ধ্রুবতারা পর্ব_৩২ পুষ্পিতা_প্রিমা

ধ্রুবতারা
পর্ব_৩২
পুষ্পিতা_প্রিমা

সন্ধ্যা সাতটা তখন। মেঘের আকাশের বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে থালার মতো মস্ত বড় চাঁদটি। নিজের আলোয় আলোকিত করেছে পুরো পাহাড়ি আর মেঘের রাজ্যকে। চাঁদের আলোয় মেঘকে দেখাচ্ছে ঘন কুয়াশার কুন্ডলীর মতো। রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে উপভোগ করা যায় সাজেক ভ্যালির দৃশ্য। তখন দশা হয় প্রকৃতিপাগলের মতো ছন্নছাড়া মানুষগুলোর মতো। সবকিছু থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ কিছুক্ষণের মধ্যে ভুলে যায় আশপাশ। যেন তার পেছনে কোনোকিছুর পিছুটান নেই। হারিয়ে যাওয়া যায় এই প্রকৃতির মাঝে। ভীষণ ভালোলাগার একটি মুহুর্ত।

খাগড়াছড়ির ইজোড় রেস্টুরেন্ট থেকে তাননা সবার জন্য ব্যাম্বু চিকেন কিনেছিল। সাথে তেতুলের জুস। রুইলুই পাড়ার মোড় থেকে পেঁপে, আখের রস। এমন সময় আখের রস পাবে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি সে। জিশু শুধু আখের রস আর পেঁপেটাই খেল। অন্যগুলো ছুঁয়ে ও দেখেনি। সব মুননার অভ্যাস পেয়েছে ছেলেটা।
তারা সবাই একটা রিসোর্টে উঠেছে। তাননা নিচতলায়, বাকিরা উপরে।
সবাইকে চিকেনের প্যাকেটগুলো আর তেতুলের জুসের ক্যান দিয়ে দিয়েছিল সে। জানেনা সবাই পছন্দ করবে কিনা? মুননাটা যা ভেজাল টাইপের ছেলে। কখন না নাকমুখ সিটকিয়ে বলবে
‘ তাননা তোর চয়স রাহার মতো এত বাজে কেন?
মনে মনে ভয়ে ভয়ে থাকলো তাননা। হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্যে বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। জিশু ঘুমানো এখনো। ও উঠলে তাননা বেরোবে ভাবলো। রাতের সাজেক এক অন্যরকম অনুভূতি।
ঈশান এল জিশানের পাশ থেকে সরে । বলল
‘ জিন্নাত রাতের খাবারটা?
তাননা ব্যালকনি থেকে সরে জিশানের কাপড় ভাঁজ করায় মনোযোগ দিয়ে বলল
‘ মুননা অর্ডার দিয়েছে পাশের হোটেলে। ওখানে রাতে নাকি ভালো খাবার পরিবেশন করা হয়।
ঈশান বলল
‘ ঠিক আছে। কখন বেরোবো?
‘ জিশু উঠলে।
‘ ওকে আমি কোলে নেব। এখন বেরিয়ে পড়ি, তাছাড়া রোয়েন আর সোয়েভ ও এখন চলে আসবে। জুনিত আর রিহান তো বোধহয় বেরিয়ে গেছে।
তাননার কপালে ভাঁজ পড়লো। বলল
‘ আমাকে না বলে? একা একা বেরিয়েছে কেন? সাহস তো কম না।
ঈশান হেসে ফেলল। বলল
‘ ওরা কি ছোট আছে? রাগারাগি করবেন না। আপনার রাগ দেখে আবার পালিয়ে আসবে। থাক না।
তাননা বলল
‘ থাক মানে? কোনো বিপদ আপদ হলে? এখানে আমরা ছাড়া ওদের অভিভাবক আর কে আছে? ফোন দিন। এক্ষুণি আসতে বলুন। না খেয়েদেয়ে বেরিয়েছে নাহ? আমি চিকেনগুলো কেন কিনলাম?
ঈশান বলল
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। শান্ত হোন। আমি দেখছি।
তাননা বেডের উপর বসলো। বেয়াদব গুলো বেশি বাড় বেড়েছে। কষিয়ে চড় দিতে হবে কয়েকটা। এত পাজি দুজন বাড়িতে কেউ সামলাতে পারেনা, আর এখানে একা একা ঘুরতে চলে গেছে।

ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমানো জিশানের গায়ে কাঁথা টেনে দিল। মাথাভর্তি চুলে হাত গলিয়ে চুমু আঁকলো কপালে,গালে । এটা তার আব্বা। তার গুড্ডু।

তেতুলের জুস একটুখানি গালে দিতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেলল রোয়েন। রাহার দিকে তাকিয়ে বলল
‘ এত টক টক কেন রাহা?
রাহা বলল
‘ তেতুলের জুস খাচ্ছেন, আর টক হবে না? পেঁপে খান। আখের রস খান। ওগুলো মিষ্টি আছে। ঝাল মানুষ কেমনে এত মিষ্টি খায় বুঝিনা।
রোয়েন কোনো কিছুই খাবেনা। কারণ রাহা তাকে ঝাল মানুষ বলেছে? রোয়েন কি ঝাল মানুষ? সে যে একটু রাগটাগ করল ওটা রাহাকে দেখালো না। সবসময় সবকিছু দেখাতে নেই। নাহলে মূল্য কমে যায়। রোয়েন স্বাভাবিক গলায় বলল
‘ রাহা আমি ওই চিকেনটা খাব না। ওটাতে বেশি ঝাল। উপরে যে লেয়ারটা দেয়া আছে ওটাতে সব ক্যাপসিকাম আর গ্রিনসিলি। আমি খাব না। তুমি খাও।
রাহা মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ আচ্ছা।
রোয়েন তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো খুঁজে পেলনা। কোথায় গেল?
রোয়েন বলল
‘ রাহা আমার জিনিসগুলো কোথায়?
রাহা বলল
‘ আপনার কসমেটিকস গুলো আমার ব্যাগের পাশে ছোট্ট কালো ব্যাগটাতে আছে। দেখেন।
রোয়েন পেল না। আসলে সে খুঁজে নিতে চাইলো না। কসমেটিক বলল কেন? ছেলেদের কসমেটিক হয় নাকি? তাছাড়া
বউ থাকলে ওসব খুঁজে নিতে ইচ্ছে করে না। সব পুরুষই চায় তার বউ তাকে সবকিছু খুঁজে দিক, তার একটু খেয়াল টেয়াল রাখুক, পাশাপাশি তার সব জিনিসের ও। রাহা উঠে বসলো বেড থেকে। আহা এই ডাক্তারের জন্য একটু ভালো করে শুয়ে ও থাকতে পারবে না সে। সারাক্ষণ প্যানপ্যান। এটা পায় না ওটা পায় না। কিছুদিন পর বলবে রাহা ডক্টর রোয়েনকে কোথাও দেখেছ?
রোদ চশমা,পারফিউম ,মোবাইল চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক ,টিস্যু,সাবান ,শ্যাম্পু মিনি প্যাক ,এডোমস ক্রিম,পেষ্টব্রাশ ,চিরুনী ,হেডফোন, ক্যামেরা,ফার্সএইডবক্স সব খুঁজে দিল রাহা। বলল
‘ পুরুষমানুষের এত সাজসরঞ্জাম লাগে আগে জানতাম না। আমার ও তো অতগুলো নেই।
রোয়েন রাহাকে টেনে বেডে বসালো। রাহার পাশে বসলো। রাহার হাত তার হাতের মুঠোয় নিল। তারপর তার গায়ের রঙের সাথে রাহার গায়ে রঙ মিলিয়ে বলল
‘ রাহা দেখো এজন্যই তুমি এত কালো।
রাহা নাকমুখ ফুলিয়ে ফেলল তখনি। নাক টানলো। চোখ ছলছল করলো।
রোয়েন হেসে ফেললো। রাহার কপাল তার কপাল দিয়ে দুম করে মেরে বলল

‘ কালো মানেই তো ভালো।
কালো বলেই তোমায় এত দামী বলে আলো।

তাই না?

রাহা হাত ছুঁড়লো। রোয়েন হাতদুটো শক্ত করে ধরে তার মাথার উপর দিয়ে গলায় মালার মতো আটকে নিল। পাহাড়ের মতো বুক ফুলিয়ে ফুলেফেঁপে থাকা নাকটার উপর অধর ছোঁয়াতেই রাগ একদম পাহাড়ের নিচে নেমে এল ঝর্ণার পানি হয়ে। একদম ভিজিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করে দিয়ে কর্দমাক্ত করে দিল সবটা।
রাহা তারপরও কৃত্রিম রাগে ফেটে পড়ে বলল
‘ আমি ভালোটালো বাসি না আপনাকে।

হাসলো রোয়েন। রাহার কাজল কালো চোখের নোনাজলকে পড়তে বাঁধা দিল একটু যত্ন করে, একটু ভালোবেসে। অতঃপর নোনাজল গুলোকে শুকিয়ে যেতে হলো। রাহাকে গলে যেতে হলো। মেয়ে মানুষের ধর্মই তো এটাই। গলে যাওয়ায় তাদের ধর্ম কর্ম। শক্ত হওয়া কি তাদের মানায়? গলতে হয়, জ্বলতে হয়,পুড়তে হয় পরিশেষে ভালোবাসার ভাগটা আবার তারাই বেশি পায়। আসলে পাওয়াই উচিত।

এডোমস ক্রিমটা হাতে লাগাতে লাগাতে সোয়েভ বলল
‘ এজন্যই বলে ডাক্তার মানুষ নিয়ে কোথাও যাওয়া উচিত নয়। এসব ক্রিম ট্রিম কি কেউ মাখে?
নোহা বলল
‘ আমার ভাইকে অমন বলছেন কেন? মশা কামড়াবে এজন্যই তো ক্রিমটা লাগাতে বলেছে। ভালো করতে নেই কারো।
সোয়েভ বলল
‘ আহা রাগ করছেন কেন?
নোহা কথা বলল না। সোয়েভ বলল
‘ বাঁশ চিকেন খেয়ে সবখানেই বাঁশ বাঁশ দেখতে পাচ্ছি আমি৷
নোহা খিক করে হেসে ফেলল। পরক্ষণেই হাসি চেপে ফেললো। সোয়েভ এগিয়ে গেল। নোহাকে তোয়ালে দিয়ে টেনে এনে নিজের সামনে দাঁড় করালো। এডোমস ক্রিম সামান্য নাকের ডগায় লাগিয়ে দিয়ে বলল
‘ ক্রিম লাগিয়ে দেই?
নোহা নড়েচড়ে বলল
‘ দরকার নেই। আমি পারব৷ সরুন।
সোয়েভ সরলো না। ক্রিম মেখে দিল নোহার হাতে। তারপর মাথায় জড়িয়ে দিল বিশাল গোলাপি রঙের ওড়নাটি। পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ পানি খেয়ে নিন। বেরোতে হবে, ডাক্তার শালা ফোন দিতে দিতে শেষ।
নোহা হেসে উঠলো আবার। পানি খেল। সোয়েভ পানির গ্লাস রেখে বলল
‘ আপনার কি হাঁটতে অসুবিধা হবে?
নোহা মাথা নাড়িয়ে নরম গলায় বলল
‘ নাহ। অসুবিধা হলে কোলে নেবেন নাকি?
সোয়েভ তার কাজ বন্ধ করে দিল। নোহার কাছে এসে গালে টোকা মেরে মৃদু হেসে বলল

নোহা আপনাকে আমি এক স্নিগ্ধ সকালে দেখলাম। এক ক্লান্ত দুপুরে আপনার পিছু নিলাম। এক গোধূলী লগ্নে আপনি আমার বাড়িতে এলেন। আর এক জ্যোৎস্নামাখা রাতে আমার হয়ে গেলেন পুরোপুরি।
আপনাকে পাওয়ার এ সময়টুকু আমার জীবনে সবচাইতে ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্ত ছিল। আপনাকে যদি না পেতাম আমার জীবনে সবচাইতে বড় আফসোস আর বড়ই দুঃখের কারণ হতেন আপনি। আর এখন আপনাকে পেলাম অথচ দেখুন মনে হয় ঝুঁকিমুক্ত নই আমি এখনো। আসলে আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের হারাতে ভয় পায় ক্ষণে ক্ষণে। আপনি যদি হাঁটতে না পারেন, কষ্ট হয় তাহলে যেতে হবে না আপনাকে। এডভেঞ্চারের আগে আপনার সুস্থ থাকাটা বেশি জরুরি।
নোহা গাল ফুলিয়ে বলল
‘ নাহ আমি যাব। আপনার অত ভালোবাসা দরকার নেই বাপু।
সোয়েভ হেসে উঠলো। নোহা ও। সোয়েভ মজার ছলে বলল

‘ ভালোবাসা এখন হয়ে গেল ঘাস।
গরু তো খেয়ে নিল, আর দিয়ে গেল বাঁশ।

নোহা হেসে উঠলো খিলখিল করে। সোয়েভ ও হাসলো।

_______

পূর্ণিমা রাত। ঘোমটাখসা চাঁদ। সন্ধ্যায় আঁধার যেভাবে ঘিরে ধরেছিল, সেই শৃঙ্খল থেকে পাহাড় ও সাজেক ভ্যালিকে মুক্তি দিয়েছে চাঁদ। সাজেকে বিদ্যুৎ আছে। তবে তা ব্যাটারিসৃষ্ট। সেই বিদ্যুৎ অবশ্য সাজেক রিসোর্ট থেকে ভ্যালির চার্চ পর্যন্ত লোকালয়ে সীমাবদ্ধ। এরপর সাজেক ভ্যালিতে বাসাবাড়িও খুব একটা নেই, তাই বিদ্যুৎও নেই; আছে শুধু অন্ধকার। অন্ধকার জায়গাটুকুতে জ্যোৎস্নায় সাজেকের সড়ক রূপালি ইলিশের মতো চকচক করছে। সেই সড়ক ধরেই চন্দ্রালোকিত রাতে হেঁটে চলেছে তিন দম্পতি একটি ছোট্ট শিশু। আর দুইজন টগবগে তরুণ। জিশান মা বাবার আঙুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল
‘ আমি মামার কাছে যাব। রোয়েন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ আসো।
জিশু দৌড়ে গেল। রোয়েন কোলে নিতে চাইলে বলল
‘ মামা ব্যাথা পাবে। হাঁটি। খালামুণি আঙুল দাও।
রাহা আঙুল দিল। জিশু দুজনের আঙুল ধরে হাঁটলো। তারপর আবার গেল সোয়েভ আর নোহার কাছে। তাননা আর ঈশান হাসলো তার কান্ড দেখে। জিশু শেষমেশ গেল জুনিত আর রিহানের কাছে। দুজনের সাথে হেঁটে হেঁটে যেতে লাগলো হেলিপ্যাডের দিকে৷ বেশিদূর হাঁটতে দিল না তাকে৷ জুনিত আর রিহান কোলে চড়ালো বেশ খানিকটা পথ৷

এরপর সবাই যখন হ্যালিপ্যাডে উঠলো তখন দেখতে পেল আরও লোকজন আছে সেখানে। প্রেমিক-প্রেমিকাও আছে। যুগলবন্দিও কয়েকজনকে ও দেখা গেল। বাচ্চারা ও হই-হুল্লোড় করছে। তারপরও নির্জন-নিরিবিলি। পাহাড় ঘুমায়, চাঁদ পাহারা দিচ্ছে। রুইলুই পাড়ায় আলো ও সুরের খেলা চলছে। এখানেও দলছুট তরুণদের কণ্ঠ ভাসে রোমান্টিক গানে ‘লাল পাহাড়ের দেশে যায়, রাঙামাটির দেশে যায়… এক্কেবারে মানাইছে তারে, এক্কেবারে মানাইছে তারে…’।

রাতে পুরো রুইলুই পাড়া জেগে ওঠে। হ্যালিপ্যাডে তরুণ-তরুণী এবং পর্যটকদের জীবন্ত আড্ডা। হঠাৎই আবার ও ভেসে এল সুর, ‘লাল পাহাড়ের দেশে যায়… এক্কেবারে মানাইছে তারে…’।

রাহা নোহা ও যখন হাত তালি দিয়ে দিয়ে গানে তাল মিলাচ্ছিল রোয়েন কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে বলল
‘ ওগুলো কি ভাষা। এক্কেবারে মানাইছে তারে? ইয়াকক।
রাহা চোখ টিপে দিল। রোয়েন রাহার দিকে আর তাকালো না। তাকিয়েছিল সেজন্য রাহা কই খুশি হবে, একটু লজ্জা পাবে। তা না? চোখ টিপছে। বেয়াদব মেয়ে।

উদ্যমী তরুণদের সুর মায়া সৃষ্টি করে পাহাড়ে। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ সামনে বা পেছনে রেখে সেলফি/ছবি তোলার মজাটাই আলাদা। লুসাই আর সাজেকের বিভিন্ন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মিটমিট আলো। কী অপরূপ! যেন আলো গ্লাসে তৈরি। রুইলুই পাড়াকে মনে হয়, স্বচ্ছ আয়নার ওপর আলোর খেলা। হ্যালিপ্যাড থেকে অভিভূত হতে হয় এ নান্দনিক দৃশ্য দেখে।

হেলিকপ্টার প্যাডের আশপাশে অনেক খানি জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস। হেলিপ্যাডের পাশেই রয়েছে সূর্যঘড়ির স্থান। সেখানে তিনটি বেঞ্চ রয়েছে দর্শনার্থীদের বসার জন্য। চাঁদের আলোয় রূপালি স্নান সেরে নেওয়ার জন্য সবাই বেঞ্চগুলোতে বসে পড়লো। নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে গান যেন বেজে উঠলো, ‘এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি।। দেখ ওই ঝিলিমিলি চাঁদ সারারাত আকাশে শলমা জরি…।’

সাজেক ভ্যালির এখান থেকেই মেঘ সবচেয়ে ভাল দেখা যায়। সবাই চোখ পাকিয়ে দেখলো এক ঝাঁক উড়ন্ত মেঘপাখি। চাঁদের আলোয় অক্লান্ত সফেদ মেঘেরা অদৃশ্য ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে দৃষ্টির সীমানা পাড়ি দিয়ে অজানার উদ্দেশে।

রুইলুই পাড়ায় আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। পেছনেই লুসাই পাহাড়ের পাদদেশ। মেঘের ওড়াউড়ি। সবুজের মধ্যে সাদা ভেলা। পাহাড়ি শিশুরা খেলা করছে। ‘পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষার হার বেড়ে গেছে’ তারই প্রমাণ মেলে।
কংলাক পাহাড় থেকে সাজেকভ্যালি, মিজোরাম পাহাড়শ্রেণি, লুসাই পাহাড় দেখতে চমৎকার। বিকালবেলায় অনেকাংশই পরিষ্কার। বিশেষ করে সাজেকভ্যালি পরিষ্কার দেখা যায়। লুসাই বা মিজোরামের পাহাড়ে মেঘের ভেলা।

পাহাড়ে আছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার। বাড়িঘরেও এসেছে বৈচিত্র্য ও আধুনিকতার ছোঁয়া। জনসমাগমেও আসছে অনেক উপজাতি। বাঙালি-উপজাতির বৈষম্যও কমছে ধীরে ধীরে। সাজেকের এলাকা বৈচিত্র্যে ভরপুর। আবেশীয় দৃশ্যের ঘনঘন পরিবর্তন। সকাল-দুপুর-বিকালে ভিন্ন দৃশ্য! রাতে ও ভোরে অন্যরকম ভালোলাগার ছোঁয়া! সবসময়ে বৈচিত্র্যময় চম্বুকীয় আবেশতা! রাতের রুইলুই পাড়ায় যেন টুকটুকে লাল ফুল, টিয়া-রঙের ঝকঝকে কলাপাতার ফাঁকে মেঘবালিকারা। মোহিনীয় দৃশ্য।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উঁচুতে হওয়ায় সাজেক ভ্যালিতে সবাই মূলত তখন মেঘের মাঝেই । তবে দূরের মেঘ চোখে পড়লেও কাছের মেঘ দেখা যায় না। তা ছাড়া, অনেক উঁচুতে হওয়ায় এখানে বাতাসও উন্মুক্ত ছিল। আর পাহাড়ি অঞ্চলেরও ধর্মই হলো দিনের বেলা গরম ও রাতের বেলা ঠান্ডা। মেঘের পর মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকে। আর ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে পুরো দেহ। ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মনের আঙিনা৷ কি অপূর্ব দৃশ্য।
রাহার পাশে রোয়েন ছিল। বাকিরা অন্যদিকে। চোখ বন্ধ করে প্রকৃতির সাথে রাহা বেশিক্ষণ ভাব করতে পারলো না। তার আগেই রোয়েনের দিকে চোখ পড়লো। রোয়েন তার তাকানো দেখে বলল
‘ ওভাবে কি দেখছ? মেয়েরা কি ওভাবে তাকায় নাকি? ওভাবে তো ছেলেরা তাকায়৷
রাহা বোকাবনে গেল।
‘ ছেলেরা মেয়েরা আবার কি? আপনি এমন কেন?
রোয়েন বলল
‘ কেমন?
রাহা বলল
‘ জানিনা। অদ্ভুত আপনি।
রোয়েন রহস্যজনক হাসলো। বলল
‘ আমি তেমন, তুমি চাও যেমন।
পরিশেষে রাহা বুঝতে সক্ষম হলো। ঠোঁটের কোণায় দেখা মিলল একটুকরো তৃপ্তির হাসি। তার দেখাদেখিও মেঘের আড়ালে থাকা চাঁদটা ও কলকলিয়ে হাসলো।

হাঁটাহাঁটা ঘুরাঘুরির পরে ক্লান্ত দেখালো তাননাকে। ঈশান বলল
‘ এখন ফিরে যায়। রাত বাড়ছে। কাল সকাল সূর্যোদয় দেখার জন্য না হয় আবার আসবে। কাল অনেক ঘুরা যাবে।
ঈশানের কথায় সম্মত হলো সবাই। সেলফি ব্রিজ যাবে। কলাংক পাহাড় যাবে। লুসাই গ্রামে যাবে। আজ এতটুকু।
রিসোর্টে ফিরে রাতের খাবার হিসেবে দেওয়া হলো জুম চালের ভাত আর বাঁশ কোঁড়ল। মাংস দিয়ে রান্না করা হয়েছে।
রাহা খেতে খেতে বলল
‘ বাঁশ কোঁড়ল আবার কি?
রোয়েন বলল
‘ বাঁশের গোড়ার কচি নরম অংশকে বলা হয় বাঁশকোড়ল। এ নামেই এটি বেশি পরিচিত। মারমারা বলে মহ্ই আর ত্রিপুরারা বলে মেওয়া। চাকমা ভাষায় একে বলা হয় বাচ্ছুরি। পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় সব স্থানেই মেলে এ সবজি। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে এটি এখন জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম। বছরের মে-আগষ্ট মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম বলা যায়। এ অঞ্চলে মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশকোড়ল পাওয়া যায়। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির পানিতে মাটি নরম হলে এটি বাড়তে শুরু করে। মাটি হতে ৪-৫ ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে এটি খাওয়ার উপযোগি হয়।
বিভিন্ন জাতের বাঁশকোড়ল স্বাদে ভিন্ন। তবে মুলি বাঁশকোড়ল সবচেয়ে সুস্বাদু বলে বেশ নামডাক রয়েছে। সবার কাছে এটি অত্যাধিক জনপ্রিয় বলে বাজারে এর চাহিদা ও দামও কিছুটা বেশি। আর তুমি যেটা খাচ্ছ সেটাই মুলি বাঁশ কোঁড়ল।
রাহা বলল
‘ বাঁশ খাচ্ছি? বাঁশ খেতে ও মজা।
কথাটা মজা করে বলল রাহা। হেসে উঠলো সবাই। রোয়েন জবাব দিল না। রাহা তার কথাকে ব্যঙ্গ করবে কেন? বর হয় না?
রাতে ঘুমাতে এসে রাহা দেখলো রোয়েন ব্যালকনিতে বসা। রাহা ডেকে বলল
‘ ডাক্তার ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাকে দেখেন?
রোয়েন জবাব দিল না। রাহা গেল। পেছন থেকে রোয়েনকে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ অ্যাই ডাক্তার।
রোয়েন নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল
‘ সবসময় জ্বালাও। আমি রাস্তা দেখছিলাম। নাক ঢলার জন্য কি রুমাল পাও না? সবসময় আমার শার্ট নিয়ে পড়ে থাকে।
রাহা কথা বলল না। বিছানায় শুয়ে পড়লো। ডাক্তার ব্যাটা আজ আসুক। একদম ধরতে দেবে না। ধাক্কা দিয়ে ওই বাঁশবাগানে পাঠাই দেবে।
রাহাকে ঢুসে ঢুসে ঘুমাতে দেখে আর ও রাগ বাড়লো রোয়েনের। ধপ করে শুয়ে সে মুখ লুকোলো বালিশে। ভরাট গলায় ডাকল
‘ ওহ রাহা আমার ঘুম আসে না।
রাহা বলল
‘ তো?
রোয়েন রাহাকে টেনে নিল। বলল
‘ ওই নিচে একটা দোলনা আছে নাহ? চলো ওখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। পরে চলে আসব।
রাহা বলল
‘ তাননা আপু আর ঈশান ভাই যদি দেখে?
রোয়েন বলল
‘ ওরা ঘুমিয়ে গেছে।
রাহা বলল
‘ নাহ, ঘুম ঘুম। রাহা ঘুম।
রোয়েন উঠে বসলো। নেমে পায়ে জুতো পড়তে পড়তে বলল
‘ আমি চলে যাই । তোমাকে ভূতে খাবে।
রাহা কাঁথা বালিশ ফেলে দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলে গেল রোয়েনের পিছুপিছু৷ তারপর গিয়ে বসলো বিশাল দোলনাটাই । পাশে রোয়েন বসলো। চাঁদটা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। রাহা মাথা রাখলো রোয়েনের কাঁধে। বলল গল্প শোনান তো একটা।
‘ পারিনা।
‘ পারবেন। বলেন।
রোয়েন বলল
‘ একটা ইচ্ছে বলি?
রাহা মাথা তুলে বলল
‘ কি?
রোয়েন বলল
‘ আগে শুই। শুঁবো?
রাহা বলল
‘ কোথায়?
রোয়েন দোলনায় পা তুলে শুয়ে পড়লো রাহার কোলে। রাহার হাতটা তার মাথায় দিয়ে বলল
‘ ব্যাথা পাচ্ছ নাকি?
রাহা মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ নাহহ।
‘ চুলে বিলি কেটে দাও।
রাহা চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিল।
আর ও একটু গুঁজে গেল রোয়েন। রাহা কেঁপে উঠলো ক্ষণে ক্ষণে । রোয়েন মৃদুস্বরে কলবলিয়ে শোনালো তার ইচ্ছের কথা।

‘ রাহা একদিন পাহাড়ের লতা ফুলের গন্ধ শুঁকে এই যান্ত্রিক জীবনকে ছুটি দিয়ে আমি জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে চাই সবুজ পাহাড়ের আদিবাসী জনপদে। সবুজ পাহাড়ে কিনারে কিনারে বাঁশের ঘর বানাবো। রাতের অন্ধকারে একাকীত্ব যখন তাড়া করে বেড়াবে তখন জোনাকিরা ছুটে আসবে আমার পাহারাদার হয়ে। সেই জোনাকি হবে তুমি রাহা। জ্বলজ্বল করে জ্বলবে আমার চারপাশে।
আঁকা বাঁকা মেঠো পথে ধরে চলতে চলতে ভুলে যাব জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা। পাহাড়ের চূড়ায় মাচাং ঘরের উপর বসে রাতের জোছনা দেখবো তোমাকে নিয়ে।
পাহাড়ের মাঝে মাঝে সাদা মেঘেরা ঢেউ খেলবে। সারাটা দিন ঝিরঝির বাতাসে শুয়ে যাবে হৃদয়। যখন রাত নামবে পাহাড়ের কোলে মেঘেরাও ঘুমিয়ে পড়বে, তখন নীরব পাহাড়ে ভেসে আসবে কলাপাতার ঝড়ঝড় শব্দ। সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকবে। কিছুটা নিরবতা,খানিকটা অন্ধকারে চাঁদ-তারা, মেঘের সঙ্গে মায়াবী রাতটা কাটিয়ে যাবে সবুজ পাহাড়ের কোলে। তখন তুমি আমি হবো, আর আমি তুমি হয়ে যাব। হবে নাহ?
রাহা তার মাথা নিচে নামালো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসে সংঘর্ষ যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে বলল
‘ আমি তো অনেক আগেই হতে চেয়েছি।

চলবে্
আপনারা এবার রোমাঞ্চকর কমেন্ট করে যান দেখি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here