ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২০||
রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। দু’ধারে চা বাগান। চারপাশের নিঃসাড় নির্জনতা অনন্তে ছড়িয়ে গেছে। গাড়ীতে বসে থাকা পাঁচজন মানুষই চুপচাপ। কেউ কোন কথা বলছেনা ওরা। রাত্রের অন্ধকারের বিষাদ যেন ওদেরকেও গ্রাস করেছে। গাড়ী ছুটে চলেছে শিলিগুঁড়ি ছেড়ে শুকনার দিকে। ঝুঁকি নেয়নি বারসাত। দুটো ঘটনা ঘটেছিল ওদের সাথে। পরিচিত ছেলেটাকে পেয়ে যাওয়া আর একইসাথে কোন ভাল হোটেলে রুম না পাওয়া। যে দুটো হোটেলে রুম পেয়েছিল ওগুলোতে থাকার মত অবস্থা ছিল না। একমাত্র উপায় বলতে পরিচিত মারাঠি ছেলেটা। নাম রজনীকান্ত। বছর পঁচিশের মত বয়স। তুখোড় ড্রাইভার। বহুবার ওর গাড়ীতে আসা যাওয়া করেছে বারসাত। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় কারণে হোটেলের ঝুপড়ি কামরার বদলে এই চলন্ত কামরাটাকেই বেছে নিয়েছে বারসাত। সাথে পাইলট গতির একজন নেপালী ড্রাইভার।
গাড়ী ছুটছিল জেট প্লেন এর গতিতে। রজনীকান্ত কোন হর্ণ দিচ্ছিল না। বারসাত একবার বলেছিল বাঁকগুলোতে হর্ণ দিতে। রজনীকান্ত জানাল, দরকার নেই। এসময় সাধারণত উল্টোপাশ থেকে কেউ আসেনা। যারা আসে তাদের হেডলাইট দুর থেকেই দেখা যায়। বারসাত আর তর্ক করেনি। তাছাড়া এমনিতেই জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে নাজেহাল অবস্থা। মারামারির কারণে আজ পুলিশী তৎপরতাটা একটু বেশীই। ধর্মঘটের কারণে পাহাড়া আরো জোরদার। চেকিং এর ধরণ দেখে সায়রাকে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওকে চোখের চাউনিতে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছিল বারসাত।
গাড়ী এখন দার্জিলিং অভিমুখে ছুটছে। মাঝেমধ্যেই চা বাগান সরে গিয়ে একপাশে খাড়া পাহাড় এসে যাচ্ছে, যার অপরপাশে খাদ। কোথাও কোথাও এর খাড়াই হাজার ফিট নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যখান দিয়ে অনায়াসে এঁকেবেঁকে চলেছে গাড়ী। যেন প্রতিটা মোচড় মুখস্ত। রাত নেমে গেছে। পাহাড়ে রাত নামে তাড়াতাড়ি। দ্রুত সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে ফেলছে।
বারসাত ঘাড় ফেরাল। শ্রাবনী আর মা’কে দেখল চোখ বুঁজে পড়ে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। পাশেই সায়রা ঠোঁটে হাত চেপে বসে আছে। জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। অথচ বাইরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। বারসাত বলবেনা ভেবেও বলে ফেলল, ” ঘুম আসছে না ? ” সায়রা তাকাল। তার আগেই রজনীকান্ত বলে উঠল, ” এই তো আর আধাঘন্টা। কার্শিয়াং পেরুলেই ঘুম। ওখানে গিয়ে টয় ট্রেন পেয়ে যাবেন অনায়াসে। তারপর সোজা দার্জিলিং শহর। তিন ঘন্টার মামলা।”
বরাসাত হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। তবে সায়রা দ্রুত মুখে হিজাব চাপা দিল। ওটা হাসি চাপার লক্ষণ। বারসাতকে রজনীকান্তের দিকে মনোযোগ বাড়াতেই হল। বিস্মিত হয়ে বলল, ” টয় ট্রেনে যাব মানে ? তুমি আমাদের নিয়ে দার্জিলিং যাচ্ছো না ? ”
-” না, স্যার। আমি অতদুর যাবো না। শহর থেকে আমাকে ফিরতে হলে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে। এসময় ট্যুরিস্ট পাবো না। তাই আমি ঘুম থেকেই ব্যাক করব।”
বারসাতের হঠাত রাগ হয়ে গেল,” সেকথা আগে বললে না কেন। আমি বীরকে বাদ দিয়ে তোমাকে নিলাম। তাহলে তো বীরকেই নিতে পারতাম। ও শহর পর্যন্ত নিয়ে যেত।”
-” মাফ করবেন সাব। আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছি টাইগার হিলে সূর্য ওঠা দেখবেন। তাছাড়া ঘুম স্টেশনের কাছাকাছি এখন ভাল ট্যুরিস্ট লজ হয়েছে। ওখানে নেমে গেলেও কোন অসুবিধায় পড়তে হবে না আপানাকে। ওখান থেকে টাইগার হিলে অনায়াসে হেঁটে যাওয়া যায়।”
-” আশ্চর্য, টাইগার হিলে সানরাইজ দেখব এমনটা তোমাকে বলেছি বলে তো মনে পড়ছেনা। ”
-” সাব আপনি খামোকা রাগ করছেন। বীরও দার্জিলিং পর্যন্ত যেতে পারত না। ওকেও ঘুম থেকেই ব্যাক করতে হত। কারণ আজকের পরিস্থিতি অন্য দিনের মত নয়, দেখছেনই তো। ”
-” তা তো বুঝলাম। এখন ঘুম এ যদি রুম না পাই তো ?”
-” পাবেন সাব। না পেলেও সমস্যা হবেনা। অাগে চলুন যাই।”
=====
রাত কত হয়েছে বোঝা যাচ্ছেনা। গাড়ীর শোঁ শোঁ শব্দ আর বাতাসের ছটফটানি ছাড়া কোন শব্দ নেই। অনেকক্ষণ এক ভাবে বসে থাকতে গিয়ে তন্দ্রামত এসে গিয়েছিল সায়রার। আচমকা মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম ছুটে গেল। চোখ মেলেই শ্রাবনীকে দেখতে পেল। ওর বাহুতে হাত রেখে ডাকছে। ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসল সায়রা। কখন চোখটা লেগে গেছে আর ওরা এ পর্যন্ত চলে এসেছে টেরই পায়নি। শ্রাবনীকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। ঠিক তখনই অনুভব করল তলপেটের হালকা চাপটা। কিছুটা অসহায় চোখেই শ্রাবলীর দিকে তাকাল। মেয়েটা ওর ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই বকবক করছে।
-” ভাইয়াটা না একদম বেরসিক। এখনও দার্জিলিং যাবার জন্য এটা ওটা খুঁজছে। আমি তো কাল বিকেলের আগে এখান থেকে এক পা নড়ছি না। ঘুম এ যখন এসেই পড়েছি ঘুমকে যায়েঙ্গে। ” সায়রা ওকে নিজের প্রয়োজনের কথাটা বলতেই যাচ্ছিল এমন সময় বাইরে তাকাতেই মনটা শান্ত হয়ে গেল। ঘুমের ঘোরে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি যে ওদের গাড়ীটা একটা হোটেল কম্পাউন্ডে এসে দাঁড়িয়েছে। তারমানে বাথরুমও পাওয়া যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিছু না বলে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেমে পড়ল সায়রা। চারপাশ ধোঁয়াটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। কেবল পেতলের ফলকে জ্বলজ্বলে সাইনবোর্ডে হোটেলের নামটা ছাড়া। ওটার ওপর আলাদা করে আলো ফেলা হয়েছে।
সায়রা ওর দুহাত বোরকার পকেটে গুঁজে আস্তে করে বেরিয়ে এল গাড়ী থেকে। পাহাড়ী হাওয়া রীতিমত হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সায়রা চারপাশে তাকাল। পেয়ারী আন্টি আর বারসাতকে দেখা যাচ্ছেনা। ওরা দুজন সম্ভবত ভেতরে গিয়েছে। শ্রাবনী এখনও গাড়ীর ডিকিতে ব্যস্ত। বেচারী শীতে কাঁপছে। সায়রা নিজেও কম শীতকাতুরে নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর চেতনা অনেকটাই অসাঢ় ভূমিকায় আছে। প্রথম কারণটা মানসিক। আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার। তারপরেই জীবনের সবচেয়ে বড় একটা সত্য ওকে গিলে খাবার জন্য হা করে আছে। হয়ত ঐ সত্যটা জানার পর সায়রা আর আগের মত ডানা মেলতে পারবেনা। হয়ত নিজেকে নিয়ে আর আগের মত স্বপ্নও দেখতে পারবে না। তবু অন্তত জানতে পারবে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয়টা শারিরীক অস্বস্তি। বাথরুম যাওয়াটা জরুরী হয়ে পড়েছে।
শ্রাবনীর পিছু পিছু হোটেলের ভেতর ঢুকে যাবার পর বারসাতকে দেখল। রিসেপশনে কথা বলছে। দারুণ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে লোকটাকে। নিজভূমে স্বর্গবাস বলে কী যেন একটা কথা আছে না। বারসাত তার উজ্জ্বল উদাহরণ। সে এখন নিজভূমে। ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বদলে গেছে। পেয়ারী আন্টিকে দেখা গেল তিনি একটা সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। সায়রা হেঁটে গিয়ে তারপাশে বসল। ওকে দেখে হাসলেন পেয়ারী।
-” শীত বেশী লাগছে ? ”
-” একটু..!” সামান্য লজ্জিত স্বরে বলল সায়রা। আসল কারণটা বলতে লজ্জা লাগছে। পেয়ারী উৎসাহের সাথে বলতে লেগেছেন।
-” এই জায়গাটাই এমন। অনেক উঁচুতে বলে শীতের প্রকোপ বেশী। পৃথিবীর সবচে উঁচু স্টেশন এই ঘুম রেলস্টেশন।” সায়রা মাথা নাড়ল, ” জি, জানি।” পেয়ারী আঙ্গুল তুললেন, “ওপাশে মল আছে। ওখানে গরম কাপড় বিক্রি করে। শীতের কাপড় চোপড় যথেষ্ট না থাকলে এখান থেকে কিনে নিতে পারো।”
-“ওহ্ তাই নাকি ? ” সায়রা বেশ উৎসাহিত হতে গিয়েও কী ভেবে কিছুটা দমে গেল। পেয়ারী হেসে ফেললেন। শ্রাবনীকে ইশারা করলেন। শ্রাবনী কাছে এলে ওকে বললেন সায়রাকে মলে নিয়ে যেতে। অবশেষে সায়রার শারিরীক অস্বস্তি দুর হল। শ্রাবনীর সাথে এবার সোজা মলে চলে এল সে। মলটা চমৎকার। খুব বড়সড় না হলেও সুন্দর আর গোছানো। অনেক ধরণের শাল আছে এখানে। সায়রা দেখেশুনে চমৎকার তিনটা শাল কিনে ফেলল। আসার আগে আব্বু বেশ কিছু ডলার ধরিয়ে দিয়েছিলেন যেন সায়রা তার প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে। সায়রা একই রকম তিনটা শাল কিনে একটা শ্রাবনী আরেকটা পেয়ারী আন্টিকে গিফট করলে শ্রাবনী কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে বসল, ” হবু ননদ আর শ্বাশুড়িকে তো গিফট করলে। হবু জামাই বেচারা কী দোষ করল বলো তো।”
সায়রা চোখ পাকিয়ে তাকালে শ্রাবনী হেসে বলল, ” আসলে আমার ভাই খুব অন্যরকম একজন মানুষ। বেচারা নিজেকে বেঁধে রেখেছে তার বউ এর জন্য। আমি চাই বারসাত ভাইয়া যেন তার বউয়ের পূর্ণ মনোযোগটা পায়। ”
-” শ্রাবনী। আমি এখনও তার বউ হইনি।”
-” হয়ে যাও। দেরী করছ কেন ? ” শ্রাবনীর অকপট উত্তর।
-” কারণ আমি এখনও তাকে জানি না। ” সায়রা আসলে বলতে চেয়েছিল যে আমি এখনও নিজেকেই জানিনা। কিন্তু শ্রাবণীকে বলতে শুনল, ” সমস্যা কী। আজই জেনে নাও। প্রথম রাঙা প্রভাতে। টাইগার হিলের বরাতে। সূর্যোদয়ের উসিলাতে।”
-” মানে ? ” সায়রা না জিজ্ঞেস করে পারলো না।
-” মানে খুব সহজ। এখন বাজে রাত দুইটা। আর দু আড়াই ঘন্টা পর আমরা টাইগার হিলে যাব। এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। টাইগার হিলে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সানরাইজ দেখব। তারপর তিনজনে মিলে নাস্তা করব আর পুরো ঘুম ঘুরব।”
-” এত লম্বা জার্নির পর আন্টি রাজী হবেন? ”
-” একদম না। সেকারণেই তো আম্মা থাকবে হোটেলে। আমরা তিনজন বেড়াব। ভাইয়া অবশ্য চট করে রাজী হতে চাইবেনা কিন্তু ওকে রাজী করাতে হবে। চলো।”
-” উনি কী সবসময়ই এরকম ? ”
-” কীরকম ? ” হোটেলের লবি ধরে হাঁটছিল দুজনে। লিফটের সামনে এসে বাটন চেপে কৌতুহলী চোখে তাকাল শ্রাবণী। সায়রা কিছুটা অস্বস্তির সুরে বলল, ” কনজারভেটিভ?”
-” ভাইয়াকে ঠিক কনজারভেটিভ বলা যাবেনা তবে ও অনেকটা রেস্ট্রিক্টেড টাইপের লোক। মানে যা নিজের তা ছাড়া বাকি বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনা। ও রক্ষণশীল হলে আমাকে জ্বালিয়ে মারত। কিন্তু এখন বুঝিয়ে মারে।” লিফট থামলে দুজনেই তাতে উঠে পড়ল।
=====
রাত দশটা। ঢাকা শহরের মত জায়গায় এটা কোন রাতই না। কিন্তু সাবাদের বাড়ীতে এই রাতের উদ্বিগ্নতা রীতিমত পেরেশান করে রেখেছে। ড্রইংরূমে বৈঠক বসে গেছে। সাবার মা তার বিছানায় শুয়েই কাঁদছেন। মিলি পাথরের মত মুখ করে বসে আছে। সাবা নিজেও পুরো বিকেল শিরির কোচিং, ক্লাসমেট বন্ধুদের বাড়ী ঘুরে এসেছে। শিরিকে কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে একটু আগে মঈন ভাই আর বড় দুলাভাই দুজনেই যাবতীয় খোঁজখবর সেরে এসেছেন। তাদের কাছেই জানা গেছে শিরি ওর টিচার ছেলেটার সাথে পালিয়েছে। শোনা গেছে ওরা নাকি বিয়ে করে ফেলেছে। এবং এই সংবাদটা শিরি নিজেই কিছুক্ষণ আগে মঈনের মোবাইলে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। এরপর মঈন ওকে তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করেছিল কিন্তু শিরি মোবাইল সুইচড অফ করে রেখেছে।
নিরবতা ভেঙে হঠাৎই রেগে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করল সুরমা । সে সাবাকে বকাবকি করছে। ওর মতে সাবা ওকে মাতব্বরী করে কোচিং এ ভর্তি না করালে শিরি এই সুযোগ পেত না। সাবা চুপচাপ। সুরমা আপার কথার কোন প্রতিবাদ করছেনা। একদম স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বাবলু হঠাৎ মাঝখান থেকে বলল, ” আমি ঐ স্যারের বাসা চিনি। ”
মঈন সাথে সাথেই বলল, ” আমাকে নিয়ে যেতে পারবে সেখানে? ”
-” হ্যা, পারব ! ” বাবলুর কথা শেষ হতেই মিলি তেতে উঠল।
-” কী শুরু করেছেন আপনি ? কে বলেছে আপনাকে ঐ ছেলের বাড়ী যেতে ? আমরা বলেছি ? ”
-” তাহলে এভাবে চুপ করে বসে থাকবে ? ”
-” হ্যাঁ, থাকব। আপনাকে এত মাথা ঘামাতে হবেনা। বাড়ী যান। বাড়ী গিয়ে নিজের ব্যপারে চিন্তা করেন। শিরির ব্যপারে আপনাকে ভাবতে হবেনা। ও যেখানে খুশি চলে যাক। জাহান্নামে যাক। ” মিলির গলা ধরে এল বলতে গিয়ে। সুরমার স্বামী মনসুর এবার কথা বলে উঠলেন, ” তোমরা এত উত্তেজিত হয়ো না তো। ওর খবর আমি ঠিকই বের করে ফেলব। চিটাগং গিয়ে কয়দিন থাকবে। পকেটে পয়সা ফুরালে সুড়সুড় করে ঢাকা আসতে বাধ্য তোমার বোন।”
-” আসলে আসুক বা না আসুক। তোমাকে বলে দিচ্ছি। আহ্লাদ দেখিয়ে যদি শিরিকে এ বাড়ীতে ঢোকানোর চেষ্টা করেছ তো তোমার খবর আছে। শিরির কোন জায়গা নেই এখানে। ও নিজের অবস্থান নিজেই নষ্ট করেছে। ওর কোন ক্ষমা নেই।” সুরমা চিৎকার করে উঠল। তাতেই মনসুর চুপ হয়ে গেলেন।
সাবা আস্তে করে উঠে নিজের ঘরে চলে এল। ওর পরপর সুরমাও ঝড়ের বেগে ভেতরে চলে গেলে মনসুর ওর পিছু নিলেন। বাবলু আড়চোখে মিলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সুযোগ বুঝে আস্তে করে কেটে পড়ল। মিলি এখনও একভাবে বসে আছে । ওর যেন কোনদিকে হুঁশই নেই। মঈন এবার উঠে এসে মিলির পাশে বসল।
মৃদুস্বরে বলল,” এত আপসেট হয়ো না প্লিজ। তোমাকে এভাবে দেখতে ভাল লাগছে না আমার।” মিলি হালকা নাক টেনে চোখ মুছতে গিয়ে টের পেল ওর হাত মঈনের হাতে ধরা। আচমকা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে । প্রায় ফোঁস করে উঠে বলল,
– ” আপনি এরকম গায়ের উপর এসে বসেছেন কেন ? আর আমার হাতই বা ধরেছেন কেন ? আবার আমাকে তুমি বলেও ডাকছেন। এত অধিকার আমি কখন দিলাম আপনাকে ? ”
-” স্যরি, মিলি। আমি আসলে…!”
-” চলে যান প্লিজ। আমার এত শুভাকাঙ্খির দরকার নেই। বোন আমার পালিয়েছে আপনার না। বেরিয়ে যান এখান থেকে। যান বলছি।”
-” মিলি প্লিজ। তুমি আমার উপর এত রেগে যাচ্ছ কেন ? ”
-” কারণ আপনি আর শিরির ঐ প্রেমিক দুজনই একই কাতারের মানুষ। প্রেম করার ভান ধরতে আপনারা ওস্তাদ। কিন্তু সামাজিক ভাবে মূল্যায়ন দেবার সময় আপনাদের গলা শুকিয়ে যায়। আমার দরকার নেই আপনার মত খাতিরের লোকের। আমার বোনের ব্যপার আমি বুঝব। যান বলছি।”
-” তুমি একথা বলতে পারলে মিলি ? ”
-” হ্যাঁ, পারলাম। আপনি বেরোন। তারপর দেখেন মুখের ওপর দরজাও কেমন করে বন্ধ করি।”
-” কী দিয়ে পরীক্ষা নেবে তুমি আমার চাওয়ার ? ”
-” কোন পরীক্ষা নেব না। আপনি চলে যান এখান থেকে। আপনাকে আমার খুব চেনা হয়ে গেছে। আপনি আসুন প্লিজ।”
-” তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো ? ”
-” হ্যাঁ, দিচ্ছি। কারণ আপনার এভাবে আসা যাওয়া দেখেই শিরি উৎসাহিত হয়েছে। ওর মনে হয়েছে বিয়ে না করেও এরকম সম্পর্ক রাখা দোষের কিছু না। আমি ওর বড়বোন। ও তো আমাকে দেখেই শিখবে। আমি আপনাকে বারবার নিষেধ করেছিলাম কিন্তু আপনি শোনেননি। অযথাই আমার দুরবস্থার সুযোগে ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যখনই দায়িত্ব নেবার প্রশ্ন এসেছে তখনই পিঠটান দিয়েছেন। ” মিলি কী বলবে সে নিজেও ভেবে পাচ্ছেনা। মাথার ভেতরটা এলোমেলো লাগছে ওর। হঠাৎ ছটফট করে উঠে ঘরে রওনা দিতে গেলে মঈন খপ করে ওর হাত চেপে ধরল। তাতেই মিলি জ্বলে উঠে তাকাল।
-” হাত ধরেছেন কেন ? ”
মঈন চট করে হাত ছেড়ে দিয়ে স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল,” এই ছেড়ে দিলাম। তবু আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ।” বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মৃদু স্বরে বলল,
– ” তোমার আপত্তি না থাকলে আজ রাতেই আমাদের বিয়ে হতে পারে। ”
মিলি ঠোঁটের কোণে হাসল, ” ও বাবা, তারপর ? ”
-” তারপর তোমাকে নিয়ে নীলিমা আপার কাছে যাব। থাকতে দিলে দেবে নাহলে বেরিয়ে আসব।”
-” বাহ্, গুড। তারপর ? ”
-” আমি ড্রাইভিং জানি মিলি। লেখাপড়াও জানি। একটা না একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারব। ”
মিলি হঠাৎ করেই যেন শান্ত হয়ে গেল। লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” থাক্, আজকেই এত বাহাদুরি দেখাতে হবেনা। আজ এমনিতেই বাড়ীর সবার মন খারাপ।”
-” না মানে, আমি চেয়েছিলাম…!” বলে মঈন থেমে গেলে মিলি তাকাল।
-” কী চেয়েছিলেন ? ”
-” তুমি আর আমি সোজা চট্টগ্রাম চলে যাই ।”
-” কেন, চট্টগ্রামে কী ? ” মিলির দৃষ্টি তীক্ষ্ম হল। মঈন মোবাইল বের করে হাতে নিয়ে বলল, ” শিরি আমাকে ফোনে জানিয়েছে ঐ ছেলের বাড়ী পটিয়া। কাজেই আমরা যদি পটিয়া চলে যাই আর শিরিকে খুঁজে বের করি তাহলে…!” থেমে গেল মঈন।
-” এর জন্য বিয়ে করতে হবে কেন ? ”
-” বাহ্, তুমি এমনি এমনিই নিশ্চয়ই আমার সাথে চট্টগ্রাম যাবেনা।”
মিলি এবার চট করে ওর মুখটা নামিয়ে নিল। লজ্জায় না অস্বস্তিতে বোঝা গেলোনা। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ” না, আমি এমনিতেও চট্টগ্রাম যাব না। শিরি আপনাকে ভুল তথ্যও দিতে পারে। অতিরিক্ত চালাক মেয়েদের গলাতেই আগে দড়ি পড়ে। কাজেই ঐ ঝুঁকিতে আমি যাব না তাছাড়া পটিয়া কোন ছোট জায়গা না। শিরি মিথ্যেও বলতে পারে। আমাদের ধোঁকা দেবার জন্য। ”
-” তাহলে কী আজ আমাদের বিয়ে হবেনা ? ”
-” উফ্, আপনি আজ যান তো। এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলব। আজ বাসায় এসব দেখার পরও একথা মুখে আনছেন কী করে ! “মঈন বড় করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবার।
” আচ্ছা, ঠিকআছে। আজ না হলেও এ সপ্তাহেই কাজ শেষ করব আমি। তোমার কোন বারণ ঐদিন শুনব না। আজ যাচ্ছি।” মঈন বেরিয়ে গেলেও মিলি তাকিয়ে রইল সেদিকে। এমন সময় সাবা পেছন থেকে এসে ডাকল, ” মিলি আপা ? ” মিলি ঘাড় ফেরালে সাবা ক্ষীণ স্বরে বলল, ” শিরি কোথাও যায়নি। ও ঢাকাতেই আছে। ”
=====
ভোর পাঁচটা। টাইগার হিলে বসে আছে ওরা তিনজন। সায়রা শ্রাবনী আর বারসাত। এখনও চারপাশ আবছা অন্ধকার। ওরা যেখানে বসেছে সেখান থেকে সূর্যোদয় পুরোটাই দেখা যাবে। জায়গাটা সেভাবেই বানানো হয়েছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারির মত করে ধাপে ধাপে সিঁড়ি কেটে বানানো হয়েছে দর্শকদের বসার জায়গা। সানরাইজ দেখার চমৎকার ব্যবস্থা। সায়রার হঠাৎ মনে হল এখানে বসেই পুরো দার্জিলিং দেখতে পাচ্ছে সে। খালামনির বাসাটা আসলে কোনদিকে !
হিমালয় থেকে ধেয়ে আসা কনকনে বাতাস হাড় কাঁপিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। সায়রা গুটিশুটি মেরে বসে আছে। কাশ্মিরী শাল গায়ে। মোটা কাপড়ের হিজাবে নাক মুখ ঢেকে রেখেছে। তারপরেও ঠান্ডায় কাবু হয়ে গেছে। ওর এখন কোন কথাও বলতে ইচ্ছে করছেনা। সে তুলনায় বারসাত এবং শ্রাবনী সহজ। শ্রাবণী এখন তার আগেরবারের অভিজ্ঞতা বয়ান করছে। সায়রার হঠাৎ এক পলকের জন্য মনে হল এই শ্রাবনী মেয়েটা ওর চেয়েও বেশি কথা বলে। সে তুলনায় বারসাত একদমই চুপচাপ। আলগা বাহাদুরি বা হামবড়াই ভাব কোনোটাই নেই ওর মধ্যে। ওর নিরবতা ভাল লাগছে সায়রার। শ্রাবনী আরো কিছু বলতে যাবার আগেই সায়রা উপর দিকে মাথা তুলল। ওর কাছে যেন মনে হল অন্ধকারের গাঢ় কালো রংটা সামান্য ফিকে হয়ে গেল। শ্রাবনী সায়রাকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল, ” এখন থেকে ঐ দিগন্তরেখায় তাকিয়ে থাকবে। আগামী বিশ মিনিট। ওখান থেকে ভুলেও চোখ সরাবেনা।”
সায়রা হেসে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। বলা যায় থেমে যেতে বাধ্য হল। কেননা দিগন্তরেখা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতেই পুরো দিগন্তরেখাটা জুড়ে সোনালী রঙের বর্ডার আঁকা হয়ে গেল। এঁকেবেকে কিন্তু চমৎকার। অসাধারণ। সেদিকে তাকিয়ে সায়রার হঠাৎ মনে হল ওদের বাড়িতে কিছু গোল্ডেন বর্ডার দেয়া চিনামাটির প্লেট আছে যেগুলোর কিনারা ঠিক এই দিগন্তরেখার মত। তবে এত উজ্জ্বল না। এটা তো যেন রীতিমত জ্বলছে। আরো দশ মিনিট ধরে দিগন্তরেখার বর্ডার সোনালী হয়েই রইল। এবার ঠিক মাঝ বরাবর এক ঝলকানী দেখা দিল অপূর্ব দ্যুতিতে। ঠিক যেন হিরের আংটির ওপর বসানো পাথর। আংটির বর্ণালীচ্ছটা ক্রমশই বড় হতে লাগল। একইসাথে স্বচ্ছ হতে লাগল পুরো দিগন্তরেখা। ধীরে ধীরে সায়রার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো সম্পূর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়োটা। যেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হল। সায়রা ঠোঁট গোল করে একভাবে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বের হতে যাচ্ছিল, ‘ হোয়াও…! ‘ তার আগেই বারসাতের ভারী স্বরে বাধা দিল।
-” উঁহুঁ….বলুন, মাশাআল্লাহ। মানে আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন। বা আলহামদুলিল্লাহ মানে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। ওয়াও মানে কী ? ”
সায়রা মুখ সামান্য কুঁচকে বারসাতের দিকে তাকাল, ” ঈরে, আমার আম্মাজান এসেছেন ! ”
-” মানে ? ” বারসাতও তাকাল। সায়রা জবাব দিলো না। তাকিয়ে রইল দিগন্ত রেখায়। শ্রাবনী ইতোমধ্যে উঠে গিয়ে পটাপট ছবি তোলা শুরু করেছে।
বারসাত মৃদু স্বরে বলল,” আগেই বোঝা উচিত ছিল। নকল পর্দা।”
-” মানে ? আমি নকল পর্দা করি ? ”
-” সেরকমই তো। পর্দা আগে মনে তারপর শরীরে।”
-” আমার মনে পর্দা নেই বলতে চান ? “সায়রা চাপা স্বরে ঝগড়া করল।
-” নাহ্, আমি চাইব কেন। যা সত্যি বলে মনে হল তাই বললাম। আমি মনগড়া কথা বলতে পারিনা।”
-” আপনি এসব কেন বলছেন আমি জানি। ” সায়রার মাঝে এখন পুরোনো বেপরোয়া ভঙ্গিটা। বারসাত জবাব দিলো না। সে মনোযোগ দিয়ে সূর্য ওঠা দেখছে। আগেও দেখেছে। তবু প্রতিবারই নতুন লাগে। দিগন্তরেখা এখন সোনালী আর সাদায় মাখামাখি। সন্ধ্যায় সাদার জায়গাটা দখল করবে লাল রঙ। সোনালির কমতি হবেনা।
-” আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আরমানের সাথে আমার কোন প্রেম ছিল না। ”
-” বাপরে, প্রেম ছিল না, এমন একজন লোককে বিয়ের জন্য ওভাবে মার্কেটে ছুটে গিয়েছিলেন ? ”
-” আপনি আগাগোড়াই আমাকে ভুল বুঝেছেন।”
-” সঠিকটা বোঝান। যদিও এর দরকার নেই। আপনি আমাকে বলতে বাধ্য নন।”
-” না, তা ঠিকআছে। তবুও আমি বলতে চাই। এটা এজন্য নয় যে আপনার সাথে আমার বিয়ে হতে হবে। এটা এজন্য যে সবটা শোনার পর আপনি নিজেই আর আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না।”
বারসাতে দৃষ্টি ফেরাল, ” এখন চাই কে বলল ? ”
সায়রা বোকার মত তাকিয়ে রইল বারসাতের দিকে। তারপর কী বলবে ভেবে না পেয়ে মুখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ” তাহলে এত কষ্ট করে বাই রোডে এলেন কেন? না করে দিলেই তো পারতেন।”
-” না করিনি কারণ আমার মা। আপনি নন। আমরা সবাই নিজেকে আসলে কমবেশী ইমপর্ট্যান্ট মনে করি সেটা বড় সমস্যা না। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কিছু জিনিস আমাদের জানা থাকা দরকার। যদিও আমরা তা জানতে চাইনা। মুলতঃ আমার বাই রোডে আসতে চাওয়ার পেছনের কারণটা মোটেও আপনি নন , আমার মা ‘ই এখানে মূখ্য। আপনার চাওয়াটা তো বাইচান্সে মিলে গেছে।”
-” তারমানে এখন আপনি বলতে চাচ্ছেন আমার প্রতি আপনার কোন ইন্টারেস্ট নেই? ”
-” কেন আপনার আছে বুঝি ? ” বারসাত সরাসরি জিজ্ঞেস করলে সায়রা থতমত খেয়ে বলল, ” ন্নাহ। তা না।”
-” তাহলে আমার আগ্রহ দিয়ে কী করবেন ? ” বারসাত বলে ফের সামনে তাকালে সায়রা উঠে দাঁড়াল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” হোটেলে ফিরে যাই চলুন।”
-” কেন, সূর্যোদয় দেখা শেষ ? ” বারসাতের কণ্ঠে কৌতুক কিনা বোঝা গেল না। সায়রা চুপ করে রইল। বারসাত এবার হালকা সুরে বলল, ” এভাবে কথায় কথায় রাগ করে নিজেকে হালকা করবেন না। সবাই আপনার জেদ ভাঙাবার দায় নিয়ে বসে নেই। এভাবে কেউ আপনাকে বারবার ক্ষমার চোখেও দেখবেনা। আপনার নিজেকে সংশোধন করা উচিত। এভাবে জীবন চলে না সায়রা। একটা সময় আপনি লোকের হাসির খোরাক হয়ে যাবেন। ”
-” হবো কী হয়ে তো গেছিই।” গলা বুঁজে এল সায়রার। চোখ মুছল।
বারসাত অপ্রস্তুত বোধ করল হঠাৎ। চারপাশে তাকাল, ” কী করছেন। এটা পাবলিক প্লেস। সবাই দেখছে। চোখ মুছুন। প্লিজ।” চাপা স্বরে ধমক দিলে সায়রা ব্যাগ হাতড়াল। বারসাত ওর পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিল সায়রার দিকে। হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিয়ে চোখে চেপে ধরল মেয়েটা। মুহূর্তের জন্য ওর ভেজা চোখ গুলো আশ্রয় নিল এক সদ্য পরিচিতের রুমালে।
চলবে….