দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_২৪

0
1318

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৪
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

পাশ ফিরে উভয়ই শুয়ে আছে। অয়নন্দিতার মতে, বিকেলটা দারুণ কেটেছে। রাত আটটা পর্যন্ত রিক্সায় ঘুরেছে। ফুচকা খেয়েছে। তার ছোটো ছোটো ইচ্ছাগুলো পূরণ হয়েছে। এর জন্য অবশ্য ফারহানকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। দেওয়াটা উচিত।
ফারহান আজ তাকে বেলীফুলের মালা কিনে দিয়েছে। তারা দু’জন ফুচকা খেয়ে যেই না রোড ক্রস করেছে তখনই দুইটা ছোটো বাচ্চা এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। তাজা বেলীফুলের মালা নিবেন নি আফা, দেহেন অনেক সন্দর কইরা বানাইছি। নেন না আফা। সে হ্যাঁ বলার আগেই ফারহান বেলীফুলের মালাগুলো কিনে নেয়। অয়নন্দিতাকে পরতে বললে অয়নন্দিতাও কনফিউজড হয়ে যায়। কোথায় পরবে এতগুলো মালা সে। শেষ পর্যন্ত ফারহানই সলিউশন দেয়। কয়েকটা দু’হাতে আর বাকিগুলো চুলে পরতে বলে। অয়নন্দিতাও ফারহানের কথানুযায়ী হাঁটতে হাঁটতে মালাগুলো পরে নেয়। বেলীফুলের ঘ্রাণটা বেশ কড়া। নাকে আটকে থাকার মতো একটা ঘ্রাণ। অয়নন্দিতার বেশ মনে আছে, সে যখন মালাগুলো নিয়ে পরছিল ফারহান তাকে দেখছিল। স্থির চোখে না দেখলেও কিছুক্ষণ পর পর দেখছিল।
একই বিছানায় রাত কাটে তাদের দু’জনের। এই পরিবেশে কামনার তাড়না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু অয়নন্দিতা আর ফারহানের ক্ষেত্রে তা আলাদা। একটু ব্যতিক্রম ধর্মী বলা চলে। অয়নন্দিতার মন ফারহানকে কী রুপে পেয়ে খুশি তা এখনও ঘোলাটে। ফারহানের মন অয়নন্দিতাকে কী হিসেবে মানতে চাইছে সেটাও ঘোলাটে। বিবাহিত জীবনে থেকে তারা দু’জনই ঘোলাটে ভাবনায় আচ্ছাদিত।
ফারহানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে অয়নন্দিতা। আবার ফারহানও অয়নন্দিতার সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশে। স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে যেই সম্পর্ক থাকার কথা সেই সম্পর্কটা হয়তো তৈরি হতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। সেই সময়টা দিন কিংবা মাস অথবা বছরেও হতেও পারে। তবুও অয়নন্দিতা বেশ ভালো আছে তার বিবাহিত জীবনে।
ফারহান দেখতে যেমন সুদর্শন। বুদ্ধিতে তেমনই চৌকস। অয়নন্দিতার কাছে ফারহানকে অপছন্দ করার মতো কোনো কারণ নেই। কিন্তু ফারহানের কাছে অয়নন্দিতা আদৌ কেমন তা জানার প্রচুর আগ্রহ আছে অয়নন্দিতার। শুধু লাজ লজ্জার জন্য জিজ্ঞেস করতে পারে না।
শাম্মি প্রায়ই অয়নন্দিতাকে বলে, ভাগ্য করে একটা বর পেয়েছিস। কয়জন পায় এমন বর। আমি যদি পেতাম তাহলে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকতাম। অয়নন্দিতার বুঝে আসে না শাম্মি কেন পায়ে পড়ে থাকার কথা বলে। নিঃসন্দেহে ফারহান অত্যন্ত ভদ্র একজন পুরুষ। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকার কোনো প্রয়োজন হয় না। ফারহান তাকে যথেষ্ট সম্মান এবং স্নেহ করে।
মাঝে মাঝে শাম্মি একদম ওভার বলে। তার প্রশ্নগুলো অনেক ডীপলি হয়। যেমন, বর কতটা আদর করে, বর কতটা ভালোবাসে, বর রাতে ঘুমোতে দেয় কি না, সকালে গোসল হয় কি না। যার উত্তর দিতে অয়নন্দিতার মোটেও ভালো লাগে না। এক কথায় ভীষণ রকম অস্বস্তি আর বিরক্ত মনে হয়। তবুও সব হজম করে হাসিমুখে উত্তির দেয়, বরটা আমার। আমাকেই তো ভালোবাসবে। ভালোবাসাকে পরিমাপ করতে নেই। তাই বলতে পারছি না কতটা ভালোবাসে। উত্তর পেয়ে শাম্মিও চুপ হয়ে যায়। এতে শাম্মির দোষ নেই। সমবয়সী বান্ধবী থাকলে একটু আধটু বলবেই। অনেকে তো লিমিট ক্রস করে ফেলে। প্রথম রাতের ঘটনা ডিটেলসে না শুনলে তাদের আবার নাকি পেটের ভাত হজম হয় না। সেদিক থেকে শাম্মি ভালো আছে।

রাত সাড়ে তিনটা।
ফারহানের ঘুম আসছে না। কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। বুকটা জ্বালা করছে। মনে হয় গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেমটা বেড়েছে। এর কারণ অয়নন্দিতার ফুচকা। সন্ধ্যায় মেয়েটাকে ফুচকা খাওয়াতে গিয়ে নিজেকেও খেতে হয়েছে। সাধারণত সে ফুচকা, চটপটি খায় না। এইগুলো খেলে তার গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম হয়। বন্দনা যতবার ফুচকা খেত, ততবার ফারহানকে জোর করত। কিন্তু ফারহান কখনও খায়নি। কিন্তু আজ যখন অয়নন্দিতা জোর করল তখন আর না বলতে পারেনি সে। পুরো এক প্লেট ফুচকা খেয়েছে সে। আর ফলাফল এখন তার বুক জ্বালা করছে। পাশ ফিরে দেখে অয়নন্দিতা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ফারহান খুব ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসে। এরপর বিছানা থেকে সরে যায়। ড্রয়ার থেকে তার মেডিসিন বক্সটা বের করে নেয়। ঘরটা অন্ধকার। লাইট অন করলে অয়নন্দিতার এত সুন্দর ঘুমটা নষ্ট হয়ে যাবে। শেষ রাতের ঘুম ভেঙে গেলে অনেক সমস্যা হয়। পরবর্তীতে আর ঘুম আসে না। ফলে সারাদিন খারাপ লাগে। সে চায়না অয়নন্দিতার ঘুমটা ভেঙে যাক। কিংবা অয়নন্দিতার নতুন দিনটা খারাপ ভাবে কাটুক। ফারহান মেডিসিন বক্সটা নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে যায়। পুরো বাড়ির সবাই ঘুমে বিভোর। ফারহান ধীর পায়ে বিনা শব্দে ডাইনিংরুমে চলে আসে। চেয়ার টেনে বসে সেখানে। সামনেই গ্লাস আর পানির জগটা রাখা আছে। গ্লাসে পানি নিয়ে মেডিসিন বক্স থেকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নিয়ে খেয়ে নেয়। কিছুক্ষণ এখানেই বসে থাকে। দেয়ালে থাকা ঘড়িটা টিক টিক করছে। সেকেন্ডের কাটা ঘুরছে অনবরত। ফারহান যেন অতীতে হারিয়ে যাচ্ছে।
মানব জীবনে অতীত বড়ো ভূমিকা পালন করে। অতীত কখনও খারাপ আবার কখনও ভালো। তবে অতীতের স্মৃতিগুলো দুঃসহ হয়ে থাকে। ফারহানের জীবনের অতীতটা সে মনে কর‍তে চায় না। তবুও অতীত তার পিছু ছাড়ে না। অতীতকে ভুলে থাকার জন্য নতুন অধ্যায়ের পাতা উলটেছে সে। কিন্তু নতুন অধ্যায়ের ভাজে ভাজে যেন সেই অতীত আরও গাঢ় হচ্ছে।
ফারহান না পারছে অতীত ভুলতে। না পারছে নতুন অধ্যায়কে আপন করে নিতে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সে যেন দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে তার শরীর যেন দিন দিন অসার হয়ে যাচ্ছে। অতীতের স্মৃতিগুলো মধুময় ছিল বটে তবে তার শেষ হয়েছিল ভয়ানক পয়জন দিয়ে। পয়জনকে বাংলায় বিষ বলায় হয়। কিং কোবরার বিষের থেকেও তীব্র এই বিষের জ্বালা। সাপের বিষে মানুষ একেবারেই শেষ হয়ে যায় কিন্তু মনুষ্য বিষে অপর মানুষটা জীবিত থেকেও তিলে তিলে মরে।

‘এই যে মশাই, কী ভাবছ এত?’
ফারহান তাকিয়ে আছে সামনে অবস্থিত নারীর দিকে। পরনে তার লাল শাড়িটা তার দেহের সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে। কী অপূর্ব তার হাসি। বিমোহিত নয়নে ফারহান তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। বলছে,
‘এভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়ালে আমার ভাবনাগুলো উল্টেপাল্টে যায়৷ তুমি বোঝো না?’
‘এত কী চিন্তা করো তুমি?’
‘আমার চিন্তার শেষ নেই সুন্দরী। তবে তোমায় নিয়ে ইদানীং একটু বেশিই চিন্তা হয়।’
‘কেন?’
‘এত সুন্দর তুমি। যদি আমি তোমায় হারিয়ে ফেলি।’
‘আমি হারিয়ে যাওয়ার পথিক হলে একদিন না একদিন পথভ্রষ্ট হবোই হবো। এরপর হারিয়েই যাব।’
‘তার মানে তুমি হারিয়ে যেতে পারো, তাই না?’
‘কে জানে। বলা তো যায় না। তবে যতদিন না হারিয়ে যাচ্ছি ততদিন আমি তোমারই আছি। বুঝলে মশাই?’
ফারহানের কথাগুলো কেন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। হাতিয়ে যাওয়ার পথিক হলে একদিন না একদিন পথভ্রষ্ট হবেই হবে। কিন্তু কেন হবে। পথভ্রষ্ট হবার জন্য তো সে এ পথে আসেনি। তবে কেনই বা পথভ্রষ্টের কথা এলো।

আল্লাহ হুয়াকবার, আল্লাহ হুয়াকবার।
ফারহানের ধ্যান ভাঙে। আজানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তার মানে চারটার বেশি বেজে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারহান। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। মেডিসিন বক্সটা হাতে নিয়ে পা বাড়ায় নিজের ঘরের দিকে। অয়নন্দিতা হয়তো এখনও ঘুমোচ্ছে। টেরও পায়নি তার পাশ থেকে ফারহান উঠে ডাইনিংরুমে এতক্ষণ বসেছিল।
বুকের জ্বালাটা কমেছে। চোখ জোড়ায় ঘুম ভর করেছে। ফারহান বিনা শব্দে বিছানায় নিজের শরীর লাগায়। সে যা ভেবেছিল তা-ই হয়েছে। অয়নন্দিতা ঘুমে। চিন্তামুক্ত ঘুম। শান্তির ঘুম। ফারহান আরও একবার চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়।

চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here