ধ্রুবতারা অন্তিম_পর্ব_৩৬ পুষ্পিতা_প্রিমা

ধ্রুবতারা
অন্তিম_পর্ব_৩৬
পুষ্পিতা_প্রিমা

সবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় যেন ছিল সবাই। সোরা নাহিল বেশ খুশি সবাইকে ফিরতে দেখে। তাননা সবার জন্য কেনা জিনিসপত্র কাপড়চোপড় গুলো দিল। ঈশানের মা বাবা আর সোয়েভের মা বাবার জন্য কেনা জিনিসগুলো রেখে দিল। শ্বশুর বাড়ি ফেরার সময় নিজের শ্বশুড় শ্বাশুড়ির জন্য কেনা শাড়ি পাঞ্জাবীগুলো নিয়ে গেল।
তাননার শ্বাশুড়ি রেগে ছিল বউমার উপর। একদম একমাস ও স্থির করে বাড়িতে থাকে না এই মেয়ে। তার নাতিটাকে নিয়ে নিয়ে চলে যায় পনের দিন না পেরোতেই। কেমন ছেলের বউ? এবার থেকে জিশুকে রেখে দেবে তাদের সাথে। শাড়ি পাঞ্জাবীগুলো জিশান দাদা দাদুর কাছে নিয়ে গেল। বলল
‘ আম্মার সাথে কেন রাগ?
আম্মা যেথায় যাবে যাক।
ঈশান নিজেই হেসে উঠলো ছেলের কথায়। আসমা বেগম বলল
‘ তার মা কে কিছু বলা যায় না।
জিশু ভুরু কুঁচকালো। বলল
‘ আমি একদম পাপার মতো হয়েছি।
ঈশান ঠোঁট চেপে আবার ও হাসলো। তাননা তাদের পেছনে দাঁড়ানো ছিল। সে ও হাসলো।
আসমা বেগম এবার বলল
‘ এসবের দরকার নেই দাদুভাই। এগুলো তোমার মাকে পড়তে বলো। আমার আছে।
জিশু বলল
‘আম্মার ও শাড়ি আছে।
আসমা বেগম বললেন
‘ শান তোর ছেলে এত পাকা পাকা কথা বলা কখন শিখলো?
ঈশান বলল
‘ ও বড় হচ্ছে আম্মা।
জিশু বলল
‘ হ্যা। জিশু বড় হচ্ছে। আর বড় হয়ে কবি হবে। তাই না ?
ঈশান বলল
‘ একদম।
জিশু হাসলো। আসমা বেগম নাতিকে কোলে তুলে বুকে জড়ালেন। তাননা পা টিপে টিপে আসলো। শ্বাশুড়ির ধমকানো শাসনগুলো তার ভীষণ ভালো লাগে। এই শাসনগুলোর আড়ালো লুকোনো স্নেহটা সে খুঁজে পায়, দেখতে পায়। আম্মা থাকলে বোধহয় এভাবেই শাসন করতো?
আসমা বেগম নিচে তাকিয়ে থাকলেন। তাননার দিকে তাকালেন না। তাননা ঈশানের দিকে তাকালো। ঈশান চোখের ইশারায় অভয় দিল। তাননা সাহস পেল। বলল
‘ আম্মা শাড়িটা পছন্দ হয়েছে?
আসমা বেগম চোখ খুলে তাকালেন। ক্ষণিকের জন্য তাননার মুখটা শুকিয়ে গেল। আসমা বেগম শাড়িটা বালিশের নিচে রেখে দিয়ে আবার জিশুকে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন
‘ ছেলের মাথার চুলগুলো যে বড় হচ্ছে মা বাবা কারো খেয়াল আছে?
তাননা বলল
‘ আজকেই কাটার কথা।
ঈশানকে বলল
‘ আপনি ওকে নিয়ে যাননি কেন?
ঈশান বলল
‘ এই তো নিয়ে যাব এক্ষুণি।
আসমা বেগম বললেন
‘ আমি বললেই তাদের হুঁশ ফিরে। এমনিতে সারাক্ষণ ঘুরাঘুরি, নাচানাচি। একটা মাত্র ছেলে। দশটা না।
তাননা ঈশানের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালো। ঈশান হাসলো।
আসমা বেগম নাতির সাথে খেলতে খেলতে বললেন
‘ দাদুভাইয়ের একটা খেলার সাথী দরকার। নাহ দাদুভাই?
জিশু বলল
‘ হ্যা।
তাননা দ্রুত প্রস্থান নিল। ঈশান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকালো। বলল
‘ আমি তাহলে আসি? জিশুকে দাও।
আসমা বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। জিশুকে দিয়ে দিলেন। ঈশান চলে গেল। আসমা বেগম ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল
‘ একদম বউপাগলা। বউ যেদিকে সেও সেদিকে।

নাতাশা বেগমের জন্য শাড়িটা রাহা পছন্দ করে নিয়েছিল। নাতাশা বেগম সেটা না জেনে বললেন
‘ আমার তাননা বুড়ির পছন্দ একদম ফাটাফাটি। কি সুন্দর শাড়ি!
রাহা মুখ ভাঙালো। বলল
‘ এটা আমি পছন্দ করে নিয়েছি। হুহহ।
নাতাশা চুপ হয়ে গেল। বজ্জাতটার প্রশংসা করে ফেলল সে?
নাহিল হেসে মায়ের পাশে বসে বলল
‘ মা দেখো তুমি না চাইতে ও আমার মেয়ের প্রশংসা করে ফেললে।
নাতাশা বেগম বলল
‘ হয়েছে।
রাহা বলল
‘ একদম বজ্জাত। মুখটা কেমন করে ফেলেছে দেখো না?
রোয়েন সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল। রাহার কথায় লাফ দিয়ে উঠলো। ধমকে বলল
‘ এই রাহা তুমি কিভাবে কথা বললে?
রাহা ভড়কে গেল। বলল
‘ কিরকম?
নাতাশা বেগম সুযোগ পেল। বলল
‘ ভাই দেখ তোর বউ সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকে। সারাক্ষণ। একদম বেয়াদব মেয়েটা। মাইর দিতে পারিস না?
রাহা বলল
‘ কেন মাইর দিবে? আমি কারো খাই না, কারো পড়িনা।
রোয়েন ভুরু কুঁচকালো। বলল
‘ তোমার গায়ের শাড়িটা ও তো আমার দেওয়া। পড়ো না মানে কি?
সালেহা বেগম বলল
‘ ভাই থাম। কি করছিস? আর ছোট তুই কি বাচ্চা? বাচ্চা মেয়ের সাথে ঝগড়া করছিস।
রোয়েন বলল
‘ সব রাহার দোষ। দাদুর না।
রাহা রেগেমেগে চলে গেল। কান্না পেল তার। গুন্ডা ডাক্তার।
রোয়েন চোখ তুলে রাহার হনহনিয়ে হাঁটা দেখলো। ভাবলো, গুন বলতে পারলে দোষ বলতে পারবে না কেন? রাহা একটু বেশি বেশি করে।
নোহা আর সোয়েভ সন্ধ্যায় চলে গেল। যাওয়ার সময় নোহা একগাদা কান্নাকাটি করলো। রাহা তার কানে কানে বলল
‘ আমি শ্বশুরবাড়ি যেতে পারি না তাই কাঁদি আর তুই না যাওয়ার কাঁদিস। বেয়াদব মেয়ে।
নোহা কেঁদে কেঁদে জোরে জোরে বলল
‘ আমি রোয়েন ভাইয়াকে বলে দেব।
রাহা মাথায় হাত দিয়ে বলল
‘ কপাল কপাল। আর কাউকে পেলিনা? মুখে গুন্ডা মানুষের নাম আসে শুধু।

___________

জায়িদ একদম বড় ধরণের আয়োজন করে বোনের ছেলে আর ছেলে বউকে দাওয়াত খাওয়ালো। জাহেদা রোয়েনকে বলল
‘ ভাই তোর বউ নিয়ে কিছুদিন এখানে থাক। তার ভালো লাগবে। তোর ও। একটু শ্বশুরবাড়ি শ্বশুড়বাড়ি ভাব লাগবে রাহার।
জায়িদ বলল
‘ একদম ঠিক। রাহামণির শ্বশুড়বাড়ি ও হয়ে গেল।
আনহা বলল
‘ বাহ তাহলে আমি রাহার শ্বাশুড়ি আর অফিসার শ্বশুড়।
সোরা আর নাহিল বলল
‘ তোমরা ও পারো।
রাহা তো সেই খুশি। ওহ শ্বশুড়বাড়ি! শ্বশুড়বাড়ি জিন্দাবাদ। তাহলে এখানে তার রাজত্ব চলবে। হুহ।
রোয়েন ভারী শরম পেয়ে গেল। ছিঃ রাহা কিভাবে লাপাচ্ছে? খুশি হয়েছে এটা দেখানোর কি দরকার? মনে মনে রাখলেই তো হয়। তার পাগল বউ। উফফ। মাইরের অভাব।
রোয়েনের উপর কড়া শাসন চললো রাহার। একদম ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। পাশে এসে বসা ও যাবে না। তাকানো ও যাবে না। শাস্তি। শাস্তি। শাস্তি।
রোয়েন একদম একপাশে গুটিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে আবার মাথা তুলে রাহাকে দেখে। আবার বালিশে চেপে গিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘ রাহাকে ছাড়া কি রোয়েনের চলে না? চলে। খুব ভালো চলে। রাহাকে রোয়েনের কি দরকার? দরকার নেই। কে তাকায় রাহার দিকে? কে ছুঁই? কে পাশে গিয়ে বসে?
বিড়বিড় করতে না করতেই আবার মাথা তুলে তাকায় রোয়েন।
রাহা বলল
‘ বেয়াদব পুরুষ। তাকান কেন? আমি কি দেখতে পাই না?
রোয়েনের একদম আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো। সে উঠে গেল। চলে গেল পাশের রুমে। রাহাকে ভূতে খেয়ে ফেলুক।
রাহা চরম অবাক। ওমা? ডাক্তার আবার নতুন কি নাটক শুরু করলো? এই ব্যাটা আর কত কি দেখাবে তাকে?
রাহা চলে যেতে না যেতেই রোয়েন আবার উপস্থিত। রাহার দিকে না তাকিয়ে আবার শুইয়ে পড়লো বিছানায়। তার ফিরে আসার কারণ হচ্ছে, ভূতে যদি রাহাকে খেয়েটেয়ে ফেলে, যদি কিছু হয়ে যায় তখন সে বউ পাবে কই? তার বাচ্চাকাচ্চার কি হবে?
রাহা মিটিমিটি হাসলো। হাই তুলতে তুলতে বলল

‘ ভাবের শেষ নাই
এই ভাব নিয়া আমি কন্ডে যায়?

রোয়েন চুপচাপ সহ্য করে নিল। বিয়ের পর পুরুষমানুষের এসব মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। সবার না, যাদের রাহার মতো পাগল পাগল বউ থাকে তাদের। যেমন ডক্টর রোয়েনের বউ।
রাহা কাঁথা গায়ে দিল। কিছুক্ষণ পর দেখলো রোয়েন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাগে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল পিঠে। অসভ্য ডাক্তার তাকে রেখে ঘুমায় কিভাবে।
রোয়েন সহ্য করে নিল। বিয়ের পর পুরুষ মানুষের শারীরিক নির্যাতন ও সহ্য করে নিতে হয়। কোনো আইন নেই। বেয়াদব আইন।

দিন গড়াতে গড়াতে অনেকদূর এগোলো। মাস দুয়েক পরের কথা। রোয়েন হসপিটালে ডিউটিতে ছিল। নার্স এসে বলল
‘ স্যার ম্যাডাম এসছে।
রোয়েন বলল
‘ কোন ম্যাডাম?
নার্স অবাক হয়ে গেল। রোয়েন ফাইল খুলতে খুলতে বলল
‘ কি হয়েছে সিস্টার? কোন ম্যাডামের কথা বলেছেন?
নার্স বলল’ ম্যাডাম মানে ম্যাডাম।
রোয়েন বলল
‘ ধ্যাত। এসব কোনো কথা? নাম কি তোমার ম্যাডামের?
নার্সকে কিছু বলতে হলো না। রাহা এসে হাজির হলো। বলল
‘ বউ কয়টা আছে আপনার?
রোয়েন রাহাকে দেখে চমকালো না। সামান্য করে অবাক হলো। তারপর নার্সকে বলল
‘ সিস্টার দৌড়ে গিয়ে পানি আনেন।
নার্স দৌড় লাগালো। রাহা নাল ফুলিয়ে বলল
‘ ম্যাডাম মানে কোন ম্যাডাম?
রোয়েন বলল
‘ তুমি আসবে আমি জানতাম নাকি? সিস্টার তোমাকে ম্যাডাম ডাকছে কখন থেকে? তুমি জানো তুমি যখন পাগল ছিলে সিস্টার তোমাকে কত মার মেরেছে। আমি ও মেরেছি।
রাহা মুখ কালো করে ফেলল। রোয়েন হেসে ফেলল। রাহা বলল
‘ মজা নেন সবসময়।
রোয়েন বলল
‘ তাহলে মজা করার জন্য আরেকটা বিয়ে করব নাকি?
রাহা বলল
‘ আহারে, একটা বিয়ে করাইতে সবাইকে যে আকাশ পাতাল দেখাইলো সে আবার করে দ্বিতীয় বিয়ে। ঢং। ন্যাকা।
রোয়েন হাসলো। বলল
‘ ঠিক আছে। এবার বলো। কি চাও?
রাহা বলল
‘ ঘুরতে যাব। রিকশায় করে।
রোয়েন বলল
‘ অসম্ভব। প্রচুর কাজ রাহা। ঝামেলা করো না। চলে যাও। চলো গাড়িতে তুলে দেই।
রাহা বলল
‘ নাহ। যাব মানেই যাব। এপ্রোণ দিন। খুলুন।
রোয়েন স্টেথোস্কোপ খুলে নিল। বলল
‘ এটা দিয়ে একটা দিয়ে বেহুশ করে এখানে বেডে ফেলে রাখবো। তার বাড়ি ফেরার সময় হুশ ফিরিয়ে নিয়ে যাব।
রাহা আর একটা কথা ও বলল না। চোখে জল নামলো আবছা আবছা। রোয়েন ডাকল
‘ রাহা?
রাহা দাঁড়ালো না। বের হয়ে এল। একদম রাস্তায় উঠে বসলো। রিকশা ডেকে উঠে বসলো। তার চাওয়ার পাওয়ার মূল্য যার কাছে নেই তার কাছে সে যাবে না। কিছু চাইবে না কখনো।
বাম হাত দিয়ে চোখ মুছে নিল রাহা। তখনি পাশে এসে বসলো একটা অচেনা অজানা পুরুষ মানুষ। সে চেনেনা এই লোককে। রাহা চেপেচিপে বসলো । এই বেয়াদব পুরুষটা তার গা ঘেঁষে কেন বসেছে?
রাহার চেপেচিপে বসা দেখে মানুষটা হাসলো। আরেকটু ভালো করে বসলো। রাহার হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে রিকশাচালককে বলল
‘ মামা চলেন তো। যতদূর যেতে পারেন।
রাহা হাতটা ছাড়াছাড়ি করতে লাগলো। মোচড়ামুচড়ি করতে করতে একসময় শান্ত হয়ে গেল। হাতটা চট করে কেড়ে নিয়ে বলল
‘ কচু। সব দাঁড়িগুলো ঢলে দিল।
রোয়েন মুখ চেপে ধরলো রাহার। বলল
‘ মামা আছেন।
রাহা মুখ থেকে হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিল। বলল
‘ কেন এলেন এখন? কাজ নেই?
রোয়েন বলল
‘ নাইট ডিউটি করে দেব।
রাহা মুখ ফিরিয়ে নিল। রোয়েন বলল
‘ ইচ্ছে করে তোর শহরে থাকতে সন্ধ্যে সকাল।
ইচ্ছে করে জ্বালতে আলো, জ্বালাতে রঙ মশাল।
রাহার মনের বরফ গলতে গলতে পানি হয়ে গেল অতঃপর। মাথাটা গিয়ে ঠেকলো রোয়েনের চওড়া কাঁধে।
দুজনের সময় কাটলো রিকশায়। রিকশা মামার কাছ থেকে তারা ছুটি নিল কানুয়াদিঘীর পাড়ে এসে। গোধূলী নরম রোদ চারপাশে। পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সূর্য্যি।

এমন একটা নরম রোদমিশালো গোধূলীতে রাহা এই মানুষটার পাশাপাশি হাঁটতে চেয়েছিল। সকালে ঘুমঘুম চোখে তারপাশে এই মানুষটাকে দেখতে চেয়েছিল। রাতের জ্যোৎস্না কিংবা নিকষকালো অন্ধকারে এই মানুষটার বক্ষতলে আশ্রয় চেয়েছিল। সে পেল ও। এতটাই পেল যতটা কল্পনা ও করেনি। ভালোবাসিনা বাসিনা বলা মানুষটা তাকে এতটা ভালোবাসলো একটু অভিযোগের জায়গা ও রাখেনি। যে অভিমানের সময়টুকু দীর্ঘ হতে দেয়না, দূরত্বের সময়টুকু কাটাতেই যে পাগলপারা হয়, এড়িয়ে চলতে গিয়ে যে আরো কাছে চলে আসে তার ভালোবাসার গভীরতা মাপা বড্ড দুষ্কর। খাদ থাকার প্রশ্নই আসেনা। ঠান্ডা দীঘির জলে পা ডুবিয়ে বসলো রোয়েন। রাহা বলল
‘ আমি বসবো না?
রোয়েন বলল
‘ বসো।
রাহা বসলো। রোয়েন দীঘির জল হাতে নিয়ে ছুঁড়লো রাহার মুখে। রাহা বলল
‘ কি করলেন?
রোয়েন বলল
‘ নামিয়ে দিচ্ছ আমার কাঁধটা। রাহা মাথা তুলে ফেলল। দাঁড়িয়ে পড়তেই রোয়েন শক্ত করে ধরে ফেলল। টেনে এনে একদম বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলে বলল
‘ আমার সাথে থেকে থেকে তুমি সুন্দর হয়ে যাচ্ছ রাহা। রাগ শিখে ফেলেছ। ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলা শিখে ফেলেছ। ঝগড়া শিখে ফেলেছ। দুনিয়ার সব বদঅভ্যেস শিখে ফেলেছ। যে মানুষটার ভেতর এত এত বদরোগ আছে তাকে ভালোবাসতে গেলে কেন রাহা ?
কি অদ্ভুত! রাহা একদমই জানেনা এই প্রশ্নের উত্তর। একটু ও জানেনা।
খুব ছোট্ট থাকতে বোধহয় আব্বা একদিন কান্না থামানোর জন্য মজার ছলে বলেছিল
‘ রোয়েন ভাইয়া বকেছে? পড়া না শিখলে তো বকবেই। আর কেঁদোনা। তুমি যখন খুব বড় হবে, রোয়েন ভাইয়াই তোমার বর হবে। লাল টুকটুকে রাহামণির বর। তখন একটু ও মারবে না। খুব ভালোবাসবে। ছবিতে থাকা তোমার ওই বড় মা আর বড়আব্বা এটাই চেয়েছিল।
ব্যস রাহা এই কথাটা একদম গেঁথে রেখেছিল মনের ভেতর। বয়স যতই বাড়লো যখনই প্রেম কি বুঝলো? যখনই ভালোলাগা, ভালোবাসার মর্ম কি বুঝলো? ঠিক তখন থেকেই সে ভালোভাসে এই মানুষটাকে। মানুষটা তাকে ভালোবাসবে ভাবতেই দমবন্ধ হয়ে আসতো মাঝেমাঝে, সেই রাহা আজকে এতটা কাছে মানুষটার। একদম বুকের ধুকপুক শব্দটা ও শুনতে পাচ্ছে। নিঃশ্বাস এসে মিশে যাচ্ছে তার নিঃশ্বাসের সাথে। কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে হীমশীতল স্পর্শে স্পর্শে।

যার একটু ছোঁয়ায় সে শীতল হয়ে পড়ে, যার একটু বকায় তার চোখে হুটহাট জল চলে আসে, অভিমান পাহাড় বাঁধে, যার একটু হাসিতে তার পৃথিবীটা ও হাসে, যার একটু দূরত্বে, একটু লুকোচুরি খেলায় দুচোখ চঞ্চল, অস্থির হয়ে উঠে, যার একটু অবহেলার বিনিময়ে এক পৃথিবী ভালোবাসা আসে তাকে রাহার চায় শতবার,হাজারবার,লক্ষ বার,কোটিবার, বারবার।

ঠান্ডা দীঘির জলে পা ডুবানোর কারণে রাহার গায়ে জ্বর জ্বর ভাব এল। রাহার হাঁচির শব্দে রোয়েন নয় তেলাপোকা ও পালালো। রোয়েন আশেপাশেই এল না। তাকে দেখলে রাহার খালি নাক মুছে দিতে ইচ্ছে হয় শার্টে। অসভ্য তার বাচ্চাকাচ্চার মা। ছিঃ।
রাহার অবস্থা বেগতিক। জ্বরের ধাক্কায় বেহুশ বেহুশ অবস্থা। বমিটমি করে উল্টায় দিল একদম। রোয়েন হাঁচির ভয়ে পালালো। কিন্তু বমি করেছে শুনে চলে এল। বলল
‘ ওহ রাহা কি শুরু করেছ? এরকম হলে তো আমি তোমাকে নিয়ে ও যেতাম না। ধ্যাত।
রাহা নিভু নিভু চোখে বিছানায় শুইয়ে পড়লো। রোয়েন তাকে নিজ হাতে খাওয়ালো। তারপর ঔষধ খাওয়ালো। তারপর ঘুমাতে বললো। রাহা ঘুমালো না। বলল
‘ ডাক্তার গল্প শোনান।
রোয়েন বলল
‘ তোমার বর ডাক্তার। গল্পকার নয়।
রাহা বলল
‘ তাহলে ঘুমায়।
রোয়েন বলল
‘ ঠিক আছে।
রাহা জোরে চিল্লাই। আমার পাশে শুবেন না। যান।
রোয়েন বলল
‘ আচ্ছা এদিকে আসো। গল্প শুনাই। আসো।
রাহা এল। রোয়েন তাকে হাতের বাঁধনে বেঁধে নিল। রাহার গালে মুখ ঘষে দিয়ে বলল
‘ তাহলে গল্প বলি। শোনো। এক ছিল ডাক্তার। তার তিনটা বউ ছিল। এক ছিল রাহা। আরেকটা ছিল ফাহা। আরও একটা ছিল, সে হলো টাহা। এই তিনজন মিলে ডাক্তারের লাইফটা ত্যানা ত্যানা,,,
রাহা বাকিটুকু বলতে দিল না। চিল্লিয়ে বলল
‘ ও আল্লাহ। এই বস্তাপঁচা গল্প আমি শুনিনা। সরেন। সরেন।
রোয়েন হেসে ফেলল। না সরেই বলল
‘ আমি তো আগেই বলেছি আমি গল্পকার নই, আমি ডাক্তার। বিয়ে করবে? গল্পকার দেখে আবার বিয়ে দেব?
রাহা নাকিসুরে কেঁদে বলল
‘ আমি বমি করে দেব আপনার গায়ে।
রোয়েন ভয় পেল না। দূরত্ব পিষে মেরে রাহাকে নিয়ে এল নিজের কাছে। গলদেশে মুখ গুঁজে দিল। সময়টুকু কাটলো একটু ব্যাক্তিগত। শেষমেশ মুখ তুলে খুশিতে বাকুম বাকুম হয়ে বলল
‘ রাহা তুমি তো শেষ করে দিলে সবটা। শেষ।
রাহা বলল
‘ কি?
রোয়েন বলল
‘ তোমার গায়ে তো মা মা গন্ধ।
রাহা বলল
‘ কিহ?
রোয়েন মুখ ছোঁয়ালো রাহার গালে। শ্বাস টেনে বলল
‘ একদম সত্যি। তোমার গায়ে মা মা গন্ধ। বাচ্চা বাচ্চা গন্ধ।
রাহা চোখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল। বলল
‘ যাহহ, মিথ্যে বলছেন। মিথ্যে বলবেন না প্লিজ।
রোয়েন হো হো করে হেসে উঠে বলল
‘ মজা। মজা ও বুঝোনা?
রাহা এবার রেগে গেল। বলল
‘ এরকম মজা করবেন না৷ আমি খুশি হয়ে গেছিলাম।
রোয়েন বলল
‘ চুপ। এখনো কক্সবাজারে ঘুরা বাকি৷ সেন্টমার্টিন দেখা বাকি। কতকিছু বাকি। তুমি বাচ্চা বাচ্চা শুরু করেছ? নিজেই তো একটা বাচ্চা।
রাহা পাশ ফিরে শুয়ে থাকলো। আর কোনো কথা নেই ডাক্তারের সাথে।

সকালে রোয়েন হসপিটালে চলে গেল। এদিকে রাহার জ্বর কমলো না। রাহার অবস্থা বেগতিক শুনে রোয়েন আবার ফিরতি পথে চলে আসলো। আসার সময় শপে গেল। কিছু কিনে তারপর ঔষধ কিনে নিয়ে চলে আসলো।
বাড়ি ফিরে দেখলো বাড়ির লোকের চোখেমুখে চাপা আনন্দ। মিঠে মিঠে হাসি। সবার চোখে এক পাহাড় সমান চঞ্চল খুশির বার্তা ঘুরছে ফিরছে। কিন্তু কেউ রোয়েনকে বলার সাহস পাচ্ছে না।
রোয়েন নির্বিকার তাকালো। রাহার রুমে যেতে যেতে তাননার ফোন এল। রোয়েন ফোন তুলে কানে দিতেই বলল

‘ এখানে থাকলে ঠাসস করে চড় বসাতাম তোর গালে।

তাননা হেসে ফেলে বলল
‘ উফফফ কি খুশি কি খুশি মুননু! আমাল মুননু বাপ হব্বে। উফফ। আমি তো এখান থেকে বাপ বাপ গন্ধ পাচ্ছি।

রোয়েন বলল
‘ সর। বাচ্চা হবে রাহার। তোদের এত খুশি কেন? সব পাগল।

রোয়েন ফোন কেটে দিতে গেল । তাননা তার আগেই বলল
‘ মিষ্টি পাঠা। মিষ্টি খামু। ওহ আমি ফিপি হবো। শোন তোর মেয়ে হলে আমি আমার ছেলের বউ বানাবো। বুঝলি?
রোয়েন বলল
‘ না। বিয়ে দেব না।
তাননা বলল
‘ মাগো মা কি দরদ? আচ্ছা বোতলে রেখে দিস। বিয়ে দিস না। বিয়ে দিলেই আমার ছেলেকে দিবি।
রোয়েন ফোন কেটে দিল। ঘরে ঢুকলো। রাহা শুয়ে ছিল । তাকে দেখে মুখের উপর কাঁথা টেনে দিল রাহা। রোয়েন তেড়ে গিয়ে কাঁথা টেনে নিয়ে বলল
‘ রাহা সবাই আমাকে দেখে দেখে হাসছে। আমার লজ্জা লাগছে। তুমি এটা কি করলে? কক্সবাজার কিভাবে যাব এখন? সেন্টমার্টিন!
রাহা হাসলো। বলল
‘ যাব।
রোয়েন ধমকালো।
‘ চুপ। সবাই এখন আমাকে নাম ধরে ডাকবে না। অমুকের বাপ তমুকের বাপ ডাকবে। তারপর বিছানায় সারাক্ষণই প্রসাবের গন্ধ থাকবে। তোমার গায়ে মা মা গন্ধ। বাচ্চা বাচ্চা গন্ধ। আমার গায়ে ও বাপ বাপ গন্ধ। বাচ্চা বাচ্চা গন্ধ।
রাহা মন খারাপ করে ফেলল৷ ডাক্তার কি খুশি হয়নি? রাহা মন খারাপ করে পাশ ফিরে শুইয়ে থাকলো। রোয়েন ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
এসে দেখলো রাহা কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমোচ্ছে। রোয়েন তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছলো। ধীরপায়ে হেঁটে এসে বসলো রাহার পাশে। দুহাত রাহাকে ঘিরে ঝুঁকে ডাকল
‘ অমুকের আম্মা?
রাহা চোখ বন্ধ করে রাখলো। কাঁথা টেনে রাখলো। রোয়েন বলল
‘ আরেহ কাঁথা সরাও।
রাহা সরালো না। চোখ ভিজে গিয়েছে তার ইতোমধ্যে। কাঁথাটা ও ভিজে যাচ্ছে।
রোয়েন কাঁথার উপর দিয়ে রাহার মুখ ছুঁলো। কানের কাছে গিয়ে বলল
‘ একটা জিনিস দেখবে?
রাহা তক্ষুণি কাঁথা সরিয়ে ফেলল। রোয়েন পকেট হাঁতড়ে দুটো ছোট্ট ছোট্ট পুতুল বের করলো। একটা ছেলে পুতুল আরেকটা মেয়ে পুতুল। রাহাকে দেখিয়ে বলল
‘ কোনটা নেবে?
রাহা তক্ষুণি বলল
‘ আপনি খুশি নন?
রোয়েনের মুখ হঠাৎ মলিন হয়ে উঠলো।
উত্তর দিল না সে। সরে গেল। রাহা বলল
‘ তাহলে আমি ,,
রাহা ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রোয়েন ধপ করে দরজা বন্ধ করলো। চলে গেল। সবকিছু যাকে মুখ ফুটে বলতে হয়,বুঝাতে হয় তার পাশ ও ঘেঁষবে না সে। তার বাচ্চা চলে আসুক। রাহাকে রেখে সে বাচ্চা নিয়ে কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন চলে যাবে। রাহাকে নিয়ে যাবে না। জীবনে ও দেখা দেবে না।
রাহা তার পিছু পিছু বের হলো।
বলল
‘ আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
রোয়েন আবার ফিরে এল। বলল
‘ তোমার জন্য আসিনি। ওই ওর জন্য এসেছি। তোমার সাথে আমার কি?
রাহা কাঁদলো। রোয়েন ধমকে বলল
‘ তোমার এই বদঅভ্যেস যদি ও পায় তাহলে খবর আছে। সারাক্ষণ প্যা প্যা।
রাহা চুপ হয়ে গেল। পায়ে ভর দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে চলে আসলো রোয়েনের কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ তে কাঁদান কেন?
রোয়েন দুহাত দিয়ে তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো। মাথার চুলের ভাঁজে বিলি কেটে বলল
‘ রাহা ও যদি রাগী হয়, সব তোমার দোষ। যদি কথায় কথায় কান্না করে সব তোমার দোষ।
রাহা বলল
‘ সব নিজের রোগ। আমাকে দোষী বানাচ্ছেন কেন?
রোয়েন বলল
‘ কারণ আমি মানেই তুমি।

_________

তিনবছর পর,,,,,,,,

ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটির কামড়ে হাতের কব্জি লাল হয়ে গেল জিশানের। সে হাত ছুঁড়ে বলল
‘ গো রায়া। উফফো আমাকে কি পেয়েছ তুমি? আম্মা? কোথায় তুমি?
তাননা দৌড়ে এল। নিচে পড়ে থাকা রায়াকে দেখে দৌড়ে গেল। বলল
‘ আম্মু কি হয়েছে? কি হয়েছে?
রায়া ঠোঁট বাঁকিয়ে কাঁদলো। আঙুল দিয়ে জিশানকে দেখিয়ে দিল। বলল
‘ জিচি ।
তাননা বলল
‘ জিচি?
জিশান হাত ঢলতে ঢলতে বলল
‘ ও আমাকে আবার কামড় দিয়েছে আম্মা।
রাহা এল। রায়াকে কোলে নিয়ে বলল
‘ ঠাসস করে মেরে একদম বসিয়ে রাখব। বেয়াদব মেয়ে। কি পেয়েছ ছেলেটাকে?
রায়া ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিল আওয়াজ করে। নাহিল এসে নিয়ে ফেলল রাহার কোল থেকে। বলল
‘ রোয়েন আসুক।
রাহা বলল
‘ আসুক। বাপ মেয়ে দুজনকে একসাথে পেটাবো।
রায়া রাহার দিকে আঙুল দেখিয়ে দিয়ে বলল
‘ আম্মি পুঁচানি।
রাহা নাক ফুলালো। ঠোঁটে হাসি।
রায়া কেঁদে কেঁদে চলে গেল। নাহিল বলল
‘ আব্বা আসলে সব বলে দেবে। কেমন? এক্ষুণি আসবে।
রায়া দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল
‘ ডাততাল?
নাহিল বলল
‘ হ্যা ডাক্তার।
সোরা এসে কোলে নিল রায়াকে। বলল
‘ বোনু আজকে সিরাত আসবে। কি মজা হবে?

রায়া খুশি হয়ে গেল।
‘ সিতা!
সোরা বলল
‘ সিরাত।
রায়া বলল
‘ সিতা,পিতা,তিতা।
সোরা হাসলো। গালে টুপ করে চুমু বসিয়ে বলল
‘ বোনু।
রায়া বলল
‘ তনু,কনু,মনু।
সোরা আবার ও হাসলো। রাহা দূর থেকে মুখ ভাঙালো। রায়া তাকে দেখে মুখ ভাঙালো। রাহা আবার ভাঙালো। রায়া ও ভাঙালো। তখনি আসলো রোয়েন। রোয়েনকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো রায়া। হাত তালি দিয়ে ডাকল
‘ আব্বি?
রোয়েন তাকালো। হাসলো। রায়া মুখ ভাঙালো তাকে। রোয়েন বলল
‘ রাহা শিখিয়েছে?
রায়া উপরনিচ মাথা নাড়ালো। তারপর কোলে উঠতে না উঠতেই বলল
‘ আম্মি পুঁচানি, রাইয়া মারএএ।
রোয়েন রাহাকে ডাকল
‘ তুমি মেরেছ ওকে?
রাহা বলল
‘ কখন?
রায়া বলল
‘ আম্মি পুঁচানি।
রাহা বলল
‘ পঁচা মেয়ে। আম্মির নামে নালিশ করে?
রোয়েন মেয়েকে নিয়ে চলে গেল।
রায়াকে বলল
‘ কোনো কথা নেই রাহার সাথে।
রায়া বলল
‘ চাতে, ভাতে, তাতে।
রোয়েন বলল
‘ এসব কি?
‘ নাহা।
রোয়েন বলল
‘ রাহা শিখিয়েছে নাহ?
রায়া মাথা নাড়ালো। বলল
‘ নাহা চিকিচে।

রাতে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেল রাহা। বাপ মেয়ে কারণে অকারণে বকবক করে। আজ ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাহা গিয়ে রোয়েনের পাশে বসলো। রায়া বলল
‘ আম্মি?
রাহা বলল
‘ আম্মা।
রায়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল
‘ আম্মি।
রাহা টুপ করে আদর বসালো মেয়ের গালে, মুখে। রায়া গাল মুছে বলল
‘ আম্মা পুঁচানি।
রোয়েন হাসলো। রায়া উঠে রোয়েনের গলা ধরে জড়িয়ে ধরলো। মুখে মুখ লাগিয়ে ডাকলো
‘ আব্বি রাইয়া ঘুম,তুম, দুম।
রোয়েন বলল
‘ হ্যা আমি ও ঘুমাবো।
রাহা মাথা রাখলো রোয়েনের কাঁধে। তা দেখে রেগে গেল রায়া। রাহার মাথা ছোট্ট হাতটা দিয়ে ঠেলতে না পেরে বলল
‘ আম্মি পুঁচানি।
রাহা বলল
‘ কি হয়েছে?
রায়া গাল ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল
‘ আব্বি আমান। আমান।
রাহা বলল
‘ না আমার।
রায়া বলল
‘ না আমান।
রায়া নিজের চুল নিল হাতের মুঠোয়। টানতে টানতে দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট স্বরে বলল
‘ ইইইইইইই,,,,,,
রোয়েন টেনে নিল বুকে। রায়া নিজের চুল ছাড়েনি। রাহা দূরে গিয়ে বলল
‘ বেতটা কোথায়? কোথায়?
রায়া ছেড়ে দিল চুল। কাঁদতে কাঁদতে বলল
‘ নাহা পুঁচানি।
রাহা বলল
‘ একদম চোপ।
রোয়েন বলল
‘ তুমি চুপ। আমাদের মাঝে আসছে কেন? আম্মি এখন ঘুমাবে।
রায়া রেগে তাকালো। রোয়েনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বালিশের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিল৷ রোয়েন বালিশ নিয়ে ফেলে বলল
‘ কি করছেন? এই রাহা সব তোমার দোষ।
রাহা বলল
‘ একদম সব বাপের তেজ!
রোয়েন রেগে তাকালো। রায়া আরেক বালিশের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিল। রোয়েন সেটা ও নিয়ে নিল। রায়া কাঁথা খুঁজে পেল। কাঁথার নিচে মুখ ঢুকিয়ে দিল। রোয়েন কাঁথা নিয়ে নিল। রায়া খাট থেকে নামলো। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেঁটে টেবিলের নিচে ঢুকে বসে থাকলো গালে হাত দিয়ে। রোয়েন চেয়ে রইলো। আটকালো না। রাহা ও চেয়ে রইলো। টেবিলের নিচ থেকে আওয়াজ এল
‘ আম্মি পুঁচানি। আব্বি পুঁচাইয়ে।
রোয়েন আওয়াজ করে হেসে দিল। রাহা ও। রাহা পা টিপে টিপে গেল। আস্তে করে বের করে আনলো রায়াকে। কোলে তুলে নিয়ে গালে টুপটুাপ চুমু বসিয়ে বলল
‘ বিলাই রাগ করে? মেউ ডাকে না কেন? এই বিলাই?
রায়া গাল ফুলিয়ে থাকলো। রাহা রোয়েনের কোলে দিল। রোয়েন কোলে নিয়ে মেয়েকে আদর করতে করতে বলল
‘ রায়া নাকি বিলাই? সত্যি? আল্লাহ রায়ার নাম বিলাই?
রায়া নাক ফুলালো। ঠোঁট ফুলালো। বলল
‘ বিনাই নেয়।
রোয়েন বলল
‘ আছে। এটা কি আমার কোলে। এটার নাম বিলাই। রায়া বিলাই।
রায়া কাঁদোকাঁদো হয়ে তাকালো। রোয়েন তাকে শুইয়ে দিল। গায়ে কাঁথা ঝাঁপিয়ে দিল। চুল সরিয়ে কপালে চুমু আঁকল। গালে টুপুসটাপুস আদর দিয়ে বলল
‘ আম্মি ঘুমাক এবার। না না বিলাই ঘুমাক।
রায়া বলল
‘ আব্বি বিনাই।
রোয়েন বলল
‘ নয়।
রায়া রাগ করলো আবার। রোয়েন মুখ দিয়ে পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল
‘ হাসেন হাসেন।
রায়া কিছুসময় পার না হতেই খিলখিলিয়ে হেসে দিল। তার হাসির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। রাহা মেয়ের পাশে শুয়ে বলল
‘ একদম বাপের মতো হয়েছে।
রোয়েন বলল
‘ তাহলে তো খুব ভালো। আমার মেয়ে।
রাহা বলল
‘ না না আমার মতো হয়েছে।
রায়া পিটপিট করে তাকিয়ে বলল
‘ আম্মা পুঁচানি। আব্বা পুঁচাইয়া।

___________

নোহার ছেলে রায়ার চারমাসের ছোট। সিরাত। রায়ার বন্ধু। তাকে পেয়ে সারাদিন খাওয়া দাওয়া ও ভুলে গেল রায়া। সিরাত ডাকে
‘ তুনি? তুনি?
নোহা আর সৌরভ হেসে বলল
‘ টুনি ডাকে আব্বা। তুনি কি?
রায়া সিরাতকে ডাকে
‘ বাবু পাপ্পি দিবো? চক্কিত দিবো?
নোহা বলল
‘ আপনি নিজে ও তো বাবু।
রায়া বলল
‘ নেয়। রায়াআ বিনাই।
তার কথা শুনে হাসলো সবাই।

জায়িদ এসে বলল
‘ কি করে ভাই বোনেরা?
রায়া হাসলো। সিরাত ডাকল
‘ পুশি পুশি?
আনহা বলল
‘ পুলিশ হবে। পুশি কি?
সিরাত পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বসে ডাকে
‘ পুশি? আননা।
আনহা হেসে বলল
‘ তোর মা ডাকেনি আমার নাম ধরে।
সোরা বলল
‘ আনহা আপা তুমি বাপ ডাকো ।
আনহা বলল
‘ এটা তো আমার ভাই।

জিনিয়া আর সাহিলের বছরি ফাতেহার দিন চলে আসলো। এতিমখানার বাচ্চা আর অনেক লোকজনকে খাওয়ানো হলো।
ঈশান সোয়েভ নাহিল জায়িদ রোয়েন জুনিত রিহান জিশান সবাই গিয়ে কবর জেয়ারত করালো। দূরে দাঁড়িয়ে তাননা দেখলো। সালেহা বেগম আর জাহেদা বেগম জায়নামাজে বসে অশ্রুজলে ভাসিয়ে দিল। আল্লাহ যাতে ওইদুজনকে খুব ভালো রাখে। বাকিদেরও ভালো রাখে।

রোয়েন মা বাবার ছবি বুকে জড়িয়ে চুমু খায়। বলে
‘ আমার কাছে জুননু তো চলে এসেছে। আর গুড্ডু তো পাশে দাঁড়িয়ে কবর জেয়ারত করেছে । জিশান গুড্ডু, রায়া জুননু। দোয়া করো আম্মা, দোয়া করো আব্বা ওরা যাতে ভালো থাকে। সবাই ভালো থাকে । একে অপরকে ভালো রাখে।

_____________

একা একা থাকতে ভালোবাসে জিশু। কবি কবি ভাব। কবিসাহেব যা দেখে তাই নিয়ে ভাবে। সেভাবে আজ ও কিছু একটা নিয়ে ভাবতে বসেছে। সে সময় কোথাথেকে দৌড়ে এসে তার পা জড়িয়ে ধরলো কেউ একজন। জিশান চমকালো। দেখলো
‘ রায়া!
রায়া তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলল
‘ জিচি, মিচি,চিচি।
জিশান বলল
‘ স্টুপিড রায়া। কি করছ?
রায়া ঘুরা বন্ধ করলো না। ঘুরে ঘুরে গাইলো।
‘ জিচি,মিচি,চিচি।
পরক্ষণেই ঘুরে পড়ে গেল রায়া। কেঁদে দেওয়ার আগেই জিশান তাকে তুলে বসালো। কোলে করে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল
‘ তোমাকে কোলে নিলে হাতে ব্যাথা হয় রায়া। সবসময় কোলে উঠার বায়না করবে না। আমার আশপাশে আসবে না। কামড়ে দেওয়ার ধান্ধা।
রায়া হাসলো। ডাকল
‘ জিচি?
জিশান বলল
‘ আমার নাম জিশান।
রায়া ডাকল
‘ জিচি পুঁচাইয়ে।
জিশান পা ধুপ করে মাটিতে আছাড় দিয়ে বলল
‘ উফফফ। আমি তোমাকে একটু ও দেখতে পারিনা রায়া। তোমাকে ভালো লাগেনা আমার।
রায়া ডাকল
‘ জিচি পুঁচাইয়ে।
দুইপরিবারের সবাই কলকলিয়ে হেসে উঠলো তাদের দুজনের কথা শুনে।
রোয়েন আর তাননা দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। দুজনই উপরওয়ালার কাছে চায়, ভালো থাকুক পরিবারটা, ভালো থাকুক আপনজন, ভালো থাকুক প্রিয়জন। ভালো থাকুক সকলে।

সমাপ্ত
যারা পাশে ছিলেন এতদিন তাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। আজকে সবার কমেন্টের আশায় আছি। কেমন লেগেছে ধ্রুবতারা?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here