দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_২৫

0
1437

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৫
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

বাড়ি ফিরে ফারহানের মুড অফ হয়ে গেছে। উপযুক্ত কোনো কারণ নেই। আর যা হয়েছে সেটা মুড অফ হবার মতো কোনক কারণও না। তবুও তার মুড অফ।
সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে ফারহান। কিন্তু কাজে মন বসছে না। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লে মাথা তুলে তাকায় ফারহান। ঘরের বাইরে সাজি দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় সাজি! সাজিকে এর আগে কখনও সে তার ঘরে আসতে দেখেনি। সে যখন বাইরে থাকে তখন সাজি না হয় মিসেস রওশন বেগম আসেন এই ঘরে। সব পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে যায়। অয়নন্দিতা এই বাড়িতে আসার পর সাজি প্রায় সময় অয়নন্দিতার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আসে। কিন্তু আবার যখন ফারহান থাকে তখন আসে না। সাজি তার বাবা এবং বড়ো ভাইকে সমান ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা করে। এটা নিয়ে ফারহানের অভিযোগ থাকলেও কখনও সাজিকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেনি। সে বোঝে সাজি তাকে সম্মান করে বলেই খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করে। অন্যদিকে ফারাশ এবং সাজির ব্যবহার অত্যন্ত বন্ধুসুলভ। এরা দুই ভাই বোন মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায় একত্রে। ফারাশ সাথে থাকে বলে সাজির উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে কারো মাথা ব্যথা থাকে না তেমন।সাজিকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারহান বলে,
‘কিছু বলবি?’
‘ভেতরে আসব?’
‘হ্যাঁ। আয়। অনুমতি নিতে হয় নাকি?’
সাজি ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। সোফায় বসতে বসতে বলে,
‘একটু আধটু তো নিতেই হয়।’
‘তোর ভাবির কাছে যখন আসিস তখনও কি অনুমতি নিয়েই ঢুকতে হয় নাকি?’
‘উহু। ভাবি যখন থাকে তখন সরাসরিই এন্ট্রি নেই।’
‘তাহলে আমার ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হয় কেন?’
সাজি এই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াই উচিত মনে করছে। কারণ উত্তর দিতে গেলে অনেক কিছুর ক্ল্যারিফিকেশন দিতে হবে যা সাজি চায় না। বিদ্বান ব্যক্তির মতো সাজি কথার মাঝখানেই ইউটার্ন মারে।
‘ভাবি যে তার মামার বাড়ি গেল। কবে আসবে কিছু বলেছে তোমাকে?’
এখানেই আপত্তি ছিল ফারহানের। সে চায়নি যে অয়নন্দিতা কোথাও যাক। কিন্তু অয়নন্দিতাকে আটকাতেও পারেনি সে। অয়নন্দিতা যখন সকাল এগারোটায় ফোন করে বলল তার মামা এসেছে। সে তার মামার সঙ্গে বাড়ি যেতে চায়। তখন অনায়াসে হ্যাঁ বলে দিলেও পরক্ষণেই মনে হয়েছিল না করলেই ভালো হতো। কিন্তু যেখানে একবার হ্যাঁ বলে দিয়েছে সেখানে না বললে ব্যাপারটা খারাপ দেখায় তাই আর কিছু বলতে পারেনি সে। ভেবেছিল অয়নন্দিতার বাড়িতে না থাকায় তার কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু এটা বুঝতেই পারেনি যে, বাড়ি ফিরে ঘরটা ফাঁকা দেখেই তার মনটা খারাপ হয়ে যাবে। এটা বুঝতেই পারেনি যে বাড়ি ফিরে ঘরটায় একজন মানুষের চোখের সামনে ঘুরঘুর করা, তা কথা না শুনতে পেয়ে এতটা বিষন্ন লাগবে। এমন মিশ্র অনুভূতিকে কী বলা যায় সেটাও ভাবতে হচ্ছে ফারহানকে।
সাজি তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবারও একই প্রশ্ন করলে ফারহান শান্ত নজরে সাজির দিকে তাকায়। ফারহানের শান্ত নজর সাজিকে অন্যদিকে ধাবিত করছে। তার চোখ যা দেখছে সেটা কি আদৌ সত্যি। তবে কি তার ভাইটা আবারও নতুন করে কিছু ভাবতে শুরু করেছে। নিজের কন্ঠকে আরও মলিন করে সাজি পরবর্তী প্রশ্ন করে,
‘ভাইয়া, তোমার কি মন খারাপ নাকি?’
বোনের প্রশ্নের উত্তরে না বোধক মাথা নাড়ে ফারহান। না বোধক হলেও সাজি বুঝতে পারে আসল ঘটনা কোথায়।
‘ভাবিকে মিস করছ, তাই না?’
এবারও ফারহান চুপ। এভাবে চুপ করে থাকলে সাজি তো কোনো কথাই বলতে পারবে না। আবার অতিরিক্ত প্রশ্ন করলেও সমস্যা। ফারহান রেগে যাবে। সবটা বুঝতে পেরেই সাজি একটা ছোট্টো নিঃশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সামনে পা বাড়াতেই ফারহান বলে ওঠে,
‘তোকে কিছু বলে যায়নি?’
ভাইয়ের কথায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ায় সাজি।
‘আমি ছিলাম না। মা’কে জিজ্ঞেস করলাম। মা বলল দুই তিন দিন নাকি থাকবে। আমি পরে অবশ্য ফোন করেছিলাম। রিসিভ করল ভাবির মামী। আন্টি বলল, ভাবি নাকি ঘুমোচ্ছে।’
‘পরে আর ফোন করেনি?’
‘নাহ।’
‘ওহ।’
‘তুমি ফোন করেছিলে?’
‘নাহ।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘এমনি আবার কী? ফোন করতে। আই থিংক ভাবির ফোনে ব্যালেন্স শেষ। যার জন্য ফোন করতে পারছে না।’
‘ব্যালেন্স শেষ হলে রিচার্জ করা খুব কঠিন কিছু না। সব কিছুর ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রয়োজন। তার হয়তো আগ্রহ নেই। তাই ফোন করছে না।’
ভাইয়ের কথায় অভিমান খুঁজে পাচ্ছে সাজি। ব্যাপারটা তার কাছে ভালো লাগছে। এতদিন পর তার ভাই কারো প্রতি অভিমান করেছে। সাজি ভাইয়ের পাশে বসে।
‘তুমি একবার ফোন করে দেখতে পারো তো।’
‘সেও তো পারে ফোন দিতে।’
কথাটা বলে শেষ করতে না করতেই ফারহানের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা টি-টেবিলের ওপর রাখা ছিল বলে স্পষ্টভাবেই অয়নন্দিতার ছবিটা স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। সাজির চোখ যায় ফোনের স্ক্রিনে। অয়নন্দিতাকে দেখা যাচ্ছে। লাল শাড়ি পরা, খোঁপায় গাজরা পরা একটা নিষ্পাপ মুখ। যার চোখ জোড়ার দিকে তাকালে মনে থাকা সমস্ত দুঃখ ভুলে থাকা যায়। যার মিষ্টি হাসি দেখলে রুপকথার রাজপুত্র তার রাজ্য ছাড়তেও বাধ্য। ইংরেজিতে ‘oyondita’ নামটা ভেসে উঠেছে। সাজি মুচকি হাসে এবং বলে,
‘দেখেছ ভাইয়া, ভাবির কথা বলতে না বলতেই সে ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করো। কথা বলো তার সঙ্গে।’
সাজি চলে গেলে ফারহান ফোনটা রিসিভ করে। এপাশ-ওপাশ দু’পাশেই নীরবতা। অয়নন্দিতা অভিমান নিয়ে ফোনটা করছে আর ফারহান, সেও অভিমান নিয়েই ফোনটা রিসিভ করেছে।
নীরবতা পালন করার মতো ধৈর্য আর নেই অয়নন্দিতার। তাই সে নিজেই বলে ওঠে,
‘কেমন আছেন?’
ফারহানের অভিমানটা কেন যেন আরও গাঢ় হয়ে গেছে। ভেতরটা অস্বস্তিতে ভড়ে উঠছে। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ফারহান বার কয়েক নিঃশ্বাস নেয়। এর ধীর কন্ঠে বলে,
‘ভালো। তুমি কেমন আছো?’
‘আমি ভালো আছি।’
‘ভালো আছো বলেই কি ভুলে গেছ?’
ফারহানের বলা এই কথাটা অয়নন্দিতার গায়ে কাটার মতো বিঁধে গেছে। মনে হলো খোঁচা মেরে বলা হয়েছে কথাটা। তবে খোঁচা মারার পেছনে যেই কারণটা লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগেনি তার।
অয়নন্দিতা এদিক-ওদিক না ঘুরিয়ে সোজাসাপ্টা করেই উত্তর দেয়।
‘কোনো একজনও কিন্তু আমায় ভুলে গিয়েছে। সেও কিন্তু আমায় ফোন করেনি। তবে কি সেও খুব ভালো আছে?’
এবার ফারহান দমে যায়। কথাটা তো সত্যি। সারাদিনেও সে ফোন করেনি অয়নন্দিতাকে। বাড়ি ফিরে এসেও ফোন করেনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দেরি হলেও অয়নন্দিতাই তাকে ফোন করেছে। এবার তার অভিমান এবং অভিযোগ দুটোই কমিয়ে দেওয়া উচিত।
অয়নন্দিতা হালকা হাসে। এতদিনে সে এটা অন্তত ভালো করেই বুঝেছে যে তার হাসিটা ফারহানকে একরকম শান্তি দেয়। আগেও খেয়াল করেছে, সে যখন ফারহানের সামনে হাসে তখন ফারহানের চোখ মুখে এক ধরনের প্রশান্তি কাজ করে।
‘আমি কি ফোনটা রেখে দিব?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নের জবাবে ফারহান বলে,
‘রেখে দেওয়ার জন্যই বুঝি ফোন দিয়েছ?’
‘কেউ যদি কথা না বলে তবে ফোনের বিল বাড়িয়ে আছে।’
‘খেয়েছ রাতে?’
‘হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ।’
ফারহান মিথ্যা বলে। সে খায়নি। তার খেতে ইচ্ছে করছে না। অয়নন্দিতার অনুপস্থিতিটা তাকে ব্যথিত করছে। খাওয়ার প্রতি অরুচি ধরেছে। আপনি খেয়েছেন?–প্রশ্নের উত্তরটা যদি ফারহান না বোধকে দিত তবে অয়নন্দিতা অস্থির হতো৷ ততক্ষণ পর্যন্ত বিরক্ত করত যতক্ষণ পর্যন্ত ফারহান না খেত। তাই অয়নন্দিতার অস্থিরতাকে দূরে রাখতেই ফারহান মিথ্যা বলে।
ফারহান ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
‘কবে ফিরবে?’
‘আজকেই তো এলাম। দুটো দিন থাকব না?’
‘থাকতে চাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। থাকি না দুটো দিন।’
‘বেশ, থাকো। ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হলো।’
‘রাগ করলেন বুঝি?’
‘নাহ। আমি শুয়ে পড়ব তো। আগামীকাল মিটিং আছে। নয়টায় অফিসে পৌঁছাতে হবে।’
অয়নন্দিতাও আর বাড়তি কথা না বলে ফোন রেখে দেয়।

পরদিন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অয়নন্দিতা, মিলি বারান্দায় বসে কথা বলছে। মিলি প্রশ্ন করছে অয়নন্দিতা উত্তর দিচ্ছে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না চাইলেও দিতে হচ্ছে। কিছু উত্তর বানিয়ে বানিয়ে বলতে হচ্ছে। মিলিসহ বাকিরা তার আর ফারহানের সম্পর্কটাকে যেমন স্বাভাবিক ভাবছে আসলে তাদের সম্পর্কটা যে তেমন স্বাভাবিক নয় এটা তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ জানে না।
অয়নন্দিতার উদাস মুখটা মিলির নজর এড়ায়নি। এতক্ষণ যাবত প্রশ্নের উত্তরগুলো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে দিলেও এখন অয়নন্দিতার সব কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মিলির সন্দেহ হচ্ছে। মিলি প্রশ্ন করে,
‘তুমি ঠিক আছো তো অয়নি?’
মিলির প্রশ্নে অয়নন্দিতা হাসিমুখে জবাব দেয়,
‘হ্যাঁ, ঠিক আছি।’
‘কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই।’
‘ভুল ধারণা তোমার। আমি ভালো আছি।’
‘আচ্ছা শোন, ফারহান ভাই কেন এলো না?’
‘কাজের চাপ বেশি৷ আর দ্বিতীয়ত হয়তো আমাদের বাসার পরিবেশ তার পছন্দ হবে না।’
‘এটা ঠিক বলেছ। তাদের বাড়িটা তো ভীষণ হাই-ফাই।’
‘এত হাই-ফাই জায়গায় বিয়ে না হলেই ভালো হতো। তাহলে জামাইও আসত। কী বলো?’
‘এভাবে বোলো না। তিনি হয়তো এসবে অভ্যস্ত না। যে যেই পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত আর কি।’
মিলি যা-ই বলুক না কেন, ফারহান যে এখানে আসবে না এটা অয়নন্দিতা ভালো করেই জানে। তার আর ফারহানের সম্পর্কটা কতখানি এগোবে সেটা নিয়ে এখনও নিশ্চিত নয় অয়নন্দিতা। হয়তো সারাজীবন টিকে যাবে নয়তো মাঝপথেই শেষ হয়ে যাবে। সম্পর্কটা যদি বন্ধুত্বের মধ্যে থেকে যায় তবে স্বামী সোহাগ তার কপালে থাকবে না। সম্পর্কটা যদি দাম্পত্য জীবনের মধ্য দিয়ে যায় তবে বন্ধুত্বটা হয়তো হারিয়ে যাবে। ইকুয়েল ভাবে দুটো পেতে ভাগ্য লাগে। আর সেই ভাগ্যটা বোধ হয় অয়নন্দিতার নেই। কারণ, ফারহানের পৃথিবীর অর্ধেকের বেশিটাই জুড়ে আছে বন্দনা।

চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here