ত্রয়ী পর্ব ১৯

0
673

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১৯||

-” কেমন আছিস রে ? ”
-” এই তো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের ঐদিকে কী অবস্থা ? “পশ্চিমবঙ্গের টান রুৎবার গলায়।
-” আর অবস্থা। মেয়েটা জ্বালিয়ে মারল।”
-” কেন ? আবার কী করল বান্না ? ”
-” কী আর করবে, বিয়ে করবে না বলে ঝামেলা তো বরাবরই পাকাচ্ছে। প্রতিটা পাত্রে তার একটা করে কমপ্লেইন।”
-” আসলে ওর ব্যপারে তোমরা একটু তাড়াহুড়াই করে ফেলেছ। আর কিছুদিন পরেই নাহয় দিতে। ওর স্কুল সার্টিফিকেটটা হয়ে যেতো। একেবারে কাঁচা বয়স তো..।” সায়রার পক্ষ নিলেন রুতবা। তাতেই জ্বলে উঠলেন নীলিমা।
-” কাজ তো আর কাঁচা না। ঐটা তো ঠিকই পাকা করছে। আরমানের মা সেদিন সুযোগ পেয়ে একগাদা কথা শোনাল।”
-” কোন আরমানের মা ? ”
-” আরে লালাম্মার ননদের ছেলে। সায়রার জন্য বিয়ের প্রস্তাব তো লালাম্মাই প্রথম আনল। বানীদের বিয়ের দিন সায়রাকে দেখেই ননদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আমি তো প্রথমে রাজীই ছিলাম না। আরমান এখনও স্ট্যাবলিশড না। যদিও পড়াশোনা ভাল। তাতে কী। মেয়ে তো আমার ফেলনা না।”
-” আরমানকে তো তোমার মেয়েই মানা করল। ”
-” সেটাই তো রাগ লাগে। মানা করে এখন আবার আরমানের জন্য লাফাচ্ছে।”
-” শোনো, আপা। সায়রাকে তুমি আমার এখানে পাঠিয়ে দাও। বুঝিয়ে সুঝিয়ে বারসাতের সাথে কলেমা পড়িয়ে দেব। বারসাতরা রয়াল ফ্যামিলি। তাছাড়া আরমানরা বাংলাদেশে থাকে বলে তোমাদের ইতিবৃত্ত জানে। বারসাতরা কালেভদ্রে বাংলাদেশে আসে। তোমাদের পাস্ট নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নাই। আর বিয়েটা একবার হয়ে গেলে তখন এসব জানলেই বা কী।”
-” হম, আমি তো তোকে ফোন করলামই এ কারণে। বহু ঝামেলা করে গতরাতে সায়রাকে পাঠিয়েছি। রাত বেশী হয়ে গিয়েছিল বলে ফোন দেইনি। এখন সকালে দিলাম।”
-” বলো কী ? ” রুতবার কণ্ঠে বিস্ময়। “বান্না দার্জিলিং আসছে ? ”
-” এত অবাক হবার কী হল ? গত এক হপ্তা ধরে তো রোজই যাই যাচ্ছি করছে। যাওয়া আর হচ্ছে না। তুই তো সবই জানিস। ”
-” জানি তো, কিন্তু তুমি যে গতকাল রাতে পাঠাবে আমাকে একটু ফোন করবে তো। আমি তখনই সতর্ক করে দিতাম।”
-” সতর্ক করে দিতাম মানে ? ”
-” আরে গত পরশু থেকে আমাদের এখানে তুমুল মারামারি। ছাত্ররা স্ট্রাইক করেছে। গাড়ী ভাঙচুর চলছে। শহরে দাঙ্গা পুলিশ নেমেছে। পরিস্থিতি কতদিনে স্বাভাবিক হয় জানি না। শিলিগুঁড়ির ট্রেনও বন্ধ। ওরা এদিকে আসবে কোন পথে ? কেন, তোমরা নিউজ দেখোনি ? ”
নীলিমা অস্থির বোধ করলেন। তার মেয়েটাকে এই বিপদের মুখে ঠেলে পাঠিয়েছেন তিনি নিজেই। অবশ্য সে একা নেই, পুরো একটা পরিবার আছে। তারপরেও।”
-” হায় আল্লাহ, কী করি এখন ? ফোনও তো করতে পারবোনা। নইলে ফোন করে কথা বলতাম।”
-” এত ঘাবড়িও না আপা। বারসাত আছে সাথে। কিচ্ছু হবেনা ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া বান্না একা নেই। পেয়ারী বাজি আর শ্রাবনী হ্যায় না উসকে সাথ।”
-” তবু, মন ঘাবড়াচ্ছে। আমিরকে জানাব ? ”
-” কী দরকার আপা ? খামোকা দুলাভাই এর টেনশন বেড়ে যাবে। কাজের কাজ তো কিছুই হবেনা। আর এসব স্ট্রাইক ফ্রাইক হঠাৎ শুরু হয় আবার হঠাৎই থেমে যায়। পুলিশ যখন নেমেছে পরিস্থিতি কন্ট্রোলে চলে আসবেই। ততক্ষণের জন্য ওদের কোন হোটেলে উঠতে হবে হয়ত। তাছাড়া বারসাত শিলিগুড়ির ছেলে, ও পথঘাট চেনে। ও জানে কোথায় কী করতে হবে। তুমি এবার শান্ত হও। ”
-” আল্লাহ ভরসা।” নীলিমার কণ্ঠের উদ্বেগ এখনও কমেনি। রুৎবা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ বদলালো, ” আচ্ছা, আরমানের মায়ের কথা কী যেন বলছিলে তখন ? ”
-” দুর, বাদ দে। অসভ্য মহিলা। বলে কী না, বাপের মেয়ে বাপের মতই হয়েছে। আমার ছেলের মাথা খেয়েছে। ভাবতে পারিস কত জঘন্য কথা ? আচ্ছা সায়রা কী আসলেই ইকবালের মত ? ”
-” আপা তুমিও যেমন । উনি বললেন বলেই হয়ে গেল নাকি। সায়রা এতটা বেপরোয়া হয়েছে সানা ভাইয়ের আদরে। শাসন করেনও নাই, আর করতেও দেন নি।”
-” তারপরেও রু। আমার ভয় হয়। সায়রার মধ্যে ইকবালের স্বভাব প্রকট। জেনেটিক একটা ব্যপার থাকেনা ! ”
-” আপা, এবার কিন্তু তুমিই বাজে বকছ। কিছু মনে করোনা , যদি রক্তের দোষই হয়ে থাকে তাহলে তুমিও তো একই কাতারে পড়ে যাচ্ছ। ইকবাল সানা লম্পট হতে পারে তবে সেদিন তালি এক হাতে বাজেনি, তাকে সমর্থন করার কারণে তুমিও সমান দোষে দোষী ছিলে।”
-” ইকবাল জবরদস্তী করেছিল আমার সাথে।”
-” এবং সেটা তুমি মেনে নিয়েছিলে। অস্বীকার করোনা আপা, তুমি নিজেও দুর্বল ছিলে। আজ যদিও দোষ ইকবালের ঘাড়ে।”
-” তুই আমার বোন হয়ে…!”
-” আমি বান্নার খালা হয়ে কথা বলছি। কারণ তুমি ওকে পেট থেকে ফেললেও বান্না আমার কাছে মানুষ হয়েছে। তুমি তো তখন কয়েক মাস আধাপাগলই হয়েছিলে ইকবালের অমন আচমকা মৃত্যুতে। শেষ পর্যন্ত আমির ভাই তোমাকে বাঁচাল। একমাত্র সেই জানত তোমাদের বিয়ে হয়নি কিন্তু সায়রার দাদীকে গিয়ে জানাল তোমরা একা বিয়ে করেছিল কিন্তু ইকবাল জানানোর সময় পায়নি। তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে তোমাকে তুলে নিল। যদিও ইকবাল সানার ইচ্ছে ছিলো না। আমির ভাইয়ের চাপেই বাধ্য হয়েছিল সে। কারণ আমির ভাই সম্পত্তি বে-দখলের ভয় দেখিয়েছিল।”
-” তাতে আমার কোন লাভ হয়নি রু। ইকবালের বেল্টের দাগ এখনও আমার বুকে-পিঠে ঘা করে রেখেছে। তোর কথা সত্যি, আমির ভাইয়ের সাপোর্ট না থাকলে সায়রার দাদী আমাকে কোনদিনও মেনে নিতেন কিনা সন্দেহ আছে।”
-” সেটাই। তাহলে বান্নাকে অযথা দোষারোপ করছ কেন ! ” নীলিমা নিরব রইলেন। রুৎবা মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন, ” সায়রার বেপরোয়া আচরণের কারণ তোমার অকারণ জোর করে করা কিছু দুঃশাসন। তুমি হয়ত ভেবেছ, এভাবে ও ভাল থাকবে। এটা আসলে ভুল। বান্না নিজেই আমাকে বলেছে। ও তোমাকে টেক্কা দিতে চায়। একটা জেদ কাজ করে ওর ভেতর। তাই তোমার ওকে বকাঝকা না করে বরং বোঝানো উচিত। কোন সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে ওকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখানো উচিত ছিল।”
-” আচ্ছা, আমি রাখি।” থমথমে সুরে বললেন নীলিমা।
-” শোনো, আপা। আমার উপর রাগ করো না। আমি তোমাকে ছোট করতে চেয়ে কথাগুলো বলিনি। তুমি বান্নাকে নিয়ে চিন্তিত কারণ সে ইকবাল ভাইয়ের রক্ত। আমি তোমাকে শুধু মনে করিয়ে দিলাম সে তোমারও গর্ভজাত। তোমার প্রভাবও ওর ওপর আছে। অযথা মেয়েটাকে এভাবে দোষী বানানোর মানে হয়না। বাবা মায়ের প্রভাব তার সন্তানের উপর পড়বেই। তা যেভাবেই হোক। আজকের সায়রা একদিনের নীলিমা। এ তো আমার নিজের চোখে দেখা। কাজেই ওকে একা দোষী করা ঠিক না। ওর আজকের এই অবস্থার জন্য তোমরা দুজনেই দায়ী। ”
-” সায়রাকে কিছু বললেই তুই আমার দিকে আঙ্গুল তুলিস কেন বলতো ? ওর মা আমি।”
-“উঁহু, জন্মদাত্রী। ওর মা তো আমি। বান্না আমার কোলেপিঠে মানুষ। ভুলে যাও কেন আপা ? বান্নাকে আমার চে বেশী তুমি চেনো না। যাক বাদ দাও। বান্নার খোঁজ লাগাচ্ছি আমি। তুমি টেনশন করোনা।” বলে ফোন রেখে দিল রুৎবা।
ফোন রেখে নীলিমা একভাবে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। চোখের সামনে ছায়াছবির দৃশ্যের মত ভেসে উঠল সেই দিনগুলি। যেদিন তিনি আর ইকবাল ছিলেন দৃশ্যত হংসমিথুন। দুরসম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হত। সেখান থেকেই পরিচয় তারপরে প্রণয়। পরিণয়ে বাধা পড়ার আগেই অপরিণামদর্শিতার পরিণতি। নীলিমা নিজের দুর্দশা জানানোর জন্য ইকবালের কাছে গিয়েছিলেন। জুটেছে প্রত্যাখ্যান আর অপমান। আমির সানার চাপাচাপিতে নীলিমাকে মেনে নিতে রাজী হলেও একটি দিনের জন্য নীলিমা স্ত্রী’র মর্যাদা পাননি। তার সেসব দিনের দুর্দশার সাক্ষী ছিল আমির সানা যে বড় ভাইয়ের অপকর্ম রুখতে বহুচেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। তারপরই হঠাৎ একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইকবাল মারা গেল । নীলিমা সেদিন আধাপাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিল ইকবালের শোকে। আসলে তা ছিল নিজের ক্রমবিপর্যয়। সেদিন আমির সানা এগিয়ে না এলে আজ নীলিমার মরণ ছিল। বড়সড় দীর্ঘশ্বাস পড়ল নীলিমার। পায়ে পায়ে হেঁটে এলেন নিজের বেডরুমে। আমির সানার পা ছুঁয়ে বসে রইলেন দীর্ঘক্ষণ। তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। ভাবতে চেষ্টা করলেন পৃথিবীতে একই মায়ের গর্ভে কেমন করে একজন মানুষ আরেকজন অমানুষ জন্ম নেয়।

=====

সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে অথচ এখনও শিরির দেখা নেই। সাবার জানামতে ওর কোচিং পাঁচটা বাজেই শেষ হয়ে যায়। এখন পৌণে ছয়টা। অথচ শিরির দেখা নেই। মেয়েটা আসছে না কেন। সাবা অস্থির হয়ে মিলির ঘরে এল। মিলিকে ঘরে পেল না। মনে পড়ল মিলির আজ কাপড় চোপড় আর রং কিনতে বাইরে যাবার কথা। সাবা বারান্দায় এসে রাস্তায় চোখ রাখল। সন্ধ্যা নামছে, রাস্তাও প্রায় ফাঁকা। কথাটা মা’কে বলতেই তিনি ক্ষীণকণ্ঠে বললেন,” ওর নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখ।”
” দিয়েছিলাম মা। ফোন বন্ধ।” আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সাবা আর থাকতে পারল না। বোরকাটা মাথায় গলিয়ে কোনরকম হিজাব বেঁধে বেরিয়ে পড়ল শিরির কোচিং এর দিকে।
শিরি অবশ্য তখন কোচিং এ নেই। পলাশ স্যারের সাথে হাঁটতে হাঁটতে একটা রেস্টুরেন্টে চলে এসেছে। স্যার নিজেই আজ ওকে আইসক্রিম অফার করেছেন। স্যারের মতে পুরো ক্লাসে শিরিকেই নাকি দারুণ বুদ্ধিমতী মনে হয় তার। এত মন দিয়ে পড়া শোনে সে। বরং শিরির ঐ গভির দৃষ্টি পলাশের পাঠদানের উৎসাহ যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। শিরি চাইলে ওকে পারসোনালি পড়া দেখিয়ে দিতেও আপত্তি নেই পলাশের।
রেস্টুরেন্টে বসে দুজনের জন্য দুই স্কুপ আইসক্রিম অর্ডার করল পলাশ। আজ তার জন্মদিন। একটু স্পেশাল হয়ে যাক। শিরি হেসে বলল, আপনার জন্মদিন মনে করে খেলে তো আমাকে আবার গিফট দিতে হবে।”
-” তুমি খুশিমনে যা দেবে তাই নেব। সেটাই হবে আমার গিফট। সব গিফট তো কিনে দেয়া যায় না।”
কথাটা শোনার পরই চিন্তায় পড়ে গেছল শিরি। সত্যিই তো, কী গিফট দেয়া যায় স্যারকে। স্যার অবশ্য বলেছে, যা খুশি। এই যা খুশিটা কী। কিনতেও তো টাকা লাগে। টাকাই তো নেই শিরির কাছে।
পলাশ মুচকি মুচকি হাসছে ওর টেনশন দেখে। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা ওকে কিছু একটা দেবার জন্য অস্থির। পলাশের এখন উচিত, সুযোগমত সেটা নিয়ে ফেলা। সেধে দিচ্ছে সে , চাইতে তো যায়নি।”
হঠাৎ শিরি কে অপেক্ষা করতে বলে বাইরে এল পলাশ। ফোন দিল কোন এক বন্ধুর নম্বরে। রঁদেভু ফিট করল। তারপরই নিজের জায়গায় গিয়ে বসে হাসল, ” কই, আমার গিফট ? ”
-” আজ তো হাতে টাকা নেই ভাইয়া। কাল দেই ? ”
-” আরে তুমি নিজেই একটা রত্ন। তোমার আবার টাকা লাগে। জাস্ট সে ইয়েস।”
-” ই…!” বলার আগেই থেমে গিয়ে বাকিটুকু গিলে ফেলল শিরি। ঘর্মাক্ত কলেবরে সাবা এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে। থমথমে মুখে বলল, ” তুই এখানে কী করছিস ? আমি তোর কোচিং হয়ে এলাম। এটা কী তোর কোচিং ? ”
-” না, মানে ? ”
-” এই আইসক্রিম কেনার পয়সা কে দিয়েছে ? ” পলাশ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত নিজেকে শিক্ষকের ইমেজে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল,” ইয়ে এক্সকিউজ মি। আপনি কী ওর বড়বোন।? ”
সাবা রুঢ় স্বরে বলে উঠল, ” তার আগে বলুন। আপনি ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন ? ”
-” আমি তো ওকে এখানে আনিনি। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে…!”
-” প্লিজ, শিক্ষকতা করতে এসে পেশাটাকে এভাবে নষ্ট করবেন না। ছাত্রীকে নিয়ে রেস্তোরাতে বসে আইসক্রিম খাওয়াটা কতটুকু ভদ্রতার সেটা আমি জানতে চাই। আমি কালই কোচিং এ কমপ্লেইন করব আপনার নামে৷ ” ঝামেলা বাড়ার আগেই শিরির হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে এল সাবা। শিরিকে এখানে কিছু বলার মানে নেই। এমনিতেই লোকজনের কৌতুহল বাড়ছে। ওকে যা বলার বাড়ি গিয়ে বলবে। তবে সে নিজে বলবে না, বলাবে মিলি আপাকে দিয়ে। কথার আগে যার হাত চলে।
===

আজ কলকাতার পত্রিকাগুলোতে ফ্রন্টপেজ দখল করে আছে ধর্মঘটের খবর। ট্যাক্সিভাড়া করতে গিয়েই চোখে পড়ল সেটা। বারসাত প্রথমটায় ব্যপারটাকে গুরুত্ব না দিলেও ওদের নেপালী ড্রাইভার জানাল শিলিগুঁড়িতে হেভি গ্যাঞ্জাম হচ্ছে।
-” হঠাৎ আবার কী হলো? ” বারসাতের কপালে ভাঁজ পড়ল।” আমার তো ওখান দিয়েই যেতে হবে।” বলেই মায়ের দিকে তাকাল। ” কেয়া কারে আম্মি?” পেয়ারী মির্জা ছেলের দিকে তাকালে। কী বলবেন ভেবে পেলেন না।
গাড়ী জলপাইগুঁড়ি এসে থামলে নেপালী ছেলেটা জানাল , এরপর সে আর সামনে এগোতে পারবেনা”। বারসাত খানিক ভেবে বলল, ” কী করা যায় বলো তো ?”
– আজ তো সব উল্টাপাল্টা সাব। আপনাকে শিলিগুঁড়ি যেতে হলে কাঞ্চনজঙ্ঘার ট্রেন ধরতে হবে। ঐদিকে আপাতত কোন ট্যাক্সি যেতে রাজী হবে না। এটা আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ বাকিটা আপনি যা ভালো বোঝেন। ” হিন্দীতে বলল নেপালী।
ছেলেটার কথা শোনার পর বারসাত নিজেও দারুণ কনফিউজড হয়ে পড়ল। গাড়ী ছেড়ে দিতে হল ওকে। আম্মাকে আর সায়রাকে একটা রেস্টুরেন্টে বসিয়ে শ্রাবনীকে আলাদা ডেকে আলাপ করল ব্যপারটা ।
শ্রাবনী বলল, “উপায় না থাকলে ট্রেনেই যাব। সমস্যা কী।”
বারসাত ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইঙ্গিতে মা’কে দেখালে শ্রাবনী হেসে ফেলে বলল, ” আম্মাও আজ অমত করবে বলে মনে হয় না। তোর হবুবধুকে খুব পছন্দ করেছে। দেখিসনা কেমন আড্ডায় মেতেছে ।”
-” হম, তাই তো দেখছি। এত কী বলছে আম্মা? ”
-” আবার কী ? বিয়ের সময়কার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছে। সায়রাও আগ্রহ নিয়ে শুনছে। ও তোর বউ হলে আম্মার সাথে জমবে ভাল। দুজনই গল্পবাজ। ” শ্রাবণীর বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল বারসাত। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, ” নাহ্, ব্যপারটা এত সহজ না। ”
-” কোন ব্যপারটা? ”
-” সায়রা মেয়েটা আরমানকে পছন্দ করে। বিয়েও করতে চেয়েছিল। ছেলেটাকেও আমি কাছ থেকে দেখেছি। সায়রার সমপরিমাণ আগ্রহ ওর মধ্যে ছিল না। অথচ সায়রা মেয়েটা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। এখানে ব্যপারটা প্রেমঘটিত যে নয় তাতে সন্দেহ নেই। ঠিক একইভাবে ওর মনে যদি আমার জন্যেও যথেষ্ট জায়গা না থাকে তাহলে অমন সৌন্দর্য আমি দুর থেকে দেখার ভুলও করব না। আমাকে জানতে হবে সায়রার মনে কী চলছে।”
-” ক্লাস টেনের একটা মেয়ের মন তার আবার স্টেশন। ভাইয়া তুইও না।”
-” ক্লাস টেন বলেই তো ভয়। আমি অপেক্ষা করতে রাজি তবু ভুল ট্রেনে উঠতে রাজী না। পরে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেবে। ”
-” হম, বুঝলাম। এবার দয়া করে কাঞ্চনজঙ্ঘার ট্রেনটা ধর। নইল রাতটা পথেই কাটাতে হবে। ”

নিউ জলপাইগুঁড়ি স্টেশন পর্যন্ত আসার পর ওরা শুনল আজ আর কোন ট্রেন শিলিগুঁড়ি জংশন যাবেনা। শিলিগুঁড়ি যেতে হলে মিনিবাস বা রিক্সা। বারসাত ভাবছিল কী করবে। এমন সময় একজন জানালো আজ বাসও বন্ধ। বারসাত একা একাই মাথা নাড়ল। রিক্সায় করে যাবার কথা অন্তত বারসাত ভাবতে পারছেনা। আবারও শ্রাবনীর দিকে তাকাল। ওর চেহারা নির্বিকার। বারসাতের দিকে তাকিয়ে হালকা কাঁধ ঝাঁকাল সে। এই মেয়ের ধারাই এমন। টেনশন ওকে ছুঁতে পারেনা। বারসাত নিজেও এত টেনশন করত না যদিনা ওর সাথে মা আর ঐ মেয়েটা থাকত। দু হাত কোমড়ে রেখে নিচের ঠোঁট দিয়ে উপরের ঠোঁটে চেপে ধরে গাল ফুলিয়ে ভাবতে বসল বারাসাত। ঘাড় ফিরিয়ে চারপাশে তাকাল। স্টেশন প্রায় ফাঁকা। চড়া রৌদ্র বলেই কিনা কে জানে লোকজন অনেক কম। যারা জলপাইগুঁড়ির দিক থেকে এসেছে তারা যে যার মত বাহন খুঁজে নিয়ে সরে পড়ছে। যদিও শিলিগুঁড়ির হট্টগোল এদিকে এসে পৌঁছায়নি কিন্তু তার প্রভাব পড়েছে।
বারসাত ট্যাক্সিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। একটু আগেই যার ট্যাক্সিতে করে এসেছে সেই নেপালি ছেলেটাকে ধরল শিলিগুঁড়ি যাবার জন্য। নেপালী মাথা নাড়ল, ” নাই সাব। মেরা এরিয়া ইঁয়েহি খাতাম।” ছেলেটা চোস্ত হিন্দীতে বলে চলল,” তবে বাহাদুর নামে একজন আছে যে প্রায়ই এখান থেকে টাইগার হিলে যায়। বারসাত চাইলে সে তাকে বলে দেখতে পারে।”
অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব। বারসাত খুশি চেপে নেপালির কাঁধে হাত দিলল যেন বহু দিনের পুরোনো ইয়ার দোস্ত। হিন্দীতেই বলতে লাগল, ” তোমার নামটা যেন কী ? ”
-” জি, আমার নাম বীর।”
-” বীর। তুমি নিজ দায়িত্বে একটু বাহাদুরকে খুঁজে নিয়ে আসো। ও যদি আমাকে টাইগার হিল পর্যন্ত নিয়ে যায় তো আমি দু হাজার রুপি দিতেও রাজী আছি। তোমার দু’শো আলাদা।”
নেপালী মাথা চুলকে বলল, ” কিন্তু রাত্রে দার্জিলিং যাওয়া রিস্কি দাদা। পাহাড়ী এলাকা। তিন আওরাত হ্যায় আপকে সাথ।” বারসাত ভাবনায় পড়ল।
নেপালী ছেলেটা এবার ‘এক মিনিট’ বলে সময় চেয়ে উধাও হয়ে গেল। বারসাত ততক্ষণে নিজের ফোনে সিম বদলে স্থানীয় সিম চালু করল। ওর পরিচিত এক ড্রাইভারের কথা মনে পড়েছে। ওকে এখন ফোন দিয়ে দেখবে । ওকে পেয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। পাহাড়ী হোক কী মেঠো পথ। এই পাহাড়ের রাণীর দেশে ওর ড্রাইভিং এ জুড়ি নেই তবে হ্যাঁ, গাড়ী যত ভালই পেয়ে যাক না কেন। আজ রাতে দার্জিলিং রওনা দেবার কথা ভাবতে পারছে না বারসাত। প্রয়োজনে রাতটা শিলিগুঁড়িতেই কোথাও কাটিয়ে নেবে। এই দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যে ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবেনা।
ভাবতে ভাবতেই ভাঙাচোরা রেস্টুরেন্টটার ভেতরে চলে এল বারসাত। যেখানে ওদের ছোট্ট খোপগুলোতে বসে কথা বলছিল আম্মা শ্রাবনী আর সায়রা। আম্মার কী একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে। চোখের পাতার চিরল চিরল পাপড়ী গুলোতে কাঞ্চনজঙ্ঘার জমাট বাঁধা মেঘ। যেন এখুনি বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। বারসাতের হঠাৎ মনে হল, দাঙ্গা আসলে শিলিগুঁড়িতে না,ওর বুকের শহরে বেঁধেছে। নিমেষেই লুটপাট হয়ে যাচ্ছে ওর এতদিনের আগলে রাখা সংযম। জোর করে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকাল। না জানি আর কত পরীক্ষা দিতে হবে সামনে যেতে যেতে।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here