ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ২১

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১

আমাদের হলুদ প্রোগ্রাম শুরু হলো নজরুলের বিখ্যাত, নেশা ধরানো,’আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস গায়্যি ‘ গানটি দিয়ে। দ্বিতীয় গানটা ছিলো, ”মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল!” তারপরের গানটি ছিলো, “নাই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল!” অথচ আমি খোঁপাই করি নি। আমার বুঝতে বাকি রইলো না এসব শয়তানি ধ্রুবর কাজ! ও দেখেছে আমি খোঁপা করি নি তাই আজকে খোঁপার ওপর তার ভালোবাসা বেশি করে জন্মেছে! চুপচাপ তামাসা দেখে গেলাম। আন্টি মুখটিপে হাসছেন। ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”বদমাইশ, একবার শুধু বাসায় যাই। তারপর তোকে মজা দেখাচ্ছি!” আমি কিছু বললাম না। ধ্রুব মিটিমিটি হাসছে।

হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত দুটোর বেশির বেজে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে আমার চোখ ঢুলুঢুলু! ধ্রুব বোধহয় আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলো আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। ঘুমে যখন আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো তখন সে বলিউডের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ধুম ধাড়াক্কা টাইপ গান প্লে করা শুরু করলো।

আচমকা কানের কাছে বোমা ফাটলে যেরকম হয় আমার অবস্থা ঠিক সেইরকম। হঠাৎ হিন্দি গানের লাউড মিউজিক বেজে উঠতেই বোকার মত চেহারা নিয়ে আশেপাশে তাকালাম। ধ্রুব আমার পাশে নেই। সরে গেছে। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিলো। কত সহ্য করা যায়! ভালো ঘুম না হলে চোখের নিচে কালি পড়ে আমার চেহারার বিচ্ছিরি হাল হবে। রাগ সামলাতে না পেরে ধ্রুবকে মেসেজ করলাম,”কালকে যদি আমাকে সুন্দর না লাগে তোমার একদিন কি আমার একদিন। তোমাকে আমি ছাড়বো না। তোমার জন্য আমি ঘুমাতে যেতে পারছি না!”

সাথে সাথেই রিপ্লাই করলো,”কালকে তোমার আসল চেহারা তো শুধু আমিই দেখবো! বাকিরা তো দেখবে মেকাপভর্তি ভূতের মত চেহারাটা!”

আমি রাগে আর কোন মেসেজে দিলাম না। ধ্রুব আবারো মেসেজ দিলো,”খোঁপা করো নি কেন?”

—“তুমি আগে বলো নি কেন তোমার খোঁপা পছন্দ?”

ধ্রুবকে দেখলাম মেসেজ সিন করে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। মুখে মুচকি মুচকি হাসি! দশমিনিটের ভেতরই প্রোগ্রাম শেষ হয়ে
গেলো।

বিয়ের দিন আর ভুল করলাম না। পার্লারে গিয়ে সবার আগে চুলের খোঁপা বাঁধার কথা জানালাম। সুমাইয়া, তরু ওদের হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ। তরু বলল,”ভয় নেই আজকে তো গানবাজনা হবে না! নিজের ইচ্ছেমত চুল সাজাতে পারো।”
প্রতিউত্তরে মুচকি হাসলাম। ধ্রুবর খোঁপা পছন্দ! সুতরাং খোলা চুলের প্রশ্নই ওঠে না!

কবুল বলার সময়ে ধ্রুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনবার কবুল বলে ফেললো। কিন্তু আমি একটু লজ্জা পাচ্ছিলাম। ধ্রুব আমাকে ভালোমতোন লজ্জা পাওয়ার সুযোগটুকুও দিলো না। হেসে উঠে বললো,”এখনো সময় আছে নিশাত, বিয়ে করবে কি না ভেবে দেখো!”

ওর কথা শুনে আচমকা খুব দ্রুতই তিনবার কবুল বলে ফেললাম। ঘরভর্তি লোকজন হো! হো করে হেসে উঠলো। আমি খালি ভেবে যাচ্ছিলাম এই ছেলে আর কতপ্রকারে আমাকে জ্বালাতন করতে পারে! হি ইজ রিয়েলি ইম্পসিবল!

সব রীতিনীতি পালন শেষে রাতের বেলা তরু, সীমা ওরা আমাকে ধ্রুবর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। পাঁচমিনিট পর ধ্রুব ভেতরে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করে দুষ্টু হাসি দিয়ে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গাইলো,”চুম্মে কি রাত হ্যায়, চুম্মে কি বাত হ্যায়, আল্লাহ বাঁচায়ে তুঝে মেরি ওয়্যার সে!”

ধ্রুব উউল্টোপাল্টা গান শুনে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড হাসি পেলেও মুখে গম্ভীরভাব বজায় রেখে বললাম,”অসভ্যের মত আচরণ করছো কেন?”

ধ্রুব আমার মেজাজের পাত্তা দিলো না। অসভ্যের মতন হেসে বলল,”আজকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না সুন্দরী!”

আমি আবারো রেগে যাওয়ার ভান করছিলাম কিন্তু ধ্রুবর কথা শুনে গালে হাত! ধ্রুব বাধা দিয়ে বললো,”দেখো নিশাত আজকে যদি তুমি আমার সাথে রাগারাগি করো তাহলে কিন্তু আমি গ্ল্যু দিয়ে তোমার মুখ বন্ধ করে দেবো।”

—“কি বললে?”

ধ্রুব আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো,”বেশি কথা বলো না। তাড়াতাড়ি সালাম করে ফ্রেশ হয়ে এসো। কালকে সকালেই মাকে খুশির খবর শোনাতে হবে!”

—“অসভ্য!”

আমি বিছানা থেকে নেমে ধ্রুবকে সালাম করলাম। ও মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছিলো। সালাম শেষে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,”আই লাভ ইউ!” আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললাম। ওর চোখে ঘোর! ঘোর আমার চোখেও।
আমার নাকের ডগায় আলতো করে কামড় দিয়ে বললো,”হে বিউটিফুল, টুড্যে আই উইল মেসমারাইজ ইউ উইথ মাই লাভ!” হৃদপিন্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। অনুভূতিগুলো উপচে পড়ার দশা! ভালোবাসার স্পর্শে টইটুম্বুর হৃদয় নামক নদীটা!

ধ্রুবর তপ্ত নিশ্বাস ঘাড় স্পর্শ করতেই চোখ বন্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুবর গায়ের মিষ্টিমধুর ঘ্রাণ আমাকে সম্মোহিত করে ফেললো। ওর কলার চেপে ধরলাম এবং আবারো ভুলে গিয়েছিলাম আমার পাশে ধ্রুব দ্যা গ্রেট শয়তান, অসভ্য, বদ, দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস করে বললো,”চুমু খাওয়ার যখন এতই শখ তখন এতক্ষন বসে না থেকে মেকাপগুলো তুলে আসলেও তো পারতে! এগুলো পেটে গেলে আমার ডাইরিয়া হয়ে যাবে!”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো বলবো না কারণ খারাপের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হলো। ওর পাঞ্জাবির কলার সমেত টেনে ধরে চুমু খেয়ে বললাম,”আজকে সারারাত আমি এভাবেই থাকবো। মেকাপ তুলবো না। দেখি তুমি কি করো!”

ধ্রুব নিজের ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল চেপে ধরে হাসছে। বাঁ চোখটা টিপ মেরে বললো,”লিপস্টিকের ফ্লেভার ভালোই! চলবে!”

আমি আবারো হতাশ! এই ছেলে আমাকে পাগল করে দেবে! ইতোমধ্যে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমার মনে প্রশ্নও জাগতে শুরু করেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি পাগলই! নাহলে ধ্রুবকে কি করে সহ্য করি! হাউ ডু আই টলারেট হিম?
হাল ছেড়ে দিলাম। ওকে ছেড়ে দিয়ে খাম্বার মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব ওর হাতঘড়িটা খুলে টেবিলে রাখলো। কাবার্ড থেকে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করে বললো,”তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি!”

—“আমি? আমি ফ্রেশ হবো না?”

ধ্রুব ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললো,”তুমি? তোমার জন্য তো আমি আছি!”

ধ্রুব ওয়াশরুমে ঢোকার পর আমি পুরো রুমে পায়চারি করছিলাম আর ভাবছিলাম কি করলে ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া যায়? কোনরকম প্ল্যানই ধ্রুবর জন্য ইফেক্টিভ মনে হলো না।

ধ্রুব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আমাকে পায়চারি করতে দেখে হাসলো। আমি চেরাচোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও হাতদুটো আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”কাছে আসো!”

প্রচন্ড আদুরে ডাক! একটু আগে কি ভাবছিলাম সব ভুলে গেলাম! হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব নিজেই এগিয়ে এলো এবং ঝট করে আমাকে কোলে তুলে নিলো!

মস্তিষ্ক বারবার সতর্ক করে বলছে,” বি কেয়ারফুল নিশাত, ধ্রুবর মাথায় হয়ত আবার কোনো দুষ্টুমি বুদ্ধি এসেছে।” কিন্তু মন বলছে,”আসুক না ক্ষতি কি!” বস্তুত এইমুহূর্তে প্রতিবাদ করা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! ধ্রুবর সান্নিধ্য আমার শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, মুচকি হেসে ওর গলা জড়িয়ে ধরলাম!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here