ত্রয়ী পর্ব ৬

0
938

~ত্রয়ী~
মোর্শেদা হোসেন রুবি

৬||
আরমান বাইক থামালে সায়রা নামল। বাইকে চড়ে অভ্যাস আছে ওর। তাই বসতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। চারপাশে তাকিয়ে বলল, ” এটা কোন জায়গা ? কী সুন্দর।”
-” কেন, এর আগে কখনও আসোনি এখানে ? ”
-” না তো। এতদুরে কখনো কখনও আসা হয়নি।”
-” এতদুর পেলে কোথায় ? এটা তো জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি। এর ছাত্র ছাত্রীরা কতদুর থেকে আসে জানো ? ”
-” এটা জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ? ইয়াল্লাহ…! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ” সায়রা দুই হাত পরস্পর চেপে ধরে চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আরমান একপাশে বাইক রেখে হাতের ইঙ্গিতে সব চেনাতে শুরু করল সায়রাকে।
-” ঐ যে ওটা আর্ট ফ্যাকাল্টি। আর ঐ যে দুরে যেটা দেখছ, ওটা অডিটরিয়াম। ”
-” হম। জায়গাটা খুবই নিরিবিলি।”
-” ভার্সিটি বন্ধ তাই। তাছাড়া এটা ব্যাক সাইড পড়েছে। ”
-” ভার্সিটি বন্ধ হলে চারিদিকে এত স্টুডেন্ট কেন? ”
-” আরে অফিস তো আর বন্ধ না। এরা এসেছে নিজেদের কাজে। কেউ বেতন দেবে কেউ ফর্ম ফিলাপ করবে। কত কাজ থাকেনা। আবার অনেকেই বহিরাগত।”
-” আচ্ছা, আমি যে হুট করে আপনার সাথে এখানে চলে এলাম। আপনার বাসায় জানলে কিছু মনে করবে না তো ? ”
-” মনে তো করবে অনেক কিছু। মনে করলে কী আর করা। সুযোগমত বলে দেব তোমার কথা।”
-” কী বলে দেবেন ? ”

-” কী বলে দেব মানে ? কচি খুকী তুমি ? কিসু জানো না ? ”

-” জানি তো। কিন্তু তখন যে বললেন আপনার আম্মা আমার সাথে কথা বলতে মানা করেছে? ”

-” সেটা তো তোমার বাসা থেকেও করেছে। অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছে।”

-” কেউ জানলে কী বলব আমরা? ”

-” বুদ্ধি করে একটা কিছু বলে দিও। আমাদের পক্ষে তো আর এখনই কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব না। ”

-” আসলে আমি এখানে আসতাম না। আজ বিকেলে আম্মু ছোট খালামনিকে আসতে বলেছে। খালামনি ঐ ছেলের বোনকে নিয়ে আমাকে প্রাথমিক ভাবে দেখে যাবে। তারপর বাড়ীতে জানাবে। আমি ওনার সামনে পড়তে চাই না। চোখে একবার দেখলেই তাদের তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে। এজন্যই বিকেলটা অন্য কোথাও কাটিয়ে সন্ধ্যা লাগিয়ে বাসায় ফিরব। বলে দেব, এক বান্ধবীর বাড়ী গিয়েছিলাম।”
-” তারা যদি ফোন করে ? ”
-” ফোন আপাতত সুইচড অফ থাকবে। বলব চার্জ ছিল না। ”
– ” মিথ্যা বলবে ? ”
-” এটা তো বলতেই হয়। সত্য কথার ভাত নাই।”
-” তুমি হলে যাকে বলে হাজীর ঘরে পাজী।”
-” আহা, আর আপনি ? জালেমের ঘরে আলেম।”
-” আমার বাবা-মা জালেম না।”
-” কিন্তু আপনি তো আলেম।”
-” আলেম হলে তোমার সাথে ঘুরতে বেরোতাম না। আমি একজন সাধারণ মানুষ।”
সায়রা হেসে গড়িয়ে পড়তে গেলে হঠাৎ আরমান ওকে হাত ধরে থামাল। চোখ সামনের দিকে। দৃশ্যটা সায়রাও দেখেছে। প্রথমে ঘৃণা হল। পরক্ষণেই আতঙ্ক বিরাজ করল ওর মনে। খোলা আকাশের নিচে একদল ছেলে আর দুটো মেয়ের নোংরা কীর্তি আরমানকেও ভীত করে তুলল। মন বলছে এরা বাইরে থেকে আসা বখাটে।
আরমান চাপা স্বরে বলল, ” যে পথে এসেছি সে পথে ফিরে যাই চলো। এরা লোক সুবিধের না। তাড়াতাড়ি। ” বলেই সায়রার কণুই ধরে উল্টো পথে হাঁটা ধরল ওরা। পা চালাল দ্রুত। কিন্তু ততক্ষণে একটু দেরীই হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েগুলো ওদের দেখে ফেলেছে। দুটো ছেলে কিসব বলতে বলতে ওদের ধরার জন্য উর্ধ্বশ্বাসে পিছু ধাওয়া করল। তাদের উচ্চকিত হাসি আর অশ্লীল ইঙ্গিতে ভয় পেয়ে প্রানভয়ে ভীতা হরিণীর মত দৌড়ুল সায়রা। এক পর্যায়ে ওরা আরমান কে ধরে ফেলল। কিন্তু সায়রার খরগোশের গতির কারণে ওরা তাল মিলাতে পারল না। কিছুদুর গিয়ে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল সায়রা। আরমানের জন্য চিন্তা হচ্ছে ওর। ওরা কী আরমানকে ধরে মারবে ? ভয়ে সায়রার কান্না পেয়ে গেল।

====

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এখন বিকেলও গড়াতে চলেছে। সায়রার মা সব জায়গায় ফোন করে ফেলেছেন কোথাও মেয়ের খবর নেই। সায়রার ছোট মামা মঈন তোয়াদের বাড়ী ঘুরে এল। হতাশাব্যঞ্জক স্বরে বলল, ” নাহ্, তোমার মেয়ে ও বাড়ীতেও নেই। আজ তো নাকি ওখানে যায়ই নাই।”
-” তোয়া বাসায় আছে ? ”
-” হ্যাঁ, ওকে তো দেখলাম। ”
-” আর ঐ যে শ্যামলা মত মেয়েটা। একটু দুরে থাকে। ওকে ফোন করেছিলি। ”
-” নাহ্, ওর ফোন নম্বর নেই।”
-” তুই একটু তোয়াদের বাসায় যা তো। ওর মাধ্যমে ঐ মেয়েটাকেও ধর। পারলে দুটোকে বাসায় ডেকে আন। এরা দুইটা সায়রার সব খবর জানে। এখন না জানার ভান করছে। কৌশলে নিয়ে আয়। চাপ দিলেই কথা বেরুবে।”

মঈন বেরিয়ে গেল। বিশ মিনিট পর তোয়াকে নিয়ে বাড়ী ফিরলেন তিনি । তোয়া সায়রার আম্মুকে দেখেই সালাম দিল। সায়রার আম্মু শান্ত মুখে সালাম নিলেন। পরম আন্তরিকতার সাথে বললেন, ” তোমাদের আরেকজন বন্ধু আছে না ? সে কোথায় ? ”

-” জি, ওর নাম সাবা। ওকে ফোন দিয়েছি আন্টি। ও সোজা এখানেই চলে আসবে।”

-” ভাল খুব ভাল।

-” ব্যপার কী আন্টি ? সায়রার কোন অনুষ্ঠান আজকে ? ”

-” কেন তোমরা জানো না ? ”

-” না তো। কী জানি না আন্টি ? ”

-” আজ তো তোমাদের বান্ধবীকে দেখতে আসার কথা ছিল। অথচ সে আজ সকাল থেকে গায়েব। বলল তোমার বাসায় যাচ্ছে।”

-” সায়রা তো আমাদের বাসায় যায় নি আন্টি।”

-” নিশ্চয়ই গিয়েছে। তোমাদের বাসা বলেই তো বেরুল। ওখান থেকেই সে অন্য কোথাও গেছে। যেন আমরা বুঝতে না পারি। আর তুমি সায়রার সব কথা জেনেও লুকাচ্ছ।”

-” বিশ্বাস করেন আন্টি আমরা কিচ্ছু জানি না। আজ যে সায়রা বাড়ী নেই তাও জানি না। আজ তো স্কুল বন্ধ।”

-” আচ্ছা ফোন দাও দেখি ওকে, তোমার নাম্বার থেকে।”

তোয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কাঁপা হাতে ফোন দিল সায়রাকে। এসব কী হচ্ছে কে জানে। সায়রা হঠাৎ না বলে কই গেল। তোয়া কান থেকে ফোন নামিয়ে বলল, ” রিং যাচ্ছে না আন্টি। ফোন সুইচড অফ।”

-” এসবই তোমাদের প্রি -প্ল্যান। তোমরা জেনেশুনে আমার মেয়েটাকে এসব করার জন্য শেল্টার দিচ্ছ। নইলে আমাদের ফ্যামিলিতে এসব পালিয়ে যাওয়া নেই। ইস্, ওর ফুপুরা জানতে পারলে আমার মান সম্মান থাকবে না।”

তোয়ার গলা শুকিয়ে এল। এরই মধ্যে সাবাকে দেখে ধড়ে প্রান ফিলে পেল তোয়া। সায়রার মা সাবাকে পেয়ে একই জেরা করলেন যেগুলো একটু আগে তোয়াকে করেছেন। সাবা অবশ্য তোয়ার মত গুটিয়ে গেল না। সে সতেজে জবাব দিল, ” সায়রা কখন কী করে কোথায় যায় এসব তো আমাদের জানার কথা না আন্টি। সে তো বাড়ী থেকে বলেই বেরোয়। কাজেই আপনারই তো জানা থাকা উচিত সায়রা কোথায় ! ”

-” আমি জানলে তোমাদের ডাকতাম না।” গুরু গম্ভীর সুরে বললেন নীলিমা হায়দার। “শোনো, তোমরা যতই এড়িয়ে যাও না কেন, আমার মেয়ে আজ তোমাদের সাহস পেয়েই এতদূর বেড়েছে। নইলে আমার মেয়েকে কী আমি চিনিনা ? ঠিক করে বল, ও এখন কার সাথে সম্পর্ক রাখছে ? ”

তোয়া আর সাবা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সায়রার মা বলতে লাগলেন, ” আমার মেয়ে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে তো ওর তো কপালে খারাবি আছেই কিন্তু তোমাদেরও ছাড় নেই। তোমাদের কপাল ভাল যে ওর বাবা দেশে নেই। সে এখানে থাকলে আজ তোলপাড় করে ফেলত। এখন আমাকে বলতে যদি সমস্যা মনে করো তো মনে রেখো, পুলিশ তোমাদের বাড়ী গিয়ে যখন তোমাদের জিজ্ঞেস করবে তখন কিন্তু সবকিছুর জবাবই দিতে হবে।”

পুলিশের কথা শুনে তোয়া আর সাবার মুখ শুকিয়ে গেল। অবশেষে সায়রার মায়ের কথা শুনে ওরা ভয়ে ভয়ে সম্মতি জানাল। দুজন মিলে সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে যাবে। নীলিমা মঈনকে আড়ালে ডেকে বললেন, ” গাড়ী নিয়ে তুই ওদের সাথে যা। এরা সবই জানে। না জানার ভান করছে। মেয়ে দুটো আড়ালে গিয়ে ঠিকই সায়রাকে জানাবে। পুলিশের ভয় দেখিয়ে এদেরকে একটু টাইট না দিলে হবে না। ”

সায়রাদের গাড়ীতে পাংশুমুখে বসে আছে তোয়া আর সাবা। সামনে ড্রাইভার আর সায়রার ছোটমামা মঈন। মেইন রোডে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ” এখন কোনদিকে যাব বলো। ”

-” মামা, আমরা কেমন করে বলব ? ”

-” দেখো, পুলিশ জানতে চাইলে যদি এই উত্তর দাও তো খবর আছে। ভালোয় ভালোয় আমাদেরকে বলে দাও আর নিজেরা বাঁচো।”

-” আমরা তো জানিনা ও কোথাও গেছে। ” কাতর স্বর তোয়ার।
সাবা কিছুটা চিন্তা করে বলল, ” ওকে গত দুদিন আপনাদের ঠিক করা আগের পাত্রটা মানে আরমানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে দেখেছি। আরমানকে ফোন দিন মামা। খবর বেরোতে পারে।”

-” আরমানের ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে ? ”

-” না তো মামা। আরমানের ফোন নম্বর আমাদের কাছে থাকবে কেন ? ” সাবা বলল।

-” আরমানদের বাসা কোথায় জানো ? ”

-” আমরা তো জানিনা মামা। কেন, আপনি জানেন না? ”

-” ঝিগতলা না কই যেন। ঠিক মনে নেই। তোমাদের ধারণা ও আরমানের সাথে আছে? ”

-” সম্ভাবনা হ্যাজ….মানে আছে।” সাবা বলেই জিভ কেটে তোয়ার দিকে তাকাল। তোয়া চুপচাপ বসে আছে। ওর চেহারা এরই মধ্যে শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে।

গাড়ী ঝিগাতলা চলে এল। মঈন পেছনে তাকিয়ে বলল, ” এখানে কোন বাড়ী জানো ? ”

-” মামা আমরা আরমানের ঠিকানা জানিনা বিশ্বাস করেন।” সাবা টলমলে চোখে তাকাল।
তোয়া মাঝখান থেকে বলে উঠল,
-” সায়রা একবার বলেছিল আরমানদের বাড়ীটা একটা দোতলা বাড়ী। ওটা নাকি ওদের নিজেদের বাড়ী।

মঈন হাসল, ” এই তো সবই জানো দেখছি। অযথা জানি না বলে ভাব দেখাচ্ছ কেন ? ”

-” কিন্তু কোন বাড়ী তা তো জানি না মামা ।” তোয়া বললে সাবা ওকে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল রাগে।
মঈন সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ” আমি গাড়ী নিয়ে বসছি এখানে। তোমরা সম্ভাব্য বাড়ীগুলোতে খোঁজ নিয়ে আসো। ”

-” কী বলেন, আমরা আন্দাজে কোন বাড়ীতে খুঁজব ? ” তোয়াকে অসহায় দেখাল।

-” যে বাড়ীকে ওরা থাকে সে বাড়ীতেই খুঁজবে নয়ত বান্ধবীকে ফোন লাগাও।”

-” মামা, ও তো ফোন বন্ধ রেখেছে। আর আমরা আসলেই জানিনা সায়রা কোথায়।”

-” দেখো, তোমরা অবস্থাটা বুঝ। সকাল থেকে সায়রার খবর নেই। ও যদি কোথাও ঘাপটি মেরে থাকে বা চলে গিয়ে থাকে সেটা আমাদের পরিবারের জন্য একটা বড় বিপর্যয়। সায়রার বাবা মানে আমার দুলাভাই বাসায় নেই। তিনি জানতে পারলে ঘটনা হবে ভয়াবহ। তখন যে ইনকোয়্যারী হবে তা থেকে তোমরা দুজনও বাদ যাবেনা। কাজেই বান্ধবীর সাফাই না গেয়ে সত্যটাই বলে দাও সেটাই ভাল।”

-” মামা, আমরা জানিনা কিছু বিশ্বাস করেন।” তোয়ার চোখে পানি জমল এবার।

মঈন কয়েক মিনিট চুপচাপ থেকে ড্রাইভারকে বলল, ” ইয়াদ আলী, গাড়ী ঘুরাও। ওদেরকে যার যার বাসায় নামিয়ে দেই। তারপর বাড়ী চল।” বলে পেছনে তাকাল মঈন।

-” এই যে মেয়েরা শোনো, ” খোঁজখবর আপাতত স্থগিত। এরপর যা হবে সিস্টেমেটিক ওয়েতে হবে। ঠিকআছে ? ইয়াদ আলী, চল।”

-” মামা, এক মিনিট।” সাবা থামাল মঈনকে। ” আমরা বরং দোতলা বাড়ী গুলো খুঁজে দেখি। যদি সায়রা এখানে এসে থাকে।”

-” গুড। দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।”

তোয়া বিরক্তির চোখে তাকাল সাবার দিকে। সাবা চোখে ইশারায় ওকে থামিয়ে তোয়াকে নিয়ে একটা দোতলা বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। ভেতরে ঢুকে চোখের আড়াল হতেই তোয়া তেতে উঠল, ” তুই কী মনে করে ওর মামার এসব উদ্ভট ইচ্ছাকে সমর্থন জানালি? তোর পাছার মধ্যে একটা লাত্থি মারা উচিত।”

-” বাসায় গিয়ে মারিস। এখন বকবক না করে শোন। ওর মামাকে দেখানোর জন্য হলেও কয়েকটা বাড়ী খুঁজার ভান করতে হবে। নইলে এরা ঠিকই আমাদের পুলিশি ঝামেলায় ফেলবে। তোর আমার বাসায় পুলিশ এলে মানসম্মানটা কোথায় থাকবে তুইই বল। এই বয়সেই ক্রিমিন্যালদের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলব নাকি ? ”

-” এখন তাহলে কী করব। ব্যাটা কেমন ফাজিল। বাসায় ফোন করে আরমানদের নাম্বারটা চেয়ে নিলেই পারে। অযথা আমাদের ভোগাচ্ছে। ” সাবা চাপা স্বরে বলল।

-” আমি ভাবছি বাসায় ফোন করে সজীব ভাইয়াকে কিছু বলব কী না।” তোয়া চিন্তিত স্বরে বললে সাবা বিরক্ত হল, ” তুই কী পাগল হয়েছিস। বাসায় জানলে উল্টা বকা খাব। তখন তোর বাসায় আমার যাওয়া বন্ধ হবে। আমার বাসায় তোর। তারচে কোনমতে এই ব্যাটার সাথে তাল দিয়ে সময়টা পার কর।”

-” হমম, আচ্ছা চল দেখি।

ভেতরে ঢুকে তোয়া বেল বাজাল। এক বয়স্ক লোক দরজা খুললেন । সাবা সালাম দিয়ে বলল, “এটা আরমানদের বাসা ? ”

-” কোন আরমান ? এ বাড়ীতে তো আরমান নামে কেউ থাকেনা।”

-” ওহ্ তাহলে ভুল করেছি। স্যরি আঙ্কেল। ”

সাবা, তোয়া বেরিয়ে এসে কিছুদুর হেঁটে আরেকটা দোতলা বাড়ীতে ঢুকল। ঠিক দু’ মিনিটের মাথায় দুজনই পড়িমড়ি করে দৌড়ে বেরিয়ে এল। একটা বিশাল ব্ল্যাক হাউন্ড কুকুর ওদের দেখেই খেকিয়ে উঠে বাড়ী মাথায় করছে। ভাগ্যিস লোহার শেকলে বাঁধা। নইলে ঠিক কামড়ে দিত। দুজনেই ভয়াবহ ভাবে হাঁপাতে লাগল। একটু শান্ত হয়ে এবার তৃতীয় বাড়ীটাতে নক করল। এখানে দরজা খুললেন এক মধ্যবয়সী লোক। তিনি গেটে দাঁড়িয়েই লোলুপ দৃষ্টিতে মেয়ে দুটিকে দেখলেন। তারপর ব্যগ্র স্বরে বললেন , ” হ্যাঁ, হ্যাঁ, আরমান তো এখানেই থাকে। এসো তোমরা। ভেতরে এসো।” তোয়া পা বাড়াতে গেলেও সাবা পেছন থেকে টানল।

-” তাহলে আরমানকে ডাকুন আঙ্কেল। আমরা এখানেই দাঁড়াচ্ছি।”

-” সেকী। তোমরা হলে আমার গেষ্ট। গেটে দাঁড়াবে মানে? ভেতরে এসো।”

-” তার আগে বলুন সায়রা কী এখানে? ”

-” সায়রা..সায়রা..?” ভদ্রলোক চিন্তার ভঙ্গি করলেন।” ওর নাম সায়রা নাকি ? তোমরা বরং ভেতরে এসে ওর কথা বলে নাও। তাহলেই তো সব পরিস্কার হয়ে যায়।”

তোয়া সাবার দিকে তাকাল, ” ভেতরে গিয়ে একবার দেখবি নাকি ? যদি মিলে যায়।? ”

-” তোর মাথা।” সাবা চাপা স্বরে ধমকাল।
তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আঙ্কেল আমাদের সাথে লোক আছে তো। আমরা ভেতরে আসতে পারব না। আপনি বরং আরমান বা সায়রাকে এখানে ডাকুন। ”

-” আরে বাবা, ওরা তো ঘুমুচ্ছে। বিশ্বাস না হলে একজন গিয়ে দেখে এস। আরেকজন দাঁড়াক এখানে। এই মেয়ে যাও দেখে এসো। লোক নিয়ে এসেছে, হুহ্।” তোয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললে সাবা এবার কটমট সুরে বলল, ” আঙ্কেল। কবরে এক পা রেখেছেন। এখনও মেয়ের বয়সী মেয়েদের দেখলে ঈমান নষ্ট করে দেন পেশাব করে লুঙ্গি ভেজানোর মত। আপনাদের তো ধরে ধরে হাবিয়াতে পাঠান উচিত। এ্যাই তোয়া আয়। বুইড়া শয়তান ! ” বলে তোয়ার হাত ধরে টেনে দ্রুত বেরিয়ে এল সাবা।

লোকটা পেছন থেকে কয়েকটা অশ্লীল কথা বললে সাবাও পাল্টা চেঁচাল, ” একদম দশ ইঞ্চি থান ইট তোর মাথায় ভাঙব। বুইড়া হারামজাদা।” এবার তোয়া লোকটার বদমতলব বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে গেল।

গেট থেকে বেরোবার মুখে সাবার মোবাইল বাজল। ফোনের দিকে তাকিয়ে সাবা ঢোক গিলে বলল, ” সারছে।”

-” কী হইসে ? ”

-” আমার বড় আপা।”

-” মিলি আপা ? ফোন রিসিভ কর। আর বল আমরা কোন গ্যাঁড়াকলে পড়সি।”

সাবা ফোন রিসিভ করে সংক্ষেপে নিজেদের বর্তমান অবস্থা জানাল। তারপর হুঁ, হাঁ বলে ফোন কেটে দিল। তোয়া তাকাল, ” কী বললেন তোর আপা? ”

-” বলল, তোরা সায়রাদের বাসায় চলে যা। আমি তোকে ওখানে নিতে আসছি। সায়রার আম্মুর সাথে একটু কথা আছে আমার।”

-” সারছে। মিলি আপা আবার কী কথা বলবেন? ”

-” হয়ত আমাদের দুজনের এতে কোন হাত নেই এসবই বলবে।”

-” চল তাহলে যাই। আমার বাসায় জানলে তো আজকেই রোজ কেয়ামত হবে।”

গাড়ীর কাছে ফিরে এল দুজনে। মঈন সিগারেটে সবে টান দিয়েছিল। ওদের দেখে সিগারেট হাতে নিয়ে নিলো।

-” কী, পেয়েছ বাড়ী ? ”

-” না, মামা। উল্টো বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছিলাম।”

-” আচ্ছা, অনেক হয়েছে। এবার ব্যাক করা যাক। সন্ধ্যা নামছে। ”

তোয়া আর সাবা জড়োসড়ো হয়ে পেছনে উঠল। মামার কপালে এখন চিন্তার রেখা। তোয়া আর সাবাও কম চিন্তিত না। সত্যিই তো সায়রা গেল কোথায় ? ”

====

সায়রা বসে আছে একটা বুনোঝোপের আড়ালে। একহাতে নিজের মুখ চেপে রেখেছে। যেন নিঃশ্বাসের শব্দটুকু বাইরে না যায়। পায়ের খচমচ শব্দ এখন অনেকটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে বলতে শুনল, ” মালটা গেল কই রে ? ”

-” পোরজাপতির লাহান উইড়া গেছে।” আরেকটা মোটা গলা শুনল সায়রা।

-” নাহ, উইড়া যাইব কই। বয়ফ্রেন্ড তো এহানে। হালারে আটকায়া রাখুম ছেমড়িরে না পাওন পর্যন্ত।”

-” ছেমড়ি বহুত চালাক। মনে হয় না বয়ফেরেন্ডের লাইগা বইব। অয় পলাইছে।”

-” আয় হায় রে। তরতাজা মালটা হাতছাড়া হয়া গেল।”

-” ঐ ছ্যাড়ারে কী করবি ? ”

-” কী আর করুম। চান্দু তো মাইর খাইয়া বেহুঁশ অইছে। এইটার পিছে টাইম খরচা কইরা লাভ নাই। এরচে চল ঐ দুইটারে নিয়া ফুর্তি করি গিয়া। ”

-” ছেড়ার পকেট চেক করছিলি?” প্রথম জন বলল।

-” হ, দেখসি। আর কিছু নাই। মোবাইল মানিব্যাগ সবই নিসি। অহন চল, ভাগি।”

-” যাওনের আগে এই জায়গাটা আরেকবার সার্চ মার। এক কাম কর। ঐ ছেড়ার মোবাইল তন ফুন দে ঐ ছেড়িরে। তাইলে ফুনটা বাজব। আমরা ছেমড়িটারে খুইজ্জা পামু।”

-” আরে কুনটা এই ছেমড়ির নাম্বার কেমনে কমু মামু? ”

-” হুত গাধা। লেহাপড়া করছোস কিন্তু মাথায় বুদ্ধি নাই। মাইয়া মাইনষের নাম যে কয়টা আছে সবটিতে একবার কইরা কল দে। ঐ ছ্যামড়ার মোবাইলে এই ছেমড়ির নাম্বার নিশ্চয়ই আছে। অই বাদইল্যা তুই কান পাত। আশেপাশে মোবাইল বাজে কী না দেখ।” বাদল নামের ছেলেটা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়াল। সায়রা এবার আতঙ্কিত হয়ে নিজের মোবাইলের দিকে তাকাল। কাঁপা হাতে নিজের মোবাইল অন করল সায়রা। মনে মনে অনবরত দুয়া পড়ছে সে।

===

সায়রাদের ড্রইংরুমে বসে আছে তোয়া আর সাবা। মাগরিবের আযান হয়ে গেছে অনেক আগেই। সায়রার মা নামাজ পড়তে গেছেন। মঈন নামাজ সেরে ড্রইংরুমে এসে বসেছে। মাথায় তার এখনও টুপি পড়া। তাকে যথেষ্টই চিন্তিত দেখাচ্ছে। তোয়া আর সাবা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সোফার এককোণে। এমন সময় বেল বাজলে মঈন নিজেই উঠে গেল দরজা খুলতে। দরজায় অচেনা এক তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলল,

–” আপনি ? কাকে চান ? ”

-” সাবা আছে এখানে ? আমি সাবার বড় বোন।”

–” ওওহ্…আসুন প্লিজ।” মঈন একটু ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল যেন।

-” জি না, আমি বসবো না। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি কোন অপরাধে আমার বোনকে এখানে আটকে রাখা হয়েছে ? ”

-” আটকে..? ইন্নালিল্লাহ। কী বলেন আপনি ? সাবাকে আটকাবো কেন ? সে তো আমাদের সায়রার ক্লোজ ফ্রেন্ড। সায়রা এখনও বাড়ি ফেরেনি বলে ওকে…!’

-” আপনার ভাগনী বাড়ী ফিরবেনা বলে আপনি আমার বোনকে আটকে রাখবেন।?
” শান্ত অথচ দৃঢ় স্বর মিলির।

-” আপনি ব্যপারটা ভুল বুঝেছেন মিস…!”

-” মিলি। আর আমি ভুল বুঝিনি। আপনি আমার বোনকে দিয়ে ঝিগাতলার বাড়ীগুলো তল্লাশী চালিয়েছেন। কী, চালান নি ? ”

-” তল্লাশী কী বলছেন ? ওখানে জাস্ট আরমানদের বাড়ীটা খুঁজে…!’

-” আরমানদের বাড়ী সাবা কেন খুঁজবে ? সাবা কী সায়রার ঠিকাদার? আপনি আপনার ভাগনিকে সামাল দিতে পারবেন না বলে কী অন্য বাড়ীর মেয়েদের এনে হ্যারাস করবেন ? কেমন মেয়ে আপনার ভাগনি যে বাসার কাউকে না বলে ভেগে যায় ? আপনারা সেই লজ্জা না করে দুটো ভদ্র ফ্যামিলির মেয়েকে এনে বসিয়ে রেখেছেন নিজের ভাগনিকে ট্রেস করতে । এত সাহস কেন আপনাদের ? ধনী হয়েছেন বলে কী বাকিদের কিনে নিয়েছেন নাকি? ” মিলির কথার তোড়ে মঈন কথা বলার সুযোগই পেল না। এরই মধ্য সায়রার মা বেরিয়ে এলেন। মিলি তাকে সালাম দিয়ে একই কথা বললে সায়রার মা নীলিমা হায়দার ভারী স্বরে বললেন, ” আমার মেয়ের সাথে দিনরাত চলে ওরা। সায়রার গতিবিধি ওরাই তো ভাল বলতে পারবে।”

-” অসাধারণ যুক্তি আন্টি। আপনার এই ভাই তো আপনার বাসাতেই থাকে। সে বাইরে গিয়ে কী করে তার সব তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন তাই না ? ”

-” তুমি তো দেখছি ভারী বেয়াদব মেয়ে ? আমার মুখের ওপর কথা বলছ? ”

-” সত্য কথা তেতোই লাগে। আমার বোনকে আপনারা পুলিশের ভয় দেখিয়েছেন বলেই বেচারী নড়াচড়া করার সাহস পাচ্ছেনা। কাজটা খুব খারাপ করেছেন আপনারা। সায়রার ফ্যামিলি বলে বেশী কিছু বলছি না। ” মিলি মঈনের দিকে তাকাল।” শুনুন, আমার বোনকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। এরপর পুলিশ ডাকলে যদি সাবাকে ডাকেন তো আমাকে সহ ডাকবেন। কথা যা বলার আমি বলব। আপনার মেয়ের যদি সম্মান থেকে থাকে তো আমাদের মেয়েরও আছে। আপনি ধনী বলে আপনার সম্মান বেশী হয়ে যায়নি।”

-” আপনি ব্যপারটা বুঝতে পারেন নি। তাই রেগে যাচ্ছেন।” মঈন বলতে চেষ্টা করলে মিলি রেগে বলে উঠল, ” কী বুঝিনি ? কোন সাহসে আপনারা বাচ্চা দুটো মেয়েকে অপরিচিত বাড়ীতে পাঠালেন। যদি ওদের কোন ক্ষতি হতো কী ক্ষতিপূরণ দিতেন আপনারা ? ”

-” শোনো মেয়ে…! ” নীলিমা ধমক দিয়ে ডাকলে মিলি সেদিকে ফিরে শান্ত স্বরে বলল।

-” আপনার কথা শুনতে আমি মোটেও বাধ্য নই। আপনার কটকট করে বলা কথা আপনার ওয়ার্থলেস ভাইকে বসিয়ে বসিয়ে শোনান। বেকার মানুষ। হাতে প্রচুর সময় তার। বসে বসে বড়লোক বোনের কথা শুনতে পারবে। এ্যাই সাবা আয়। তোয়া, তুমিও এসো।”

সাবা আর তোয়া উঠে আসার সময় মঈন মিনমিন করে স্যরি জাতীয় কিছু বলতে চাইল কিন্তু নীলিমা আপার কারণে পারল না। তিনি ধমক মেরে ওকে থামতে বললেন।
মঈন আর কথা বাড়াল না তবে তেজস্বীনি মেয়েটাকে চলে যেতে দেখে বুকটা হু হু করে উঠল। ইতস্তত করে ওদের পিছু নিতেই যাচ্ছিল মঈন। কিন্তু পেছন থেকে নীলিমা ডাক দিলে মঈনকে থেমে যেতে হল।

চলবে…..

(গত পর্বে দুটো ভুল ছিল যা এই পর্ব থেকে সংশোধন করে নিচ্ছি। সাবা কয়েকজন ভাইবোনের ছোট বোন আর রাশেদ সজীব এরা মেডিকেলে পড়ছে। ভর্তি পরীক্ষা না। তারা সরাসরি মেডিকেলের ছাত্র।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here