ধ্রুবতারা পর্ব_৩৩ পুষ্পিতা_প্রিমা

ধ্রুবতারা
পর্ব_৩৩
পুষ্পিতা_প্রিমা

পাহাড়ের একটি নাম না জানা গাছের আবডালে বসা একটি অচেনা পাখি৷ গাছের ডালে বসে পাখিটি নেচে নেচে আনমনে গান শুরু করেছে। অন্ধকার কাটেনি এখনো। একদম একা পাখিটি। কেউ নেই সাথে। রোয়েনের বেশ মায়া হলো পাখিটার জন্য। এত সকাল সকাল পাখিটা ঘুম থেকে কি করে উঠে গেল? কেউ সাথে নেই কেন? রোয়েন না হয় উঠে গেছে একটু ব্যতিক্রমী হওয়ার জন্য। পাখিটা কেন?পাখিটার কি ও ব্যতিক্রমী হতে ইচ্ছে করছে? তার বাসায় ও তার একটি সঙ্গী আছে? ঘুমন্ত রেখে সে চলে এসেছে?
যদি তাই হয় তাহলে তো খুব ভালো। কিছুক্ষণ গল্প করা যাক পাখিটার সাথে। কিন্তু পাখিটা কি রোয়েনের ভাষা বুঝবে? বুঝবে যদি এই পাখিটা এক প্রেমিকপুরুষ কিংবা প্রেমীকালতা হয়ে থাকে। বুঝার কথা। প্রেমিকের ভাষা প্রেমিক বুঝে। প্রেমিকা বুঝে।
আচ্ছা পাখিটা কি একসময় খুব ঘাড়ত্যাড়া ছিল? ছিল বোধহয়৷ এখনো আছে। ঠিক রোয়েনের মতো। ঘাড়ত্যাড়া মানুষ আবার ঠিক হয় নাকি? ঘাড়ত্যাড়ামি থেকেই যায় শুধু পরিবর্তন হয় মানুষ সাপেক্ষে। বলা যেতে পারে একদম সূচনা থেকে শুরু করে। যেখানে রোয়েন ছিল পড়ালেখা আর চারদেয়ালের মাঝে বন্দী এক যুবক । চারদেয়ালের সেই দেয়ালে দেয়ালে থাকা ছবির মানুষগুলোর সাথে হত তার যত ভাবসাব। আর রাত নামলেই আকাশের তারার সাথে। বাড়ির মানুষদের সাথে কথা হত প্রয়োজনের চাইতে ও কম। এই খিটখিটে, গোঁয়ার ছেলেটার যতসব নম্রতা দুর্বলতা বোনটার কাছে এসে। বোনের আবদার, প্রয়োজন, আদর সব প্রকট হয়ে উঠতো ভাইটার কাছে এসে। তখন সে অন্য এক মানুষ রোয়েন। বোনের কাছে সে একটা পৃথিবী। একসাথে বড় হয়ে উঠা দুজন একে অপরের পরিপূরক। তারপরে ও বোনের একটু চাওয়া পাওয়া ছিল ভাইকে ঘিরে। তার ভাইটা হাসে কম, কথা বলে কম। খিটখিটে মেজাজের। তার জীবনে এমন কি কেউ আসবে না যে একদম রাঙিয়ে দেবে তার জীবনটা। ধূসর রঙে ঢেকে থাকা আকাশটাতে কি কখনো সূর্য উঠবে না? আম্মা আব্বা ভাইটার সব হাসিখুশি কেড়ে নিয়ে গেল?
এমন প্রশ্ন তাননা তার ভাইকে করতো। ভাই পিটপিট করে তাকিয়ে বোনের কথা শুনতো। আসলে যা না শোনারই সমান। কথাগুলো ছুঁতো না তার ভাইকে। তবে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের প্রতি, ছোটছোট ভাই বোনের প্রতি ছিল তার অগাধ স্নেহ। রোয়েন ভাইয়া বলতেই তাদের মনে যেমন ভীতি জেগে উঠতো ঠিক তেমন জেগে উঠতো এক আকাশ শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস, ভরসা। মাতৃপিতৃসম মানুষগুলোর কাছে সে আশ্রয়। আর দুই দাদু নানুর কাছে সে একটা ছোট্ট অবুঝ শিশু। একটি ছোট্ট পুতুল। তারা কখনো সেই পুতুলটাকে ইচ্ছেমত রাগায় কখনো হাসায়। ওই যে দুজনের দিয়ে যাওয়া দুটো ভালোবাসা। দুটো আদর। দুটো আমানত। এদের জন্যই তাদের বেঁচে থাকা। কারণটা এই দুজনই। তাননা আর মুননা। এই দুই রাখিবন্ধন।
প্রত্যেকের কাছে এক এক রকম, এক এক ভাবে সংজ্ঞায়িত রোয়েন। তবে সন্ধ্যার আকাশের দুটো তারা যখন একসাথে জ্বলজ্বল করে তখন আর ও একটি তারা এসে জ্বলতে থাকে তারা দুটির আশেপাশে। রোয়েনের মেজাজ খারাপ হয়, রাগ হয়। ওই অচেনা নাম না জানা তারাটা কেন তার আপনদের আশপাশে? কেন তার আপন হতে চাইছে? কেন এত নির্লজ্জ? রোয়েনের রাগ হয় তা কি বুঝে না?
রোয়েন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান ছেলে৷ সে বুঝতে পারে কে কি চায়৷ সন্ধ্যা হলে সে যখন ছাদে আসে তখন তার পিছুপিছু ছাদে আসা মেয়েটি যে বই হাতে নিয়ে এদিকওদিক পায়চারী করত তা কি আপনাআপনি? রোয়েন কি তার কারণটা তখন বুঝেনি? কথায় কথায় মেয়েটি ওই অচেনা তারাটির দিকে আঙুল দিয়ে যখন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করত
‘ রোয়েন ভাইয়া ওই তারাটিকে কি বলে?
তখন ও কি রোয়েন কিছু বুঝেনি?
আর তার প্রিয় কফি সময় মতো বানিয়ে দেওয়ার জন্য যে পড়ার টেবিল ছাড়তো মেয়েটা রোয়েন কি এতটাই বোকা যে তখন কিছু বুঝেনি সে।
সে বুঝতো সবকিছু যখন সে তার পড়ার টেবিলে মাথা গুঁজে রাখতো তখন মেয়েটি বই নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পড়তো তার ঘরে। কি কারণ? পড়া বুঝে নেওয়া? তাননা ও তো ছিল? তাননার কাছে যায় না কেন? রোয়েনের কাছে কেন? রোয়েনের বড্ড রাগ হয় তা কি রাহা বুঝেনা?
আর রোয়েন যখন পাত্তাই দিত না মেয়েটিকে, মেয়েটি রাগে যে কলম ঘুরাতো তার ঘরের রঙিন দেয়ালে। সেগুলো কি কখনোই রোয়েনের চোখে পড়েনি?
আর খাবার টেবিলে।

রোয়েনের অঙ্গভঙ্গি, কথার ধরণ, খাওয়ার ধরণ রাগ করার ধরণ সবকিছুই যে মেয়েটি অনুকরণ করতো, মাঝেমাঝে তার কথা শুনে মেয়েটা যে মিটিমিটি হাসতো আর ভুলেই কখনো চোখাচোখি হলে যে লজ্জা আড়ষ্টতায় বোবা হয়ে যেত, এসব আজগুবি রোগ কি ধরতে পারেনি রোয়েন?
খুব তাড়াতাড়িই ধরতে পেরেছে রোয়েন। কথায় আছে একটা মানুষের প্রতি প্রেম থাকলে তা ভুলে ভুলে প্রকাশ ঘটে যায়। তাই রোয়েন শাস্তি দিত রাহাকে। পড়া না পারলে, রেজাল্ট খারাপ আসলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতো। নাহ মেয়েটা তাতে ও সোজা হয় না। যখন একদম বিয়ের কথা উঠলো দেয়ালের ওপাশে মেয়েটার কান্না, আর ছাদে না আসার ব্যাপারটা কি রোয়েন ধরতে পারেনি?
পেরেছিল। কিন্তু সে যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কখনো কারো মায়ায় জড়াবে না। এসব তাকে মানায় না। অনুভূতিদের সাথে লড়াই করা যায়? তারা যদি জেগে না উঠে তাহলে কি আর করার আছে? তাই রোয়েন একদম দূরে চলে গেল। যদি রাহার মনবদল হয়। যদি রাহা পাল্টায়।
নাহ রাহা পাল্টালো না। দীর্ঘ চার বছর পর ফিরে এসে সে দেখলো রাহা পাল্টায়নি একটুও। বরং রাহার নীরব পাগলামিটাই বেশিই চোখে পড়তো রোয়েনের। এতে আর ও ক্ষুব্ধ হলো রোয়েন। রাহা আগে তার সাথে কথা বলতে গেলেই আধমরা হতো, লজ্জায় কুঁকড়ে যেত৷ আর তখন মুখেমুখে কথা ফিরিয়ে দিতে শিখে গিয়েছে। রোয়েন অবশ্য এতে খুশি। আর ও খুশি হতো যদি রাহা এটা বুঝে যেত যে সে যা চাচ্ছে তা কখনো হওয়ার নয়। যার মন বলতে কিচ্ছু নেই তারকাছে ভালোবাসা আশা করাটা কি বোকামো নয়?
রাহা বুঝতে চাইলো না। রোয়েনের অবহেলা আর সূক্ষ্ম হেলায় টলটলে পানিভর্তি দীঘির মতো চোখদুটো সবসময় যে লুকোনোর চেষ্টা করতো রাহা, রোয়েন তা ও দেখতে পেত। তা ও তার মন গলল না। তবে খারাপ লাগা ছিল। কেন রাহা তার জন্য কাঁদবে? মূল্যবান চোখের অশ্রু জড়াবে? ভালোবাসা দিতে যারা পারেনা তাদের ভালোবাসা পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।
রাহার ওই নামহীন অনুভূতি আর অভিমানগুলো জায়গা পেল না রোয়েনের কাছে। তাদের জায়গা হয়ে উঠলো না। অবশেষে তার সাথে বিয়ে বিয়ে শব্দটাই সে বন্ধ করে দিল। এবং নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে রাহাকে ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে দেবে ভেবে নিল। রাহা তখন পাগলামি করেনি। মেনে নিয়েছিল সবটা। রোয়েন ও খুশি৷ যাক এবার সবটা অন্তত ভালো ভালোই হবে। কিন্তু রোয়েনকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে পালালো রাহা। বন্দী হলো এক পিশাচের কাছে। রোয়েন তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই বন্দী হলো। ওই পশুগুলোর কাছে আর রাহার কাছে। আর ছাড়া পেল কই?
সেই যে বন্দী হলো অপবাদে, কলঙ্কে রোয়েনকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল রাহা। রোয়েনকে একদম নিঃস্ব করে দিল। অপরাধী বানিয়ে দিল বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কাছে। সেই অপবাদ আর অভিযোগ থেকে বাঁচতে রোয়েন মাত্র একটা পথই খুঁজে পেল যা তাকে দেখিয়েছিল তার তাননা। তার সেই বোনটা ও তাকে কথা শোনালো। সে বোনের কথায় রেখেছিল শেষে। তারপর পরই শুরু হলো এক নতুন কাহিনী।
অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীন রাহার যত্ন নেওয়া, সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সেড়ে তোলা। রাহা চাওয়ার এতটা জোড় ছিল সে পাগল হলো তবু ও রোয়েনকে নিজের করে ছাড়লো। ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা ওই পাগল রাহার কাছে গিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করতে করতে একসময় শান্ত থাকা শিখে গেল৷ যে মেয়েকে দেখলেই রাগে টগবগ করে ফুটতো সে সেই মেয়ের বকবকানি শুনতে শুনতে ও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল । এলোমেলো চাহনি আর এলোমেলো কথার ভাঁজে মেয়েটি বন্দী করে নিল রোয়েনকে। ছোট্ট ছোটো আবদার আর অনুরোধ গুলো ফেলার ও সুযোগ হয়ে উঠেনি রোয়েনের। ঔষধ খাওয়ানো, ভাত খাওয়ানো, মাথার চুল আঁচড়ানো, কাপড়চোপড় ধুয়ে শুঁকিয়ে দেওয়া, বকবকানি হয়ে উঠলো রোয়েনের নিত্যদিনের সঙ্গী। মাঝেমাঝে রোয়েনের পাথর বুকে শুয়ে শুয়ে করে বসা রাহার ছোট্ট ছোট্ট কিছু ব্যক্তিগত আবদার। রোয়েন ফেলে দিত ছুঁড়ে। পরক্ষণেই আবার তাকে কুড়িয়ে নিতে হতো। এভাবেই রাহার সব বাজে অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে বাজে হয়ে গেল রোয়েন। মানসিকভাবে অসুস্থ রাহা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া জানতো না তখন। তাই নানারকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা নিয়ে রোয়েন পড়েছিল অস্বস্তিকর অবস্থায়। পরে আবার তা নিজেকে সামলে নিতে হয়েছে। এই যে এতকিছু করা। রোয়েন শান্তি পেল মনে মনে। যাক তার উপর অভিযোগের পাল্লা কমছে এবার। সে মনেপ্রাণে চায় রাহা সুস্থ হয়ে উঠুক। তার গায়ে লেগে থাকা অপবাদ মুছে দিয়ে রাহা শুদ্ধ করে দিক রোয়েনকে। রোয়েন তখন ও অস্বীকার করে রাহার জন্য কোনো অনুভূতি নেই তারমধ্যে।
রাহা যখন হুটহাট উন্মুক্ত বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো, গলা জড়িয়ে ধরে নাক ঘষতো। কিছু আকষ্মিক ভয়ানক আবদার করে বসতে লাগলো শক্ত রোয়েন তখন বুঝে যেতে লাগলো সে রাহার সাথে জড়িয়ে গেছে খুব আলগোছে। শীতের কম্বলের নিচে বক্ষতলে চাপা পড়ে থাকা মেয়েটির চোখেই তখন ঘুম নামতো তার শরীরের উষ্ণতায়। হয়ত তার ও। পাশাপাশি কাছাকাছি থেকে ভুলে আনমনে খুব কাছাকাছি গিয়ে ও দূরে সরলো রোয়েন। কারণ সে বিশ্বাস করে রাহার জন্য তার মনে বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই।
সে হয়ত বুঝেই উঠতে পারলো না অনেক আগেই নিজেকে সে সমর্পণ করে দিয়েছে রাহার কাছে।
রাহা সুস্থ হলো ধীরধীরে। রোয়েনের ভুল হলেও রাহার মনে থাকে ঔষধ খাওয়ার সময়। কোনো এক সন্ধ্যায় রোয়েনের দ্বারা এক ভুল হয়ে গেল। রাগে, অভিমানে রোয়েন বন্ধুদের সামনে অস্বীকার করলো রাহাকে। সে তো অস্বীকার করেনি বরং এটাই বুঝাতে চেয়েছিল সে রাহাকে যাথার্থ্য সম্মান আর অধিকার দিয়ে সবার সামনে নিজের সহধর্মিণী পরিচয় দেবে কিন্তু সব উল্টো হয়ে গেল। হয়ত নিজের ভুল ছিল। ওরকম ভাবতে গেল কেন সে?
ব্যস, রাহা তারপর থেকেই দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। ওই রাহাহীন একা ঘরটাতে একা একা পুড়লো রোয়েন৷ কেন পুড়লো সেটা তখনও রোয়েনের কাছে ধোঁয়াশা। তবে এটুকুই তার মনে আসলো এখন তার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে তাই রাহা সরে গিয়েছে। ভালোই তো।
রাহা তার কাছে কেন থাকবে? সে রাহার কেউ হয় না। দিনেক পর সে জানতে পারলো রাহা নেই বাড়িতে। চলে গিয়েছে গ্রামে। রাহার চলে যাওয়ার কারণটা ও রোয়েন। সে দূরত্ব চাইছে। রোয়েনের সাথে এক বাড়িতে আর থাকা যাচ্ছেনা। ফলস্বরূপ তার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা উঠলো, আর রাহার সাথে ডিভোর্স। আশ্চর্যজনক হলে ও রাহার আর্তনাদ চোখে পড়েনি রোয়েনের। তারমানে ভালোবাসা শব্দটা নিছক। কাছে আসলেই মূল্যহীন হয়ে পড়ে শব্দটা। নাহলে এতবড় একটা সিদ্ধান্তে রাহাকে এত চুপ দেখাবে কেন? কোর্টে গিয়ে তার আর ও একটা বড় প্রমাণ পেল রোয়েন। সত্যি বলতে রোয়েনের নয়, অনুভূতি রাহার নেই। স্বার্থপর রাহা। খুব স্বার্থপর।

আঘাত পেল রোয়েন। রাহা তাকে আঘাত করলো। সে কি রাহাকে চেয়েছে নাকি? তাহলে এভাবে এসে আবার তাকে ছুঁড়ে ফেলার কোনো মানে হয়? অন্যায় কি তার সাথে হয় নি? রাহা ভালো থাকবে না। রাহা ভালো থাকতে পারে না। দেশান্তর হতে হতে সে শাপ দিল রাহাকে। সে চললো রাহাকে ছেড়ে। রাহা ভুলেও তাকে আটকালো না। একবার ও বলল না, আপনি যাবেন না। আমি আমার কাছ থেকে অনেক কিছু পাই।

তবে রাহাকে দেওয়া সে শাপ নিজের উপর এসে পড়লো যেন। বিমান গিয়ে পড়লো এক নিঝুম দ্বীপে। রোয়েন মৃত্যুর সাথে লড়লো। ঠিক তখনি মনে হলো তার সেবাশুশ্রূষা করার জন্য রাহা থাকার দরকার ছিল৷ সব শোধবোধ হয়ে যেত। রাহার অনুপস্থিতি ওখানে টের পাওয়ার কি দরকার ছিল সেটা ও জানেনা রোয়েন ৷ সে ফিরে আসলো পুনরায়। তাকে ফিরে পেয়ে প্রাণ ফিরে পেল বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের। কিন্তু সে ফিরে এসে যার চোখে তাকে হারানোর হাহাকার দেখতে চেয়েছিল তাকে দেখতে পেল না। এত শক্তপোক্ত মনটা আকুলিবিকুলি করলো টলটলে দুটো চোখে ব্যাথা দেখার জন্য। সে দেখতে পেল না৷
গ্রামে গেল তাননার সাথে। রাহা চোখে পট্টি বেঁধে এগিয়ে এল তারদিকে। খুঁজে নিল, ধরে নিল তাকে। পরক্ষনেই চেখের পট্টি খুলতেই রোয়েন দেখতে পেল সেই কাঙ্ক্ষিত চোখদুটো৷ যাক এইবার অমন একটা নির্ঝন দ্বীপে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু না সব ভুল। রাহার মনে তার জন্য যা অনুভূতি ব্যাকুলতা ছিল তা আর দেখতে পাওয়া গেল না। রোয়েন দেখতে পেল না। আচ্ছা তার মানে ভালোবাসা ও তাহলে ফুরিয়ে যায়? রাহার ভালোবাসা কি তবে ফুরিয়ে এসেছে?
রোয়েনকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রোয়েনের দেওয়া পছন্দের শাড়ি গায়ে দিল রাহা। শাড়ি এত প্রিয় তারমানে শাড়ি দেওয়া মানুষটা ও প্রিয়?
চোখের সামনে তক্ষুনি ভেসে এল করুণ দৃশ্য। রাহা সংসার করছে অন্যের সাথে। তার ঘরটা বাজেভাবে রেখে, নষ্ট করে, ময়লা করে, কম্বলে,বিছানায় রাহা রাহা গন্ধ মাখিয়ে আবার বিয়ের পিড়িতে?
রোয়েনের গায়ে ও তো রাহা রাহা গন্ধ। সাবান ঢললে ও যায় না। শ্যাম্পু ঢললে ও যায় না। হাজারটা পারফিউম দিলেও যায় না। সব শার্টে কোর্টে রাহা রাহা গন্ধ। রোয়েনের তখন রাহাকে ভীষণ প্রয়োজন পড়লো। তার ঘর পরিষ্কার করার জন্য, তার মন পরিষ্কার করার জন্য, তাকে শুদ্ধ করার জন্য রাহাকে তার প্রয়োজন হলো। ভালোবাসা টালোবাসা ওসব কিছু সে বুঝেনা। শুধু এটুকু বুঝলো তার রাহাকে চায়। চায় মানে চায়। তাননা ও ভয় দেখিয়ে বসলো। সে এই বাড়িতে আর পা রাখবে না। রোয়েন অতঃপর রাহার বিয়ে ভেঙে দিল। রাহার ঘর হবে তার ঘর। রাহার বাড়ি তার বাড়ি। রাহা ঘুমাবে তার ময়লা ঘরে। রাহা ঘুমোবে তার রাহা রাহা গন্ধে মাখা কম্বল গায়ে জড়িয়ে। অন্যকোথাও যাবে কেন?
রোয়েনকে পঁচালো, রাহাকে ও তো পঁচতে হবে।

রোয়েন রাহাকে বলেছিল সেদিন,
‘ অন্য কারো সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা মেয়েটাকে ভালোটালো বাসিনা আমি। আমাকে নষ্ট করে, আমার ঘরটাকে নষ্ট করে যে আবার অন্যত্র বাসা বাঁধতে চায় তাকে ভালোবাসিনা আমি। কখনোই না৷
রাহা হেসেছিল রোয়েনের কথায়।
আবদার করে বলেছিল
‘ তাহলে ভালোবাসি বলেন।
রোয়েন চুপ হয়ে গেল৷ এমন ভয়ানক শব্দমালা তার মুখ দিয়ে নিঃসৃত হওয়ার আগেই মৃত্যু হোক। রাহা হাসলো আওয়াজ করে রোয়েনকে চুপ থাকতে দেখে। হাসতে হাসতে বলল
‘ যে ভালোবাসি বলতে ভয় পায়, সে ভালোবাসতে জানে বেশি।
যে ভালোবাসি বলতে পারেনা, সে আগলে রাখতে জানে বেশি।
ভালোবাসিনা শব্দটার পেছনে ও লুকিয়ে থাকে এক আকাশ ভালোবাসা।
ভালোবাসি তো সবাই বলতে জানে, কিন্তু শেষপর্যন্ত ভালোবেসে যেতে ক’জন পারে?

ব্যালকনি থেকে সরে পড়ে রাহাকে ঘুম থেকে টেনে তুললো রোয়েন। তাড়া দিয়ে বলল
‘ রাহা আমি চলে যাচ্ছি। তুমি থাকো।
রাহা ঘুমঘুম গলায় বলল
‘ আরেকটু ঘুমায় না।
রোয়েন বলল
‘ সূর্যোদয় দেখব না? মিস হয়ে যাবে রাহা। তাড়াতাড়ি উঠো।
রাহা উঠতে চাইলো না। রোয়েনের জোরাজোরিতে উঠে মুখ হাত ধুঁয়ে নিল। তারপর সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লো হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্য। সাজেক ভ্যালির রাতের দৃশ্য একরকম, সকালের দৃশ্য একরকম। রোজ সকালে বা ভোরবেলায় রুইলুই পাড়াময় মেঘ ভাসে। সড়ক থেকে ফাঁক গলিয়ে মেঘ দেখাটা আসলেই মজাদার। মেঘবালিকারা মাঝরাত থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত প্রচণ্ড রকমের খেলা খেলে। ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে চলে যায় কেউ কেউ। দুপুরে পাহাড়/উপত্যকায় সাদা মেঘের মধ্যে সবুজ খেলা করে। বিকালে সবুজের ওপর সাদা ধোঁয়া উড়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ।

সাজেক ভ্যালির সড়কে হাঁটাতে শুরু করলো সবাই। সকালের নাশতা লুসাই গ্রামের হোটেলে সাড়তে হবে আজ। তার আগে সূর্যোদয়। হেলিপ্যাড থেকে সূর্যোদয়টা ভালোভাবে দেখা যায়। সাজেকের পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথটি খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন

সোয়েভ, রোয়েন আর ঈশান একসাথে। জুনিত আর রিহানের সাথে জিশান। তাননার সাথে নোহা আর রাহা।
হ্যালিপ্যাড যাওয়ার পথে বেশ উঁচু উঁচু কয়েকটা গাছ দেখা গেল। রাহা তাননাকে বলল
‘ এগুলো কি গাছ?
তাননা ঈশানকে ডেকে জিজ্ঞেস করল। ঈশান বলল
‘ এগুলোর নাম বৈলাম। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘকায় গাছ। লম্বায় এরা সর্বোচ্চ ২৪০ ফুট পর্যন্ত হয়।
রাহা বলল
‘ দারুণ।

সাজেকে রাতে দেখা গিয়েছিল রূপালি আলোর ঝলকানি। উন্মুক্ত আকাশের বুকে অসংখ্য তারা আর পূর্ণিমার চাঁদের অপূর্ব আলোকসজ্জা। দিনে সূযের সোনালি আলোর অপেক্ষায় হা্ঁটতে লাগলো সবাই । তবে ভোরে যতটুকু আলো ফুটেছে, তাতেই আবিষ্কার করা গেল আরেক সাজেক ভ্যালি। সবুজ ও পাহাড়ের প্রাচুর্যে ঘেরা সাজেক ভ্যালি। সাজেকে ঢেউ খেলানো অসংখ্য উঁচু-নিচু পাহাড়। যেগুলো সবুজ বনানীতে ঘেরা। চোখ জুড়ানো নিসর্গ। এটাকে মেঘপুরীর উপত্যকাও বলা যেতে পারে। পাহাড়ের প্রশস্ত বুক, আদিবাসীদের ঘর-বসতি ও নির্জন প্রকৃতির সঙ্গে দারুণ এক সখ্য আছে ভাসমান মেঘপুঞ্জের। পাহাড়ের বুক চিরে আপন মনে বয়ে চলেছে কাচালং ও মাচালং নামে ছোট দুটি নদী। নদী দুটির রূপ যেন সত্যিই পাহাড়ি কন্যার। দুটি নদীর বুকে প্রায় সব সময় ভাসতে দেখা যায় বাঁশের চালি, যা সবার দৃষ্টি কাড়ে। চালিতে বাঁধা বাঁশ সরাসরি চলে যায় কাপ্তাই লেক হয়ে কর্ণফুলি পেপার মিলে। আর পাহাড়ি পথ বেয়ে চলা রাস্তার দুধারে গড়ে উঠেছে স্থানীয় উপজাতীয়দের গ্রাম। সেসব গ্রামের জনমানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনধারা ঘিরে মুহূর্তেই আপ্লুত হয়ে ওঠে আগন্তুক পথচারীর আবেগ।
আসলে সাজেক ভ্যালির প্রকৃতি ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতে বসে রঙের মেলা। সাজেকের আবহাওয়া ও সৌন্দর্য, রাতের আকাশে চন্দ্র-তারা ও দিনের আলোয় লাল সূর্য মিলেমিশে একাকার। এ দৃশ্য নিমিষেই সবার মনকে উদাস করে তোলে।

সূর্য ওঠার আগেই সবাই হেলিপ্যাডে গিয়ে পৌঁছালো । তাদের আগেই আরো অনেক লোক এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে সূর্যোদয় দেখার জন্য। তাদের পরও আরো অনেক লোক এলো। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত সূর্যোদয়ের দেখা মিলল। দূরে সাজেকের চেয়েও উঁচু আরেকটি পাহাড়ের পেছন থেকে ধীরে ধীরে সূর্য আবির্ভূত হলো। সূর্যটা যেন ওই পাহাড়ের গুহায় সারা রাত লুকিয়ে ছিল। দিনের আলো ফুটতেই গুহা থেকে বেরিয়ে এলো। মনে হলো, কোনো মহারাজ তার সিংহাসনে আসীন হলেন, আর সবাই তাকে অভ্যর্থনা জানালো। মনমাতানো দৃশ্যটি ক্যামেরা বন্দী করলো রোয়েন আর সোয়েভ। রাহা, নোহা আর তাননা সাজেকে প্রথমবারের মতো দিনের আলোতে মেঘের চঞ্চল উড়াউড়ি দেখলো। খুশিতে আত্মহারা হলো। জিশান তো লাপাতে লাপাতে বলল
‘ আমরা আকাশে উঠেছি? আমরা মেঘ ধরেছি? উড়োজাহাজ ধরব?
সবাই তার কথায় হাসলো। কয়েকটা মেয়ে তার গাল টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ নাম কি বাবু?
জিশান রাগ করে বলল
‘ গাল টানো কেন? গাল টানলে রাগ লাগে নাহ?
তাননা বলল
‘ আব্বা এভাবে কেউ কথা বলে?
জিশান জিভে কামড় দিল। বলল
‘ আর কক্ষণো বলব না কেমন? আম্মা কি রাগে?
তাননা ছেলেকে আদর করে বলল
‘ একদম না।
জিশান হাসলো। রোয়েন তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ মামা কি খাবে বলোতো এবার?
জিশান যা যা খাবে তা তা অকপটে বলে ফেলল। রোয়েন মহাঝামেলায় পড়লো। এত এত চিপস চকলেট এখানে সে কোথায় পাবে?
তাননা বলল
‘ ভাই কিছু কিনতে হবে না। ওর চিপস চকলেট আমার ব্যাগে আছে। রিসোর্টে ফিরে দেব। ব্রেকফার্স্ট করবে, চিন্তা করিস না।
রোয়েন মাথা নাড়ালো।

হ্যালিপ্যাডটা রুইলুই পাড়ার কাছাকাছিই অবস্থিত। রুইলুই পাড়াই সাজেক উপত্যকার মূল কেন্দ্র। এখানে লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাড়ার সবগুলো বাড়ির রং লাল–সবুজ। রুইলুই পাড়ার নিচ থেকে প্রধান উপত্যকার অংশ শুরু। দীর্ঘ পথ শেষ করে বহুদূরে দাঁড়িয়ে আছে মিজোরামের প্রাচীন সুউচ্চ পাহাড়ের শ্রেণি। ঐতিহ্যবাহী লুসাই গ্রাম রুইলুই পাড়ায় হ্যালিপ্যাডের কাছেই। জনপ্রতি ৩০ টাকার প্রবেশ ফি দিয়ে লুসাই গ্রামে প্রবেশ করলো সবাই। লুসাই পাহাড়ের একেবারেই পাদদেশে এ গ্রামের অবস্থান। রাতের বেলা ঝিঁঝি পোকার ডাকে মুখরিত। প্রবেশমুখেই স্বাগত জানালো লুসাই গ্রাম। এখানে লুসাই জনগোষ্ঠীর ধারণ করা কিছু পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র পাওয়া যায়। সাজেক এলাকার একমাত্র গাছ বাড়ি বা ‘ট্রি হাউস’ লুসাই গ্রামেই পাওয়া যায়। বেশ সুন্দর একটি গ্রাম।
গাছবাড়ি থেকে রাতে আকাশের তারা গোনার চেষ্টাও করা যায়। এক রাত থাকার জন্য ৪ হাজার টাকা ভাড়া। আরও কটেজ আছে। ভাড়া ২-৩ হাজার টাকা। এখান থেকে মেঘ ছুঁতে পারা যায় ভালো করে। দোলনায় দুলতে বেশ ভালোই লাগে। নবদম্পতির জন্য আদর্শ জায়গা যাকে বলা হয়।
লুসাই গ্রামে পথের ধারে পাহাড়ি ফলমূল বা জিনিসের পসরা বসায় পাহাড়ি মেয়েরা। লুসাই মেয়ের হাতের ‘ব্যাম্বু টি’ খেতে ভিড় থাকে বেশি । রাতের বেলায় বেশি ভিড় থাকে।
তাননা ঈশানকে ডেকে বলল
‘ ব্যাম্বু টি খাব।
ঈশান বলল
‘ আচ্ছা, দেখছি।
রাহা বলল
‘ এখানে সবকিছুতে ব্যাম্বু কেন আপু?
তাননা হেসে বলল
‘ পাহাড়ি জায়গা মানেই তো বাঁশ আর বাঁশ।
রাহা বলল
‘ ওহহ।
সবাই ব্যাম্বু টি খেল বেশ আয়েশ করে। তারপর পরেই ছোটখাটো হোটেলে ঢুকে পড়লো। অনেক বড় হোটেলটি। অনেক পর্যটকদের দেখা গেল। সবাই সেখানে ব্রেকফার্স্ট সাড়ছে।
গোলগাল টেবিলগুলোতে সবাই গোল করে বসলো। সকালের নাশতা হিসেবে দিল
ভুনা খিচুড়ি, পাহাড়ি মুরগীর মাংসের চপ আর রসালো ডিম, পরোটা, ডাল, চা। রোয়েন বলল
‘ এতকিছু একসাথে খেলে ভুড়ি বাড়তে বেশিদিন লাগবে না।
রাহা বলল
‘ আপনি না খান আমরা খাব। আপনার সবকিছুতে ভুড়ির চিন্তা। আমি খাই। ভুড়ি বাড়লে বাড়বে।
রোয়েন ধমক দিল। খবরদার রাহা, বেশি খাবে না। বেশি খেলে আমি তোমাকে এখানে রেখে চলে যাব। সোয়েভ বলল
‘ আচ্ছা আমি নিয়ে যাব। রাহা তুমি ইচ্ছেমত খাও তো।
নোহা আর তাননা মিটিমিটি হাসলো। ঈশান রোয়েনের রাগী চেহারা টের পেয়ে বলল
‘ আহা রোয়েন খাবার নিয়ে বউকে এভাবে প্যারায় রাখলে কি করে চলবে ভাই? বউ তো। খেতে দাও।
রোয়েন চুপ করে থাকলো। রাহার সাথে সে জীবনে ও আর কথা বলবে না। ত্যাড়া মেয়ে একটা তার কোনো কথা শোনে না।
রাহা মুরগীর চপ আর পরোটা খেতে খেতে বলল
‘ উফফ কি টেস্টি? এগুলো ভালো মাইনষ্যের খাবার। সবাই খেতে জানেনা।
সবাই রোয়েনের চেহারা দেখে মিটমিটিয়ে হাসলো যদি ও তা রোয়েনের অগোচরে। সবাইকে হাসতে দেখলে বেচারার তো রাগের সীমা থাকতো না।

লুসাই গ্রাম ঘুরে কয়েকটা বাঁশের জিনিসপত্র কিনলো তাননা। বেশি কিনতে দিল না রোয়েন। ওগুলো বয়ে বেড়াবে কে? কিনতে বললে তো পুরো বাজার কিনে ফেলবে তাননা। মন খারাপ হলেও আসলে সত্যি। রাঙামাটি ঘুরবে তারা, এতগুলো জিনিস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে অসুবিধা হবে।

রুইলুই পাড়া থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা পথ কংলাক পাড়া। পাংখোয়াদের বসবাস এখানে। সব মিলিয়ে ১৫ পরিবারের বসবাস হবে। বিশাল পাথরখণ্ডের পাদদেশেই কংলাক পাড়ার অবস্থান। কংলাকের পাথরচূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক উপত্যকা চমৎকারভাবে এক নজরে দেখা যায়। রুইলুই পাড়ার পাদদেশে দারুণ এক সংযোজন অ্যাডভেঞ্চার ট্রেইল। সেখানে কাটলো এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। রোয়েন রাহার উপর ক্ষেপে দূরে দূরে থাকলো। দল থেকে বিচ্যুত হয়ে। রাহা তাননাকে জিজ্ঞেস করল
‘ তোমার ভাই কোথায় গেল?
তাননা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। রাহা পা বাড়ালো সেদিকে। তাননা ডেকে বলল
‘ তোকে খুব জ্বালায় না?
রাহা হাসলো। বলল
‘ আমিই বেশি জ্বালায়।
তাননা বলল
‘ পারিস তোরা।
রাহা হেসে উঠে চলে গেল। রাহাকে আসতে দেখে রোয়েন উল্টোপথে হাঁটা ধরলো। কলাংক পাড়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেছে সবাই। রাহা দৌড়ে দৌড়ে রোয়েনের পিছু নিল। তারা মিলিয়ে গেল নিমেষে। বাকিরা ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে। রোয়েনের কাছাকাছি আসতে না আসতেই রাহা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। ওমাগো বলেই চিল্লিয়ে উঠতেই রোয়েন পিছু ফিরে তাকালো। রাহাকে পড়ে থাকতে দেখে হেসে উঠলো। পেট চেপে ধরে হাসিতে ফেটে পড়লো সে। রাহা কাঁদোকাঁদো হয়ে চেয়ে রইলো। রোয়েন এগিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ উঠো। এখনো ভালোকরে হাঁটা শিখলে না রাহা।
রাহা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল
‘ আমি ব্যাথা পেয়েছি আর আপনি হাসছেন?
রোয়েন হাসি থামিয়ে দিয়ে বলল
‘ উফফ রাহা। তোমার সাথে আমি জীবনে ও কথা বলব না বলেছিলাম। উফফ।
রাহা এবার হেসে ফেলল। হাত ঝেড়ে মুছতে মুছতে বলল
‘ ওহহ তাহলে তো ভালোই হলো।
রোয়েন কপাল ভাঁজ ফেলে রাখলো। রাহা ধুপ করে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল

আপনার রাগগুলো দিয়ে আমি পাহাড় বানাবো।
আপনার হাসিগুলো দিয়ে আমি ঝর্ণা বানাবো।
এই পুরো আপনিটাকে দিয়ে আমি আমাকে বানাবো।

রোয়েন চোখ নিচে নামিয়ে রাহার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রাহা হাসলো। রোয়েন হাসলো না তবে তার চোখ হাসলো রাহার সাথে।
রাহা নীরবে সম্মতি পেয়ে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে ধরলো। খানিকটা সময় নিয়ে তারপরেই ছাড়লো।

কংলাক পাহাড়ের উপরে কংলাক পাড়া অবস্থিত। সাজেক ভ্যালি মূলত রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। চারদিকে পাহাড় , সবুজ আর মেঘের অকৃত্রিম মিতালী চোখে পড়ে । সাজেক ভ্রমণরত পর্যটকদের কাছে এটি এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রুইলুই পাড়া হতে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে এটি অবস্থিত; সাজেকের হ্যালিপ্যাড হতে ৩০-৪০ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাক পাড়ায় যেতে হয়।
কংলাক পাড়াটি কমলাক পাড়া নামেও পরিচিত । স্থানীয় তথ্য মতে , এই পাড়াটির পাশে বড় বড় কমলা বাগান অবস্থিত বলে এটিকে কমলাক পাড়া বলা হয় । পাহাড়ের নিচে কংলাক ঝর্ণা অবস্থিত এবং এই ঝর্নার নামানুসারেই এই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে।
পাহাড়চূড়ার ছোট্ট গ্রামটিতে ত্রিপুরা ও লুসাই নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস ৷ জুম চাষ এ পাড়ার প্রধান খাদ্য ও উপার্জনের উৎস। বেশি চাষ হয় হলুদ ,আদা ও কমলার। কংলাকে পানি সংকট রয়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়বে একাধিক ও বড়বড় পানির রিজার্ভার। বৃষ্টির জমানো পানিই এ পাড়ার পানির মূল উৎস। অধিবাসীরা ঘরের চালা থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রিজার্ভারে ধরে রাখেন ও দৈনন্দিন কার্যাদি সম্পন্ন করেন।

কলাংক পাড়া ঘোরাঘুরি শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে কমলক ঝর্ণা দেখার জন্য চলে গেল সবাই। সাজেক ভ্যালির পাহাড়ের সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখার পর আরো রোমাঞ্চিত হওয়ার ঘুরে আসা দরকার কমলক ঝর্ণাটি। কমলক ঝর্ণার স্থানীয় নাম পিদাম তৈসা ঝর্ণা বা সিকাম তৈসা। সুন্দর ঝিরিপথ দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে কমলক ঝর্ণা। জিশান পানি পেয়ে কান্না ভুলে গেল। নিজেকে ভিজিয়ে নিল। ঈশান তাননাকে ডাক দিয়ে বলল
‘ আপনারা মা ছেলে কি শুরু করেছেন? ঘুরতে এসে হসপিটাল দেখাবেন না তো?
তাননা দৌড়ে এসে ঈশানের হাত ধরলো। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল
‘ আসেন আপনাকে ও ভিজিয়ে দিই।
ঈশান যেতে চাইলো না। তাননা জোর করে নিয়ে গেল। রাহা আর নোহা তো আগে থেকেই ভিজে টুইটুম্বুর। রোয়েন ভিজলো না। সোয়েভ ও না। নোহা জোর করে রোয়েনকে আর সোয়েভকে টেনে নিয়ে আসলো। রাহা বলল
‘ আজ সাজেকের শেষ দিন, না ভিজলে চলে? আপনারা ছেলেরা এমন কেন?
রোয়েন বলল
‘ ভিজো ভালো করে। যদি হাঁচি দাও আমার সামনে খবর আছে তোমার। নাক কেটে নেব একদম।
রাহা ইচ্ছে করে হাঁচি টেনে বলল
‘ আলহামদুলিল্লাহ।
রোয়েন নাকমুখ কুঁচকে রাখলো। সন্ধ্যার দিকে রিসোর্টে ফিরে দুঃসংবাদ ভেসে আসলো কানে। সোলার প্যানেলে সমস্যা হওয়ায় সাজেকের সবখানে বিদ্যুৎ পরিবাহকে সমস্যা হওয়ায় বিদ্যুৎ সেবা বন্ধ। রিসোর্টের আলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার চারপাশে। তার চাইতে ভালো বাইরে। ইতোমধ্যে পাহাড়ের আশেপাশে, রুইলুই পাড়ার মোড়ে মোড়ে মোমবাতি বিক্রি শুরু হয়েছে। রোয়েন আর সোয়েভ মোমবাতি কিনে নিল। বিদ্যুৎ আসতে আসতে মাঝরাত হতে পারে তা জানালো সাজেক বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। ততক্ষণে কি সবাই অন্ধকারে থাকবে? কাল সকালেই তো সবাই ফিরে যাবে আজ এমন হতে হলো?
জিশান চারপাশে অন্ধকার দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। তাননা শান্ত করাতে পারলো না৷ শেষমেশ রোয়েন ঘুরতে নিয়ে গেল। চোখে ঘুম নামলে তাননার কাছে দিয়ে গেল।
নোহা রাহা নিচের দোলনায় বসেছিল তাননার সাথে। ঈশান আর সোয়েভ ফিরলো। রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের পাশে রিসোর্ট বুকিং করে৷ কাল সকাল সকাল রওনা দেবে তারা। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো পাশের হোটেলে।

ফাল্গুনের শেষ। ফাল্গুনী হাওয়া বইছে চারপাশে। ঘরে মোমবাতি জ্বালানো ছোট্ট টেবিলটার উপরে। জ্বলজ্বল করে মোমবাতি জ্বলছে আর মোম গলে পড়ছে। রোয়েন ঘরে ঢুকে এল। হাতে আর ও কয়েকটি মোমবাতি। একজন লুসাই ছোট্ট মেয়ে তাকে দিল এমনি এমনি। টাকা ও নেয়নি। রাহা মন খারাপ করে ব্যালকণিতে বসেছিল। ঝর্ণার পানিতে ভিজেছে, আর ফিরে গোসল নিয়েছে। কিন্তু চুল থেকে তোয়ালে খুলে নেয়নি। যদি ঠান্ডা লাগে রোয়েন দেখে নেবে রাহাকে। একদম ধাক্কা মেরে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ফেলে দেবে।
রাহা রোয়েনকে দেখে ঘাড় ঘুরালো। বলল
‘ আগেরকার মানুষগুলো বিদ্যুৎ ছাড়া ক্যামনে থাকতো? দেখুন না চারপাশটা কেমন লাগছে।
রোয়েন বলল
‘ চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। চুল শুকিয়ে নাও।
রাহা তার কথা শুনলো না। রোয়েন শার্ট বদলে নিল। কালো শার্টটি গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল
‘ রাহা থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেব এখন। কি বলেছি শুনোনি?
সাথে সাথে রাহা ফিরলো তার দিকে। আচমকা টলটলে হয়ে গেল চোখদুটো। আশ্চর্য ভালো কথা ও কেউ এভাবে বলে? ভালোভাবে বলা যেত না?
রোয়েন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে রাহার দিকে চোখ তুলে তাকালো। রাহা ফিরে গেল সাথে সাথে। চোখদুটো লুকিয়ে তোয়ালে ছাড়িয়ে নিল। চুল মুছে তোয়ালে শুকাতে দিয়ে আবার গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো ব্যালকণির কাছে। রোয়েন রাহার দিক তাকিয়ে ডাকল
‘ রাহা?
রাহা জবাব দিল না। রোয়েন কিছুই বুঝলো না। বলল
‘ ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। এসো।
রাহা সরলো না। রোয়েন বুঝে নিল সবটা। ধীরপায়ে হেঁটে দাঁড়ালো রাহার পেছনে। রাহা সামনে ফিরলো না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রোয়েন সরে গেল।
রাহার বড় সাইজের ওড়নাটা নিয়ে গিয়ে রাহার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। ভেজা ভেজা গন্ধে মাতাল হয়ে শুধালো
‘ তোমার ঠান্ডা লাগছে।
রাহা ভারী কন্ঠে বলল
‘ লাগছে না৷ বলেছি আপনাকে? সরেন।
রোয়েন সরলো না। ভেজা চুলের মাঝে নাকমুখ ডুবালো। কিছু সময় নীরবে পার হতেই সে রাহাকে কোলে তুলে নিল। যৌবন শেষ হওয়ার আরেক ধাপ পার করলো। রাহাকে কোলে নিতে নিতে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। এখনো বাচ্চাকাচ্চার বাপ হয়নি। মোমাবাতির নিয়ন নরম আলোয় আলোকিত ঘরটা। সে আলোর ছটা এসে আলোকিত করল সহধর্মিণীর মুখ। এক অভাবনীয় অপ্রত্যাশিত একটু বিস্ময়কর আবদার করে বসলো রোয়েন।
‘ এই রাহা তোমাকে একটি ছুঁলে রাগ করবে? কান্না করবে? পালিয়ে যাবে? তাহলে ছুঁবো না।
রাহা একটার ও জবাব করলো না। অনুভূতিদের তখন দফারফা অবস্থা। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। খুব অল্প সময় যেতে না যেতেই হাত পা ঠান্ডায় জমে গেল রাহার। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিতে না দিতেই হিমশীতল অধৈর্য অধরের ছোঁয়া পেল তার অধরে।
এক টুকরো জ্যোৎস্নার ফালি যেন ঢুকে এল একদম নির্লজ্জের মতো সেই ঘরে। কিছু মুহূর্ত, কিছু ক্ষণ, কিছুটা সময় পার হলো।
দুজনের অধর থেকে অধর একটু আলাদা হতেই হঠাৎ যেন রাহার কানে ভেসে এল,

আমার রাতের আকাশে তুমি ধ্রুবতারা।
মনকে করেছো চঞ্চল, বিহ্বল দিশাহারা।

চলবে
টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে। রিচেইক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here