ধ্রুবতারা পর্ব_৩৫ পুষ্পিতা_প্রিমা

ধ্রুবতারা
পর্ব_৩৫
পুষ্পিতা_প্রিমা

রাঙ্গামাটি জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে কাপ্তাই লেকের কোল ঘেঁসে তৈরি পলওয়েল পার্ক সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় রাঙ্গামাটির অন্যতম সেরা বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। বৈচিত্রময় ল্যান্ডস্কেপ, অভিনব নির্মাণশৈলী এবং নান্দ্যনিক বসার স্থান পার্কটিকে দিয়েছে ভিন্ন এক মাত্রা। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে ও চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থীর পদচারণার পলওয়েল পার্ক মুখর হয়ে উঠে।
মেরি গো রাউন্ড, হানি সুইং, মিনি ট্রেন, প্যাডেল বোট ইত্যাদি বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইড ছাড়াও পলওয়েল পার্কে আছে ভুতুড়ে পাহাড়ের গুহা, পাহাড়ী কৃত্রিম ঝর্ণা ও কলসি ঝর্ণা, ক্রোকোডাইল ব্রিজ, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প, লেকভিউ পয়েন্ট, হিলভিউ পয়েন্ট, লাভ লক পয়েন্ট, মিনি চিড়িয়াখানা, এক্যুরিয়াম, ফিশিং পিয়ার, ক্যাফেটেরিয়া, সুইমিংপুল, কার পার্কিং এবং পলওয়েল কটেজ। এছাড়া এখানে পিকনিক সহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ রয়েছে এই পার্কে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।

পাহাড়ী কৃত্রিম ঝর্ণা ও কলসি ঝর্ণা, ক্রোকোডাইল ব্রিজ, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প, লেকভিউ পয়েন্ট, হিলভিউ পয়েন্ট, লাভ লক পয়েন্ট এই জায়গাগুলো দেখে অন্য সবকিছু থেকে এই পার্কটাকে ব্যতিক্রমী মনে হলো রাহার। এত এত সুন্দর মনমাতানো পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই মন খারাপ হয়। সারাটাদিন ঘুরলো, ফিরলো, খেল সবাই। জিশান লোহার ঘোড়ার গাড়িতে চড়লো। সবাইকে হাত নাড়িয়ে বলল

‘ জিশু চড়ে ঘোড়ার গাড়ি।
আম্মা দেখে হাসে।
আব্বা বলে যাব বাড়ি।
চলে এসো পাশে।
মামা করে বুকাবুকি
খালামুণির সাথে।
খালামুণি নেশা খেয়েছে
তেঁতো ধরেছে ভাতে।
নুহা করে কাশাকাশি
ভাত খাবে না বলে।
সোয়েভ মামা রেগে বলে
কি দোষ করেছে ভাতে?
রিহান, জুনিত ভালো ছেলে
মনটা দিয়ে শোনো।
যাওয়ার সময় ফুরিয়ে এসেছে
ঝামেলা করো না কোনো।
জিশুসোনা চোখের মণি
সবাই বলে জানি।
জিশু কি কবি হবে?
বলোতো একটুখানি।

সবাই করতালি দিল। রোয়েন বলল
‘ কেয়া বাত জিশুসোনা।
জিশু গাল এলিয়ে হাসলো। রাহা বলল
‘ আপনি আমাকে বকেন সেটা তো কিছুদিন পরে বইয়ে ও ছাপানো হবে। কবিসাহেব তো বইয়ে লিখে দেবে।
রোয়েন বলল
‘ চুপ। ওটা ভাবছ কেন? এটা ভাবো যো তুমি নেশা করেছ সেটা জিশু তার কবিতায় বলে ফেলেছে।
রাহা বলল
‘ তাই তো!
তাননা হেসে বলল
‘ থাম তো তোরা। আমার বাচ্চাটা এখনো মাটির সাথে কথা বলে।
ঈশাম বলল
‘ হায়রে কবিতা নিয়ে শুরু করে দিয়েছ তোমরা?
রোয়েন বলল
‘ জিশুকে রাহার সব দোষগুলো বলতে হবে যাতে সে রাহাকে নিয়ে বাজে কবিতা বানায়। একদম খুব ভালো হবে।
রাহা মন খারাপ করে ফেলল। ডাক্তারের সাথে আর কোনো কথা নেই। কথা বলল না রাহা। বলল, আমি বাড়ি যাব। থাকব না এখানে। রোয়েন সেটা বুঝতে পারলো। জিশু ঝগড়া হয়েছে জেনে বলল

‘ মামা একটু বকেছে বলে
মামি দিয়েছে আড়ি
নাক ফুলিয়ে বলল রেগে
যাব আমার বাড়ি
তার বাড়ি, মামার বাড়ি
একি কথা হলো
তারপরও বুঝল না মামি
মামা বলল, ভালো।
মামার বউকে মামি ডাকে
জানি সেটা আমি
তাই তো খালামুণি না ডেকে
ডাকলাম এবার মামি।
খুশি হয়ে মামি আমায় আদর করে দিল
মামি ডাকায় মামা রাগ করে
আমায় আড়ি কেটে দিল।
বউকে কেন মামা বোন বুঝাতে চায়?
মামা কি মামির সাথে নেশা মিশিয়ে খায়?

সবাই আওয়াজ করে হেসে ফেলল। তাননা তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল

‘ পাকনামি তো অনেক৷ এবার চলেন যাই।
ঘুরাঘুরি অনেক হলো, এবার বলুন বাই।

জিশান বলল

‘ না আর ও ঘুরব। তাননা বলল
‘ আর কোথায়?
ঈশান বলল
‘ আজকের দিনে সবখানে ঘুরব। রাতটা ও। যতটুকু ঘুরা যায়। কাল সকাল দশটার দিকে পাড়ি দেব। তাননা মাথা নাড়ালো। রাহা রাগে ফুলেফেঁপে থাকলো। রোয়েন ও। জিশু রাহাকে মামি ডাকবে কেন? কেন? রাহা কি ঘুষ খাওয়ালো কবিকে?
আবার নিজের উপর ও রাগ লাগলো। সে খালামুণি ডাকতে বলবে কেন? মামি ডাকতে বারণ করে কেন? সবসময় রাহার সাথে রাগ করবে কেন?

________

সবাই এবার রওনা দিল নতুন আরেকটি জায়গায়। মুপ্পোছড়া ঝর্ণায়। এটি
প্রস্থের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি ঝর্ণা। অনিন্দ্য সুন্দর মুপ্পোছড়া ঝর্ণা দেখার জন্য সবাইকে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার বাঙ্গালকাটায় যেতে হলো। কাপ্তাই লেক পাড়ের এই উপজেলা সাথে সড়ক পথে কোন সংযোগ নেই। কাপ্তাই উপজেলা হতে শুধুমাত্র নৌ-পথে এই উপজেলায় যাওয়া যায়। দূর্গম পার্বত্য এলাকা হওয়ায় এখানে অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়ে আছে প্রচুর ঝর্ণা। চাকমা শব্দ বিলাই অর্থ বিড়াল এবং ছড়ি অর্থ পাহাড় হতে প্রাবাহিত ঝর্ণা। মুপ্পোছড়া ঝর্ণা বিলাইছড়িতে অবস্থিত বৃহত্তম ঝর্ণাগুলোর একটি। বিলাইছড়ি হতে শুধুমাত্র নৌপথে বাঙ্গালকাটাতে যাওয়া গেলেও বাঙ্গালকাটা হতে ট্রেকিং করে মুপ্পোছড়া ঝর্ণায় যেতে হয়।

ঝর্ণাটা দেখে সবাই আবার পাড়ি জমালো ধুপপানি ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্য।
রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ওড়াছড়িতে গেলে দেখা মিলে এই অনিন্দ্য সুন্দর ধুপপানি ঝর্ণার । ২০০০ সালের দিকে এক বৌদ্ধ ধ্যান সন্ন্যাসী এখানে ধ্যান শুরু করেন, পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষের মাধ্যমে এই ঝর্ণা সকলের কাছে পরিচিতি পায়। তঞ্চঙ্গ্যা শব্দ ধুপপানি ঝর্ণার মানে হচ্ছে সাদা পানির ঝর্ণা। ভূমি থেকে ধুপপানি ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ১৫০ মিটার। এই ঝর্ণার আসেপাশে রয়েছে হরিণ, বুনো শুকর, বনবিড়াল এবং ভাল্লুক সহ বেশ কিছু বন্য প্রাণী। প্রায় ২ কিলোমিটার দূর থেকে ধুপপানি ঝর্ণার পানি আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায়। কি অদ্ভুত মনমাতানো সেই ঝপঝপ শব্দ।

তাছাড়া টুকটুক ইকো ভিলেজ,ডলুছড়ি জেতবন বিহার, তবলছড়ি আনন্দ বিহার,আসামবস্তি ব্রীজ,উপজাতীয় জাদুঘর,ওয়াজ্ঞা চা এস্টেট,কর্ণফুলি কাগজ কল,দুমলং,নৌ বাহিনীর পিকনিক স্পট,পাবলাখালী বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য,বনশ্রী পর্যটন কমপ্লেক্স সব জায়গায় ঘুরলো। রাতের খাবার খেল প্যানোরমা জুম রেস্তোরায়। সেখানে রাতের খাবারে দিল। সাদা ঝরঝরে ভাত,সালাদ,বিগল বিচি
যা দেখতে ছোট ছোট দানার মতো- হালকা করে তেলে ভাজা হয়। এমনিতে এর কোনো স্বাদ নেই। এটি মূলত খেতে দেওয়া হলো শুটকি মাছ ও কাঁচামরিচের ভর্তার সাথে।
তারপর দিল,কচি বাঁশের তরকারী।
এটি একটি অসাধারণ আইটেম। রাঙ্গামাটি এসে এই খাবারটি হতে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। কচি বাঁশের তরকারি। স্বাদ অসাধারণ! পুঁই বা অন্যান্য শাকের সাথে এটি রান্না করা যায়, অথবা ভাজি। কচি বাঁশ খেতে খুবই নরম- মুখে দেওয়া মাত্র গলে যায়।
তারপর দিল কেবাং।
এটি আসলে খাবার রান্নার একটি পদ্ধতি। শক্তসামর্থ বাঁশের খোলের ভেতর মাংস ভরে সেখানে তেল-মশলা দিয়ে বাঁশটিকে পোড়ানো বা ঝলসানো হয়েছে। এর স্বাদ এবং অভিজ্ঞতা সবাইকে স্মৃতির পাতা ঘুরাবে।
তারপর দিল কাঁচকি ফ্রাই।
এটি অবশ্য আদিবাসী কোন খাবার নয়। তবে এর স্বাদ অতুলনীয়। সাধারণ পদ্ধতিতেই বড় বড় কাচকি মাছ তেলের উপর ভাজা হয়। গরম গরম খেতে ভীষন মজার খাবার এটি।
সবাই তৃপ্তি করে খেল। রাহা আর নোহা ভাত খেল না কাল রাত থেকে। আজ রাতেই খেল। দারুণ স্বাদ খাবারগুলোর। রোয়েন শুধু সালাদ আর কেবাং করা মুরগীর মাংস দিয়ে খেল৷ বাকিগুলো ঝাল হওয়ায় ছুঁয়ে ও দেখলো না।
রাহা খেতে নাক ফুলালো। সে জানে ডাক্তার তার দিকে তাকিয়েছে। রোয়েন কষ্ট পেল, রাহা সামান্য কারণে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। বেয়াদব রাহা।
সবাই খেয়ে দেয়ে রিসোর্টে ফিরে গেল। সকালে রওনা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। রোয়েন, ঈশান আর সোয়েভ অনেক বাজার আর কাপড়চোপড় ও নানারকম জিনিসপত্র কিনে নিল যারা আসেনি তাদের জন্য। দাদু নানুদের জন্য জুতো আর শাড়ি কিনলো। নাহিল জায়িদের জন্য পাঞ্জাবী পায়জামা,পারফিউম। সোরা আর আনহার জন্য শাড়ি, হিজাব, চুড়ি কিনলো। খাওয়ার দ্রব্যাদি কিনলো। আর ও কতকিছু।

রাতে ঘুমে ঢলতে লাগলো রোয়েন। রাহা তার সাথে রেগে আছে সেজন্য ঘুমাতে পারছে না। রাহার রাগ ভাঙাতে হবে৷ কিন্তু রাহার রাগ ভাঙাতে গিয়ে সে নিজেই রাগ করে বসে থাকলো। সে বিশ্বাস করে রাহার জন্মই হয়েছে তার রাগ ভাঙানোর জন্য। সে রাগ করবে আর রাহা রাগ ভাঙাবে। কিন্তু রাহা ব্যালকনির কাছে বসে থাকলো আনমনা হয়ে। উদাস হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। শাড়ির অবিন্যস্ত আঁচল গড়াগড়ি খাচ্ছে। রোয়েন গর্জে বলল
‘ আমার ঘড়ি কোথায়? পাচ্ছিনা কেন?
রাহা বলল
‘ ঢং।
রোয়েন রেগে গেল। বলল’ কিছু পাই না খুঁজলে। সব হাওয়া হয়ে যায়।
ধুপধাপ এটা ওটা ছুঁড়ে মারলো রোয়েন।
রাহা বিড়বিড় করল
‘ সব রাগ তার। আর কারো নেই। জীবনে ও সে কথা বলবে না।
রোয়েন রেগেমেগে একদম শুইয়ে পড়লো। বালিশের নিচে দু হাত ঢুকিয়ে মুখ চেপে রেখে ঘুমালো। রাহা অনেক্ক্ষণ পরে এসে শুইয়ে পড়লো। রোয়েনের দিকে ফিরতেই রোয়েন মুখ ফিরিয়ে নিল। রাহা ও মুখ ফিরিয়ে নিল। কথা বলবে না মানে বলবে না। রোয়েন রাগে বালিশে দুম করে মাথা দিয়ে মারলো। সামান্য কথায় রাগ করতে হয়?
রাহা মিটিমিটি হেসে ফেলল। ফিরলো না। রোয়েন নড়তেচড়তে ঘুমিয়ে গেল একদম। রাহা বলল
‘ যাক বাবা ঘুমিয়ে গেল? ওইই রাগের ফ্যাক্টরী?
রোয়েন তো ঘুম। রাহা একটু এগিয়ে গেল। রোয়েনের গায়ের উপর কাঁথা টেনে দিল। একঝাঁক ভারী মাথার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিল৷ আরেকটু দূরত্ব কমিয়ে অধর ছুঁয়ালো ললাটে। পরপরই রোয়েন ঘুমঘুম চোখ খুললো। রাহাকে কাছে দেখে ফেললো। রাহা লজ্জায় দূরে যেতেই রোয়েনের হাতের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। উদর টেনে এনে রোয়েন তাকে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ করে ঘুম ঘুম গলায় বলল
‘ রাহা আমার বাচ্চাকাচ্চা যদি তোমার মতো রাগ টাগ করা শিখে তোমার খবর আছে। সব তোমার দোষ।
রাহা বাকহারা। কি বলে এই ডাক্তার?
রাহা বলল
‘ ছাড়েন। কাছে টানেন কেন? সারাক্ষণ রাগ দেখায় আবার কাছে টানে।
রোয়েন ঘুম গলায় বলল
‘ বেয়াদব ঘুম ও রাহা রাহা করে। আমার কি দোষ?
রাহা চুপ হয়ে গেল। আবেশে চোখ বন্ধ করলো। রোয়েন নড়েচড়ে এসে ঠাঁই খুঁজে নিল রাহার কাছে। গলদেশের একপাশে নাকমুখ গুঁজে দিল। তপ্ত শ্বাসে রাহাকে মাখামাখি করে দিয়ে ঘুমিয়ে গেল।

তারপরের দিন সবাই চলে আসলো নিজেদের বাসস্থানে।

চলবে,
আজ গল্প দেওয়ার কথা ছিল না। যতটুকু লিখেছি দিয়েদিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here