ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
৫||
সজীবকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় ওঠার পর রাশেদ ঠিক করল আজ আর কোথাও যাবেনা। সোজা হলেই ফিরে যাবে। খামোকা বাইরে ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। তারচে রুমে ফিরে গিয়ে একটু পড়াশোনা করলেও সেটা কাজে দেবে। ভর্তি পরীক্ষার এমনিতেও আর বেশি দেরী নেই। ভাল মত প্রিপারেশন নিতে না পারলে সব পরিশ্রম জলে যাবে। এ পর্যন্ত আসতে কত কষ্ট যে ওর হয়েছে তা ওই জানে। পরিবারের সমর্থন ছিলনা বললেই চলে। যার কারণে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে।
এস এস সি আর এইচ এস সি’র টপ রেজাল্টের পর একমাত্র আম্মাই ছিলেন যিনি ওর ঢাকায় এসে ডাক্তারী পড়াকে সাপোর্ট করেন। তাঁর বড় আশা যে ছেলে ডাক্তারীতে চান্স পাবে। কিন্তু আব্বা মসজিদের ইমাম। তাঁর এসব দুনিয়াবী প্রত্যাশা কম। তিনি চেয়েছিলেন রাশেদকে তাঁর বড়ছেলের মত মওলানা বানাবেন। কিন্তু রাশেদের মাদ্রাসা লাইনে আগ্রহ কম দেখে আর চাপাচাপি করেন নি। আম্মার কথাতেই সম্মতি দিয়েছেন। অবশ্য রাশেদের রেজাল্ট সেরকম না হলে এপথে পা বাড়ানো অসম্ভবই ছিল। ওগুলোও তাকে কম সাহায্য করেনি। দুটো টপ রেজাল্ট ওকে পুরো গ্রামে সাধারণ থেকে এনে অসাধারণের পর্যায়ে ফেলেছে। ফলে মায়ের উৎসাহ আর মামাদের পরামর্শে বাবা বুঝ নিলেন। মামাদেরও একই কথা, রাশেদ যদি ডাক্তারীতে নাম করতে পারে তো সমস্যা কী। ফ্যামিলিতে এক আধজন ডাক্তার তো দরকার আছে। ধরা যাক, রাত বিরতে হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন কী করবে। নিজেদের একজন ডাক্তার থাকলে তাকে ঘুম থেকে তুলে ডেকে নেয়া যাবে। বাইরের ডাক্তারদের কী সবসময় এভাবে পাওয়া সম্ভব ? এমনতর বহু সুবিধার লোভ দেখিয়ে আব্বাকে রাজী করানো হয়েছিল। রাশেদের ছোটমামা নিজেই উপযাচক হয়ে তার পরিচিত এক ছেলের সিটে ওকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নইলে ওকে এখন মেসের ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকতে হত আর বদনা নিয়ে বাথরুমে লাইন দিতে হত। এবার ভালোয় ভালোয় ভর্তি পরীক্ষাটায় টিকে গেলে রক্ষা। তখন মেডিকেল ডরমিটরীতেই সিট পেয়ে যাবে রাশেদ। আর কয়েকটা দিন কষ্ট করতে হবে এই যা।
রাশেদের সিটের মালিক ছেলেটার ঢাকাতেই নিজেদের বাড়ী আছে। সে হলে থাকেনা কিন্তু তার ভাগের সিটটা সে গোপনে ভাড়ায় খাটিয়ে দুটো পয়সা পায়। হলের অনেকেই এমন করে। এটা এখানে অনেকটা ওপেন সিক্রেট এর মত। তবে মাঝেমধ্যে নিয়ম রক্ষার জন্য ছেলেটাকে হলে এসে থাকতে হয়। যেদিন ছেলেটা থাকতে আসে সেদিন আবার ফ্লোরে ঘুমাতে হয় রাশেদকে ।
অবশ্য ছেলেটা প্রথম দিকে ভদ্রতা করে বলেছিল, ” আরে শীতের রাত। এক পলকে কেটে যাবে। নিচে শোবে কী। আসো দু ভাই এক লেপের তলে ঢুকে রাত পার করে দেই। প্রভোস্ট টেরও পাবে না।” শুনে রাশেদ গম্ভীর স্বরে জানিয়ে দিয়েছিল যে, এমনটা তার ধর্মে নিষেধ আছে। দুজন সাবালক পুরুষ বা নারী একই চাদরের নিচে ঘুমাতে পারবে না। যেমন পারবে না এক বাথরুমে গোসল করতে।”
ছেলেটা বিস্মিত হয়েছিল শুনে। বলেছিল,
-” কেন ? এতে সমস্যা কী ? ভাই ভাই বোন বোন কী শোয় না ? ”
-” না। শুতে পারবে না। কারণ এ জাতীয় অভ্যাসগুলোই অন্তরে সমকামীতার বীজ বপন করে দেয়। বাইরের কেউ চট করে এসে গায়ে হাত দিতে পারেনা। কিন্তু যে তোমার পাশে শোবে তার হাত তোমার স্পর্শকাতর জায়গায় লাগতেই পারে। এতে কামনার উদ্রেক ঘটবে। এটা হারাম।”
-” হম।” বলে ছেলেটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল কথাটা শুনে। তারপর হেসে ফেলে বলেছিল, -” অথচ দেখ, তোমাদের মাদ্রাসাগুলোতে হোমোসেক্সুয়ালিটির সমস্যা অনেক বেশী।”
-” কথাটা কতটুকু সত্য জানিনা। তবে এখানে প্রশ্ন মাদ্রাসা বা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি না। যা নিন্দনীয় তা নিন্দনীয়। প্রশ্ন হল রুলস এন্ড রেগুলেশনস মানার। আর মাদ্রাসার কথা যদি বলো তাহলে বলব, কাপড় যত সাদা দাগ তত স্পষ্ট। মাদ্রাসা ইসলামের শিক্ষাকেন্দ্র বলেই মাদ্রাসার অন্যায়গুলো খুব বেশী হাইলাইটেড। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোর দিকে তাকাও আর দেখো তাদের কী অবস্থা। বাইরের দেশে পারিবারিক সম্পর্কগুলো কতটা ঠুনকো তা খোঁজ নিলেই জানবে। পাশ্চাত্য কালচারে তো ভাই বোন কনসেপ্টটাই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে ওরা।”
ছেলেটা মাথা চুলকে হেসে ফেলেছিল। পাশের সিটের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলেছিল, ” মোল্লা ভাই এর কথা শুনেছ। তাদের সবটাতেই রেস্ট্রিকশন।” বলেই রাশেদের দিকে তাকিয়ে দুষ্টামীর ভঙ্গিতে বলল, ” আমার প্রাইভেট পার্ট চুলকাচ্ছে। ওখানে ছুঁতে পারব তো ? নাকি ওখানে হাত দেয়াও নিষেধ?”
-” ব্যপারটা নিয়ে যতই ফান করো না কেন আজকের দিনে এটা যে কত বড় সমস্যা তা নেট খুললেই দেখতে পাবে। হ্যাঁ, এটাও নিষেধ। তবে প্রয়োজন সাপেক্ষে। বিনা প্রয়োজনে কেউ নিজের লজ্জাস্থানও দেখবে না বা ছোঁবে না। এটাই আদেশ। এখন তুমি যদি এর বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা জানতে চাও তো আমাকে সময় দিতে হবে। কারণ এ ব্যপারে আমি এখনো এতটা পান্ডিত্য অর্জন করিনি যে তর্ক করতে পারব। ”
-” ব্যাখ্যা না জেনেই মেনে নিচ্ছ কথাগুলো? ”
-” অবশ্যই। ব্যখ্যার আশায় থাকব কেন ? সাইন্টিস্টরা নিজেরাই কী শতভাগ কনফার্ম করতে পারেন ? তারাও তো ফলসিফিকেশন টেস্টের ভিত্তিতেই কথা বলেন। তারপর দেখো, তারা আজ একজন যা বলেন কাল আরেকজন এসে তা ভ্রান্ত প্রমান করে দেয়। যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। ইসলামের এমন একটা কথা বলতো। যেটা নবীজি সাঃ একবার বলেছেন আর পরে কেউ তা মিথ্যে প্রমান করেছে ? পারবে ? পারবে না। কারণ তিনি কোনোদিন মনগড়া কোন কথা বলেন নি। তাঁর সব কথা ওহীর ভিত্তিতে বলা। সে কারণেই আমরা তাঁর কথা শোনামাত্রই মানি। ব্যখ্যার অপেক্ষায় থাকিনা। আমরা কেবল এটুকু নিশ্চিত হই যে, ঐ কথাটা আসলেই তিনি বলেছেন কিনা। ব্যস্, এতটুকুই। কারণ তাঁর নাম দিয়ে অনেক ভুল কথাই তো চালানো হতে পারে বা হচ্ছেও। আমাদের কাজ সেসব থেকে সাবধান থাকা। ”
এরপরে ছেলেটা আর কথা বাড়ায়নি। রাশেদও আর তর্ক করেনি। তর্ক জিনিসটা বরাবরই তার অপছন্দ। একান্ত বাধ্য না হলে তর্কে মাতেনা সে।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল রাশেদ। চারটা বাজতে এখনও বিশ মিনিট বাকি। হঠাৎ মত বদলালো। রিতুর রিস্ট ওয়াচটা কেনা দরকার। গত একমাস ধরে ওর ঘড়িটা কিনি কিনি করে কেনা হচ্ছে না। আজ সকালেও ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল বেচারী। ঘড়ি কেনা হয়নাই শুনে মুখভার করে ফেলেছিল। এদিকে বৃহস্পতিবার আসতে আর মাত্র দুদিন বাকি। রাতের ট্রেনেই রওনা দিতে হবে ওকে। এর মধ্যে সময় বের করতে না পারলে এবারও কেনা হবে না। তারচে হাতে যে বাড়তি সময়টা আছে সেটা ঘড়ি কেনার কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। এমনিতেও হাসপাতাল ছেড়ে বেরোনো মুশকিল হয়ে যায়। রাশেদ রিক্সাওয়ালার কাঁধে টোকা দিল।
====
জায়গাটা চমৎকার। টুং টাং শব্দ ছাড়া আর বড় ধরণের কোন শব্দ নেই। অনেকগুলো লোক একসাথে ফিসফিস করলে যেরকম শব্দ হয় ঠিক সেরকম শব্দ হচ্ছে। আবছা আলোয় সায়রাকে রহস্যময় দেখাচ্ছে। আরমান ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
-” এখানে বসতে আপত্তি নাই তো ? এখানে তোমাকে কেউ দেখবে না আর দেখলেও এই অল্প আলোয় চিনবে না। ঠিক আছে তো ? ”
-” হমম।” ক্ষীণ কণ্ঠে শব্দটা উচ্চারণ করে সায়রা ঘাড় ফিরিয়ে চারপাশ দেখল। বিরাট বড় হলরুমটা। মাঝখানে মাঝখানে ছোট ছোট গোল টেবিল পেতে রাখা আছে। তার উপর সুদৃশ্য টেবির কভার আর টেবিলের উপর চমৎকার সব ডিজাইনের গ্লাসে টিস্যু পেপার বুনে রাখা। যেন ধানের ছড়া।
সেদিকে তাকিয়ে সায়রা বলল, ” জানি, আপনি আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবছেন। তাই না?”
-” এখনও না।” আরমান তার সামনের গ্লাস থেকে টিস্যু খুলে হালকা ঝাড়ি দিয়ে সামনে বিছাল। সায়রার গ্লাসেরটাও নিজেই তুলে ঝেড়ে দিয়ে ওর হাতে তুলে দিল। বড় বাটি থেকে স্যুপ নিয়ে ওর বাটিতে তুলে দিয়ে বলল,
-” তুমি নিজেই আমাকে ফোন করে দেখা করতে চাইলে। আমি তোমাকে এখানে আসতে বললামম। তুমি চট করে রাজী হয়ে গেলে। এখন আবার মুখ কালো করে বসে আছ। সবমিলিয়ে আমি অবাক হচ্ছি এটা ঠিক কিন্তু তোমাকে খারাপ মেয়ে ভাববো এখনও সেরকম পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে বলে মনে করিনা। ”
-” না মানে। আপনাকে সেদিন যা তা বললাম। আজ আবার নিজেই সেধে দেখা করতে এলাম। সে জন্যেই ভাবলাম..!”
-” যা তা বলার কারণটা বলে ফেলো তাহলে এখানে আসার কারণটা বুঝতে পারব।”
-” আপনি আপনার আম্মাকে কী বলেছেন ? মানে আমার আব্বু আগামী কাল ঢাকায় ফিরলেই তো আপনার আম্মু ফোন দেবে আব্বুকে । উনি আমার আব্বুকে কী বলবেন আসলে? ”
-” কী আর বলবে, আমি যা বলেছি তাই বলবে।”
-” আপনি কী বলেছেন? ” সায়রা আতঙ্কিত চোখে তাকাল।
আরমান গরম স্যুপ নেড়ে তাতে চিলি সস মিশিয়ে চামচে তুলে চেখে দেখল। তারপর চামচ ভরে গরম স্যুপ মুখের সামনে ধরে বলল, ” আম্মুকে বলেছি, মেয়েটা আমাকে পছন্দ করেনা। আর কিছু বলিনি।” বলে আরমান তৃপ্তির সাথে স্যুপে চুমুক দিল।
সেদিকে তাকিয়ে সায়রা বড়সড় ঢোক গিলে বলল, ” এটা বলেছেন ? হায় হায়। তাহলে তো এতক্ষণে আমার আম্মুর কানে খবর চলে গেছে। আমার কপালে এবার সিরিয়াস খারাবি আছে। ” সায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে হাত দিল। আরমান সায়রার প্লেট থেকে স্যুপের চামচটা তুলে টিস্যু দিয়ে মুছে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল, ” স্যুপটা ঠান্ডা হচ্ছে। গরম গরম খেয়ে নাও।”
-” দুর স্যুপ। আপনি এখনই এসব বলতে গেলেন কেন। আপনার আম্মা নিশ্চয়ই অনেক রাগ করেছেন কথাটা শুনে।”
-” হম, তা তো একটু করেছেনই। আমাকে ওয়ার্নিং দিয়ে দেয়া হয়েছে, আমি যেন ঐ মেয়ের সাথে আই মিন তোমার সাথে কোন যোগাযোগ না করি, ফোন না ধরি। পাত্তা না দেই।” বলে মুচকি হাসল আরমান।
-” ইস্, ইন্নালিল্লাহ। তার মানে আপনার আম্মুর কাছে আমি এখন পুরা কালপ্রিট ? ”
-” একদম..।”
-” তাহলে আপনি এখানে এলেন কেন। মায়ের কথা না শুনে ? ” সায়রার মুখ শক্ত হল।
-” আমার মা শিখিয়েছিলেন, কেউ অনুরোধ করলে যেন তা সাধ্যমত রক্ষা করি। তুমি ফোনে যেভাবে কাঁদছিলে, শুনে আর থাকতে পারলাম না। আচ্ছা, ঘটনা কী বলতো ? ছেলেটা কী তোমাকে ছ্যাঁকা দিয়েছে ? ” আরমান আরেক চামচ স্যুপ মুখে নিলো।
-” কোন ছেলে? কিসের ছ্যাঁকা? আপনি এসব কী বলছেন ?”
-” যার জন্য তুমি আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছ সেই ছেলে। যার পাশে বসে মুভি দেখছিল। ঐ স্পাইক কাট ছোকড়ার কথা বলছি। যে তোমার….! থাক বললাম না।”
-” ইস ছিঃ, ঐ ছেলে আমার লাভার হতে যাবে কোন দুঃখে। ওরা তো আমাদের সাথে ফাজলামি করছিল। দেখেও সাহায্য করতে আসেন নি এখন আবার টিটকিরি মারা হচ্ছে।”
-” আমার কী দায় পড়েছে যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাব ! আমি কী জানতাম সে তোমার লাভাব না ? আচ্ছা, ভালো কথা। তোমরা তিনজন মিলে একা সিনেমা হলে গেলে কী মনে করে। বাইরে কী কী ঘটে তোমরা কী জানো না ? ভাগ্য সহায় নয়তো সেদিন অনেক খারাপ কিছু ঘটতে পারত। ”
-” আসলেই কাজটা ভুল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওদের আমরা চিনি না। বিশ্বাস করেন।”
-” করলাম। এখন খাও। স্যুপ শেষ করে আমাকে জানাও কেন আমাকে ফোন করে বাইরে দেখা করতে চেয়েছ। এমনি এমনি নিশ্চয়ই চাওনি।”
বাটির মধ্যে আনমনে চামচ নাড়তে নাড়তে কাচুমাচু ভঙ্গিতে একবার আরমানকে দেখল সায়রা। তারপর বলল, ” না মানে। ভাবলাম। বাবা যখন ঠিক করেছে তখন…!”
-” তখন…?”
-” আপনি নিশ্চয়ই খুব ভাল।”
-” হঠাৎ এত মাখন মেরে কথা বলছ। মাখনের দাম কমে গেল নাকি? ”
-” আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। ”
-” অপমান এটা না। অপমান সেটা যেটা তুমি আমাকে ফোনে বলেছিলে।” আরমান পরপর কয়েক চামচে স্যুপ সাবাড় করে টিস্যু ঠোঁটে চেপে ধরে অবাক হয়ে বলল, ” কী হল, এভাবে বসে আছ কেন। পুরো স্যুপ তো ঠান্ডা করে ফেললে।”
-” আমি স্যুপ খাবো না। আর আমি এখন উঠব।” থমথমে মুখে বলল সায়রা।
-” স্যুপ না খেলে এর দাম দিয়ে যেতে হবে। এমনি এমনি যেতে পারবে না।” আরমান কিছুটা দৃঢ় গলায় বললে সায়রার চোখে পানি চলে এল এবার। হালকা নাক টেনে চোখ মুছলে আরমান সহজ সুরে বলল ” স্যুপটা শেষ কর। ”
-” না, খাবো না।” সায়রার চোখ থেকে টপটপ পানির ফোঁটা ঝরে পড়ল।
-” আচ্ছা, আর বকবো না যাও। আসলে, সেদিন রাতে ফোনে ওসব বলে আমার মন এবং মেজাজ দুটোই বিগড়ে দিয়েছিলে তুমি। তার উপর তোমাদের বাড়ী থেকে নেগেটিভ আন্সার পেয়ে আমার আম্মু মহা খেপে গেছে। আমাকে সোজা বলে দিয়েছে ভুলেও যেন তোমার ছায়া না মাড়াই। তারপরেও তো আমি তোমার সামনে। বোঝার আর কিছু বাকি আছে ? ”
-” তারমানে কী ? আপনি আমাকে পছন্দ করেন।? ” সায়রার ভেজা চোখে অন্যরকম আকুতি।
আরমান শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” তুমি চাইলে মাইক দিয়েও বলতে পারি। ডায়াসে দাঁড়াবো ? ”
-” যাহ্…!” লাজুক হেসে স্যুপে মন দিল সায়রা। আরমান টেবিলে হাত দুটো রেখে সামান্য ঝুঁকে বসে বলল, ” আমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবে? ”
সায়রা স্যুপ মুখে দিয়ে বলল, ” আপনাকে আমার প্রথম দিনই ভালো লেগেছিল।”
-“… কিন্তু পাত্তা দাওনি। কারণ তখন আমাকে তোমার ভাল লাগেনি। তাই না? ”
-” আপনি সেই তখন থেকে এরকম কড়া কড়া কথা বলছেন কেন বলেন তো ? ”
আরমান সামান্য হেসে মাথা ঝাঁকাল। তারপর ঠোঁট মুড়ে কি যেন ভাবল। বলল,
-” তুমি খুবই তরলমতি একটা মেয়ে সায়রা। খুব দ্রুত মুড বদলে যায় তোমার। গত একমাস ধরে তোমাকে চিনি। তুমি দেখতে আকর্ষনীয় বলে তোমার পিছু লেগেছিলাম তোমার খোঁজ খবর নেবার জন্য। যা দেখলাম তা আমার জন্য বিপদজনক।”
-” মানে ?”
-” মানে হল, তোমার মন কচুর পাতায় গড়াগড়ি খাওয়া পানির ফোঁটার মত টল-টলায়মান। যে কোন মুহূর্তে মাটিতে গড়িয়ে পড়তে পারে। স্থৈর্য বলে কোন জিনিস তোমার স্বভাবে নেই। আমি তোমার বয়সটা পার করেছি সায়রা। এই ষোলো বছর বয়সটা আসলে বড় মারাত্মক। আমি আমার মনটা এমন কাউকে দেব না যে এটা যত্ন করতে পারবে না। হাত থেকে ফেলে ভেঙ্গে ফেলবে। কাজেই…!”
-” আমার এমন কোন দায় পড়েনি যে আমি আপনার মন নেবার জন্য ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকব।” তীব্র স্বরে বলে উঠে দাঁড়াল সায়রা। আরমান বিস্মিত স্বরে বলল,
-” আমার পুরো কথাটা তো শোনো । ”
-” কেন শুনব আপনার কথা। আমি কী বেহায়া নাকি ? ”
-” চুপ করে শান্ত হয়ে বসো সায়রা। আমার পুরো কথা না শুনে তুমি এরকম লাফাতে পারবে না। আমার কথা শোনার পর তুমি যা বলবে আমি শুনব।”
-” না, আমি বসব না। আপনি আমাকে অপমান করেছেন।”
-” হম, অপমান তো তোমার নাকের ডগায়। আমি দাঁড়ালে তোমার অপমান, বসলে তোমার অপমান আর তুমি ফোন দিয়ে প্রস্তাব মানা করে দিলেও সেটা আমার মান-সম্মান , ফোনের আশায় প্রেসক্লাবে দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরও তোমার ফোন না আসা আর সেটাকে সুইচ অফ পাওয়া আমার মান সম্মান। ছ্যাবলা পেয়েছ আমাকে ? আঙ্গুলের ইশারায় ডাকবা আর ইশারাতেই দুর করে দিবা ? কেন নেব আমি এই ঝুঁকি ? বলো ?”
সায়রা এবার আস্তে করে বসে পড়ল। দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ” আমার ছোট খালামনি আমার জন্য আরেকটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু টাক মাথা। আপনাদের প্রস্তাবটা ফিরে যাবার পর আম্মু ছোট খালামনির প্রস্তাবটা হাতে নিয়েছে। বলেছে আমার আব্বু দেশে ফিরলে কথা বলবে। সেজন্যেই কোন দিশে না পেয়ে আপনাকে জরুরী ভিত্তিতে ফোন দিয়েছি। ”
আরমান চুপচাপ শুনল। কোন জবাব দিলো না।
সায়রার কথা শেষ হলে মৃদু স্বরে বলল,
-” আচ্ছা। দিশে না পেয়ে আমাকে ফোন দিলে কারণ আমার মাথায় চুল আছে তাই…?”
-” আর আপনি ঐ ছেলের চেয়ে লম্বা, একটু হ্যান্ডসামও আছেন। ” লাজুক হাসল সায়রা। আরমান বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দুহাতে নিজের চুলগুলো মুঠো করে ধরে বসে রইল। কী বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না সে।
চলবে।