ধূসর ভালোবাসা পর্ব-২৬

0
822

#ধূসর_ভালোবাসা
২৬ পর্ব

সন্ধ্যার কিছু পরে মামনি আর নানী বাড়ি ফিরলেন। উনাদের সাথে অল্প কিছু কথা বলেই, উনাদের ফ্রেশ হতে বলে আমি রান্না ঘরে গেলাম। সানেকা খালাকে লেবুর সরবত করতে বলে, আবীরের ঘরে এসে আবীরের পাশে বসে রইলাম।

– আবীর কি করে বলবো মামনিকে? তুই বলবি ভাই?

– আমি পারবো না আপু।

– তাহলে কি করবো?

ইরা খালামনিকে ফোন দিলাম, কিভাবে মামনিকে জানাবো। এটা নিয়ে কথা বলার জন্য। খালা মনি বললেন, তাহনীম মামার সাথে কথা বলতে।
আমি বড় মামাকে ফোন দিলাম, মামাকে সব বললাম। মামা বললো, রাতের খাওয়ার পর যেনো মামাকে মামনির সাথে কথা বলিয়ে দেই। মামা নিজে মামনিকে সব বলবে।

সানেকা খালাকে রাতের খাবার টেবিলে দিতে বলে, মামনির কাছে এলাম। আমি আর আবীর মামনিকে নিয়ে খেতে বসলাম। নানী এসে বসলো।

মামনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা এই কয়দিনে কেমন মলিন হয়ে গেছো। চোখ মুখ কালো লাগছে। ঠিক ভাবে খাওনি তোমরা। সানেকা, বুবু তুমি ওদের ঠিক মতো রেধে দাওনি তাইনা। তবে কি অবন্তি, ওখানে আমার একদম ভালো-লাগছিল না। তোমাদের কোন খোঁজও নিতে পারছিলাম না।

নানী বলে উঠলেন, আসলেই। সুন্দর বনে পৌঁছানোর পর থেকেই তোদের মামনির একটাই কথা বাড়ি যাবো। ছেলেমেয়ে গুলো যে কেমন থাকলো। তার নাকি বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

মামনি বললেন, একবারে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল খুব দরকারি কোন জিনিস হারিয়ে গেলে যেমন কষ্ট হয় তেমন। অস্থির লাগছিল। কেন যে তোমাদের রেখে গেলাম। বেড়িয়ে কোন আনন্দই পাইনি। শুধু শুধু মনের মধ্যে অশান্তি হচ্ছিল। অবন্তি জানিস, মনে হচ্ছিল খুব জোরে কাঁদি, তাহলে হয়ত বুকের মধ্যে শান্তি লাগবে। সবাই বার বার বলছিল, আমার মন খারাপ কিনা। কিন্তু আমিতো নিজেই কিছু বুঝছি না। ওদের কি বলবো বল?

– সেটাই মামনি। আমি বললাম।

মামার সাথে কথা হলো যে রাতে মামনিকে আর বাবার কথা বলবো না। সকালে বলবো।

সকালে নাস্তা করার পর বড় মামা মামনিকে ফোন করলেন, এবং বাবার কথা বললেন। মামনি চুপ করে বসে রইলেন। শুধু চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আমি আর আবীর সকালেই নানীকে সবটা বলেছিলাম। আমরা সবাই মামনির পাশে গিয়ে বসলাম। মামনি আমার হাতটা ধরে ছোট মানুষের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর কিছু সময় বিলাপ করে কাঁদলো। মামনিকে আমরা কেউ থামাইনি। সে কাদুক, মনের পুরোটা কষ্ট উজার করে কাদুক। কতটা সময় পর মামনি আমাকে আর আবীরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,

– শেষ বার নিয়াজের মুখটা দেখতে পেলাম না। যাকে নিয়ে পুরো জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম, সে জীবন থেকে বিদায় নিল। কিন্তু শেষ দেখা আর হলো না।

মামনি একে একে সবার কথা জিজ্ঞেস করলেন। সবাই কেমন আছে। ছোট দাদির কথাও বললাম। আরো বললাম,

– মামনি ছোট দাদি তোমার সাথে কথা বলতে চায়। মোবাইল নম্বর নিয়ে এসেছি। আর রাজু নামে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন।

– সে কি চায়, তার মনের বাসনাতো পূর্ন হয়েছে। আবার আমার সন্তানদের বাবার মৃত্যূতে, আমার সন্তানদের কাছে তার কি চাওয়া।

– মামনি উনি ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন। সে তোমার সাথে কথা বলতে চায়।

– খবর্দার, সে যেন এই স্পর্ধাই না করে। আমি এ জনমে তার সাথে কথা বলবো না। সে যদি ফোন করে বলে দিও, আমার কাছে নয়, উপরওয়ালার কাছে ক্ষমা চাইতে বলো। জীবনের সব কর্মের ক্ষমা হয় না মা। তাকে বলে দিও।

মামনি নিজের ঘরে গিয়ে বেলকনির রকিং চেয়ারে বসলো, পাশে আমরা দুজন। আজ আর মামনিকে একা রাখবো না, মামনি নিজের মনে কি থেকে কি, কত শত কথা বলেই যাচ্ছে। চোখের কোন থেকে অনবরত পানি ঝরেই যাচ্ছে। মামনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এক বারে দেখতে তোমার বাবার মতো হয়েছো। আমার চুলের মাঝে হাত দিয়ে বললেন, যে দিন তুমি এ পৃথিবীতে আসো, সে দিন তোমার বাবা খুব খুশি হয়ে ছিলেন। বলেছিলেন, তার রাজকন্যা হয়েছে। চাঁদের এক টুকরো একটা মেয়ে।

আর আবীর হয়েছিল আমার মায়ের বাসায়, তোমার বাবা ভেবেছিল যে আবীর মেয়ে, তাই ১৩ দিন পর আবীরকে দেখতে আসে। এসে আবীর মেয়ে নয় ছেলে, এটা দেখে সে খুব খুশি হয়। আর আবীর তোমার বাবার কোলে গিয়ে খুব হাসতে থাকে। সে তোমার বাবার কোলে থাকতেই বেশি পছন্দ করতো। আবীরকে একটা সময় নিয়াজ খুব ভালো বাসতো। মামনি আজ তার স্মৃতির পাতায় হাতড়ে বেড়াচ্ছে বাবাকে। আমি তার চোখে বাবার জন্য এক অন্যরকম ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি। মামনি বাবাকে একেবারে হারিয়ে ফেলেছে আজ। তার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা ছিলেন বাবা। আজীবন তার স্বপ্ন গুলো ছিলো বাবাকে ঘিরে। আজ তার সব স্বপ্নই মলিন, ধূসর, আবছায়া।

মামনি দুপুরে গোসলের পর একটা ধব ধরে সাদা শাড়ি পরলেন। সাদা শাড়িতে মামনিকে দেখে প্রথমে চমকে গেছিলাম।

আবীর মামনির এই পোশাক নিতে পারছে না, সে বললো, মামনি তুমি কেন সাদা শাড়ি পরলে?

তারপর মামনি কাছে এসে বললো, নিয়াজের মা আমার নিয়াজের বৌ হয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা কেড়ে নিলেও বিধবা হবার অধিকার কাঁড়তে পারবে না। এটা একান্তই আমার অধিকার। আমার ফেলে আসা দিনের প্রতিটা পর্যায়ে ছিল নিয়াজ, ভবিষ্যতেও ওর হয়েই আমি মরতে চাই। আর সে কারনে আমি নিয়াজের বিধবা স্ত্রী।

আমরা দুই ভাইবোন কোন কথা আর খুঁজে পেলাম না। নানী আমাদের ডেকে বললেন, তোমার মাকে তার ইচ্ছে মতো চলতে দাও। তবে খেয়াল করলাম বিকেল নাগাদ মামনির কথা কেমন কেঁপে কেঁপে তোতলানোর মতো করে বলছে। সন্ধ্যার সময় ডাক্তারের কাছে নিলাম। ডাক্তার বললেন, মামনির রেষ্ট দরকার। প্রেসার খুব বেশি। অন্যান্য সমস্যা গুলো বাড়ছে।

আর মামনির যে অবস্থা শরীরের তাতে ব্যাংকের চাকরী মামনির জন্য কঠিন কারন মামনির শরীর এখন আর আগের মতো নেই। অফিস এর কাজে ভুল হচ্ছে প্রায়। বেশি সময় অফিস করতে পারছে না মামনি।

বাবা মারা যাবার পর থেকে মামনি পুরো পুরি বাবার স্মৃতিতে ডুবে থাকে। আমি চাই মামনি চাকরিটা ছেড়ে দিক। কিন্তু নানী বলেন, যে তোর মা চাকরি করছে বলে তাও ভালো আছে। নইলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।

নানী সব সময় একটা কথা বলেন, শুনতে খারাপ লাগলেও কথা টা আসলেই ভাবায়। নানী বলেন,

– নিয়াজ এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবিনি। নিয়াজের বহু কিছু দেখার ছিল। বহু কষ্ট পাওনা ছিল। এতো সহজে, তাড়াতাড়ি সে চলে যাবে এটা কখনই কল্পনা করিনি। ভেবেছিলাম, বেঁচে থাকতে থাকতে নিয়াজের শেষ পরিনতি যেন দেখে মরতে পারি। অথচ নিয়াজই চলে গেলো আমার আগে।

-নানী, আল্লাহ কপালে যা লিখে রেখেছেন। তাই হবে। তবে প্রতিটা কর্মের শাস্তি আছে, তোমার কাছেই শুনেছি। ভালো কর্মের ভালো ফলাফল, খারাপ কর্মের খারাপ ফল। জানিনা, বিধাতা আমার বাবার ক্ষেত্রে কোন ভাবে হিসেব করেছেন। তবে উনার হিসেবে কোন ভুল হবে না।

সাদ এর সাথে যোগাযোগ না করলে আমি কষ্ট পাই। আবার তার বাবার কথা মনে পড়লে, পরোক্ষনেই সব কেমন ওলোট পালোট লাগে। আজ বিকেলে অফিস শেষে সাদের সাথে দেখা করবো। বেশ অনেক দিন দেখা হয়নি।

সারাদিন অফিসে এমনিতেই মন ভালো হয়ে আছে। আসলে সাদের সাথে দেখা করবার আগে আমার মন এমনটাই ভালো থাকে। সাদের মতো মানুষকে বুক ভরে শুধু ভালোবেসে গেলেও খুব কম মনে হয়। সে আমার পাশে যদি না থাকতো, আমি হয়ত হারিয়েই যেতাম।
সাদ দূরে থাকলেও সব সময় মনে হয়, সে আমার পাশেই আছে। জীবনের কঠিন সময় গুলোতে সে আমার একটা বিশ্বস্ত ছায়া। সাদ এর ভালবাসার হাত আমার পাশে ছিল বলেই কত কষ্ট আমি সহজেই পাড়ি দিয়েছি। আমার আঁধারে আচ্ছন্ন, অন্ধকার জীবনের প্রদ্বীপ তুমি সাদ। এই তোমাকে ভালোবেসে হাজার জীবন পাড়ি দেয়া যায়। এই জীবনে আজও সুস্থ হয়ে বেঁচে আছি, তোমার ভালোবাসার শক্তিতে।

ঐতো সাদ দাড়িয়ে আছে, দূর থেকে সাদকে দেখতে, আজ খুব সুন্দর লাগছে। সে আমার পছন্দের সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরেছে। চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ করলেও, বাতাসে তা এলোমেলো করে দিচ্ছে। তাতে সাদকে আরও বেশি ভালো লাগছে।

– এই ছেলে, এতো সেজেগুজে বাহিরে এসেছো কেন?

– মানে?

– নজর লাগতে পারে।

– কে দেবে নজর, শুনি!

– এইজে আশে পাশে কত ডায়নী থাকতে পারে।

– ওহ, আমিতো আমার পাশে তোমাকেই দেখছি।

– কি, আমি ডায়নী? যাও, তোমার সাথে কোন কথা নাই।

– সরি, সরি। তবে ডায়নীকে ডায়নী বললেও দোষ। হা হা হা ।

– যাও, কথা বলবোই না। চলেই যাবো।

– যেও না, তোমার মত ভূতনি আমার জীবনে যে খুব চাই। কারন আমার মত ভূতের কপালে তুমি ছাড়া আর কিছুই নিতে পারবো না। এই এক জীবনে শুধু তুমি পাশে থেকো তাহলেই চলবে। আমার ভূতনি।

দুজনে সারাটা বিকেল খুব ঘুরলাম, আড্ডা দিলাম। সময়টা আমার সোনার ফ্রেমে আটকে রাখতে খুব মন চায়। সাদের সাথে কাটানো সময় গুলোতে আমার জীবনের সব বিষাদ ভুলে যাই। সে সময় টুকু আমার একচিলতে জীবনের স্রেষ্ঠ পাওয়া। এই এক জীবনে শুধু সাদ যদি পাশে থাকে, কোন দু:খ কষ্ট আমাকে ভাঙ্গতে পারবে না।

– বহুদিন বাড়ি যাওনি, তোমার একবার বাসায় যাওয়া উচিত। বাবা মা কেমন আছেন। তাদের পাশে থাকা তোমার উচিত।

– আমিও ভাবছি, অবন্তি। অনেক দিন বাসায় যাই না। বাবা মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখিনি।

– তাহলে আর দেরি কেন?

– আগামীকাল বৃহস্পতিবার, অফিস করেই চলে যাও।

– ঠিক আছে। মহারানী, ভুতনী আপনার হুকুম স্বীয় ধার্য। কাল অফিস করেই চলে যাব বাড়ি।

বাসায় ফেরার পথে ভাবলাম, সাদকে যেতে তো বললাম। কিন্তু সাদের বাবা যদি জোর তরে সাদকে বিয়ে দিয়ে দেয়। নানা তা হবে না। ইনশাহ আল্লাহ, সাদ ফিরে আসবে আমার হয়ে।

বাসায় এসে দেখি মা খুব চিন্তা করছে, আবীর বাড়ি ফিরে নি। মাকে সান্তনা দিলাম যে, চলে আসবে। চিন্তা করো না। কিন্তু নিজের রুমে এসে ভয় করতে শুরু করলো। আজ কাল আবীর কেমন করে যেন কথা বলে। কোন ভয় ছাড়াই, বেপরোয়া ভাবে। রাত এগারোটা বাজে আবীর এখনও বাসায় ফিরেনি।

#সিরাজুম_মনিরা

একজন লেখকের একটা পর্ব লিখতে নিম্নে ৪/৫ ঘন্টা সময় লাগে। সেটাকে ঠিক ঠাক করে পাঠকের কাছে তুলে ধরেন আমাদের খুশির জন্য। আমরা ৪/৫ মিনিটে সেটা পড়ে শেষ করে একটা লাইক দিয়ে next লিখে চলে যাই। এটা না করে একটু ৮/১০ সেকেন্ড খরচ করে ছোট্ট সুন্দর একটা কমেন্ট করলে লেখকের লিখায় আরও স্পৃহা আসে, কষ্টটা কে সার্থক মনে হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here