ধূসর ভালোবাসা পর্ব-১৬

0
933

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব – ১৬

একটা পুরো জীবন পার করার পর যখন জানতে পারা যায়, পুরোটাই ভুল। তখন আসল বলে কিছুই থাকে না, সবই মেকি। আমার ধূসর অবছায়া জীবনে এখন পুরোটাই মিথ্যে। বহু চেষ্টা করে যখন নিয়তিকে পালটাতে পারলাম না, তখন সে নিয়তিকেই পাল্টে ফেলা শ্রেয়।

মেয়ের আর ছেলের হাত ধরে আরেকটা জীবনে পা দিতে যাচ্ছি। জানি না সেখানে কি লেখা আছে নতুন করে। তবে জীবনের সাথে যে আগে থেকেই লড়াই করে আমি অভ্যস্ত। তাই নতুন করে লড়তে আমার কোন ভয় নেই।

সকালে নিয়াজ নাস্তা করে বের হয়ে গেলো। ছেলে মেয়ের হাত ধরে, বেরিয়ে পড়লাম। পেছনে তাকাইনি একবারো। পেছনে ফেলে আসা আমার ধুসর ঘুনে ধরা জীবন, সামনে এগিয়ে গেলাম আলোকিত কোন জীবনের আশায়, যেখানে আতঙ্ক, হাহাকার আর মিথ্যে মরিচিকা নেই। আছে শুধু প্রান খুলে নিশ্বাস নেবার মতো ভালোবাসা, আর বুকভরা সুন্দর কিছু স্বপ্ন। আছে আপনের মায়াভরা হাতের স্পর্শ, নয়তো কোন মিথ্যে অবছায়া।

ঢাকায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো, বাসায় পৌছে বাবার সামনে দাঁড়ালাম। বাবা কিছুক্ষন আমার কপালের ক্ষতটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

– এতো দেরি কেন করলি মা? আর একটা কথা এর আগে বহুবার রাগ করে এসেছিস, আবার নিয়াজের কথায় সব ভুলে গিয়ে চলেও গেছিস। কিন্তু এবার যদি চলে যাস, তাহলে আমার মৃত্যূর খবর পেলেও, আমার মুখ দেখতে আসবি না।।

– বাবা আমি কোথাও যাবো না, কোত্থাও না। আমি সব ছেড়ে চিরতরে চলে এসেছি বাবা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

– শোনা মা, তোর দুটো বাচ্চা, ওরা আমার নয়নের মনি। তুই ওদের জীবন নিয়ে একটুকু ভাববি না। আমি আছি ওদের জন্য।

বাবা আমাকে ইরেগুলার ব্যাচে ভর্তি করে দিলেন, মাস্টার্সের জন্য। আবীরকে একটা বোডিং স্কুলে। কারন আমি জানি নিয়াজ অনেক নাটক করবে। আমার ছেলের জীবনে নিয়াজের কোন ছায়া পড়ুক তা আমি চাই না।

অবন্তিকে স্কুলে ভর্তি করলো বাবা। তবে বাবার শরীরটা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রেসারটা হাই হয়ে যাচ্ছে, ডায়বেটিস ধরা পড়েছে। হার্টেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। বাবা আমাকে ব্যাংক গুলোনে এপ্লাই করতে বললেন।

আবীর রাজি হচ্ছিল না, বোর্ডিং এ যাওয়ার জন্য। বাবা মাও রাজি নয় কিন্তু আমি আবীরের জীবনে আমার কষ্টের কোন প্রতিচ্ছবি পড়তে দেবো না। অবন্তিটা প্রায় মন খারাপ করে বসে থাকে। মেয়েটাকে সান্তনা দেবার ভাষাও খুঁজে পাই না।

এ বয়সে পড়াশোনা মোটেও ভালো লাগে না, কিন্তু আমাকে যে পারতেই হবে। আমার নিজের জন্যে, আমার সন্তানদের জন্যে।

নিয়াজ মাঝে মাঝে রাতের বেলা নেশার ঘোরে ফোন করে, মাফ চায়। কান্না কাটি করে। একবার রাবেয়া খালা ফোন করে বললেন যে, নিয়াজ ওদের বাসায় গেছে। আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। বাবা খালাকে বলেছে, যদি নিয়াজকে বাসায় ঢুকতে দেয় তাহলে আমাদের সাথে যেন সম্পর্ক ছিন্ন করে।

রোজ রাতে নিয়াজের ফোনের অত্যাচারে বাবা আমাকে আর ফোন ধরতে দেয় না। আর রাতে টেলিফোনের রিসিভার তুলে রাখে। বাবা এতো বকা দেয় তবুও মাঝে মাঝেই টেলিফোনে ফোন দেয়। বাবার ভয়ে বাসায় আর আসতে পারেনি।

মাঝে মাঝে সবকিছু অন্ধকার মনে হয়, মনে হয়যে হয়ত আমি কিছুই করতে পরাবো না। কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছি। কিন্তু সবাই অভিজ্ঞতা চায়। জিজ্ঞেস করে, মাঝে এতোদিন চাকরির জন্য চেষ্টা কেন করিনি?

তবে এতো কিছুর মাঝে আমি এটাই বুঝেছি, লড়াইটা আমার নিজের। আমার নিজেকেই যুদ্ধ করতে হবে। বাবা খুব চিন্তা করে আমার জন্য। বিশেষ করে, কোন চাকরি হচ্ছে না সে কারনে।

ভাগ্যের কি লেখা, আজ ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। আমার সামনে বসে যে ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, সে হলেন, বাবার অফিসের সেকেন্ড অফিসার ‘আলতাফ’। সে এখন অনেক বড় পোষ্টে চলে গেছেন। আমাকে চিনতে পেরেছে কিনা বুঝতে পারলাম না।

ইন্টারভিউটা খুব ভালো হয়েছে। আমার চাকরিটা হয়ে গেলো। বাবা খুব খুশি হয়েছেন। অবশেষে মনে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। আমার সন্তানদের সব ইচ্ছে আমি নিজে পূরন করতে পারবো। আল্লাহর অশেষ রহমত নইলে এতো কিছু অসম্ভব ছিল।

তবে বেশিদিন এ সুখ আমার সইলো না, বাবা সুস্থ মানুষ রাতে ঘুমালেন। সকালে আর উঠলেন না। ঘুমের মাঝেই উনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। পৃথিবী শুন্য করে, আমাদের এতিম করে বাবা চলে গেলেন।

বাবা এভাবে হঠাৎ চলে যাবেন, আমার জীবন আবার অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। মাত্রই মনে হচ্ছিল সব কাটিয়ে উঠছি। কিন্তু নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেলো। এখন আমার দায়িত্ব আরো বেশি, মা অবন্তি ও আবীর এই এখন আমার জীবন।এদের দেখা শোনার সব দায়িত্ব এখন আমার।

নিয়াজ বেশ কিছুদিন চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার। তারপর আর সামনে আসেনি, কারন ততদিনে নিয়াজ আবার অন্য রঙ্গীন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। রংপুরের যে পাড়ায় ছিলাম, সেখানের প্রতিবেশিদের সাথে আমার কথা হয়। উনাদের মুখে শুনেছি, নিয়াজ খুব ভালো আছে। তাকে বাঁধা দেবার কেউ নেই। যা ইচ্ছা তাই করে বেড়ায়।

একদিন একটা চিঠি এসেছে বাসায়, মা রেখে দিয়েছেন। আমি অফিস থেকে ফিরলে মা চিঠিটা দিলেন। খুলে দেখলাম, ডিভোর্স পেপার। যাতে নিয়াজের সিগনেচার নেই, আছে আমার দেবরের সিগনেচার। বুঝতে বাকি রইল না, এটা আমার শাশুড়ির কাজ। আর হাতের লিখাটা চিনতে পারলাম কারন, আমার দেবরের লেখা পড়ার হাতে খড়ি আমার কাছে। তাই ওদের হাতের লেখা আমি চিনি।

তবে এই ডিভোর্সের কথা আমি কাউকে বলিনি। মা কিংবা অবন্তি এ কথা শুনলে খুব কষ্ট পাবে।

নিয়াজ এখন তেমন করে আর যোগাযোগের চেষ্টা করেনা, এর মানে ডিভোর্স সে নিজেও চায়। আমি এখন আর এগুলো নিয়ে চিন্তা করতে চাইনা। তবে মাঝে মাঝে নিয়াজকে জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে হয়, আমার কি দোষ ছিলো? কেন সে জোর করে আমার জীবনে আসলো? কেনই বা আমার জীবন নিয়ে এভাবে খেললো?

তবে নিয়াজ এখন খুব ভালো আছে, ওর চোখে এখন পুরো পৃথিবী রঙ্গীন। কেউ নেই বাঁধা দেবার। আমার শাশুড়ি, তার ইচ্ছে মতো ছেলের সম্পদ লুট করতে পারছে আর চোখের সামনে ছেলের অধ পতন দেখছে। তবে এতে নিয়াজের মায়ের কোন আসে যায় না, তার তো লোভ শুধু টাকার। সন্তানের বলি দিয়েও সে টাকা নিতে দ্বীধা করবে না।

নিয়াজ ওর জীবন নিয়ে খুব ভালো আছে, আর আমি আমার সন্তানদের নিয়ে ভালো আছি। এই বেশ। কি দরকার আর অবন্তি ও মায়ের কষ্ট বাড়ানোর, ডিভোর্সের কথা বলে।

ছেলেটা বোর্ডিং এ ভালো রেজাল্ট করছে, অবন্তি পড়ায় অনেক ভালো। মেয়েটার জীবনে কোন ক্ষতি আমি হতে দেবো না। মায়ের শরীরটা ভালো থাকে না, বাবা চলে যাবার পর থেকে। ভাই আর ইরাকে দেখিনা অনেক দিন হলো। শুধু ফোনেই কথা হয়। জীবনটা পাল্টালো এটা সত্য কিন্তু বহু কিছুই হারিয়ে গেলো।

আর হারিয়ে যাবার যোগ বিয়োগের হিসেব আমার পক্ষে খুব কষ্টের। কেন এমনটা হলো? কেন জীবন এমন করে হিসেবের বাহিরে রয়ে যায়।

জানিনা নিয়াজ কেমন আছে, তবে সবার আড়ালে আমার চোখ নিয়াজের জন্য ভিজে। বহু রাত আমার নিয়াজের কথা ভেবে নির্ঘুম ভাবেই পার হয়ে যায়। আজো আমি কল্পনা করি, নিয়াজ সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একদম একটা ভালো মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে। ছেলে মেয়ে নিয়ে আমরা আবার সুখের কুটির সাজিয়েছি। যদিও আমি নিশ্চিত, এটা হবার নয়।

আমার মেয়ে এখন বেশ বড় হয়েছে, সে অনেক দৃঢ মনের সাহসী ও বিচক্ষন মেয়ে। তাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি, অনেক স্বপ্ন।

আমার ছেলেটা, আমাকে বোঝে কিনা জানি না। তবে সে বেশ লক্ষি, পডাশোনাতেও বেশ ভালো। এইতো জীবন। তবুও বেলা শেষে আমার মন খুঁজে ফেরে কোন এক পায়ের চিহ্ন। কোন এক ফেলে আসা বিকেলের শুভ্র বাতাস, সেই বাতাসে কারো এলো চুল। তবুও আমার বেখেয়ালী মন খুঁজে, কাউকে। হৃদয়ের আঙ্গিনায় যার অবাধ বিচরন। লোক চোক্ষের আড়ালে কোথাও কখনও তার যদি দেখা পাই।

এক অবাক সমাজ আমাদের, কোথাও কোন একা মেয়ে দেখলেই মনে করে অসহায়। মাথার উপর বাবা নেই, নেই স্বামীর পদচিহ্ন। সে কারনে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অনেক হাত আমার আশে পাশে দেখতে পাই। কিন্তু বাহিরের এই মানুষ গুলো জানেনা, সব হারিয়ে একা পথে যে মেয়ে গুলো হাটতে শুরু করে, তারা আসলে একা নয়। সয়ং বিধাতা তাদের সহায় হয়ে পাশে থাকে।

#সিরাজুম_মনিরা
২৭-০৬-২০২০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here