ধ্রুবতারা
পর্ব_২৯
পুষ্পিতা_প্রিমা
তালুকদার বাড়ি থেকে বধূবিদায় শেষে সবাই আবার যাত্রা করলো বরের বাড়িতে। পাশাপাশি দুইবাড়ির মধ্যে কনে আদান-প্রদান বেশ দেখতে মজার। ঈশান আর সোয়েভের আফসোস তারা এত সুযোগ সুবিধা পায়নি। রোয়েনের শ্বশুরবাড়ি যেতে গাড়ি ভাড়া লাগবে না৷ ফলমূল, নাশতা পানি নিয়ে যেতে হবেনা। ফোন করে শ্বশুরবাড়ির মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া লাগবে না। ফলে মোবাইলের খরচটা ও বেঁচে যাবে। আহা একটা মানুষকে আল্লাহ এতগুলো সুবিধা কি করে দেয়? তারা কি দোষ করলো? তারা একটা সুবিধা অন্তত পেত। কি দোষ হতো তাতে?
রাহাকে কোলে নিয়ে এসেছে এইজন্য হাত ব্যাথা করলো রোয়েনের। সোফায় রাহাকে এমনভাবে ছেড়ে দিল, সোফা ভাগ্যিস নইলে রাহা শেষ। এভাবে ধপাস করে ফেলার ইচ্ছে থাকলে কোলে নেওয়ার কি দরকার ছিল?
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে রোয়েন বলল
‘ তুমি তো ভার আছ রাহা। দেখতে শুকনা হলে কি হবে, তোমার হাড্ডিগুলো ভার। উফফ আমার হাত গেল। উফফ।
এমন খাপছাড়া কথা শুনে রাহা থ মেরে তাকিয়ে থাকলো। কেমন বেয়াদব মানুষ? কোলে নিতে কে বলেছে? খোঁচা মেরে কথা বলতে কে বলেছে? রাহা কিছু বললো না। রোয়েন জানে কারো কথার জবাব না দেওয়া কথাটাকে পাত্তা না দেওয়া। তারমানে রাহা তার কথাকে পাত্তা দেয়নি। কেন? বিয়ে করেছে বলে দামে উঠেছে? ভাব নিচ্ছে? তা ও রোয়েনের সাথে? রোয়েন এতই সস্তা? বেশ! রাহা থাকুক তার মতো। রোয়েন রাহাকে তার ঘরে ঢুকতে দেবে না। তার ঘরের ভাগ দেবে না। কিছুতেই দেবে না। সবকিছু দখল করে নিচ্ছে রাহা। এ হতে পারে না। এখানে রাহার রাজত্ব চলবে না। রোয়েনের রাজত্ব চলবে। রাহা ভালো না। সুন্দর না। রাহাকে রোয়েনের একটু ও ভালো লাগেনা। সে একটু ও ভালোটালো বাসেনা৷ ওসবের ধারেকাছেও রোয়েন থাকেনা। জঘন্য বিচ্ছিরি ওসব শব্দ,কর্ম আর অনুভূতি। রোয়েনের ফালতু কাজ করার সময় কোথায়?
রোয়েন তার ঘরের দিকে যেতে যেতে ভাবলো সে আজকাল বেশি বেশি ভাবছে। মনের সাথে আজকাল বেশি ভাবসাব হয়েছে৷ মনে মনে সারাক্ষণ বকবক করতে শুরু করেছে। অবশ্য সেটা একপ্রকার ভালো ও হলো। সে আর রাহার সাথে ভাবসাব করবে না। মনের সাথে ভাবসাব করবে।
কিন্তু মনটা ও জঘন্যরকম বিচ্ছিরি। অসভ্য। বেয়াদব। সারাক্ষণ রাহা রাহা করে। বেয়াদব মন রোয়েনের। ডাক্তার যদি রোগীর মতো আচরণ করে তখন কি করতে হয়? উফফ সব রাহার দোষ। সব।
ঘরে গিয়ে শেরওয়ানি পাল্টাতে গিয়ে রোয়েন নিজেকে আয়নায় দেখলো। দেখেই ভাবলো বাহ রোয়েন দেখতে রাহার চাইতে ও সুন্দর।
এই দেখ আবার ও রাহার কথা। এখানে তাননার কথা মাথায় আসলে কি হতো? মানা যেত সে তাননার চাইতে ও সুন্দর। তার আম্মার মতো হয়েছে সে। আম্মাও সুন্দর। আম্মার ছেলে ও সুন্দর। কিন্তু রাহা কালো।
ধুরর আবার রাহা। রাহা টাহা এখন বাদ। রাহা নিয়ে কোনো কথা চলবে না৷ মাথা নষ্ট করে দিল।
মিষ্টিমুখ চললো অনেক সময় ধরে। রাহা বিরক্ত হয়ে চিল্লিয়ে সালমা বেগমকে বলল
‘ নানু মাফ করো আমায়। এটা আমার বাড়ি। অত মিষ্টিমুখ করা লাগবে না।
সালমা বেগম হেসে ফেললেন৷ বললেন
‘ বইন আজ থেকে এটাই তোর শ্বশুরবাড়ি।
রাহা বলল
‘ কচু।
এইবাড়িতে কোন জায়গায় তেলাপোকারা থাকে সেটা ও মুখস্থ আমার৷ আবার নাকি শ্বশুরবাড়ি? কচুরবাড়ি!
সোয়েভ বলল
‘ রাহা একদম ঠিক কথা বলেছ৷ তোমার বরকে বলবে যাতে আলাদা প্ল্যাটে রাখে তোমাকে। তোমার ও তো শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হয়।
ঈশান সমর্থন জানালো সোয়েভকে৷
লাল সাদা রঙের টিশার্ট পড়ে নিচে আসার সময় রোয়েনের কানে আসলো কথাগুলো। তাকে আসতে দেখে সবাই তাকালো। রোয়েন বলল
‘ আরেহ এসব এবার শেষ করো। বিয়ে বিয়ে গন্ধ লেগে আছে গায়ে।
সোয়েভ বলল
‘ কখন লেগেছে? লাগার সময় তো আসেনি এখনো।
সবাই ঠোঁট চেপে হাসলো। নাহিল আর সোরা চলে গেল। রোয়েন শান্ত চোখে চেয়ে থাকলো সোয়েভের দিকে। কাছে গিয়ে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল
‘ তুই এত বেয়াদব জানলে আমার বোন দিতাম না তোকে।
সোয়েভ হো হো করে হাসলো। বলল
‘ তোর বোনকে তুলে নিয়ে যেতাম মামা।
রোয়েন নাক সিটকালো।
‘ আমি শুধু জিশুর মামা। তোর মামা কেন হবো? তোর বাচ্চার মামা।
সোয়েভ আবার ও হাসলো। রোয়েন রাহাকে দেখলো। তাননা আর নোহা তার পাশে বসা। তিনজনই ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। রোয়েন বলল
‘ এই রাহা তাড়াতাড়ি এসব শাড়ি টাড়ি পাল্টে নাও। তোমাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। যাও যাও।
রাহা সোফায় হেলান দিয়ে মজা করে বলল
‘ আমার পায়ে ব্যাথা করছে। উফফ।
তাননা বলল
‘ ভাই যা তো তোর বউকে কোলে করে নিয়ে যাহ। যাহ।
রোয়েন শক্ত চাহনি দিয়ে রাহার দিকে তাকালো। বলল
‘ আমি কি তোমার গাড়ি নাকি? একবার নিয়েছি বলে কি বারবার নেব? মামার বাড়ির আবদার। লিসেন রাহা উল্টাপাল্টা কথা বলবেনা আমার সাথে। পছন্দ না।
রাহা হাসলো। রোয়েন বলল
‘ মিনিমাম লজ্জা শরম নেই। বউমানুষ ঘোমটা টেনে বসে থাকবে, তা না করে ফালতু কাজকারবার।
রাহা রোয়েনের প্রতিক্রিয়া দেখে হাসলো। কিছু বলল না। রোয়েন কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। ঈশান রোয়েনকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আরেহ ভাই চোখে চোখে কথা পরে বলো। অনেক সময় আছে। আমরা একটু ও ডিস্টার্ব করব না। এখন সময় আমাদের দাও৷ বিয়ে তো করেছ, বউ পালাবে না আর।
রোয়েন মহাবিরক্ত, মহাজ্বালাতনে আছে এদের নিয়ে। এসবের মূল কি রাহা নয়?
______________
বিয়ের শাড়ি পাল্টে দিয়ে রাহাকে অন্য একটা শাড়ি পড়িয়ে দিল তাননা আর নোহা। রাহা বলল
‘ ত্রিপিছ পড়ি না?
জাহেদা বেগম ছিলেন। তিনি ধমক দিয়ে বললেন
‘ ফালতু কথা বলবিনা রাহা । নতুন বউদের শাড়ি টাড়ি পড়ে সাজগোছ করে থাকতে হয়। চুলার ধারেকাছেও যাবিনা। হাতের মেহেদীর রঙ যেন তাড়াতাড়ি না মুছে।
রাহা বলল
‘ এগুলো তো কুসংস্কার দাদু।
জাহেদা বলল
‘ মারেম্মা তুই আমাকে সংস্কার শিখাবি?
রাহা চুপ করে গেল। থাক এরা পুরাতন আমলের। কাজ হবে না।
রোয়েনের বিছানার উপরে জিশান বসে রইলো রাহার পাশে। তাননা আর নোহা ও সাথে। কয়েকটা আত্মীয় স্বজন রাহাকে দেখতে আসলো আবার। একজন বলল
‘ কি বউ দেখব? এরে তো এখানে এলে রোজ দেখি।
জিশান বলল
‘ আমি ও দিখি। বউ দিখি৷ মামার বউ।
হাসাহাসি করলো সবাই।
তাননা বলল
‘ দেখিয়েন না আর। আপনারা এভাবে দেখতে থাকলে আমার ভাই কি দেখবে?
উফফ এমন কথায় কান গরম হয়ে উঠলো রাহার। এরা দুইভাইবোন কেউ কারো থেকে কম না। হেব্বি ডেঞ্জারাস।
জিশান হাই তুলতে তুলতে তাননাকে বলল
‘ আম্মা ঘুমাবো।
তাননা বলল
‘ আচ্ছা চলেন। খালামুণিকে টা টা দেন৷
জিশান টা টা দিল। নোহা বলল
‘ গায়ে হলুদের চাপে পড়ে আমার ও ঘুম হয়নি। রাহাপু তুমি থাকো। আমরা আসি।
রাহা গাল ফুলিয়ে বলল
‘ আমার ভয় করে তো।
তাননা বলল
‘ ঢং করিস না। তুই কি এই ঘরে নতুন নাকি? এর আগে ও তো থেকেছিস।
রাহা লজ্জা পেয়ে গেল। তাননা বলল
‘ তুই ও ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট।
রাহা গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। তাজা বেলীফুলের সুগন্ধি চারপাশে। বেলীফুল দিয়ে কেউ বাসরঘর সাজায়? বাসর ঘর হবে গোলাপে গোলাপে গোলাপি। তা না! ডাক্তারের আবার বেলীফুল পছন্দ। সবখানে সাদা সাদা। শুধু লাল টকটকে রাহা। ছাই!
এভাবে একা একা বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যাথা করে উঠলো রাহার। আরেহ তার বরবাবু কি বাসর রাতের ভয়ে কোথায় পালালো নাকি? আজব মানুষ আজব কাজ করতেই পারে।
ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই। দরজায় খটাখট আওয়াজের কারণে ঘুম ভেঙে গেল রাহার। ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুললো সে। ছোট ছোট চোখে চেয়ে রোয়েন ঠান্ডা চাহনি দিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় বলছে
রাহা তাড়াতাড়ি সরে পড়ো। আমি ঘরে ঢুকবো।
রাহা দাঁড়িয়েই থাকলো। সরার কথা মাথায় এলো না। রোয়েন রাহাকে ডিঙিয়ে চলে গেল। হাতের বাহুতে বাহুতে ঘষা লাগলো। রাহা হাতের বাহু ঢলতে ঢলতে বলল
‘ অসভ্য ডাক্তার।
রোয়েন কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। গায়ে এখনো বিয়ে বিয়ে গন্ধ লেগে আছে। শাওয়ার নিতে হবে।
রাহা রোয়েনের রুমে থাকা রিডিং টেবিলে মাথা রেখে চেয়ার টেনে বসলো। ঘুমঘুম চোখে সে বিড়বিড় করলো
‘ ডাক্তারের গায়ে কে। পায়খানা করে দিল আবার? এত সাবান ঢলাঢলি কেন?
পরে সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম যে বাঁধা মানেনা।
রোয়েন ভেজা চুল মুছতে মুছতে আসতেই রাহাকে দেখলো। ছিঃ রাহা গোসল করেনি? ইয়াক।
রাহা কি নোংরা। রাহার গায়ে ও বিয়ে বিয়ে গন্ধ। মাংসের গন্ধ। রাহা এভাবে থাকলে সে থাকতে পারবে না। রোয়েন রাহাকে টেনে তুললো।
বলল
‘ রাহা যাও গোসল করে ফেলো। তোমার গায়ে বিয়ে বিয়ে গন্ধ৷
রাহা ঘুম ঘুম গলায় বলল
‘ নাহহ। বিয়ে হয়েছে তাই বিয়ে বিয়ে গন্ধ। করব না।
রোয়েন ধমক দিল।
‘ যাও বলছি। নইলে এক্ষুণি এই ঘর থেকে চলে যাব আমি। সবাইকে ডেকে বলব তুমি ঘুমাতে দিচ্ছনা আমায়।
রাহা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল
‘ আপনাকে দেখে নেব আমি। আপনার শার্টে সর্দি মুছে দেব।
রোয়েন দু পা পিছু হেঁটে বলল
‘ ছিঃ ছিঃ রাহা। আচ্ছা যাও যাও আগে গোসল করে আসো। বিয়ের গন্ধ সহ্য হচ্ছেনা আমার।
রাহা অন্য একটা শাড়ি নিয়ে নাকিসুরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
শীতের ভাব চলে গেছে। গরম শীতের মাঝামাঝি অবস্থা। তারপর ও রাহার শীত লাগলো।
গোসল সেড়ে আসতেই রোয়েন আঁড়চোখে তাকালো। রাহা নরম পায়ে হেঁটে আসলো। মিনমিন করে বলল
‘ আপনাকে সালাম করতে বলেছে দাদু। দেখি পা টা দিন৷ আমার ঘুম পাচ্ছে। লম্বা ঘুম দেব। আপনার সাথে বাসর ঘর করার ইচ্ছা নাই।
রোয়েন বলল
‘ পা ছোঁয়ার দরকার নেই। এমনি সালাম দেওয়া যায়।
রাহা বলল
‘ দাদু তো,
রোয়েন চ কারান্ত শব্দ করল মুখ দিয়ে। রাহা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সালাম দিল।
রোয়েন সালাম নিলে ও আওয়াজ করল না।
রাহা বলল
‘ দাদু নামাজ পড়তে বলেছে।
রোয়েন বলল
‘ জানি।
রাহা মাথা নাড়লো।
দুজনেই নামাজ পড়লো একসাথে।
নামাজ শেষে রাহা জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে বলল
‘ আপনার চুল দিয়ে পানি পড়ছে। শার্ট ভিজে যাচ্ছে।
রোয়েন মহাবিরক্ত। কড়া গলায় বলল
‘ তুমি তোমারটা দেখো। নিজের চুলের পানি মুছেছ? ঘরটা পুরো ভিজিয়ে ফেলছো। টোটালি ডিজগাস্টিং।
রাহা মুখ কালো করে ফেললো। দুচোখে পানি ছলছল করলো কিন্তু সে তা দেখালো না। কথাটা ওভাবে বলার কি ছিল? রাহার সাথে কি ভালোভাবে কথা বলা যায় না? হয়ত যায় না।
রোয়েন তার টেবিল গুছিয়ে রাখতেই ফোনে কল আসলো। ফোন কানে দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল রোয়েন। রাহা একগাদা রাগ, অভিমান নিয়ে আবার টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।
রোয়েন ঘরে ফিরে এসে রাহাকে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাতে দেখলো। ভাবলো রাহা তার ভালো চাইতে লাগলো কখন থেকে? ভালোই তো তার বিছানার ভাগ নিচ্ছে না। সে আরামে ঘুমাতে পারবে। রোয়েন রুমের লাইট বন্ধ করে দিল। শুয়ে পড়লো। রাহার ঘুম ছুটে গেল। দেখলো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাহার ভয় করলো। সাথেসাথে বুক ভারী হয়ে কান্না আসলো। সবাই তাকে কার গলায় ঝুলিয়ে দিল আবার? যে তার রাগ, অভিমান বুঝে না। হাসি কান্না টের পায় না। কি দরকার ছিল অত ঘটা করে বলার, আমি রাহাকে বিয়ে করব, অন্য কেউ না।
রাহা টেবিলে মাথা রাখলো। টেবিল ভিজে উঠলো নোনাজলে। পরক্ষণেই ভয় লাগলো। আর থাকতে না পেরে সে নিজের ফোনের লাইট জ্বালিয়ে দিল। বিছানার দিকে মারতেই দেখলো জ্বলজ্বল করে কি দুটো যেন জ্বলছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। এলোমেলো চুল। এলোমেলো চাহনি। রাহা লাইট সরিয়ে নিল। লাইট বন্ধ করে দিল। তারপর টেবিলে মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়লো। ডাক্তার জেগে আছে। ভয়ের কিছু নেই। পরক্ষণেই ভারাক্রান্ত মনে ঘুমাতে হলো তাকে৷
রোয়েন নিজেই লাইট জ্বালালো। সবাই তাকে ঘাড়ত্যাড়া ডাকে। অথচ রাহা আস্ত একটা ঘাড়ত্যাড়া।
টেবিলে মাথা রেখে ঘুমানো রাহাকে পাঁজা খোলা করে তুলে নিল রোয়েন। সে অল্পতেই বুড়ো হয়ে যাবে রাহাকে কোলে নিতে নিতে। তার বলশক্তি এজন্যই ক্ষয় হয়ে যাবে। খাটে শুয়ে দিতেই রাহা পিটপিট করে তাকালো। বসে পড়লো। চোখদুটো ভারী ফোলা।
নেমে যেতেই রোয়েন শাড়ির উপর পায়ে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেললো। অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো রাহার। রোয়েন বলল
‘ নামবে না। তোমার পায়ে হাত দিতে চাই নি। তুমি বাধ্য করেছ।
রাহা পা গুটিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। হাত দিয়ে পা দুটো জড়িয়ে ধরলো। মাথা নিচু করে রইলো।
রোয়েন কিছু একটা ভেবে ড্রয়ারের কাছে গেল। একজোড়া নূপুর নিয়ে এসে রাহার সামনাসামনি বসে বলল
‘ কালকে যখন সবাই জিজ্ঞেস করবে আমি তোমাকে কি দিয়েছি, তখন সবাইকে বলবে ধমক দিয়েছি। কান্না করিয়েছি। বুঝেছ?
রাহা মাথা তুললো না। রোয়েন বলল
‘ পা দাও। দেখতেই পাচ্ছি নিজের ভবিষ্যত, বাকিটা জীবন আমাকে তোমার সেবা করেই পার করতে হবে। কোলে নিয়ে নিয়ে যৌবন শেষ করতে হবে।
রাহা পা আর ও গুটিয়ে নিল। রোয়েন নিজেই পা টেনে আনলো। সোনালি রঙের নুপুর জোড়া পড়িয়ে দিতে দিতে বলল
‘ বিয়ে করা মানেই পুরুষত্ব ফলানো নয় রাহা। পুরুষত্ব ত্যাগ করা। নাহলে তুমিই বলো আমি কখনো এসব কাজ করেছি? এসব মেয়েদের কাজ। কি আশ্চর্য নুপুরটা লাগাতেই পারছিনা।
রাহা মাথা তুললো এতক্ষণে। নুপুর?
সাথেসাথে দুচোখ নোনাজলে ভর্তি হলো তার। টলটলে চোখদুটো রাহার অসাবধানতায় রোয়েন দেখে ফেললো। নুপুরের আংটা লাগানোর চেষ্টা করতে করতে বলল
‘ এই নুপুরগুলো সুন্দর নাহ? অবশ্যই সুন্দর। রোয়েনের পছন্দ বলে কথা। সুন্দর হলে কি হবে দোষ ও আছে রাহা । নুপুরগুলো হাঁটলে শব্দ করেনা। ধরতে পারো আমার মতো।
রাহা নাক টানলো। রোয়েন নুপুরে মনোযোগ দিল। রাহা তার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ আপনি খারাপ।
তাতে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করল না রোয়েন। হাসলো। রাহার চোখ থেকে টপটপ জল পড়লো এবার প্রকাশ্যে। রোয়েন নুপুরজোড়া পড়িয়ে দিয়ে চোখ তুলে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বলল
‘ তোমার এবার ও পালানো উচিত ছিল রাহা। তাহলে তো আর আমাকে বিয়ে করতে হত না। এভাবে কাঁদতে ও হত না৷
রাহা চোখ তুললো না। হাতের কব্জি দিয়ে চোখ মুছে বলল
‘ আমি থাকব না আপনার সাথে। আপনার কাছে। খারাপ মানুষের সাথে থাকব না আমি।
রোয়েন হেসে ফেললো। বলল
‘ ইউ মে গো নাও। দরজা খুলে চলে যাও যেখানে ইচ্ছে। গো।
রাহা দেরী করলো না।
বিছানা থেকে নামলো। গটগট পায়ে হেঁটে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হলো। যেই বের হলো সেই আরেক বিপদ। পুরো বাড়িটা অন্ধকার। বিয়ের ঝামেলা চুকিয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। কতদিন ঘুমায়নি মানুষগুলো? সবকিছুর মূলে কি রাহা রোয়েন ছিল না?
রাহা কান্না মাখা চোখজোড়া বা হাত দিয়ে মুছলো। আবার নিজের ওই ঘরটাতে তাকাতেই দরজার কাছে পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখতে পেল। ভেজা চুল আঙুল দিয়ে নাড়িয়ে আবার পেছনে হাত দিয়ে ছেলেটা রাহাকে বলল
‘ ততটা দূরে যাও। যতটা দূরে গেলে আবার ফিরে আসতে পারবে।
রাহা নাক টানলো। শাড়ির আঁচল দিয়ে নাকমুখ মুছে বলল
‘ তো আপনি আমাকে কষ্ট দেন কেন? সোয়েভ ভাই, আর ঈশান ভাইকে দেখেন না? বউকে কিভাবে ভালোবাসে।
রোয়েনের মেজাজ খারাপ হলো। রাহা অন্যদের সাথে তার তুলনা করবে কেন?
রাহা রোয়েনের রাগী চেহারা টের পেল। তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেল৷ রোয়েন লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করতে চেয়ে ও পারলো না রাহার জন্য। তারপর লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। রাহা অন্ধকারে পা টিপে টিপে দরজা বন্ধ করলো। তারপর রোয়েনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতেই রোয়েন একছিঁটকে হাতটা ছুঁড়ে ফেললো৷ উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ চেপে বলল
‘ আমি ঘুমাচ্ছি রাহা। দূরে যাও।
রাহা বলল
‘ আমার শীত লাগছে। কাঁথা দেন৷
রোয়েন বলল
‘ দেব না। ওরকম বলেছ কেন? তোমার সাথে আমার কিসের কথা?
রাহা হাসলো মিটিমিটি। শাড়ির আঁচল টেনে গায়ে জড়ালো। তারপর আলো আঁধারিতে রোয়েনের আবছা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। রোয়েন মুখ ফিরিয়ে নিল। রাহা অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। ধুরর আজকে কি আর চোখে ঘুম নামবে। এই ব্যাটার ফসফস নিঃশ্বাসের শব্দে মরি যায় মরি যায় অবস্থা। রাহার সত্যি ঠান্ডা লাগতে শুরু করলো। পাতলা নকশাতোলা কাঁথাটা রোয়েন গায়ে দিল আষ্টেপৃষ্টে। রাহা গাল ফুলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম আসলো না। কান্না আসলো। ডাক্তার তাকে শাস্তি দিচ্ছে। মায়া দরদ নেই একটু ও। ঢুসে ঢুসে ঘুমোচ্ছে। রাহার ও সময় আসবে।
রাহা শাড়িটা ভালো করে গায়ে জড়াতে না জড়াতেই রোয়েন বাঁধা দিল। টেনে রাহাকে কাঁথার নিচে ঢুকিয়ে শাড়ির আচঁল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের বক্ষতলে পিষ্ট করে বলল
‘ তুমি ওটা দিয়ে নাক মুছেছ। আবার গায়ে জড়াচ্ছ? আমার সাথে থাকলে ওসব বদঅভ্যেস বাদ দিতে হবে। বুঝেছ।
রাহার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। বক্ষতলে এমনভাবে পিষ্ট হলো মান,অভিমান, রাগ, অনুরাগ সব পিষে আমিষ হয়ে গেল। একটুখানি ভালোবাসামাখাময় ছোঁয়ার সান্নিধ্যে নেতিয়ে পড়লো রাহা।
আসলে ভালোবাসার কাঙালদের ওই একটুখানিটা এক আকাশ মনে হয়। চাতকদের কাছে একফোঁটা বৃষ্টিটা এক সাগর মনে হয়।
ভালোবাসাহীন, মায়াহীন, অনুভূতিহীন, মরুভূমির মতো খা খা করা রৌদ্দুরময় হৃদয়ের বুকে প্রেমের বৃষ্টি নামানো তাদের পক্ষেই সম্ভব।
আর যারা শতবার অবহেলা করে ও ভালোবাসা পায়, অবজ্ঞার পর যত্ন পায়, পাগলের মতো ভালোবাসার একটা ভালোবাসার মানুষ পায় তাদের কথা নাই বা বলি।
সময় নিয়ে কপাল ভিজলো রাহার। কান ছুঁয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে গেল
‘ তোমার কাছে আমি অন্যরকম।
ভালোবাসি বেশি, প্রকাশ করি কম।
চলবে
দেরী হওয়ায় দুঃখিত