তোমায় ঘিরে #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব-৮

#তোমায় ঘিরে
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

অর্ধেক রাস্তায় যেতেই আবার এক বিপত্তির সম্মুখীন হলো। ধরীতা অঝোরে কাঁপতে লাগল। জ্বরের প্রকোপ বেড়ে গেল তার। সারা শরীর কেমন জানি অসাড় লাগছে তার। বুকে হালকা ব্যথাও হচ্ছে। যতই নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে ততই আরও জ্বরের প্রকোপে তলিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ভীষণ ভার ভার লাগছে। পেছনের সিটে বসা অবস্থা থেকে অধরার কোলে শুয়ে পড়ল সে। শুয়ে পড়তেই অধরা ধরীতার গায়ে হাত দিয়ে লক্ষ্য করল ওর শরীর জ্বরে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। শরীরের তাপ এতই বেশি যে শরীরে হাত দিয়ে মনে হচ্ছে আগুনে হাত দিয়েছে। ধরীতা কাঁপতে কাঁপতে বলল

“ভীষণ ঠান্ডা লাগছে আমার।”

অধরা দ্রূত গলায় সিয়ামকে ডাক দিল। আর বলে উঠল

“স্যার ধরীতার শরীর ভালো লাগছে না। ওর জ্বরও বেড়েছে অনেক। ওর শীত লাগছে। শীতে কাঁপছে। এসিটা একটু বন্ধ করে দিন। নাহয় বেচারির কষ্ট হবে অনেক। গতকাল রাত থেকে ওর জ্বর।”

সিয়াম পেছনে না তাকিয়েই প্রথমে এসিটা বন্ধ করল। তারপর গাড়িটা এক পাশে থামাল। থামিয়ে সামনে থেকে পেছনে এসে ধরীতার কপালে হাত দিয়ে লক্ষ্য করল জ্বরের প্রকোপ অনেক বেড়েছে। ধরীতার কাঁপুনি হচ্ছে প্রখর। মাথায় ব্যান্ডেজ করা জায়গাটাও ফুলে গিয়েছে। ব্যান্ডেজের আশপাশটা লাল হয়ে আছে। সিয়াম অধরাকে বলল

“ওকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। ওকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। যে হারে জ্বর বেড়েছে ডাক্তার না দেখালে ভালো হবে না। আর মাথার আঘাতটাও বেশ ফুলে গেছে ওর। এখনই দ্রূত ডাক্তার দেখাতে হবে। পানিও নেই যে জলপট্টি দিব। ”

কথাগুলো বলে সিয়াম দ্রূত গাড়িটা নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিল। প্রচন্ডরকম খারাপ লাগছে ধরীতার অবস্থা দেখে। নিজের ভেতরে এমন খারাপ লাগার কারণ তার জানা নেই। কেনই বা ধরীতার প্রতি এত মায়া তাকে গ্রাস করছে সেটাও সে জানে না। এদিকে ধরীতা সিয়ামকে কিছু বলতে চেয়েও পারছিল না। বুঝতে পারছিল তারা হাসপাতালের পথে রওনা দিচ্ছে। তবে ক্লাস না করে হাসপাতালে গেলে তার মামী যে তাকে আবারও কথা শুনাবে সেটা সে বুঝতে পারছে। হয়তো তার মামী বলবে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার জন্যই সে নাটক করেছে অসুস্থতার। এছাড়াও বিভিন্ন কটু কথা বলে তাকে আঘাত করবে। ঐ আঘাতটা এ আঘাতের কাছে কিছু না। মাঝে মাঝে মানসিক যন্ত্রণার কাছে শারিরীক যন্ত্রণা একদম ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু শরীরের এত বেহাল দশা যে মুখ খুলে হাসপাতালে না যাওয়ার কথাটাও সে বলতে পারছে না। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে তার সে সাথে চোখও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাত পা অনেক টানছে। দম বন্ধ হয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছে।

সিয়াম হাসপাতালের সামনে এসে গাড়িটা থামাল। ধরীতাকে কোলে করে গাড়ি থেকে নামাল। সিয়ামের কোলে উঠার পর ধরীতা শুধু চোখ টেনে সিয়ামের দিকে তাকাল। এক পলক তাকিয়ে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল। সিয়াম ধরীতাকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার পর ধরীতার কান্ডিশন দেখে তাকে ভর্তি রাখল। মাথাটা ড্রেসিং করে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দিল। জ্বরের জন্য ইনজেকশন আর ঔষধ দিল। ধরীতা বেডে শুয়ে আছে। এর মধ্যে সিয়াম অধরাকে ভার্সিটিতে পাঠিয়ে দিল। আপাতত সিয়াম ধরীতার পাশে আছে সুতরাং অধরার প্রয়োজন পড়বে না। একসাথে দুজনের ক্লাস মিস গেলে বাসায় গিয়ে সমস্যায় পড়তে পারে এটা বেশ সিয়াম আন্দাজ করতে পারছিল। তাই অধরাকে ক্লাসে পাঠিয়ে কেবিনের এক পাশে ধরীতার কাছে বসে আছে সে। এর মধ্যে ধরীতা ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েছে। ধরীতার ঘুমানোর সময় সিয়াম রাণীর খোঁজ নিল। রাণী আগের চেয়ে ভালো আছে। আরেকটু ট্রিটমেন্ট করলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে।

ধরীতা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে চোখ টেনে তাকাল৷ সিয়ামকে পাশে দেখে লজ্জিত গলায় বলল

“আপনার প্রতি আমার অনেক রাগ ছিল। বারবার বুদ্ধি করছিলাম আপনাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়।”

কথাটা আর বাড়াতে পারল না ধরীতা, সিয়ামের খিলখিল হাসির শব্দে। সিয়াম খিলখিল করে হেসে জবাব দিল

“আপনি আমাকে শায়েস্তা করতে কেন চাচ্ছেন? আপনার কোন পাঁকা ধানে আমি মই দিয়েছি শুনি? ”

“আপনার অনেক কথায় আমি অপমানবোধ করেছি। আর সেজন্য ভেবেছিলাম আপনাকে শাস্তি দিব।”

“তা এখন কী ভাবছেন? শাস্তি দিবেন নাকি মত পাল্টেছেন?।”

“এখন মনে হলো আপনি মানুষটা খারাপ না। তাই শাস্তি মাফ করে দিয়েছি। ”

“যাক বেঁচে গেলাম। আচ্ছা আপনি আপনার বাবাকে ঘৃনা কেন করেন? আর সেদিন সবাইকে দেখলাম আপনার বাবাকে দেখলাম না। তিনি কোথায়?”

“আমেরিকায় তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে স্যাটেল আছেন। আমার জন্মের পরপরই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে আমেরিকা চলে যায়। এরপর আর আমাদের খোঁজ নেয় নি। নানার অনেক সম্পত্তি থাকলেও সে সম্পত্তি মাকে দিয়ে গেলেও সেগুলো যেন আমি আর মা ভোগ করতে না পারি তাই মামা বাধ্য হয়ে আমাদের তার কাছে রাখেন৷ শাসনের নামে স্বৈরীচারিতা করে বেড়ান। বাবাকে ঘৃনা করি এজন্যই বাবা মায়ের আর আমার দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে নিজের স্বার্থ দেখেছেন। আমার মাকে দেখুন স্বামী থাকা সত্ত্বেও বিধবার মতো আছে। নিজের সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও ভাইয়ের কথায় উঠতে বসতে হচ্ছে। আমার অবস্থানটাও দেখুন কোথায় ঠেকেছে। সারাদিন মামা,মামীর কথা শুনে থাকতে হচ্ছে। ভেতরে চাপা কষ্টগুলো তো কাউকে প্রকাশ করা যায় না। মামা, মামীরা চেয়েছিল বিয়ে দিতে। কোথায় থেকে একেকজন ধরে নিয়ে আসে। যারা মোটেও আমার যোগ্য না। বিয়েতে রাজি না হলে কপালে জুটে কটু কথা। আর যোগ্য ছেলেরা আমার পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে এগিয়ে আসে না। এই যে আমার আর আমার মায়ের এ অবস্থার জন্য কে দায়ী বলুন? উত্তর আসবে বাবা। এজন্যই আমি আমার বাবাকে ভীষণ ঘৃনা করি। আর বাবার প্রতি ঘৃনা থেকেই আমি কোনো পুরুষ মানুষ সহ্য করতে পারি না। তারা স্বামী হিসেবেও পারফেক্ট না,ভাই হিসেবেও না বাবা হিসেবেও না। ”

ধরীতা সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে এক নাগারে কথাগুলো বলে চোখটা বন্ধ করল। সিয়ামের হাতটা আপনাআপনি ধরীতার মাথায় চলে গেল। ধরীতার প্রতি কেন জানি না তার তীব্র অধিকার কাজ করছে। না চাইতেও একটা দুর্বলতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। ধরীতার এলোথালো চুলগুলো হালকা টানতে টানতে বলল

“তাই বলে সবাই খারাপ না। একদিন আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যাব৷ তখন ছেলেদের প্রতি এ ধারণাটা আপনার পাল্টে যাবে। আচ্ছা সকালে কোনো নাস্তা করেছিলেন কী?”

ধরীতা সিয়ামের স্পর্শ পেয়ে স্থির হয়ে শুয়ে আছে। এ স্পর্শে এক অদ্ভূত ভালোবাসার ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে সে৷ সিয়ামের প্রশ্নে মাথা নেড়ে জবাব দিল না। সিয়াম ধরীতার কাছে বসে হালকা গলায় আবার প্রশ্ন করল

“কী খাবেন বলুন। দুপুর হয়ে গিয়েছে।”

ধরীতা সংকোচ ছাড়াই উত্তর দিল

“আমার খুব কাচ্চি খেতে ইচ্ছা করছে।”

এতটা নিঃসংকোচে সে কীভাবে সিয়ামের কাছে আবদার করল জানে না। তবে এখানে সে একটা কমফোর্ট জোন পেয়েছে বলা যায়। সিয়াম মোবাইলটা বের করে খাবার অর্ডার করল। ধরীতার মাথায় হালকা হাতে হাত বুলাতে লাগল। ধরীতা চোখ বন্ধ করে সিয়ামের স্পর্শটা অনুভব করতে করতেই পুনরায় ঘুমিয়ে গেল। শরীরটা দুর্বল তাই তার ঘুমও বেশি হচ্ছে।

বেলা বাজে তিনটা। টানা দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। তবুও চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। মনে চাচ্ছে আরেকটু ঘুমাতে। তবুও চোখের সাথে যুদ্ধ করে চোখ দুটো টেনে খুলল। সাথে সাথে মনে হলো বাইরে থেকে শিরশির করে কোনো শীতল অনুভূতি এসে শির ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। কারণ

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here