ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১১||
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বাসের জন্য দাঁড়াল সাবা। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে ওর। আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েছে এটাই খারাপ লাগার একমাত্র কারণ না। আম্মু তো অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। তবে খারাপ লাগছে এই ভেবে যে পরিবারের এই দুঃসময়ে সে কিছু করতে পারছেনা। এটা যে কতটা কষ্টের তা ভুক্তভোগী মাত্রেই বলতে পারবে। বাবা নেই বলে জীবনের প্রতি পদে পদে কষ্ট সঙ্গী হয়ে থেকেছে সাবার। আত্মীয় স্বজনের দুর্ব্যবহার, বন্ধু বান্ধবদের বক্রোক্তি আর প্রতিবেশীদের বাঁকা চাহনী গা সওয়া হয়ে গেছে। তবু মন্দের ভাল হিসেবে বড় আপা স্বামী পেয়েছে ভাল। বয়স একটু বেশী হলেও বড় মনের মানুষ তিনি। সাবাদের পরিবারের বিভিন্ন প্রয়োজনে বেশ উদার ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। এক আত্মীয়ার ঘটকালিতেই বিয়ে। বাসার কেউ রাজী ছিলনা। একা বড়আপা রাজী হয়ে গেলেন। আজ মনে হয় আপা ভুল করেন নি। আপার খুচরো টাকায় সাবারাও ভালভাবেই উতরে যাচ্ছে। এই তো, একটু আগেও আম্মার চিকিৎসার জন্য বেশ অনেকখানি টাকা দিয়েছে দুলাভাই বড়আপার হাতে।
তবে সায়রার মামার ব্যপারটা এখনও মাথায় আসছেনা সাবার। তিনি ওদের বাসায় কখন এলেন আর আম্মাকেই বা হাসপাতাল পর্যন্ত কেন টেনে আনলেন তা বুঝে আসছেনা। যদিও শিরি বলছে অন্য কথা, ওর মতে মঈন মামা মিলি আপাকে পছন্দ করে। হয়ত বিয়েও করতে চাইবে। শিরির অনুমান কতটুকু ঠিক তা সময়ই বলে দেবে তবে সায়রার সাথে এটা নিয়ে কথা হওয়া দরকার। সায়রার মা’কে যতটুকু চেনে সাবা, তিনি প্রান থাকতে তার ভাইকে এমন পরিবারে বিয়ে করাবেন না যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। দেখা যাক। তবে প্রশ্ন হল, মঈন মামার মত দুর্বল চরিত্রের মানুষকে বিয়ে করলে মিলি আপা কী ভাল থাকতে পারবে !
সাবার চিন্তাজ্বাল বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে হুঁশ করে একটা বাস এসে থামল ওর সামনে। সাবা দ্রুত তাতে উঠে লেডিস সিটে বসে পড়তে উদ্যত হল আর তখনই খেল ধাক্কাটা। ঠিক ধাক্কা না, বরং এটা ইচ্ছাকৃত। লোকটা ভীড়ের সুযোগে সাবার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করতে গিয়েই ধাক্কাটা দিয়েছে। সাবা কড়া চোখে তাকাল। মনে মনে বলল, হারামজাদা। নিশ্চয়ই এতক্ষণে টের পেয়ে গেছিস আমার গায়ে হাত দেবার পরিণতি।
আড়চোখে লোকটাকে দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল সাবা। লোকটা তার অপকর্ম করা হাতটাকে অন্য হাতে চেপে ধরে বারবার ডলে যাচ্ছে। সম্ভবত তার হাত ছিলে গেছে। সায়রার বুদ্ধি এটা। ওই শিখিয়েছিল, তুই অন্তত বাইরে যাবার সময় বোরকা পড়ে নিবি তাহলে নিজেকে পুরো কভার করে রাখতে পারবি আর অতি অবশ্যই বুকের চারপাশের হিজাবে পিন গেঁথে রাখবি যেন কেউ অন্যায় সুযোগ নিতে এলে খোঁচা খেয়ে সরে যায়। সেভাবেই মোট পাঁচটা পিন গেঁথেছে সাবা। যেখানে যেখানে প্রয়োজন মনে করেছে সেখানেই জায়গামত পিন গেঁথে রেখেছে। অবস্থা এমন হয়েছে পিনের জ্বালায় অনেকেই ওর গা ঘেঁষেও দাঁড়াতে পারছেনা। একজন মহিলাতো বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল, এখানে পিন দেয় মানুষ। দেখেন তো হাতটা ছিলে গেল।”
-” স্যরি, আপা। নাথিং টু ডু।” উদাস কণ্ঠে কথাটা বলেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সাবা।
====
সায়রা কাঁদছে। হাপুস নয়নে। কারণ ওর আব্বু ফিরেছেন। তিনি ফেরার ঘন্টাখানেক পরই নীলিমাও তার নালিশের ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন। এখন নালিশ সালিশ শেষে বাপ-মেয়ের আবেগঘন পুনর্মিলনী পর্ব চলছে। আমির সানা মেয়ের কান্নাভেজা চোখে চুমু খেয়ে বলেন, ” রোতে নাহি মেরি বেটি। রোইয়ে মাত। বলেন, আপনার কী ইচ্ছা ? দার্জিলিং যেতে চান না, এই তো ?”
-” চাই। তবে থাকতে চাই না বেড়িয়ে চলে আসব ।” বাপের কাঁধে মাথা রেখে বলল সায়রা।
-” আচ্ছা, এটা নাহয় গেল আর বারসাত এর ব্যপারটা কী করবেন ? মানা করে দেবেন ? ”
-” বারসাত কে ? ”
-” আপনার রুৎবা খালামনির দেবরের ছেলে। গতকালই সে তার মা’ আর ছোট বোনকে নিয়ে ঢাকায় এসেছে। দুদিন থাকবে তারপর চলে যাবে। ”
-” আমি তার ব্যপারে এখনও কিছু জানি না আব্বু। ” আদুরে সুর সায়রার কণ্ঠে।
-” জানেন না তো জেনে নেন। বুলাউঁ…?”
-” না না। আমি এখন কারো সাথে কথা বলব না। দেখা করবো না।”
-” আচ্ছা, আপনি এখন ঘরে যান আমি আপনার আম্মির সাথে কথা বলি।”
বাপের গালে চুমু দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যেতেই নীলিমা ফোঁস করে উঠলেন, ” এটা কোন ধরণের শাসন হল ? তোমাকে আমি বললাম মেয়েটাকে একটু শাসন করে আর তুমি উল্টো ওকে মাথায় তুললে।”
-” আরে এত অস্থির হচ্ছো কেন। আরমানদের ব্যপারটায় ওর মন এখন খারাপ আছে। তবে আরমানের ব্যপারে ওকে শক্ত হতে দেখে আমি খুশি। আমার মনে হয় আরমানের চেয়ে বারাসাতরা ভাল হবে ওর জন্য।”
-” তোমার মেয়ে কী শিলিগুঁড়ি গিয়ে থাকতে রাজী হবে ? ”
-” দেখা যাক না। বারাসাতের সাথে ওর পরিচয় হোক। জান পেহচান হলে তখন বোঝা যাবে। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই।”
-” তুমি তো বলবেই। তােমার মেয়ের যন্ত্রনায় আমার রাতের ঘুম হারাম হবার যোগাড়। সমানে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। যাদের ফেরাচ্ছি তারাই মুখ কালো করে ফেলছে। এভাবে ওকে বেশীদিন রাখা যাবে ঘরে ? তার উপর তোমার মেয়েটাকে বলে যদি নিকাব করাতে পারলাম। বোরকাই তো পরে স্টাইলিশ। ওভাবে পর্দা হয় ? মুন্নী বাজিতো ফেসবুকে ওর ছবি দেখে সেই করাচি থেকে শাসাচ্ছেন আমাকে। বলে, এত সুন্দর মেয়েটাকে এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার জন্য ছেড়ে রেখেছিস নীলি। কপালে দুঃখ আছে তোর।”
-” মুন্নীবাজির কথা বাদ দাও। আমার মেয়ে বয়সের হিসাবে যথেষ্টই পর্দা করে, তাছাড়া ও বাচ্চা মানুষ। ওকে জোর করলে তো হবে না, বোঝাতে হবে।”।
-” তুমি বোঝাতে থাকো। আমি পারবো না।” নীলিমা উঠে গেলেন।
-” আচ্ছা, সে দেখা যাবে। মঈনের খবর কী বলতো ? আসার পর থেকে ওকে দেখলাম না।”
-” কী জানি। ‘ বাইরে যাচ্ছি ‘ বলে তো বিকাল থেকে গায়েব। কোথায় গেছে কে জানে।”
=====
-” শরৎচন্দ্রের মেজদিদি পড়েছেন ? ”
মোহাম্মদপুরের একটা নার্সিং হোমের তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল দুজনে। মিলির চোখে রাত জাগার ক্লান্তি। ইচ্ছে হচ্ছিল মঈনকে বলে, ‘ আপনি এখন যান। পরে নাহয় আসবেন। আমি এখন মায়ের পাশের খাটটায় ঘুমাব।’ কিন্তু বলতে পারল না। লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ সে। ঐ সময় মঈন ঘরে না থাকলে কীভাবে কী করত কে জানে। মঈন নিজেই ছোটাছুটি করে ট্যাক্সিক্যাব এনেছে। আম্মাকে তুলে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছে। তারপরেই না ফোনে খবর পেয়ে বড়আপা দুলাভাই আর বাকিরা ছুটে এসেছে। দুলাভাই অবশ্য এরই মধ্যে ইঙ্গিতে বলে গেছে, ভালোই তো জুটাইছিস। হাতছাড়া করিস না। তোর জন্য দেখলাম দিওয়ানা মাস্তানা। মিলি কোন জবাব দেয়নি। সে এখনও জানেনা। ওর কাছে মঈনের প্রয়োজনটা আসল কী।
-” কই, বললেন না? ” মঈনের ডাকে সম্বিত ফিরল মিলির।
-” কী বলব ? ”
-” মেজদিদি পড়েছেন কী না? ”
-” ওহ্, হ্যাঁ পড়েছি। ”
-” আমার জীবনে মেজদিদি উপন্যসের সৎদিদি হলেন নীলিমা আপা।” হালকা গলায় বলে দুরে তাকিয়ে রইল মঈন।
রাতের ঢাকা মিটিমিটি জ্বলছে। মিলি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে মঈনের দিকে। মঈন এক শব্দে বুঝিয়ে দিয়েছে সায়রাদের বাসায় ওর অবস্থান কোথায়।
চলবে.