#তোমায় ঘিরে
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫
এর মধ্যে নার্স এসে একটি সংবাদ দিল যা শুনে সবাই ভয় পেয়ে গেল। নার্স জানাল পুলিশ এসেছে। কারণ এক্সিডেন্টের মামলা তাই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করবে। অধরা ভয়ে চুপসে গেল। অধরা একটু ভীতু স্বভাবের। অল্প কিছুতে ভয় পেয়ে যায়। একটু কিছুতেই যেন তার গা হাত পা কাঁপতে থাকে। আর পুলিশের কথা শুনে যেন তার কলিজাটায় কেঁপে উঠল। এদিকে ধরীতা আর সিয়াম ভাবছে রাণীর কিছু হলে এর দায়ভার তাদের উপর পরে কি’না। এখন রাণী সুস্থ আছে তবে হিতে বিপরীত কিছু হলে কীভাবে সামাল দিবে সে চিন্তায় তারা করছে। তাদের চিন্তার ঘোর কাটে অধরার কথায়
“ধরীতা এবার তো মনে হয় পুলিশের হাতে মাইর খেতে হবে। জেলে যেতে হবে। আজকে শুধু একটার পর একটা অঘটন ঘটছে। এমনিতেই তোকে বাবা দেখতে পারে না তার উপর দেরি হয়ে রাতও হয়ে গেছে। এখনও বাসায় যেতে পারছি না। এখন যদি পুলিশের ঝামেলায় পড়ি আর বাবা মায়ের কানে যায় তোর কী অবস্থা হবে ভেবেছিস? আমার থেকে তোর অবস্থা বেশি খারাপ হবে। এমনিতেই তোকে কত কথা শুনতে হয়।”
ধরীতা অধরার এ ন্যাকামিগুলো একদম সহ্য করতে পারে। অধরার এই ছিটকাঁদুনি স্বভাব তার ভীষণ খারাপ লাগে। অধরাকে কিছুটা ধমকের সুরে বলল
“থামবি তুই? আমরা কী অন্যায় করেছি নাকি যে পুলিশ এসে আমাদের ধরবে? আর রাণীর অবস্থা ভালো সুতরাং এত ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। ”
সিয়াম তাদের কথোপকথন শুনে হালকা গলায় বলে উঠল
“আপনারা থামুন। চলুন দেখে আসি পুলিশ কী বলে। আর এখানে যতই কথা বলে সময় নষ্ট করবেন ততই বিষয়গুলো আরও হজবরল হবে। কাজ করার সময় এত কথা বলতে হয় না। এতে কাজ আরও জটিল হয়ে যায়। সবকিছুর বাইরে আরেকটা অধ্যায় হলো নিয়তি। আপনার আমার নিয়তিতে যা থাকবে তাই হবে। জেলের ভাত থাকলো জেলের ভাত খাব। এত চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। ”
কথাটা বলেই সিয়াম রওনা দিল করিডোরের দিকে। ধরীতা অধরাকে পুনরায় আরেকটা ধমক দিয়ে বলল
“কান্না রেখে চল তো।”
বলেই হাতটা টেনে নিয়ে ধরীতা বের হলো। পুলিশ তিনজনকে রাণীর ব্যাপারে সাময়িক জিজ্ঞাসা করে চলে গেলেন। পুলিশ যাওয়ার পর ধরীতা অধরার মাথায় একটা থাপ্পর দিয়ে বলল
“দেখেছিস মাথামোটা, পুলিশ কিছুই করেনি। শুধু শুধু ভ্যাবলার মতো কাঁদছিলি। তোরে মন চাচ্ছে মাথায় ঘাট্টা মারি।”
ধরীতার কান্ড দেখে সিয়াম মৃদু গলায় বলল
“আরে আপনি ওকে এভাবে মারছেন কেন? আপনার হাত পা অনেক নড়ে। আপনি একটু বেশিই করেন সবার সাথে। বেচারির মাথায় ব্যথা পাবে তো।”
সিয়ামের আদিক্ষেতা ধরীতার একদম ভালো লাগছে না। সিয়াম যেমনটা করছে তা থেকে বুঝা যায় মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। ধরীতা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল
“আমাদের বাসায় যেতে হবে। রাত দশটার উপর বাজে। ফোনও বন্ধ হয়ে আছে। বাসা থেকে কেউ কল দিয়ে পাচ্ছেও না হয়তো। বাসার সবাই চিন্তা করবে। রাণীর মায়ের ঠিকানা তো পুলিশকে দেওয়া হয়েছে উনারা বাকিটা বুঝবেন। আর আপনি তো আছেনেই। আমাদের এখন যেতে হবে। আমরা গেলাম।”
ধরীতার কথা শুনে সিয়াম তার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকাল। কত দ্রূত সময় চলে গেল সেটাই সে ভাবছে। ধরীতার কথার উত্তরে সিয়াম বলল
“চলুন আপনাদেরকে দিয়ে আসি। আর একজন নার্সকে রাণীর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের দিয়ে এসে আবার এখানে আসব। ”
ধরীতা মুখটা ভেঙচি কেটে বলল
“আপনার যেতে হবে না আমরাই যেতে পারব। এখান থেকে বাসা বেশি দূর না। রিকশা দিয়ে চলে যাব।”
“এত রাতে দুজন মেয়েকে একা আমি ছাড়তে পারব না। আপনাদের কিছু হলে এর দায়ভার আমার উপর পড়বে। দায়িত্ব থেকে আপনাদের দিয়ে আসব। ”
ধরীতা আর কথা বাড়াল না। সিয়ামের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল
“চলুন তাহলে।”
তিনজনেই রওনা দিল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গাড়িটা চলছে। বাইরে হুট করেই প্রবল বৃষ্টি পড়তে লাগল। গাড়ির জানালা দিয়ে প্রবল বেগে বৃষ্টির ছাঁট লেপ্টে যাচ্ছে। সিয়াম গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করাল। এত বৃষ্টি হুট করেই চলে আসবে বুঝতে পারেনি তারা। কোনো রকম গর্জন তুর্জন ছাড়াই যেন বৃষ্টি ধূপ করে পড়তে লাগল। আকাশটা কালো হয়ে চারপাশ বেশ অন্ধকার। ধরীতার এবার একটু ভয় লাগছে। একে তো দেরি হয়েছে তার উপর বৃষ্টি। ফাটা কপাল হলে যা হয় আরকি। ছোটো বেলায় বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের সাথে মামার বাড়ি থাকে সে। মামারা খাওয়া পড়ার খরচ চালালেও মানসিক অত্যাচার থেকে কখনও নিস্তার দেয় না। অধরা ধরীতার শুধু ফ্রেন্ড না মামাত বোনও। অধরা ধরীতাকে ভীষণ ভালোবাসে। তার বাবা, মা কখনও ধরীতাকে কিছু বললে সে প্রতিবাদ করে। এর জন্যও দোষ পড়ে ধরীতার উপর। তাদের ধারণা তাদের আদরের মেয়ের মাথা খাচ্ছে ধরীতা। মামার রাগটা কমে গেলেও মামীর রাগটা কখনও কমে না। তিনি সারাক্ষণই ধরীতার মায়ের সাথে কটু বাক্যে বুলি আওরাতে থাকেন।
ধরীতা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। অধরা বুঝতে পারছে ধরীতা চিন্তা করছে বাসায় কী হয় সেটার জন্য। তার উপর অধরার মা হয়তো এতক্ষণে তার ফুফুকে যা’তা বলা শুরু করে দিয়েছে। সে ধরীতার কাঁধে হাত রেখে মোলায়েল গলায় বলল
“চিন্তা করিস না। বাসায় গিয়ে আমি সব ম্যানেজ করে নিব নে। মা, বাবা তো একটু এমনেই জানিস। তুই একদম মাথা ঠান্ডা রাখ।”
সিয়াম চুপচাপ বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করছে। সে বুঝতে পারছে ধরীতা আর অধরা কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছে। তবে সেটা বৃষ্টির শব্দের জন্য শুনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি খানিকটা কমলো। সিয়াম গাড়ি চালানো পুনরায় শুরু করল। মিনেট পনেরোর মধ্যেই গাড়িটা বাসার সামনে থামল। ধরীতা আর অধরা গাড়ি থেকে দ্রূত নেমে সিয়ামকে না বলেই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। সিয়ামের কাছে বিষয়টা একটু অদ্ভুত লাগলেও গায়ে মাখাল না। পেছন দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করল ধরীতার হাতের ঘড়িটা সিটে ফেলে রেখে গিয়েছে। সে দ্রূত গাড়ি থেকে নেমে ঘড়িটা দিতে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই বিস্মিত হয়ে গেল। এক মধ্য বয়স্ক মহিলা ধরীতাকে ইচ্ছামতো গালি দিচ্ছে আর পাতিল বাসন ছুড়ে দিচ্ছে। সিয়াম বুঝতে পারছে না তিনি কে৷ একটা পর্যায়ে মহিলাটা স্টিলের গ্লাস ছুড়ে মারল ধরীতার দিকে। গ্লাস টা ধরীতার কপালে লেগে কপাল ফেটে টপটপ করে রক্ত পড়তে লাগল। সিয়াম নিজেকে কিছুটা আড়াল করে রাখল। ঘটনা বুঝার প্রবল চেষ্টা করেও পারছিল না। এদিকে অধরা মহিলাটাকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। মহিলাটায় হলো ধরীতার মামী নাজনীন বেগম। নাজনীন বেগম ভেতরে যেতেই ধরীতার মা তহুরা বেগম এসে ধরীতার মাথা চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সিয়ামের আর সাহস হলো না তাদের মুখোমুখি হওয়ার। তবে সিয়াম অবাক হচ্ছে ধরীতার কথা ভেবে। যে মেয়ে অল্পতে রেগে যায় হাত পা ছুড়াছুড়ি করে সে মেয়ে কীভাবে এতগুলো কথা সহ্য করল এবং নিজেকে সামলে নিল। মাথায় আঘাত পাওয়ার পরও চুপ থাকল। সবকিছু মিলিয়ে বিষয়গুলো সিয়াম বেশ গুলিয়ে ফেলছে। বেশিক্ষণ সেখানে আর দাঁড়িয়ে রইল না। সেখান থেকে দ্রূত বের হয়ে গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে আসলো।
হাসপাতালে এসে দেখল রাণীর মা ততক্ষণে চলে এসেছে। নিজের মেয়ের পাশে বসে সেবা করছে। সিয়াম রাণীর মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে বিদায় নিয়ে বাসায় গেল। বাসায় যেতে যেতে তার রাত দুটো বেজে গেল। বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে সে পড়ল নতুন বিপাকে।
চলবে?