ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ১৯

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৯

আমি ফ্যালফ্যাল করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে ছিলাম। ও আমার হাত ধরে না থাকলে এইমুহূর্তে সত্যি সত্যি নিজের হাতে চিমটি কাটতাম। আহা! ভালোবাসা!
ও আমার অবাকের পাল্লাটাকে আরো ভারী করে দিয়ে পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”তোমার গিফট!”
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এসব কি সত্যিই ঘটছে? সন্দেহের দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালাম। ও মুচকি হেসে বক্স খুলে সুন্দর একটা নোজ রিং বের করে আমাকে পরিয়ে দিলো। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,”পছন্দ হয়েছে?”
আই ওয়াজ স্টানড! আমি হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলাম শুধু।

ধ্রুব আমাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করালো। হাতের ওপর হাত রেখে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,”কিছু বলছো না যে? পছন্দ হয় নি?” সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মৃদু কোমল হেসে বললাম,”হয়েছে! খুব পছন্দ হয়েছে!”

—“আর কিছু চাই?”

—-“সালামি?”

ধ্রুব ফের হেসে উঠে বললো,”সালামিও লাগবে?” আমি উপরে নিচে মাথা নাড়ালাম।

—“ঠিক আছে বলো, কত লাগবে?”

ধ্রুবর বিশ্বাস নেই। যে কোন মুহূর্তে নিজের স্বরূপে ফিরে এসে আমার রোমান্টিক ফিলিংস এর ফিউজ উড়িয়ে দিতে পারে। তাই সময় নষ্ট না করে বললাম,”পাঁচ হাজার!”

ধ্রুব কোনরূপ প্রতিবাদ করলো না। মিষ্টি হেসে বললো,”ঠিক আছে, দিলাম তোমাকে পাঁচ হাজার! কিন্তু আমাকে কি দেবে?”

জবাব আমার কাছে রেডিই ছিলো।বললাম,”তোমাকে তো সালাম দিয়েছি আর কি দিবো?”

ধ্রুব আরেকটু কাছে ঘনিয়ে এসে বললো,”উঁহু! শুধু সালামে চলবে না।”

ভাবলাম সালামি না দেওয়ার বাহানা করছে। মুখভার করে বললাম,”তবে কি চাও?”

ধ্রুব আমার ঠোঁটে আলতো টোকা দিয়ে বললো,”লেন্ড মি ইউর লিপস ফর ফাইভ মিনিট!”

লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলাম আমি।
ওর হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালিয়ে আসতে চাইলাম। ওর আমার ডান হাত চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলল,”টাকা তো নিয়ে যাও।”

—“লাগবে না অসভ্য!”

ধ্রুব জোরপূর্বক আমার হাতের পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললো,”মনে রেখো সুন্দরী সময়মত সব উসুল করে নেবো!”

ঈদের দিনেরপর থেকে আর ধ্রুবর সাথে ভালোমত কথা বলারও সময় পাই নি। বিয়ের কেনাকাটার ব্যস্ততা ছাড়াও আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দেওয়া নিয়েও বেশ ব্যস্ত সময় কেটেছে।
আজকে ঈদের তৃতীয় দিন। আগামীকাল আমাদের গায়ে হলুদ। বিয়ে উপলক্ষ্যে ইতমধ্যে আত্মীয়স্বজনরা সবাই আসতে শুরু করে দিয়েছে। আপু দুলাইভাই গতকালই দেশে ফিরেছে।

সন্ধ্যার দিকে আত্মীয়স্বজনদের সমাগমে সবগুলো রুম ভর্তি হয়ে গেলো। বাসাভর্তি মেহমানরা সবাই মিলে গল্পগুজব হৈ-হুল্লোড়ে পুরো বাসাটাকে সরগরম করে তুললো! চারদিকে উৎসবমুখর
আমেজ! আমি এক কোনায় অবলার মত বসে সবার কাণ্ডকারখানা দেখছিলাম! সবাই নিজ নিজ গল্পে মেতে আছে। হঠাৎ আপু আমাকে টেনে সবার মাঝখানে বসিয়ে দিলো।

এবার বেশিরভাগ মেহমানদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে গেলাম আমি এবং ধ্রব! সবাই একজোট হয়ে ধ্রুবর বিষয়ে আমার পেট থেকে খুঁচিয়ে কথা বের করার জোর চেষ্টা চালালো। ওদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে রীতিমত হাঁপিয়ে গেলাম। উপায়ন্তর না পেয়ে মাকে বললাম,”আমার শরীর খারাপ লাগছে।ছাদে গিয়ে কিছুক্ষন হাঁটাহাটি করবো!” মা রাজী হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই কাজিনরা সব ছাদে যাওয়ার অযুহাতে আমার পিছু ধরলো। মোটকথা, এরা কোনভাবেই আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।

লাইটিং এর আলোয় পুরো ছাদ ফকফকে উজ্জ্বল! আমরা ছাদের দক্ষিণ পাশটাতে গোল হয়ে দাঁড়ালাম গল্প করার জন্য। ধ্রুব কখন ছাদে উঠেছে জানি না। মহিলা পার্টির উপস্থিতি টের পেয়ে সুড়সুড় করে নেমে যাচ্ছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ছাদের দরজার পৌঁছানোর আগেই সুমাইয়া ‘ধ্রুব ভাইয়া’ বলে সজোরে চেঁচিয়ে উঠলো। সাথে সাথে আমি ছাড়া বাকি সবাই ওর কাছে গিয়ে হাজির। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুবই টায়ার্ড! আমি কারন জিজ্ঞাসা করবো বলে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু এবার নতুন তামাশা শুরু হলো। আমাকে আর ধ্রুবকে একসঙ্গে পেয়ে ঠাট্টা মশকরার লেভেল অন্যদিকে চলে গেলো। লজ্জায় আমার কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেলো। কোনভাবে এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি! ধ্রুব মিটমিট করে হাসছে। হাসবেই! কারণ আমি বিব্রত হচ্ছি। যেখানে আমার অশান্তি সেখানেই ওর শান্তি। অতএব ওর কাছ থেকে কোন রকম সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়ে কাজিনদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম,” মা ডাকছে। তাড়াতাড়ি নিচে যেতে হবে।”

কথা শেষ করেই আর দাঁড়ালাম না। সোজা নিচে নেমে গেলাম। কিন্তু বাসায় আসার পরেও শান্তি পেলাম না। কাজিনদের কেউ নিচে নামছে না দেখে টেনশন শুরু হয়ে গেলো। ধ্রুবকে নিয়ে ওরা কি করছে আল্লাহই জানে। কেন যেন মনে হচ্ছিলো ওর শরীর খারাপ! ওকে একা ফেলে আমার এভাবে নেমে আসা উচিৎ হয় নি। ফোন দিবো কি দিবো না ভাবছিলাম। শেষমেশ দিয়েই ফেললাম।

ফোনে ধ্রুবকে যা-ই জিজ্ঞেস করি ও কেবল হুঁ, হ্যাঁ উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো। আশেপাশে কাজিনদের উপস্থিতি আন্দাজ করে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”তুমি কি একা আছো?”
সাথে সাথেই ওপাশ থেকে হাসির রোল পড়ে গেলো। ধ্রুবও হাসতে হাসতে বললো,”ফোন স্পিকারে!” আমার মেজাজ এক লাফে সপ্তম আসমানে উঠে গেলো! ওর জন্য আমি টেনশন করে করে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর শয়তানটা কাজিনদের সাথে হাত মিলিয়ে আমার সাথে মজা নিলো! রাগে ফোন কেটে ,মেসেজ দিলাম,”আই হেইট ইউ!”

রিপ্লাই এলো না। রাগের পরিমান আরো বেড়ে গেলো। ভাবছিলাম কি করলে ওকে শিক্ষা দেওয়া যায়! ভাবতে ভাবতেই রিপ্লাই এলো,”আই অলসো হেইট ইউ!”

এইমুহূর্তে ধ্রুব আমার সামনে থাকলে নির্ঘাত ওর চুল টেনে টাক বানিয়ে দিতাম! অত্যাধিক রাগে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে মন চাইছে। আবারো মেসেজ টোন বেজে উঠলো। সিন করতেই দেখলাম,”রিপ্লাই মেসেজ সুমাইয়া দিয়েছে। পরে ফোন দিচ্ছি তোমাকে!”

আমি ওর ফোন না ধরার সিদ্ধান্ত নিয়ে বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই আপু আমাকে ধ্রুবদের বাসা থেকে ওয়াসিফকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিলো। ওয়াসিফ আপুর চারবছরে ছেলে। ধ্রুব বলতে দিশেহারা। দেখলেই ‘লুবো মামা, লুবো মামা’ শুরু হয়ে যায়। এসেছে থেকেই ধ্রুবর লেজে লেজে ঘুরছে। ধ্রুব ওকেও খোঁচায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে খোঁচানোর পরেও ওয়াসিফ ঘুরে ফিরে ধ্রুবর কাছেই যাবে। কালরাতে ওয়াসিফ ধ্রুবর কাছে ঘুমিয়েছে।

কালরাতের রাগ এখনো রয়ে গেছে। তাই ধ্রুবর সাথে আরেকদফা ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ওদের বাসায় ঢুকলাম। আন্টি জানালো ধ্রুব ঘুমাচ্ছে। ওর ঘরে গিয়ে দেখলাম দুজন খাটের দুই মাথায়। ধ্রুব পাশবালিশ জড়িয়ে ধরে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওয়াসিফ ধ্রুবর পায়ের দিকে শুয়ে ওর ডান পা-টাকে পাশবালিশের মত জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। ওয়াসিফের অবস্থা দেখে আমি রাগে ধ্রবকে ঘুম থেকে তুলে বললাম,”ওয়াসিফ কোথায়?
ধ্রুব চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,” ওয়াসিফ কোথায়?” ধ্রুব তার পায়ের দিকে ইশারা দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,”সারারাত আমাকে জ্বালিয়ে এখন পা ধরে মাফ চাইছে? ইন্টারেস্টিং তো!”

—“তুমি ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিলে না কেন?”

—“কতবার ঠিক করে শোয়াবো? এই ছেলে তোমার মত বিচ্ছু! স্থিরতা নেই। পুরো খাট চক্কর দিয়েছে। হাত পা ছুঁড়ে রাতে অলরেডি তিনবার আমার গালে চড় মেরেছে।”

আমি রাগে কটমট করে ধ্রুবর দিকে তাকালাম। ছোট বাচ্চাদের হাত পা ছোঁড়ার অভ্যেস থাকতেই পারে তাই বলে আমার সামনে আমার বোনের ছেলেকে বিচ্ছু বলবে! ওয়াসিফ কে টেনে কোলে তুলে নিলাম। টানাটানিতে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। শুরু হয়ে গেলো গলা ফাটিয়ে কান্না। কোল থেকে নামার জন্য ছটফট শুর করে দিলো। আমি গালে চুমু খেয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে কোনভাবেই ওকে শান্ত করতে পারছিলাম না। ও নিজের মত চিৎকার করে যাচ্ছিলো। কান্নার থামার কোন লক্ষণ না দেখে ধ্রুব ওকে আমার কোল থেকে নিয়ে আলতো করে গাল টেনে দিলো। মাথা নাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল,”কান্না থামা আমার বাপ! থামা বলছি। নইলে তোকে আর তোর খালাকে একসাথে তুলে আছাড় দেবো! আছাড় চিনিস? আছাড়? একদম আছাড় মারবো! হাত পা ভাঙবে! ভালো হবে না?”
ওয়াসিফ ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,”লুবো মামা!”

আমি অগ্নিদৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমাকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করে এসব করছে। রাগে দুঃখে গা জ্বলে যাচ্ছিলো। জোরপূর্বক ওয়াসিফকে আমার কোলে নিয়ে নিলাম। ধ্রুব ওয়াসিফের গাল টেনে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। আমি ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওয়াসিফকে বললাম,”আর কখনো যদি তুই ওর কাছে গিয়েছিস! তোর একদিন কি আমার একদিন। তোকে কোলে নেওয়ার লোকের কি অভাব আছে?”
ওয়াসিফ আবারো খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,”লুবো মামা!”
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here