তৃষ্ণা পর্ব ২৮

0
1363

তৃষ্ণা
পর্ব ২৮
মিশু মনি
অংশীর এখন বড়ই সুখের সময়। ছোট্ট সোনামণিকে নিয়ে সারাদিন হেসেখেলে কেটে যায়। প্রীতম প্রতিদিন একবার করে এসে দেখে যায় অংশীকে। অনেক্ষণ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে, বাবুর সাথে গল্প করে। অংশী সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে।
বাচ্চার বয়স বাড়ছে। নাম রাখা হলো অমি। অমির চেহারা ফর্সা, লম্বা নাক, কপালটা একেবারে মাহিবের মত। অংশীর মাঝেমাঝে অমি’র মুখের দিকে চেয়ে মাহিবকে ভেবে কষ্ট হতে থাকে। ভীষণ কষ্ট হয়। মাহিব এখনো বুকের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে আছে। টেনে বের করে আনা যায় না ওকে। কি যে যন্ত্রণা অংশীর মনে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে প্রীতমকে বরণ করে নিতে। কিন্তু পারে না। পাগল মনটা মাহিবের জন্যই উন্মুখ হয়ে উঠছে দিনদিন।
দিনগুলো এভাবেই অতিক্রম হচ্ছিলো। এরই মাঝে অংশী প্রীতমকে জানায় ব্যবসায়ের জন্য লোন দরকার। হাতে টাকা পেলে যেকোনো মুহুর্তে কাজ শুরু করে দিতে চায় অংশী। প্রীতম সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে লোনের ব্যবস্থা করবার জন্য।
খুব বেশিদিন চেষ্টা করতে হলো না। একটা এনজিও থেকে লাখ খানেক টাকা পেয়ে গেলো অংশী। তাই দিয়ে ছোট্ট করে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করে দিলো ব্যবসা।
অমি’কে কাজের মেয়ের কাছে দিয়ে অংশী নিজের কাজ করে। শাড়িতে ব্লক ডিজাইন দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলে। মোটামুটি কিছু শাড়ি ও জামা নিয়ে অংশী শুরু করলো তার দোকান।
প্রথমদিনে একটা কাপড়ও বিক্রি হলো না। অংশী দোকানে বসে থাকে অমিকে কোলে নিয়ে। অমি’কে খাওয়ানো, জামাকাপড় বদলে দেয়া, গল্প করা, খেলা করা এসব করেই সময় কাটে। প্রথমদিন কোনো কাস্টমার না পেয়ে হতাশ হলো অংশী।
দ্বিতীয় দিনেও কোনো কাস্টমার জুটলো না। অবশেষে তৃতীয় দিন দুজন কাস্টমার পাওয়া গেলো যারা অংশীর জামাকাপড় দেখে খুবই প্রশংসা করলো কিন্তু বিক্রি হলো মাত্র একটা জামা।
অংশী হতাশ হলো না। সারারাত জেগে নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনে লেগে পড়লো। কয়েকটা ডিজাইন মনের মত না হতে হতেই অবশেষে একটা ডিজাইন খুব আকর্ষণীয় হলো। ভোরবেলা মনে প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলো অংশী।
৩০
বেশ কয়েকদিন সময় লাগলো দোকানের পরিচিতি বাড়তে। এরই মাঝে অংশী একজন পাইকারি কাস্টমার জোগার করে ফেললো। লোকটা প্রথমদিনেই অর্ডার দিয়ে গেলেন দশটি শাড়ির। দিনরাত এক করে পরিশ্রম করে শাড়ির ডিজাইন করলো অংশী। একদিকে বাচ্চা সামলানো, একদিকে নিজের শরীরের ক্লান্তি, অন্যদিকে পরিশ্রম। তবুও অংশী হাল ছেড়ে দেয়ার মেয়ে নয়। নিজে উপার্জন শুরু করার পর থেকে সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করেছে অংশীর। হাতে টাকা থাকলে নিজের জন্য যা খুশি কিনতে পারে, সন্তানের জন্য কিনতে পারে। এই আনন্দটাই বা কম কিসে? শুধুমাত্র এ কারণে হলেও তো মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া উচিৎ। প্রীতমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো অংশীর।
প্রীতম দেখা করতে এলো রাত ন’টায়। অংশী দোকান বন্ধ করে বাসায় কাজ করছে। কাজ করছে। প্রীতম অংশীর কাজ দেখে চমকিত হলো। অংশীর হাতের ডিজাইন ধীরেধীরে উন্নত তর হচ্ছে। বেশ ভালো লক্ষণ। প্রীতম হাসিহাসি মুখে বললো, ‘বাহ, দিনদিন দেখছি তোমার কাজ চরম আকর্ষণীয় হচ্ছে..’
অংশী হেসে জবাব দিলো, ‘তাই বুঝি? তবে দু একটা জামা কিনে নিয়ে গেলেও তো পারেন।’
প্রীতম ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ওমা তাই!’
ভ্রু কুঁচকালেও চলে যাওয়ার সময় বোনের জন্য একটা জামা, মায়ের জন্য একটা শাড়ি নিয়ে হিসেব করে অংশীকে টাকা বুঝিয়ে দিলো প্রীতম। অংশী টাকা না নিয়ে বললো, ‘টাকা দিচ্ছো কেন প্রীতম ভাই?’
প্রীতম বললো, ‘এটা তোমার বিজনেস অংশী। আর বিজনেসের জায়গায় কোনো কম্প্রোমাইজ হবে না। ব্যবসা থেকে এক পয়সা এদিক সেদিক করা যাবে না। বুঝেছো?’
অংশী হাসলো। প্রীতম দু হাজার টাকা অংশীর হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেলো। টাকা দু হাজার বুকে চেপে ধরে যত্ন করে রেখে দিলো অংশী।
ব্যবসায়ের পরিচিতি ক্রমশ বাড়ছে। আজকাল সারাদিনেই মোটামুটি কাস্টমার দের ভিড় থাকে। অংশী সকালবেলা কাজ করে আর বিকেলবেলা দোকান খুলে বসে। কাজের মেয়ের বেতন আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। আগের বেতনে সে কাজের পাশাপাশি অমি’কে সামলাতে চায় না।
অমি ধীরেধীরে বড় হচ্ছে। অংশীকে সে আগের চেয়েও বেশি জব্দ করতে আরম্ভ করেছে। এই সব জব্দ সহ্য করেও একটা মেয়ের পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। নিজেই কাজ করা, নিজেই ডিজাইন করা, আবার নিজেই দোকানে বিক্রি করা। সব একসাথে করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে অংশী। তবে সুখের কথা হচ্ছে কাজের ব্যস্ততায় সময় খুব আনন্দে কাটে। নিজের ব্যবসায়ের অগ্রগতিতে মানসিক শান্তিও অনুভূত হয়।
দোকানের জন্য একজন কর্মীকে নিয়োগ দেয়া দরকার। কিন্তু দুদিন ধরে প্রীতম আসছে না। হয়তো কাজের চাপে আছে। কিন্তু প্রীতম না এলে অংশীরও ভালো লাগে না।
চতুর্থ দিন প্রীতম এসে অমি’কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। আজ প্রীতমকে কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে। প্রতিদিনকার চেয়ে একটু আলাদা। মুখটা করুণ, চোখেমুখে চিন্তার ছাপ, বয়স যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।
অংশী প্রীতমের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার কি হইছে প্রীতম ভাই?’
প্রীতম হাসার চেষ্টা করে বললো, ‘কই কিছু না তো।’
অংশীর কৌতুহল বেড়ে গেলো। বললো, ‘বলো না প্রীতম ভাই কি হইছে তোমার?’
প্রীতম এবার না বলে থাকতে পারলো না। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে বললো, ‘অংশী, আমার উপর রাগ করবে না তো?’
– ‘রাগ করবো না প্রীতম ভাই। কি লুকাচ্ছো বলো না?’
প্রীতম আমতা আমতা করে বললো, ‘অংশী। দুদিন আগে পরিবারের চাপে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে হয়েছে।’
অংশী একটা বড়সড় ধাক্কা খেয়ে গেলো। বিয়ে হয়ে গেছে!
প্রীতম বললো, ‘অনেক চেষ্টা করেছি বিয়েটা না করার। কিন্তু আব্বু এত অসুস্থ ছিলো, তার কথা না করতে পারিনি। ওই মুহুর্তে আব্বুকে বিয়ের কথা না দিলে সে খুব কষ্ট পেতো। আমার কাজিনের সাথে সেদিনই বিয়ে হয়ে গেছে আমার। আব্বু আম্মু ছোটবেলা থেকেই চাইতো আমি ওকে বিয়ে করি।’
অংশী হাসলো। প্রথম দিকে বুকে চিনচিন ব্যথা হলেও পরক্ষণে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, ‘অভিনন্দন প্রীতম ভাই। বিয়ে তো করতেই হতো একদিন। হয়ে গেছে ভালোই হয়েছে। আপনার বাবার শরীর এখন কেমন?’
– ‘বাবার শরীর ভালোর দিকে। আমাকে মাফ করিস অংশী।’
কথাটা বলতে গিয়ে প্রীতমের গলা কেমন যেন কেঁপে উঠলো। অংশী হাসার চেষ্টা করলো। প্রীতমকে হাসিমুখে বিদায় দিলেও রাতে কোনো অজানা কারণে পাগলের মত কাঁদলো অংশী। সারা রাত কেঁদেই কাটিয়ে দিলো। কেন যে এভাবে ব্যকুল হয়ে কাঁদলো তার কারণ নিজেরই অজানা। তবে আজ অনেকদিন পর খুব কষ্ট হচ্ছে ওর, খুব।
দুদিন পর যখন প্রীতম আবার এলো, অংশী প্রীতমের হাত ধরে বললো, ‘প্রীতম ভাই, তুমি আর আসিও না। নতুন বিয়ে করেছো, এখন বউকে সময় দাও। আমার পাশে তো সবসময়ই আছো, আমার পথ তো দেখিয়ে দিয়েছো। এখন আমাকে একলা এ পথে চলতে দাও।’
প্রীতম অংশীর কথা শুনে অত্যন্ত আবেগী হয়ে উঠলো। যাওয়ার সময় অংশীর দিকে তাকিয়ে ওর চোখ বারবার ভিজে উঠছিলো। প্রীতম চলে গেলে আরেকবার কষ্টে ডুকরে কেঁদে উঠলো অংশী।
প্রীতমকে বিদায় জানিয়ে একাকী লড়তে প্রস্তুত হলো। এ যুদ্ধ অংশীর একার। আজ থেকে প্রীতম বলে আর কেউ তার পাশে নেই। হয়তো পাশে আছে সবসময়, ছায়ার মত। তবুও আগের সেই প্রীতম আর প্রীতমের মাঝে নিজের চাওয়া, আবদার বা কথা বলার ধরণ সবই বদলাতে হবে। প্রীতমের বুকের ভেতর কি যন্ত্রণা চলে সেও বুঝতে অসুবিধে হয়নি অংশীর। সম্প্রতি এই বড়সড় আঘাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
ব্যবসায়ের জন্য আরেকজন সহায়তাকারী প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহুর্তে কাউকে নিয়োগ দিলে তাকেও বেতন দিতে হবে। তারচেয়ে বরং নিজের একটু কষ্ট হলেও কাজগুলো একাই করে যেতে হবে। আজকাল অংশী যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে অনেক বেশি ভাবায়, অনেক সময় নেয়। কাজের চাপ থাকাটাও এক অর্থে ভালো, কাজের ভেতরে থাকলে কোনো অযথা দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করে না। কাউকে মনে করারও সময় হয় না।
নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলো অংশী। অমি’কে খেলনা দিয়ে বসিয়ে রেখে নিজে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়ে। যতক্ষণ না অমি কাঁদতে কাঁদতে ব্যকুল হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত অংশী কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। পরিশ্রম করার মাঝেও একটা আলাদা প্রশান্তি আছে।
দোকানে বেঁচাকেনা যা হচ্ছে, তাতেই দিব্যি চলে যাচ্ছে সবকিছু। তবুও ব্যবসাকে বড় করার জন্য লেগে আছে অংশী। এবার আরো বড় পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।
অংশী অমি’কে কাজের মেয়ের কাছে রেখে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। আজকে দোকান বন্ধ রেখে ও অন্য দোকানে দোকানে ঘুরবে। দেখবে, শিখবে কিভাবে কাস্টমারদের সাথে কথা বলতে হয়। একটা বড় শপিং কমপ্লেক্সে ঢুকে জামাকাপড় নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। ব্লক প্রিন্টের শাড়ি দেখতে চাইলে দোকানদার ওকে যে শাড়িগুলো দেখালো সেগুলো হাতে ধরে উল্টে পাল্টে দেখলো অংশী। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে দোকানীকে দেখালো। দোকানদার শাড়ি দেখে মুগ্ধ হলেন। অনেক অনন্য ডিজাইন, উন্নত কাপড় আর খুব যত্ন নিয়ে করা তা বোঝাই যাচ্ছে। উনি আরো অবাক হলেন যখন অংশী বললো, ‘এটা আমার নিজের করা শাড়ি। আপনার কেমন লেগেছে?’
দোকানীর মুগ্ধতার রেশ কাটছিলো না। বললো, ‘আপনি আরো কি কি ডিজাইন করেন?’
– ‘আমি এরকম অনেক নতুন ডিজাইন করে আপনাকে দেখাতে পারবো। আপনার ভালো লাগলে আপনি কি আমাকে অর্ডার দেবেন?’
এমন নিঃসংকোচ প্রস্তাবে দোকানী বেশ অবাক হলো। অংশী আত্মবিশ্বাসী সুরে বললো, ‘আমার কাজ দরকার, আর আপনার ভালো শাড়ি বা জামা। আমি আপনাকে আরো ভালো ডিজাইন দেখাতে পারি। যা অর্ডার করবেন সে অনুযায়ী কাজ করে আমি আপনাকে দিয়ে যাবো। কাজ পছন্দ হলে টাকা দেবেন। বলুন আপনি চান কিনা?’
স্পষ্ট করে কথা বলছে অংশী। দোকানী হাসিমুখে ওর কথা শুনছে। সরাসরি এভাবে এখন পর্যন্ত কেউ ওনার কাছে শাড়ি বিক্রির ব্যাপারে কথা বলতে আসে নি।
অংশী একটা শাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা আপনার কত টাকায় কেনা?’
– ‘পনের শো।’
অংশী দোকানীর কাছে এগিয়ে এসে বললো, ‘এই শাড়ি আমি বানিয়ে দেবো, তেরশো টাকায়। অন্যরা যে দামে দিচ্ছে তারচেয়ে বহু অংশে কম দিবো। চলবে?’
দোকানদার অংশীর কথাবার্তায় অবাক ছাড়া আর কিছুই হতে পারলেন না। অংশী কথায় আবেগ নেই, আন্তরিকতা নেই, শুধু স্পষ্টতা আছে। অনেক ধাক্কা খেয়ে এই মেয়ে ব্যবসায় এসেছে সেটা নিশ্চিত। উনি বললেন, ‘আগে আপনি আমাকে স্যাম্পল দেখান, তারপর বাকিটা।’
অংশী আর এক মুহুর্ত দেরি করেনি। এক দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আরো কয়েকটা দোকানে ঢুকলো। সবার সাথে একইভাবে কথাবার্তা চালিয়ে গেলো। এরমধ্যে একজন শুধু সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছে। বাকিরা সবাই আরো নমুনা দেখতে চেয়েছে। মনে অনেক তেজ ও ভরসা নিয়ে অংশী অনেক টাকার রং, কাপড় কিনে নিয়ে বাসায় ফিরলো।
এসে দেখে অমি নিষ্পাপ ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে। ছেলের পাশে শুয়ে আদর করে দিয়ে বললো, ‘লক্ষীসোনা, তোর মাকে একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দে। তোকে মানুষ করতে হবে তো। মা তোকে সময় দিতে পারে না, কষ্ট পাস না সোনা আমার।’
অমি’কে খাবার খাইয়ে কাজে লেগে গেলো অংশী। নিজেই নিজেকে অনুপ্রাণিত করছে, সাহস জোগাচ্ছে। বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। সংগ্রাম ব্যতীত কে কবে সফল হতে পেরেছে? মনেমনে বললো, ‘একটা ধাক্কা আমাকে কখনোই থামাতে পারবে না। পারবে না মাহিব।’
পুরোটা বিকেল, সারারাত কাজ করে গেলো অংশী। শেষেরদিকে মনের মত কাজ হচ্ছিলো না বলে রেখে দিলো। পরেরদিন দোকান খুলতেই ছন্দা ও তার বান্ধবীরা এলো দেখা করতে। এই এক বছরে মেয়েগুলো অনেক বড় হয়েছে। স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠেছে। অংশীর প্রাণের বন্ধু ওরা। কতভাবে যে অংশীকে সাহায্য করেছে তার কি কোনো শেষ আছে!
মেয়েরা অংশীর কাজ দেখে পুলকিত হলো। ওরা সবাই নিজেদের জন্য একটা করে জামা পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে গেলো অংশীর থেকে। যাওয়ার সময় অংশীকে বলে গেলো, ‘যত কাছের মানুষ ই হোক না কেন, বিজনেস ইজ বিজনেস। কাউকে ফ্রিতে কিচ্ছু দেয়ার মানে হয় না।’
ওদের কথা অনেক ভরসা দেয় অংশীকে। অনেক্ষণ ভর সবাই মিলে গল্প, আড্ডা চালিয়ে গেলো। অমিকে কোলে নিয়ে সবাই আদর করে দিলো। সবাই জানে অংশীর স্বামী অংশীকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই ওরা আরো বেশি সম্মান করে অংশীকে। অংশী কথার এক ফাঁকে ছন্দাকে ডেকে বললো, ‘আমাকে সাজগোজের একটা ভালো উপায় বলে দে তো। কিভাবে সাজগোজ করবো?’
ছন্দা বললো, ‘তুমি তো এমনিই সুন্দর। তোমার আবার সাজগোজের প্রয়োজন আছে নাকি?’
– ‘আছে। আমার জীবনে একটা বিশেষ দিন আসতে চলেছে। সেদিন আমি সাজবো, মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজবো।’
ছন্দা কৌতুহলী হয়ে উঠলো, ‘তাই নাকি? কি গো সেই দিন?’
অংশী হেসে বললো, ‘আছে একটা দিন। নিজের বানানো সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পড়বো, চুল বাঁধবো, খুব সুন্দর করে সাজগোজ করবো। এবার শিখিয়ে দিবি নাকি নিজেই শিখে নিবো?’
ছন্দা অংশীকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘বাপ রে। তর সইছে না দেখছি। কাল এসে দেখিয়ে দিবো। তোমার সাজগোজ তেমন করতে হবে না। চোখে কাজল আর আইলাইনার দিবা, হালকা করে লিপস্টিক দিবা, ব্যস।’
অংশী মাথা ঝাঁকালো। ছন্দাকে টাকা দিয়ে বললো, ‘কাল আমার জন্য এগুলো কিনে এনো তো।’
ছন্দা হেসে বললো, ‘আচ্ছা আনবো।’
ওরা চলে গেলে অংশী কিছুক্ষণ দোকানে বসে রইলো। কোনো কাস্টমার আসছে না দেখে চলে এলো বাসায়। অমিকে বসিয়ে রেখে শাড়িতে কাজ করতে শুরু করে দিলো। আজকে দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ শুরু করায় মনের মত ডিজাইন হচ্ছে। অংশী খুব উচ্ছ্বসিত মনে কাজ করে গেলো।
এভাবে টানা কয়েকদিনের কাজ শেষে সবচেয়ে সুন্দর কাপড়গুলো নিয়ে সেই শপিং কমপ্লেক্স গুলোতে গেলো দেখানোর জন্য। শাড়ি দেখে দোকানদার রা হতবাক! নিঁখুত আর মনোমুগ্ধকর কাজ। মুগ্ধ হওয়ার মতই। ওনারা প্রথম দেখেই অর্ডার করে ফেললেন।
সবমিলিয়ে অংশীর মোট অর্ডার হলো পঞ্চাশটা শাড়ি, ষাট টা থ্রি পিছ। এবার আরো নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে।
একটা মুহুর্ত ও নষ্ট করতে চাইলো না অংশী। মনের মাধুরি মিশিয়ে খুব পরিশ্রমের সাথে ধীরেধীরে কাজ করে গেলো। কাজ করতে করতে যখনই ক্লান্তি নেমে আসে, অমিকে কোলে নিয়ে দোকানে চলে আসে। দোকানেও টুকটাক বিক্রি হতে থাকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কতবার যে ছেলেকে আদর করতে হয়, খাওয়াতে হয়, নিয়ে খেলতে হয় সে কেবল অংশী ই জানে। বাচ্চাকে সামলে নিজের কাজ করাটা খুবই কঠিন। মেয়েটা কঠিনকেই বরণ করে নিয়েছে।
কঠোর পরিশ্রমের পর যখন প্রথমবারের অর্ডারের শাড়ি ও কাপড়গুলো দোকানে ডেলিভারি দিলো, তখন খুশিতে, আনন্দে চোখে জল চলে এলো অংশীর। এতদিনের পরিশ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থ হাতে পেয়ে গর্বে বুকটা ভরে উঠলো। আজ অংশী স্বাবলম্বী হতে পেরেছে, ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে অংশীর প্রতি। ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম মানুষকে তার শ্রেষ্ঠ জায়গাটায় পৌঁছে দেয়, এই বাক্যে বিশ্বাস করে অংশী। সে লক্ষ্যেই পরিশ্রম করে যাচ্ছে ও। জীবন ওকে একটা শিক্ষাই দিয়েছে, কোনো পরিস্থিতিতে কখনো হাল ছাড়তে নেই। জীবন সঠিক সময়ে ঠিকই তার গতি ফিরে পায়।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here