তৃষ্ণা পর্ব ২৭

0
1178

তৃষ্ণা
পর্ব ২৭
মিশু মনি
.
গোধূলী বেলায় স্মরণিকার পাশে বসে থাকা মাহিবের মনে হঠাৎ ই সাহসের সঞ্চার হয়। আকাশের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা স্মরণিকার হাত চেপে ধরে বলে, ‘স্মরণিকা, তোমায় একটা কথা বলবো, রাগ করবে না তো?’

স্মরণিকা মৃদু স্বরে বললো, ‘রাগ করবো কেন? বলো না কি বলবে?’

মাহিব গভীর আবেগ জমিয়ে আর্দ্র কণ্ঠে বললো, ‘তুমি কি আমার আকাশ হবে?’

স্মরণিকা চমকে ওঠে। কিন্তু মুখে লজ্জার আভা। যেন এই সময়টির জন্যই অপেক্ষা করেছিলো সে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে, ‘ কি করবেন সে আকাশে?’

– ‘সে আকাশে আমি মুক্ত পাখির মত উড়বো।’

স্মরণিকা হেসে ওঠে। পরক্ষণেই লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে ওর মুখ। সংকোচে, দ্বিধায় এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। বুকের ধুকপুকুনি বের গেছে ওর। মাহিব চাতকের মত চেয়ে আছে স্মরণিকার দিকে। স্মরণিকা আর কিছু না ভেবে মাহিবের হাতের উপর হাত রেখে বলে, ‘হুম। আমি তোমার আকাশ হবো। আমার আকাশে তুমি যত ইচ্ছা উড়বে মুক্ত পাখির মত।’

– ‘সত্যি!’

– ‘হুম সত্যি।’

মাহিবের কাঁধে মাথা রেখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে দুজনে। হাতের বন্ধনে হাত। দুজনের মনে একটা অচেনা অনুভূতি। আজ থেকে ওরা মনেমনে প্রতিজ্ঞা করছে, একজন আরেকজনের পাশে থাকবে সারাটি জীবন। স্মরণিকা অনুভব করছে, এই মুহুর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।

৩১

দিন যত বাড়তে থাকে, সম্পর্ক তত গাঢ় হতে থাকে। স্মরণিকার শর্টফিল্মের কাজ কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন সময় শুধুই দুজনের। প্রণয়ের মধুর ক্ষণ এগিয়ে আসে। প্রথমে আলতো চুম্বন, হাতে হাত রাখা, একসাথে পথ চলা, বিদায়ের ক্ষণে জড়িয়ে ধরা। দিন যত বাড়ছিলো, ক্রমশ একে অপরের শরীরের প্রতি প্রবল টান অনুভব করছিলো।

ভর দুপুরে মাহিব ঘুম থেকে উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় স্মরণিকার ফোন, ‘এই আরো কতক্ষণ লাগবে আসতে?’

– ‘লক্ষিটি আমি রেডি হচ্ছি। তুমি এগিয়ে আসো না।’

– ‘ওকে আসছি। তারাতাড়ি বের হও।’

মিনিট পনেরো কেটে যায়। মাহিব এখনো গুণগুণ করে গান গাইছে আর চুল আচড়াচ্ছে। স্মরণিকা আবারও ফোন করে, ‘কি গো, কতক্ষণ লাগবে?’

– ‘এইতো আমি রেডি সুইট হার্ট।’

– ‘উফফ কতক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো? আমি তোমার বাসার সামনে।’

– ‘বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো।’

– ‘উহু, তুমি এসে বরণ না করলে বুঝি আমি একা আসবো?’

মাহিব হেসে ফেলে। দ্রুত বাইরে এসে দেখে স্মরণিকা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। মাহিবকে দেখেই ছুটে এসে আলিঙ্গন করে স্মরণিকা। মাহিব ওর হাত ধরে হেসে বললো, ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে..’

স্মরণিকা হাসতে হাসতে বললো, ‘আসবো বাবা আসবো।’

মাহিব স্মরণিকার হাত ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে আসে। দিনের বেলা মা বাবা, মিষ্টি মিঠি কেউই বাসায় থাকে না। পুরো বাসা ফাঁকা। সিঁড়ির কাছে এসে স্মরণিকাকে কোলে তুলে নেয় মাহিব। স্মরণিকা খুশিতে উল্লাস করে ওঠে। মাহিবের ঘাড় পেঁচিয়ে রাখে ও। মাহিব স্মরণিকাকে কয়েক পাক ঘুরিয়ে দোল দিতে থাকে। স্মরণিকা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, ‘উহু পড়ে যাবো তো।’

মাহিব কোনো বাঁধা শোনে না। স্মরণিকাকে কোলে করে ওর শোবার ঘরে নিয়ে আসে। স্মরণিকাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটাই তোমার ঘর প্রিয়। বুঝে নাও..’

স্মরণিকা ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলে, ‘ওয়াও! বিউটিফুল! আজ থেকে এটা আমার ঘর?’

– ‘হ্যাঁ প্রিয়। তোমার ঘর।’

স্মরণিকা মাহিবের কলার টেনে ধরে গলায় ঝুলতে থাকে। মাহিবের চোখে চোখ রেখে দুজনাতে বলাবলি হয় হাজারো কথা। ধীরেধীরে মাহিবের মুখটা কাছে এগিয়ে আসে, স্মরণিকাও এগিয়ে আসতে থাকে কাছে, আরো কাছে। একটা সময় দুজনের ঠোঁট নিবিড়ভাবে মিলিত হয়। তারপর পুরো শরীর। মাহিব স্মরণিকাকে কোলে নিয়ে বিছানায় এনে ফেলে, ঝাঁপিয়ে পড়ে স্মরণিকার উপর। প্রেমের উন্মাদনায় স্মরণিকা তখন হো হো করে হাসছিলো। মাহিবের কৃষ্ণ চুলগুলোকে দুহাতে টেনে ধরে মাহিবকে নিজের বুকে চেপে ধরে। ভালোবাসার নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয় স্মরণিকার জীবনে..

ক্লান্ত হয়ে একে অপরকে জড়াজড়ি করে আরামের ঘুম দিয়েছে। কলিং বেজ বাজছে অনেক্ষণ ধরে। মাহিব বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লো। এই অসময়ে আবার কে! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা আড়াইটা বাজে। কারোরই তো এ সময়ে আসার কথা নয়।

শার্টটা গায়ে জড়িয়ে দ্রুত এসে দরজা খুলে দেয়। আগন্তুক ছেলেটা একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘স্যার আপনার পার্সেল।’

মাহিব কৌতুহলী হয়ে খামটা হাতে নিলো। উপরে দেখলো গোটা গোটা অক্ষরে নাম লেখা, ‘অংশী আহসান’। চমকে ওঠে মাহিব। অংশী পার্সেল পাঠিয়েছে, তাও আবার এই বাড়ির ঠিকানায়! অদ্ভুত ব্যাপার।

খামটা খুলে দেখে পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট। টাকাগুলো দেখে খানিকটা সময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় মাহিব। অংশী সেদিন বলেছিলো এই টাকাটা ধার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি, ফেরত দিয়ে দেবো। সে কথা রেখেছে। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেলো মাহিব। অংশী কোথায় আছে এখন?

মাহিবের কপালে চিন্তার ছাপ পড়ে। এতদিন পর কোথা থেকে উদয় হলো অংশী! অংশীর কোনো খোঁজ মাহিব রাখেনি। মেয়েটা কোথায় গেছে, কিভাবে টিকে আছে কিছুই জানার চেষ্টাও করে নি। অবশ্য জানার কোনো উপায়ও ছিলো না কেননা অংশীর কাছে কোনো ফোন নেই। সেই দিনের পর অংশী নিজে থেকেও কখনো যোগাযোগ করে নি। স্মরণিকার আগমনে মাহিব নিজেও ভুলে গিয়েছিলো অংশীর কথা। আজ হঠাৎ টাকা পাঠিয়ে সে কেনই বা মনে করিয়ে দিতে চাইলো? স্বাভাবিক কারণেই অংশীর বর্তমান অবস্থা জানার জন্য কৌতুহল জাগছে মাহিবের। কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে রইলো। নিজের ঘরে এসে বিছানার উপর স্মরণিকার নগ্ন শরীর দেখে ভুলে গেলো সমস্তকিছু। খামটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে এসে আবারও জড়িয়ে ধরলো স্মরণিকাকে।

৩২

অফিসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো মাহিব। আজকাল কাজের চাপ বেড়ে গেছে। স্মরণিকা অফিসে ঢুকেই রাগত স্বরে বললো, ‘কাল রাত থেকে ফোন কেন ধরছো না তুমি?’

মাহিব মাথা না তুলেই উত্তর দিলো, ‘ব্যস্ততা যাচ্ছে খুব। রাতে টায়ার্ড ছিলাম তাই ফোন অফ করে ঘুমিয়েছি। সকালে উঠেই দৌড়ে অফিসে চলে এসেছি।’

– ‘ভালো। সে কারণে নিজের প্রেমিকার খোঁজ নিতে হবে না?’

– ‘হবে। অবশ্যই হবে। কিন্তু আমার প্রেমিকাকেও তো বুঝতে হবে যে তার প্রেমিক ইয়া বড় বিজি ম্যান।’

স্মরণিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘ওকে ফাইন। যেটা বলা দরকার, কাল আমাকে দেখতে এসেছিল। ওনাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে। আমার বাবা মাও ওই ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আব্বুকে অনেক বুঝিয়েছি, তোমার কথা বলেছি। আজকেই তোমাকে আব্বুর সাথে দেখা করতে হবে।’

মাহিব এবার মাথা তুলে এক পলক স্মরণিকার দিকে তাকালো। পরক্ষণেই আবার মাথা নামিয়ে কাজে মন দিয়ে সহজ ভঙ্গিতে বললো, ‘দেখা করলাম। তারপর?’

– ‘মাহিব, আমাদের রিলেশনের ছয় মাস হয়ে গেছে। আর আমি এমবিএ কমপ্লিট করেছি অনেক আগেই। আমার বিয়ের চাপ কেমন তুমি হয়তো জানো না। আমি নিড ম্যারি, মাহিব।’

– ‘বাট আই নো নিড। আমি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে করতে পারবো না। আমার যে পেশা, তাতে আমাকে বিয়ে করাটাই মানায় না।’

স্মরণিকা ভীষণ অবাক হলো। অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না। অস্থির হয়ে বললো, ‘তোমার বয়স ঊনত্রিশ মাহিব। কবে বিয়ে করবে?’

– ‘তো? বয়স একটা হাস্যকর ব্যাপার। শোনো, আমি তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। তুমি টেনশন কোরো না।’

স্মরণিকা উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, ‘তুমি ফিল্ম মেকার। বাবা মেনে নেবে কিনা সেটাই সন্দেহ। তার উপর পাঁচ বছর ওয়েট করতে বললে কিভাবে সম্ভব মাহিব?’

মাহিব ল্যাপটপ বন্ধ করে স্মরণিকার দিকে তাকালো। দৃঢ় কণ্ঠে বললো, ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো বোঝানোর। না মানলে তুমি কি করবে সেটা তোমার ব্যাপার।’

– ‘আমি সবকিছু ছেড়ে চলে আসবো। কিন্তু তুমি তো এখন বিয়েই করতে চাইছো না।’

– ‘তাহলে ওই ছেলেকে বিয়ে করে নাও। পাঁচ বছর পর তাকে ছেড়ে আমার কাছে চলে এসো।’

– ‘মাহিব, এই সিরিয়াস বিষয়টা নিয়ে তুমি ফান করছো?’

মাহিব কোনো কথা না বলে পিয়নকে ডেকে কফি আনতে বললো। কফি চলে এলে স্মরণিকা রাগের মাথায় কফির মগ মেঝেতে ছুড়ে মেরে বললো, ‘তোমার কফি তুমি খাও। আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে না।’

হনহন করে বেরিয়ে গেলো স্মরণিকা। মাহিব কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে আবারও কাজে মন দিলো। বিড়বিড় করে বললো, ‘সামান্য একটা ব্রেকাপে কিইবা আসে যায়। কাজে মন দাও মাহিব, কাজে মন দাও।’

৩৩

আজ আকাশটা একটু মেঘলা হয়ে আছে। চারিদিক আবছা আবছা লাগছে। ঘরে শুয়ে থাকতে পারছে না অংশী। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। পেটে একটু একটু চিনচিন ব্যথা। হঠাৎ অনুভব করলো নিচের দিকে ভিজে যাচ্ছে। তবে কি ছোট্ট সোনামণি টার পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে গেছে?

সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে। অংশীর সময়ও থেমে থাকে নি। প্রায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অংশীকে কোনো কাজই করতে দেয়নি প্রীতম। একটা কাজের মহিলা অংশীর জন্য রেখে দিয়েছে যে রান্নাবান্না ও থালাবাসন মাজার কাজ করে দিয়ে যাবে। প্রীতম প্রায় প্রতিদিন ই একবার করে অংশীর খোঁজ নিয়ে যেতো। অংশীর শরীরের যত্ন নিতো, চুল আঁচড়ে দিতো, মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া, ফলমূল খাওয়ানো, কোনোকিছু তেই কমতি রাখে নি। অংশী আজকাল প্রীতমের সাথে খুব প্রাণখুলে কথা বলে। ওর যে একটা ভয়ংকর অতীত ছিলো, সে কথা প্রায় ভুলেই গেছে। প্রীতম যখন অংশীকে ডাক্তার দেখানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়, নিজের ভেতর একটা সুখ অনুভব করে। বাবা হওয়ার মাঝে যে সুখ, কেন যেন সেই আনন্দটুকু ঘিরে রাখে প্রীতমকে।

মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে প্রীতম। আশেপাশের গাড়ির হর্ণ ওর কানে আসছে না। বুকের ভেতর একটা সুখের মত ব্যথা বাজছে। মনটা কেমন যেন ছটফট করে। অংশীকে বারবার দেখতে ইচ্ছে হয়, অংশীর পাশে সবসময় থাকতে ইচ্ছে হয়। মেয়েটা কি বোঝে প্রীতম ওকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে?

সত্যিই ভালোবাসাটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেছে যে প্রীতমও মাঝেমাঝে অবাক হয়। অংশীর সামনে চেষ্টা করে স্বাভাবিক থাকতে। কিন্তু কতগুলো রাত প্রীতমের ঘুম হয় না। এপাশ ওপাশ করেই রাত কেটে যায়। বুকের বাম পাশে চিনচিন করে ওঠে। অংশীর নিষ্পাপ মুখশ্রী ভেসে ওঠে চোখের সামনে। প্রীতম কিছুতেই নিজেকে অংশীর থেকে ফেরাতে পারে না।

অংশী হয়তো জানেনা প্রীতমের এই কঠিন অসুখের কথা। অসুখ ই তো, একটা মানুষ রাতের পর রাত ঘুমাতে পারে না। সারাক্ষণ ছটফট করে, একটা অচেনা ব্যথায় ব্যথিত হয়ে বারবার বিছানার উপর উঠে বসে। মাঝেমাঝে অংশীর কষ্টের কথা ভেবে চোখে জল আসে, বুকটা শূন্য শূন্য লাগে। ইচ্ছা করে ছুটে অংশীর কাছে চলে যায়। অনেক আকুতি মিনতি করে অংশীকে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘ভালোবাসো না আমায়। একটু ভালোবাসলে ক্ষতি কি হয়?’ কিন্তু বলতে পারে না প্রীতম। অংশী যে বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের বাঁধনে ওকে বেঁধে রেখেছে, তা ছিন্ন করার অধিকার ওর নেই। যদি ভুলেও অংশী কখনো জানতে পারে প্রীতম ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে, তবে হয়তো অংশীও কষ্ট পাবে। সেই কষ্ট টুকু অংশীকে দিতে চায় না প্রীতম।

আপনমনে যখন অংশীর কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো, তখন মোবাইলটা বেজে ওঠে। অংশী ফোনে বললো, ‘আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে, খুব ব্যথা হচ্ছে।’

প্রীতম আর স্থির হয়ে থাকতে পারলো না। পাগলের মত ছুটে গেলো এম্বুলেন্স ডাকতে। সামান্য কয়েক মিনিটের পথটাও যেন দীর্ঘ হয়ে উঠলো। আকাশ আরো মেঘলা হয়ে এসেছে। গুমট অন্ধকার, ভ্যাঁপসা গরম। বোধহয় যেকোনো মুহুর্তে বৃষ্টি নামবে। প্রীতম এম্বুলেন্সে বসে ক্রমশ প্রার্থনা করছে আল্লাহ যেন অংশীকে ভালো রাখে।

অংশীর জন্য ভেতরটা খুব ছটফট করছে ওর। ঘামতে শুরু করেছে প্রীতম। সে সময়ে গাড়ি এসে অংশীর বাসার সামনে থামলো।

অংশীকে জাপটে ধরে এম্বুলেন্সে তোলার সময় প্রীতমের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছিলো। অংশী আচমকা ওর দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে পলক ফেলতে পারলো না। ওর চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। প্রীতম অংশীর মুখটা দুহাতে ধরে নরম সুরে বললো, ‘কিচ্ছু হবে না। সব ভালোভাবে হবে দেখো।’

এম্বুলেন্সে বসে অংশী যখন ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে রইলো, প্রীতম ওর হাত চেপে ধরে কেবলই স্বান্তনা দিতে লাগলো। প্রীতমের চোখে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার ছাপ পুরো মুখ জুরে। স্থির হয়ে থাকতে পারছে না ছেলেটা। বারবার বলছে, ‘আল্লাহ, মেয়েটাকে এত কষ্ট দিও না। আমি সহ্য করতে পারছি না। সুস্থ করে দাও আল্লাহ, স্বাভাবিক করে দাও।’

অংশী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে প্রীতমের দিকে। ব্যথাটা ক্রমশ বেড়ে উঠছে। এ কেমন প্রসব যন্ত্রণা, যন্ত্রণায় চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। শরীর অস্থির লাগছে ভীষণ। অংশীর শরীর ঘামছে।

প্রীতম আরো শক্ত করে অংশীর হাত চেপে ধরলো। অংশীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘ঠিক হয়ে যাবে অংশী। একটু সহ্য করে নাও। খুব ভালো কিছু হবে। আল্লাহ আমাদেরকে রহমত দান করছেন অংশী। এ সন্তান আমাদের জন্য রহমত।’

অংশী চোখ বন্ধ করে ফেলে। মাহিবকে মনে পড়ছে ভীষণ। মাহিবের সন্তান আজ পৃথিবীর মুখ দেখতে চলেছে অথচ সে জানেও না। ও হয়তো ভুলেও গেছে অংশী নামক এই অভাগিনীকে। অথচ যে অংশীর কেউই নয়, যাকে এক মুহুর্তের জন্যও অংশী ভালোবাসে নি, আজ সেই মানুষ টাই চোখের জল ফেলছে, প্রার্থনা করছে। জগতের নিয়ম এত অদ্ভুত কেন!

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে অংশী। চিৎকার করতে পারছে না। ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যথা সহ্য করছে। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাইরে নেমেছে তুমুল বৃষ্টি।

হাসপাতালে এসে অংশীকে যখন নার্সরা নিয়ে যাচ্ছিলো, শেষ মুহুর্তেও প্রীতম অংশীর হাত ধরে রইলো। অংশীর মুখ দেখে বুকে ব্যথা হচ্ছে ওর। এতটা কষ্ট হচ্ছে যে বারবার আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলো।

গলা ফাটানো চিৎকার করে একটা ছোট্ট নিষ্পাপ সন্তানের আগমন এই পৃথিবীতে। অংশী সোনামণির কান্নার শব্দ শুনেই চোখ বন্ধ করে ফেললো স্বস্তিতে।

কিছুক্ষণ পর নার্স এসে বললো, ‘আপনার ছেলে হয়েছে। বাবুর মুখ দেখবেন না? উঠুন উঠুন। চোখ খুলুন।’

অংশী সেদিকে না তাকিয়েই বললো, ‘বাইরে একজন অপেক্ষা করছে, তাকে ডাকুন না।’

নার্স অংশীর কোলে সন্তানকে তুলে দিলো। চোখ মেললো না অংশী। চোখ বুজে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি অনুভব করতে লাগলো। নিজেকে আজ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে ওর। সেইসাথে আকাশ সম কষ্ট হচ্ছে। একটা পূর্ণতার আনন্দ, একটা মাহিবের শূন্যতা ওকে আঁকড়ে ধরে রইলো। একদিকে আনন্দে চোখে জল আসছে, আরেকদিকে কষ্টে কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এ এক অন্যরকম কষ্ট। অংশীর হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না। এত সংগ্রাম করে অবশেষে সেই সন্তান পৃথিবীতে এসেছে। অংশীকে এতগুলো মাস কি যে কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সে কেবল অংশীই জানে।

নার্স প্রীতমকে এসে বললো, ‘আপনার ছেলে হয়েছে। মিষ্টি মুখ করান। তার আগে বাবুকে দেখে আসুন। আপনার স্ত্রী আপনাকে ছাড়া বাবুর মুখ দেখবে না। কি ভালোবাসা রে..’

কথাটা শুনে খুশিতে ভরে গেলো প্রীতমের বুক। অংশীকে স্ত্রী বলাতে একটা সুখ অনুভব করলো ও। সেইসাথে তীব্র ব্যথা ও।

প্রীতম এসে যখন অংশীর পাশে দাঁড়ালো, অংশী চোখ মেলে সর্বপ্রথম প্রীতমের দিকে তাকালো। প্রীতমের মুখটা প্রসন্ন হাসিতে উজ্জ্বল।

এবার দুজনে একসাথে তাকালো সন্তানের মুখের দিকে। এক পলক দেখেই অংশীর বুক ফেটে কান্না চলে এলো। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো অংশী। কত নিষ্পাপ একটা মুখ, ছোট ছোট হাত, ছোট ছোট পা, ছোট্ট একটা নাক। কি অপূর্ব সৃষ্টি বিধাতার! অংশী কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়লো প্রীতমের পেটের উপর। প্রীতম অংশীকে চেপে ধরে রইলো খানিকটা মুহুর্ত।

অংশী কান্না থামিয়ে বললো, ‘এ নিষ্পাপ জান বাচ্চাটার কোনো বাবা নেই। আপনি ভাবতে পারেন প্রীতম ভাই?’

অংশীর আত্মা ফেটে যেতে চাইলো। প্রীতম বাবুটাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, ‘আমি ওর বাবা। আজকে আমি সুখে পরিপূর্ণ হয়ে গেছি অংশী। বিশ্বাস করো। বাবা না হয়েও বাবা হওয়ার আনন্দে আমি গর্বিত। এ সন্তানের বাবা আমি। ও আমাকে বাবা বলে ডাকবে।’

অংশী ছলছল চোখে প্রীতমের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘এত ভালোবাসেন কেন আমায়?’

প্রীতমের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনা অংশী। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার ভেতরে…’

প্রীতমের গলা ধরে এলো। অংশী খপ করে প্রীতমের হাত ধরে ফেললো। আর্দ্র কণ্ঠে বললো, ‘এত কষ্ট নিয়ে ঘুমান কি করে?’

প্রীতম কথা বলতে পারলো না। অংশী ওর ভেতরের অনুভূতিটুকু অনুভব করতে পেরেছে এই সুখেই ওর হৃদয় ভরে গেলো।

হাসপাতালের ছোট্ট একটি কক্ষে একটি নিষ্পাপ শিশুকে কোলে নিয়ে দুটি মানুষের অন্তর সুখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। এ সুখ স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো সুখ। অংশীর দীর্ঘদিনের কষ্টের অবসান হলো আজ। এ কান্না কষ্টের কান্না নয়, এ কান্না সুখের কান্না।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here