো থাকবো। মাহিব সাহেবকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। ধার দিবেন আমারে? পরে শোধ কইরা দিবো।’

প্রীতম অংশীর চোখে চোখ রেখে ওকে আশ্বস্ত করে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পায় অংশী।

 

ভালো থাকার প্রতিজ্ঞা করলেও রাতে ঘুমাতে কষ্ট হলো অংশীর। অনেকদিন পর আজ কাঁদলো ও। সব চাপা কষ্ট ভেতর থেকে জেগে উঠছিলো। ততই অংশী দৃঢ় সংকল্প করছিলো, নিজেকে আর কষ্ট দেবে না ও। মাহিবের উপর জেদ করেই অংশী ভালো কিছু করবে। করতেই হবে।

 

 

৩০

একা একা লোকাল বাসে ওঠার সাহস এখনো অংশীর হয় নি। রাস্তার ধারে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বাসে উঠতে পারে না ও। বাসগুলো পুরোপুরি থামে না। চলন্ত বাসেই লাফিয়ে উঠে পড়তে হয়। কে জানে এমন নিয়ম কেন। তবুও অংশী হাল ছাড়েনি। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় হোক, তবুও বাসে উঠবেই।

এভাবেই প্রত্যেকটা সংকল্প অংশীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষে রূপ দিতে লাগলো। বাসে দাঁড়িয়ে থেকে চলাচল করা, দোকানদারদের কাছ থেকে প্রতারিত হওয়া, বাসের হেলপার দের থেকে প্রতারিত হওয়া। এভাবে প্রতারিত হতে হতে অংশী আগের থেকে বুদ্ধিমতী হয়ে উঠলো। অভিজ্ঞতা মানুষকে জ্ঞানী করে তোলে এটা চরম সত্যি একটা কথা। অংশীর ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন ঘটছে ক্রমশই।

নিজে নিজে বাজার করা, নিজেই রান্না করা, অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়া, এভাবেই অংশীর সময় কাটতে লাগলো। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধলো অন্য জায়গায়। পেট টা ধীরেধীরে ফুলে উঠছে। এখন চলাফেরা করতে কষ্ট হয় অংশীর।

 

ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে অংশী কাজের প্রতি দক্ষতা, একটানা লেগে থাকা, মেধা খাটানো সবই শিখে গেলো। এখন শুধু একটা প্রতিষ্ঠান নিজে প্রতিষ্ঠা করার পালা। এর জন্য যে মূলধন দরকার, তা তো নেই। এখন এই মূলধন টাই জোগাড় করতে হবে। যেভাবেই হোক, উঠে দাঁড়ানোর জন্য একটা ব্যবসা শুরু করতেই হবে। এতদিন প্রীতমের থেকে অনেক টাকা নেয়া হয়ে গেছে, এগুলো সব শোধ করতে হবে। ভেবে ভেবে সারারাত ছটফট করে কাটলো অংশীর। কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারলো না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here