ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১৮||
সাত সকালেই আরেকটা দুঃসংবাদ। দুঃসংবাদগুলোর ধরণই বুঝি এমন। এরা যখন আসে একা আসেনা। দলবেঁধে আসে। একজন আসা ধরলে তার পেছন পেছন বাকিগুলোও আসতে থাকে। সায়রা বেলাতেও ব্যতিক্রম হয়নি। একটু আগেই বারসাত ফোনে জানাল সে আজ যেতে পারবে না। তার গাড়ী কাল রাতে নষ্ট হয়ে গেছে। তার আরেকটা গাড়ী নেই। আর থাকলেও তাতে করে লং ড্রাইভে যাবার মত দুঃসাহস নাকি সে করত না। তার এই গাড়ীটা নাকি তার পক্ষীরাজ ঘোড়ার মত ছিল। এরে ছাড়া উনি সহজে নড়েন চড়েন না। খবরটা শোনামাত্রই সায়রার পুরোনো সত্ত্বা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাকে দার্জিলিং যেতেই হবে। উড়ে হলেও। কথাটা বারসাতকে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যেন জানত সায়রা এই কথা বলবে। উত্তরটা তাই ঠোঁটে ঝোলানোই ছিল।
” আম্মা প্লেন ভ্রমনে কমফোর্ট না সায়রা। ওনার এক্রোফোবিয়া আছে। ”
সায়রার মাথা সেই তখন থেকেই গরম হয়ে আছে। নীলিমা কয়েকবারই মেয়েকে দেখে গেছেন। হয়ত সায়রাকে এত নীর্লিপ্ত দেখে তিনি অভ্যস্ত নন। সায়রা নড়াচড়া না করে একজায়গায় বসে আছে এটা তার জন্য ভীতিকর একটা ব্যপার। টুকটাক কথা বলে মেয়ের মুড বোঝার চেষ্টা করলেন। মেজাজের তল ছুঁতে পারেন নি। সায়রা আজও সুবোধ বালিকাই আছে। যদিও মাথায় চলছে চিন্তার ঝড়। আজ দার্জিলিং রওনা দিতেই হবে। কিন্তু কীভাবে সায়রা জানেনা। বারসাত একমাত্র উপায় কিন্তু সেই উপায়ও গন কেস। সায়রা ভেতরটা অস্থির হয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের ফোন তুলল।
-” আস্সালামুআলাইকুম।”
-” ওয়াআলাইকুমুস্সালাম। ”
-” ইয়ে, আজ আট তারিখ, কাল নয় তারিখ।”
-” জি, পরশু দশ তারিখ তারপরের দিন এগার তারিখ।”
-” না মানে, নয় তারিখটা আমার আর রুৎবা খালামনির জন্য স্পেশাল।”
-” তো ? ”
-” আমার দার্জিলিং যাওয়া জরুরী।”
বারসাত এবার নিরব হয়ে গেল। সায়রাও চুপ। কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর বারসাত বলতে বাধ্য হল, ” হোয়াই মি ? আপনার মা’কে বলুন।”
-” আপনি তো দু একদিনের মধ্যে ঐদিকে যাবেনই। বাড়ি আপনার।”
-” তা তো যাবই। প্রতি দু তিন মাসেই যেতে হয়। সেটার সাথে এটার সম্পর্ক কী ? ”
-” আমাকে যে করেই হোক কালকের মধ্যে দার্জিলিং থাকতে হবে।”
-” এবার কিন্তু আপনিই ছেলেমানুষি করছেন সায়রা। আমার সমস্যা আমি আপনাকে বলেছি।”
-” আমরা প্লেন বা গাড়ী ছাড়াও তো যেতে পারি।”
-” হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমার এত হাঁটার ইচ্ছে নেই। তাছাড়া হেঁটে গেলে আমাদের মাসখানেক বা তার বেশী সময় লাগবে। আমার আবার পরশু..!”
-” আপনি আসলেই একটা অভদ্র !” ঠাস করে ফোনটা স্ক্রাডলে রাখল সায়রা।
দুপুরে ভাত খেল না ঠিকমত। তোয়া ফোন করে জানতে চেয়েছিল ওর যাত্রা সম্পর্কে। সায়রা জানিয়ে দিয়েছে ওর আজ দার্জিলিং যাওয়া হচ্ছে না। শুনে তোয়া ওকে বাসায় ডেকেছিল। সায়রা তাতেও অমত প্রকাশ করে বলেছে, সে আজ কোথাও যাবেনা। ওর মনটা আজ খুব খারাপ। খুব খুব খারাপ।
=====
শিরি নতুন কোচিং এ ভর্তি হয়েছে। যদিও এরকম কথা ছিলনা। কোচিং এ পড়াবার সামর্থ ওর পরিবারের নেই। বড়বোন সুরমা কে বলতে গিয়ে একগাদা লেকচার শুনে এসেছে। শোন্, লেখাপড়ায় মন থাকলে কোচিং লাগেনা। রিক্সাওয়ালার ছেলেরা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় কেমন করে। ওরা তো কোচিং করার পয়সা পায়না। হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। এই যে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের ডঃ আতিয়ার রহমান। ওনার জীবনী জানিস ? শিরি আতিয়ার রহমানের জীবনী শোনার জন্য দাঁড়ায়নি। চলে এসেছে মুখ কালো করে। সংসারের সিংহভাগ খরচ সুরমা আপা টানে। সে এরকম কথা বললে সেটা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। কিন্তু নাইনে ওঠার পর কমার্স নিয়ে মহা মুসিবতেই পড়েছে শিরি। হিসাব বিজ্ঞান, ফিন্যান্স ব্যাঙ্কিং এর কিছুই বোঝে না সে। যে খরচের ভয়ে সাইন্স নেয়নি সেই খরচ তো কমার্সেও। টিচার ছাড়া এসবে পাশ করা কীভাবে সম্ভব শিরির মাথায় ঢোকেনা। সামনেই হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। অথচ হিসাব-বিজ্ঞানের কিছুই এগোনো হয়নি। চিন্তায় মাথার চুল পাকার দশা হয়েছে শিরির।
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। রাতের রান্না করার জন্য রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল সাবা। আম্মু অসুস্থ হবার পর থেকে রাতের রান্নাবান্না ওকেই করতে হচ্ছে। সুরামা আপা থাকতে এলে রান্নাটা সে’ই করে। মিলি আপা আগে করত। ইদানীং সে একটা কাজে হাত দিয়েছে। রঙবেরঙের কাপড় কিনে এনে তাতে ব্লক বাটিক টাইডাই করে অনলাইনে বিক্রি করা। সারাদিন যেমন তেমন সন্ধ্যার পর সে নিজের ঘরে বসে বেচাকেনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ফলে রাতের রান্না খাওয়া অলিখিত ভাবে সাবার উপর এসে পড়েছে। তবে রাতের ঝামেলা সবসময়ই কম। মিলি আপা দিনে যা রান্না করে রাতে সেটাই গরম করতে হয় আর দুই পট চাল ফোটাতে হয়। কোনদিন তরকারী না থাকলে দুটা ডিম ভাজো আর ঘন করে ডাল রান্না করো, ব্যস। এগুলো করতে সাবার আধাঘন্টার বেশী সময় লাগেনা। এমনিতেও সে ছোটখাট কাজে সময় নষ্ট করতে রাজি না। সন্ধ্যেটা সে পড়াশোনাতেই কাটাতে ইচ্ছুক। কিছুদিন পরেই এস এস সি পরীক্ষা। ভালমত পরীক্ষা দিতে না পারলে ভাল কলেজে চান্স মিলবেনা বোঝে সাবা। ওর স্বপ্ন তখন স্বপ্নই থেকে যাবে।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখল শিরি মন খারাপ করে রুটি সেঁকছে আর থেকে ওড়নায় চোখ মুছছে। সাবা প্রথমটায় পাত্তা দিল না। শিরির অভ্যাস আছে কারণে অকারণে কাঁদার। ও নাটক দেখেও কাঁদে, সিনেমা দেখেও কাঁদে। কনটেস্টে প্রতিযোগীদের আবেগঘন বক্তব্য শুনেও খুশিতে চোখ মোছে আবার ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশকে হারতে দেখলেও কেঁদে কেঁদে কেটে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। সেই শিরি একা একা চোখ মুছবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তবু সাবা না জিজ্ঞেস করে পারলো না।
-” কাঁদছিস কেন ? ”
-” এমনিই।”
-” ও আচ্ছা।” বলে চলেই আসছিল। আর তখনই শিরি কেঁদেকেটে জানাল ওর কান্নার রহস্য। সব শুনে ভেবেচিন্তে সাবা বলেছিল ‘দু’একদিন পরে জানাব’। দু একদিন না ঠিক পাঁচদিন পর সাবা নিজে ওকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছে এই কোচিংটাতে। তিনমাসের প্যাকেজ কোর্স। টাকা এককালীন দিতে হবে। প্রথম মাসে ফ্রি ক্লাস। সাবা প্রথমেই বলে দিয়েছে, এক মাস ক্লাস করে দেখ। ভাল বুঝলে ভর্তি করিয়ে দেব। টাকার জন্য ভাবিসনা। যেভাবে পারি ম্যানেজ করব। সেই থেকে শিরি নিয়মিত কোচিং এ যাচ্ছে। এক মাস গেলে তারপর বোঝা যাবে এখানে পড়ার ফায়দা কী। তবে শিরি আগেই বুঝে ফেলেছে। হিসাব বিজ্ঞানের তিনটা ক্লাস করার পরই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেভাবেই হোক সে এই কোচিংয়েই পড়বে। তাতে ফায়দা হোক বা না হোক। কারণ পলাশ স্যারকে একদিন না দেখে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না। তারচেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল।
======
সন্ধ্যের মুখেই নীলিমা জানালেন বারসাত গ্রীন লাইনের চারটা টিকিট যোগাড় করেছে। সায়রাকে তৈরী হয়ে থাকতে বলেছে। রাত নয়টায় বাস ছাড়বে।
নির্বিকারে কথাটা শুনলেও মনের ভেতরের উত্তেজনাকে দমিয়ে রাখতে পারলো না সায়রা। আম্মু বেরিয়ে যেতেই সে ছোঁ মেরে ফোন তুলে নিল। বারসাতকে কল দিল।
-” শুনলাম বাসে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ? ”
-” লাক্সারী বাস। আশকরি সমস্যা হবেনা। আম্মা শ্রাবনী দুজনেই বাসে অভ্যস্ত।”
-” আপনি অভ্যস্ত নন তাই তো ? ”
-” আমার কথা ছাড়ুন। আপনি রাত সাড়ে আটটার মধ্যে সব গুছিয়ে মঈন মামার সাথে কল্যানপুর চলে আসবেন। আন্টিকে সব বলে দিয়েছি।”
-” হঠাৎ এত ঝামেলা মাথা পেতে নেবার কারণ? ”
-” আম্মা নিজেই বাড়ী যাবার জন্য অস্থির। ভেবে দেখলাম আপনার প্রয়োজনটাও অগ্রাহ্য করার মত না। শ্রাবনীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। ব্যস্ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল। চারটা টিকিট কিনেছি। আপনি আমি আম্মা শ্রাবনী।”
-” অনেক ধন্যবাদ।”
-” মেনশন নট। ধন্যবাদের কিছু নেই এখানে। তারপরেও দিতে চাইলে শ্রাবনীকে দেবেন।ওই জোর করল, রাখছি।”
ফোন রেখে তৈরী হল সায়রা। কয়েকদিনের জন্য পর্যাপ্ত কাপড় গুছিয়ে নিতে হবে। আব্বুর সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে রাখল। আমির সানা অবশ্য খুব খুশি। মেয়ে বারসাতের সাথে ভিড়েছে। কেবল নীলিমাই মেয়ের আচরণে চিন্তিত। তিনি মনে মনে একটা বড় ঝড়ের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। চাইলেই এ ঝড় এড়ানো যেত। কিন্তু তাতে লাভ কী। ঝড় যেহেতু আসবেই সেটা এখন আসলে যা পরে আসলেও তা। তারচে এখনই আসুক।
শান্ত মুখেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে উঠল সায়রা। মঈন আছে ওর সাথে। ইচ্ছে আছে সায়রাকে বাসে তুলে দিয়ে একটু মিলির ওখানে যাবে। মেয়েটা আজকাল ওর সাথে ঠিকমত কথা বলেনা। বিয়ে শাদীর কথা বলতে গেলেই অপমানজনক ভাবে বলে ওঠে, আগে যথেষ্ট বড় হন। তারপর বিয়ে করতে আসবেন। শুনে খারাপ লাগলেও চুপ থাকে মঈন। রাগ তো হয়ই না বরং মিলিকে কাছে পাবার নেশাটা আরো বেশী করে চাপে তখন। কিন্তু মেয়েটা বড় শক্ত। এত শক্ত কেন কে জানে। সহজে মুচকিও হাসতে চায়না। বললে বলে, আমার হাসির দাম আছে।
=====
সায়রাদের বাস ছাড়ল ঠিক সাড়ে নয়টায়। কল্যানপুর থেকে বুড়িমারী। সারারাতের টানা জার্ণি। মাঝে কোথাও বিশ্রামের জন্য থামবে কিনা জানেনা সায়রা। জানার ইচ্ছেও নেই। বাসা থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত নিয়েই বেরিয়েছে। সায়রা এমনিতেও জার্ণিতে অভ্যস্ত। বাসে ওর কোন সমস্যা হয়না। সে তুলনায় বারসাতকে মনমরা দেখাচ্ছে। ঐ বেচারা বাসে উঠেই নিজের সিটে বসে ঘুম দেবার আয়োজন করছে। তবে শ্রাবনী আর পেয়ারী আন্টি অনেক বেশী সপ্রতিভ। শ্রাবনী বসেছে সায়রার পাশের সিটে। পেছনে বারসাত আর ওর মা পেয়ারী মির্জা।
রওনা দেবার আগে ওদের সবাইকে নাস্তার ছোট্ট প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হলেও সায়রা তা গ্রহনে অস্বীকৃতি জানাল। পাউরুটি সে এমনিতেই পছন্দ করেনা। তার উপর সেদ্ধ ডিম খেয়ে মুখ গন্ধ করার প্রশ্নই ওঠেনা। দেখা গেল বারসাতেরও একই অবস্থা। সেও তার নাস্তার প্যাকেট দান করে দিয়েছে। বাসে ওঠার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট তিনটা কথা বলেছে সে। ‘সব ঠিকআছে তো ?’ ‘আর কিছু লাগবে ?’ ‘রাতে দরকার পড়লে আমাকে ডাকবেন’। সায়রার মন মানসিকতা আগের মত নেই নইলে এই তৃতীয় বাক্যটা নিয়ে লোকটাকে ইচ্ছামত বিব্রত করা যেত। কিন্তু সায়রা আজ নিজেই বিব্রত। যে তার জন্ম বৃত্তান্ত জানতে আজ ছুটে চলেছে দার্জিলিং এর দিকে।
==
বুড়িমারী পৌঁছুতে সকাল সাতটা বাজল। সায়রা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। শ্রাবনীর ধাক্কায় ঘুম ছুটে গেল ওর। বাস থেমে গেছে। এসিও বন্ধ করে রেখেছে। বেশীর ভাগ যাত্রীকেই দেখা গেল বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে। সায়রা নেমে এল। ওর পেছনে শ্রাবনী। তবে বারসাতকে দেখা যাচ্ছেনা। পেয়ারী আন্টিও নেই। তারমানে মা ছেলে আশেপাশেই কোথাও আছে। জায়গাটা ভাল করে দেখার জন্য বেরোল সায়রা। তবে কোন বিশেষত্ব নজরে এলোনা। আর দশটা বাসস্ট্যান্ড যেমন হয় তেমনই। আশেপাশে দুচারটা দেবদারু যদিও দেখা যাচ্ছে তবে বেশীর ভাগই ন্যাড়া।
-” গরম লাগছে।” কপালে টিস্যু চেপে শ্রাবনী বলল।” তোমার লাগছে না? ”
সায়রা তাকিয়ে হাসল। ” হিজাবের পুরোনো অভ্যাস তো। চট করে গরম লাগেনা।”
-” চলো বুড়িতে ঢুকি।”
-” বুড়ি? ”
-” এখানকার প্রাচীন হোটেল। ”
-” তোমার ভাইয়া কোথায়? দেখছিনা যে ? ”
-” মনে হয় ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। বর্ডার ক্রসিং এর পেপার্স ঠিক করতে গেছে। ”
-” কতক্ষণ লাগবে জানো ? ”
-” কেন, তোমার কী তাকে দরকার ? আমাকে বলতে পারো।”
-” না, তেমন কিছু না। ঐ ট্রাকগুলো কিসের ? ” অদুরে দাঁড়ানো সারি সারি ট্রাক দেখে জিজ্ঞেস করল সায়রা।
-” এটা বলতে পারিনা। এসো তো। হোটেলে যাই। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেব।”
পনের মিনিটের মাথাতেই বারসাতের দেখা মিলল। শ্রাবনীই প্রথমে জানতে চাইল, “আম্মি কাঁহা? ”
-” কেন, আমি তো কাউন্টারেই বসিয়ে রেখে গেলাম। দাঁড়া দেখছি।” বারসাত চলে গেলে সায়রা শ্রাবনীকে জিজ্ঞেস করল, ” তোমরা কয় ভাই বোন? ”
-” বাহ্, সিভি না দেখেই ? ”
-” সিভি ? ”
-” কারিকুলাম ভিটা। তোমার আম্মু চেয়ে নিয়েছিলেন।”
-” আমি দেখিনি। সত্যিই।” বলতে গিয়ে কিছুটা লজ্জিত বোধ করল সায়রা। প্রথমবারের মত। মনে পড়ল, বারসাতের সাথে ওর পরিচয়ের সূত্র। লোকটা ওর পাণীপ্রার্থী। আর তার পরিবারের সাথেই ভ্রমণে বেরিয়েছে। মানে কী ? সায়রা কে রাজী বলে ধরে নেবে ওর মা বোন। বারসাত কী ভাবছে সেটা নাহয় বাদই থাকল। ” সায়রা বাইরে তাকাল।
-“এক ভাই এক বোন। মানে ভাইয়া আর আমি।”
-” ওহ্। ”
-” তোমার নিশ্চয়ই খুব পছন্দ হয়েছে আমার ভাইয়াকে ? ”
-” উম ? ” প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল সায়রা। ইতোমধ্যে বারসাত আর পেয়ারী আন্টি চলে আসায় আলোচনা ধামাচাপা পড়ে গেল। চারজন মুখোমখি বসতে গিয়ে এই প্রথমবার বারসাতকে সামনা সামনি ভাল করে দেখার সুযোগ হল সায়রার। সেদিনের হুলুস্থুল সন্ধ্যায় আর চলমান গাড়ীতে অস্থির মেজাজে লোকটাকে দেখার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। আজ প্রথম সকালের এই সোনালী রোদে একেবারেই অন্যরকম দেখাচ্ছে লোকটাকে। যথেষ্ট লম্বা আর একহারা গড়ন। শরীরের কোথাও বাড়তি মেদ নেই। চাপদাড়ীর কারণেই কিনা কে জানে গায়ের রঙের হলদে আভা রীতিমত বিকিরণ ঘটাচ্ছে। নিজের দুধে আলতা গায়ের রং নিয়ে একটা আলাদা গর্ব ছিল সায়রার। আজ বারসাতের সামনে নিজেকে কালোই মনে হচ্ছে।
-” এখন আমরা কোথায় যাব ভাইয়া ? “শ্রাবনী তাকাল ভাইয়ের দিকে।
-” শিলিগুঁড়ি রেস্ট হাউজ। ”
-” ঘুম হয়ে যাবে ? ”
-” না, অনেক ঘুরপথ হয়ে যায় ওটা। কেন ? ঘুমে কী আছে ? ”
-” কিছুনা। দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। তিতলীতে দেখেছি। অসাধারণ।”
-” আজ না। সাম আদার ডে। আজ দুপুর নাগাদ শিলিগুঁড়িতে না পৌঁছাতে পারলে বিপদে পড়ে যাব।”
-” কিসের বিপদ? ”
-” আছে কিছু। সব কথা বলে বোঝানো যায়না।” বারসাত কথা শেষ করে চায়ে চুমুক দিল। সায়রার দিকে তাকাল। মেয়েটার মুখ একদিনেই শুকিয়ে গেছে। ঘটনা কী। অবশ্য তার তো এখন আরমান নামের ছেলেটার সাথে থাকার কথা ছিল। বিয়েটা হলো না কেন জানা হলো না। আম্মি সাথে আছে নয়ত শ্রাবনী সমস্যা না। জিজ্ঞেস করত বারসাত।
-” এখান পর্যন্তই বাংলাদেশের সীমানা শেষ। এখন আমরা ভারতে ঢুকব। ” সায়রার কথা শুনতে ইচ্ছে করছিল বারসাতের। প্রশ্নটা ওর দিকে তাকিয়েই করল। মেয়েটা রেগে গেলে চোখে মুখে কথা বলে। কিন্তু এ মুহূর্তে সে মুচকি হেসেই রয়ে গেল। জবাব দিল না। সামথিং ইজ রং। বারসাত আবার বলল,
-” শীতের কাপড় এনেছেন? ”
-” এই গরমে শীতের কাপড়? ” না বলে পারল না সায়রা ! ”
-” শিলিগুঁড়িটা পার হলেই বুঝবেন শীতের কামড় কেমন হয়।”
সায়রা সামান্য হাসল, ” শুনেছি রাতে দার্জিলিং ভ্রমণ নিরাপদ না, কথাটা কী সত্যি? ”
-” কে বলেছে? ”
-” না, এমনিই।”
পেয়ারী এতক্ষণে মুখ খুললেন, ” আমি তো কয়েকবার এ পথে গেছি। এমন কিছু তো শুনিনি।’
-” ওহ্, তাহলে আমারই ভুল।”
-” আপনার ট্যাক্সিটা নষ্ট না হলে আমরা ঘুম হয়েই যেতাম।”
-” ট্যাক্সি তো একদিন ঠিক হবে ।” বারসাত চায়ের কাপ সরিয়ে রাখল। শ্রাবনী বলে উঠল,” তখন সায়রাকে নিয়ে ঘুম ঘুরিয়ে আনিস।”
-” যদি সুযোগ আসে।” বারসাত হাসল না।
-” কীরকম সুযোগ? ” সায়রাও ছাড়ার পাত্রী নয়।
-” ধরুন বাবলির মত।” বলে বারসাত শ্যেন দৃষ্টি হেনেই উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে। বিল চুকাতে হবে। ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে। বাসে আর যেতে চাচ্ছেনা। টাকা বেশী লাগুক তবু ট্যাক্সিই বেটার। শ্রাবনী মা’কে নিয়ে বাইরে এল। পেছনে সায়রা। মনে মনে তখনও বাবলি হবার সাধ। কিন্তু আজ না সে বাবলি। আর না অভির জায়গায় বারসাত।
চলবে….