# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২
বিয়ের পর ধ্রুবর অনেক কিছু নতুন করে লক্ষ্য করেছি। বাইরে থেকে বাসায় এলে ধ্রুব কখনো আগে আমাদের ঘরে ঢোকে না। আন্টি কিচেনে থাকুক, ডাইনিং এ থাকুক কিংবা নিজের ঘরে থাকুক সবার আগে আন্টির সাথে দেখা করবে। তাঁর সাথে কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে তারপর ধীরেসুস্থে আমাদের ঘরে আসবে। ও যখন আন্টির সাথে বসে গল্প করে আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখি। এই তো সত্যিকারের পুরুষ!
আমাদের বিয়ের নয়দিনের মাথায় ধ্রুবর ছুটি শেষ। হয়ে গেলো। ধ্রুবর চেহারা দেখার মত! সারাদিন কাচুমাচু চেহারা নিয়ে ঘুরছে। মনে হচ্ছে যেন আমি চাইলে ওর ছুটি বাড়িয়ে দিতে পারি! আগামীকাল ওর ফ্লাইট! কিচেনে ওর জন্য ভালোমন্দ রান্না করছিলাম। ও এসে হঠাৎ করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো। ওর গলায় আমার ওড়না ঝোলানো। চুলোর তাপে গরম লাগে বিধায় খুলে ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে এসেছিলাম। ধ্রুব সেটা গলায় ঝুলিয়ে আমার সামনে এসে উঁকি মেরে দেখলো কি রান্না করছি। পর্যবেক্ষণ শেষে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত করে বললো,”অনেক ভেবে দেখেছি। ছুটি বাড়িয়ে কোন লাভ নেই। তোমার রান্না এবং ওখানকার রান্নার কোয়ালিটি একই। খুব বাজে! সুতরাং থেকেও কোন লাভ হবে না।”
আমি ওর ঠাট্টায় যোগ দিলাম না। মন মেজাজ ভালো নেই। ওর চলে যাওয়ার খবর শোনার পর থেকেই বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বুক ফেটে কান্না আসছে ! চুপচাপ নিজের মত রান্না করছিলাম। আমার মুড অফ বুঝতে পেরে ধ্রুব বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় মুচকি হেসে আমার কানের কাছে গুন গুন করে গেয়ে উঠলো,”ভ্রমর কইয়ো গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে, অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর কইয়ো গিয়া!” আমি ওর দিকে খুন্তি তাক করতেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো।
রাতে আমি ওর ব্যাগপত্র গোছাচ্ছিলাম। সারা বিকেল কেঁদেছি। চোখ ফুলে ঢোল! ও বাসায় ছিলো না। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। ফিরে এসেই খোঁচানো শুরু করলো। ওর চলে যাওয়ার দুঃখে আমি নাকি কাঁদতে কাঁদতে জলোচ্ছ্বাস বইয়ে দিয়েছি এসব বলে আমাকে খেপাচ্ছিলো। যদিও ওর কথাগুলো সত্যি ছিলো। কিন্তু আমি স্বীকার করলাম না। বিরক্ত হওয়ার ভান করে বললাম,”কিসের চাকরী করো তুমি? এত ছুটি দেয় কেন তোমাদের? যাও ভাগো তাড়াতাড়ি, অসহ্য হয়ে গেছি!”
ধ্রুব বিন্দুমাত্র পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমার কথাটা শোনার পর ওর রিয়েকশনটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে ওর দিকে পলকহীনভাবে চেয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো। বললো,”তাই নাকি? এবার গেলে কিন্তু সহজে আর আসবো না।”
—“আসার দরকার নেই, আমি তো খালি দোয়া করছি কখন যাবে তুমি আর কখন আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো!”
ধ্রুব আবারো হেসে উঠে বললো,” কেন রাতে ঘুম হয় না? সারারাত কি করে তোমার বর?”
ধ্রবর কথা শুনে লজ্জায় আমার কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেলো। ওর,বাহুতে দুটো কিল মেরে বললাম, “নির্লজ্জ! লজ্জা করে তোমার? আমি জাস্ট ঘুমানোর কথা বলেছি। তুমি চলে গেলে দিনরাত চব্বিশঘন্টা শুধু আরাম করে ঘুমাবো।”
—“ঠিক আছে ঘুমিয়ো। কিন্তু আমি ফিরে এসে যদি দেখি তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চালকুমড়া হয়ে গেছো তাহলে কিন্তু খবর আছে বলে দিলাম। আমার সব যেন আমি ঠিক পাই।”
আবারো রেগে ধ্রুবকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু দরজায় টোকার আওয়াজ পেয়ে দুজনেই চমকে উঠলাম। আন্টি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি হেসে বললেন,”কিসের খবর রে ধ্রুব?” ধ্রুব হাসলো। আন্টিকে খাটের ওপর বসিয়ে নিজে তাঁর পাশে বসে বললো,”দেখো না মা নিশাত বলছে আমি চলে গেলে নাকি ওর ভালো লাগবে! আমাকে বলছে আমি এখনো যাচ্ছি না কেন?”
ধ্রুবর বলার ভঙ্গিমা দেখে আন্টি হেসে ফেললেন। আমিও হাসলাম। আন্টিও রেগে যাওয়ার ভান করে আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন,”আমার ছেলে চলে গেলে তোকে আমি বেঁধে পিটাবো।”
—“ওকে সহ্য করার চেয়ে তোমার মার খাওয়া ঢের ভালো!”
ধ্রুব আড়চোখে আমাকে উদ্দেশ্য করে আন্টিকে বললো,”শোনো মা, কালকে আমি যাওয়ার সময় তুমি ছাড়া যদি আর কেউ কেঁদেছে তাহলে মনে রেখো সে আমার সৎ বউ! আর যে কাঁদবে না সে আমার আসল বউ! এই আমি বলে রাখলাম!”
আন্টি হেসে কুটিকুটি। আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। ধ্রব আবারো তার শয়তানি হাসিটা দিয়ে বললো,”মনে রেখো। কাঁদলে কিন্তু তুমি আমার সৎ বউ!”
পরের দিন ধ্রুব বাসা থেকে বেরোনোর সময় আন্টি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। আমি এককোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার ভেতরে কি হচ্ছিলো তা আমি কাউকে দেখাতে চাইছিলাম না। ধ্রুবকে তো না-ই। প্রাণপণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম।
বেরোনোর সময় ধ্রুব আমাকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো,”আসি?”
আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু হয়ে গেলো। আন্টি ওকে ইশারা করতেই গম্ভীরমুখে আমার দিকে এগিয়ে এলো। চোখমুখ প্রচন্ড লাল। দেখে মনে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। বাইরে থেকে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছিলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো,”আবার আসবো তো, কাঁদছো কেন?”
ঐমুহূর্তে আমার মন চাইছিল ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমতন কিছুক্ষন কাঁদি। কিন্তু সামনে মুরুব্বিরা থাকায় চক্ষুলজ্জায় রুমে যেতে পারছিলাম না। করুণ মুখের ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব বুঝতে পারলো। হাতের ব্যাগ রেখে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,”আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।”
আমিও ওর পেছন পেছন বেডরুমে ঢুকলাম। ঢোকার সাথে সাথেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,”এভাবে কান্নাকাটি করলে আমি ওখানে গিয়ে থাকবো কি করে?”
আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। ও অস্থির হয়ে আমাকে শান্ত করা চেষ্টা করছিলো। গালে চুমু খেয়ে বললো,”কান্না থামাও নিশাত, প্লিজ কান্না থামাও। ”
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম,”আবার কবে আসবে তুমি?”
ধ্রুব হেসে উঠে বললো,”চাকরি করতে যাচ্ছি ভাই, আবার বিয়ে করতে নয়। এত কান্নাকাটির কিছু নেই, তিনমাস পরেই আবার ফিরছি।”
—“সত্যি তো?”
ধ্রুব দুহাতে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। চোখের পাতায় আলতো চুমু খেয়ে বললো,”একদম সত্যি!” আমি আবারো ওর বুকে মাথা রেখে গলা জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,”নিজের যত্ন নিও কেমন? আর মায়ের খেয়াল রেখো!”
কথা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আমি হাত চেপে ধরলাম। ও পেছন ফিরে মলিন হেসে বললো,”কি?”
আমি ফের ওর কাছে সরে গেলাম। দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,”নিজের শরীরের যত্ন নেবে।” তারপর কালরাতে ওর কথাটা মনে পড়তেই বললাম,”আমিও যেন আমার সব ঠিক পাই! নাহলে কিন্তু খবর আছে বলে দিলাম।”
ধ্রুব আমার নাক টেনে দিয়ে বললো,”নটি গার্ল, আমার কথা আমাকে বলা হচ্ছে।” আমি অনুযোগ করে বললাম,”কথা ঘোরালে চলবে না। আগে বলো তুমি নিজের যত্ন নেবে?
ধ্রুব কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বললো,”ঠিক আছে নেবো!” তারপর আবার আমার কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলো। আমিও পেছন পেছন বেরোলাম। কান্না কিছুতেই থামছিলো না।
আমার কান্না দেখে আন্টি হেসে ফেললেন। ধ্রুবও হাসতে হাসতে বললো,”কালরাতে কি বলেছিলাম মনে আছে? আজ থেকে তুমি আমার সৎ বউ!” দুঃখের মাঝেও আমি, মা,বাবা সবাই হেসে ফেললাম। ও দরজার কাছে যেতেই আমি আবারো জোরেসোরে ফুঁপিয়ে উঠলাম। মা আমাকে জোর করে ভেতরে নিয়ে গেলো।
এয়ারপোর্টে ধ্রুবর সাথে বাবা, রাফি ভাই, আর তরুর হাজবেন্ড যাচ্ছে। সবাই চলে গেলে আমি আন্টিকে জড়িয়ে ধরে ডুঁকরে কেঁদে উঠলাম। আন্টি নিজেও কাঁদছিলেন। পুরো বাড়ি নিস্তব্দ নিরব! ধ্রুব বিহীন একমুহূর্তেই যেন সবকিছু খাঁ খা করছে।
রাতে যখন রুমে গেলাম কাঁদতে কাঁদতে আমার বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার দশা। ধ্রুবর মাথার বালিশ, পাশবালিশ, জামা জুতো সবই আছে কিন্তু ধ্রুব নেই! সারারাত এপাশ ওপাশ ছটফট করলাম। সকালে ঘুম ভাংলো আন্টির ডাকাডাকিতে। ধ্রুব ফোন করেছে। তিনি আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ধ্রুবর হাসি হাসি গলা শোনা গেলো। বললো,”হ্যালো সৎ বউ? কি খবর তোমার? ফোন বন্ধ কেন? কান্নাকাটি কি এখনো চলছে না অফ হয়েছে?”
আমার চোখ ছলছল! অভিমানী কন্ঠে বললাম,”নিষ্ঠুর!”
ওপাশ থেকে ধ্রুবর হাসির আওয়াজ পেলাম। বললো,”একদিনেই এই হাল! তিনমাস থাকবে কি করে?”
আমি আবারো ডুঁকরে কেঁদে ফেললাম। ধ্রুব বাস্তবিকই খুব নিষ্ঠুর! আমি এত কষ্ট পাচ্ছি আর ও হাসছে! নিষ্ঠুর ছেলে। ফের অভিমানী কন্ঠে বললাম,” তুমি থাকবে কি করে? তোমার কষ্ট হবে না?”
—“আমি? আমার আশেপাশে কত সুন্দরি রমনীরা ঘুরঘুর..”
—“আই লাভ ইউ!”
ওপাশে সব নিরব! কেবল নিশ্বাসের শব্দ! বুঝতে ধ্রুব ফোন কানে রেখে চুপচাপ বসে আছে।আমি চুপ করে রইলাম। একটুপর কিঞ্চিৎ হাসির আওয়াজ শোনা গেলো। হেসে উঠে বললো,”আবার বলো, রেকোর্ড করে রাখবো! আগামীবার বাসায় এলে কাজে লাগবে!”
আমি চুপ করে রইলাম। মনে হচ্ছিলো সারাজীবন ধরে ওর কথা শুনলেও মন ভরবে না। তবুও মনে হবে কেবল শুনেই যাই! আধঘন্টার মত কথা বলার পর ধ্রুব ফোন রাখলো। ফোন রাখার সাথে সাথেই আবার সেই শূনতা!
.
.
.
চলবে