#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ১০
#Rifat_Amin
লেগুনা থেকে নেমে যার যার ব্যাগপত্র গুছিয়ে জাফলং ভিউ রেস্টুরেন্টে আসলো সবাই। অভি হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুপুর দেড়টা বাজে। সবার চেহারার মাঝেই ক্লান্তির ছাপ। রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে জাফলং এ থাকার জন্য জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সবাই। মিষ্টি আর চলতে পারছে না এসব ব্যাগপত্র নিয়ে। এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে টেনে নিয়ে যেতে যেতে একেবারে ক্লান্ত সে। অভির দিকে তাকিয়ে বললো-
– আমার ব্যাগটা একটু ধর না। একদম চলতে পারছি না।
– আমার কাঁধেও তো একটা ব্যাগ। আর কয়টা নেবো? একটু কষ্ট কর।
– পারবো না আমি কষ্ট করতে।
– না পারলে আর কি করার। এভাবেই যেতে হবে।
অভির কথায় সৌমিত্র মিটিমিটি হাসছে। তার সাথে মিথিলা’ও যুক্ত হলো। মিথিলা এক ধরনের চাপা স্বভাবের মানুষ। সহজে সবার সাথে মিশতে পারে না। তবুও এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। সবার সাথে হাসি, আনন্দে থাকার মাঝে অদ্ভুত সুখ প্রাপ্তি হচ্ছে। সৌমিত্র বললো-
– বাচ্চা মেয়েটার ব্যাগটা একটু নে’না দোস্ত। রাতে তোকে খাইয়ে দিলো। আর তুই এটুকু কাজ করতে পারবি না? তুই আসলেই একটা অকৃতজ্ঞ লোক। তার প্রমাণ দিলি।
সৌমিত্রের কথায় ভ্রু কুঁচকালো অভি। মিষ্টির পক্ষ নিয়ে কথা বলার বিশেষ কারণটা খুঁজে পেলো না সে। অভি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো –
– তুই ওর ব্যাগ দেখেছিস? মনে তো হয় না ওটা ব্যাগ, যেনো একটা হাতিকে দেয়া এক বেলার খাবার।
অভির কথায় ফুঁসে উঠলো মিষ্টি। এমনিতেই ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে পারছে না সে। সেখানে এমন কথায় রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার। অভিকে মাথায় তুলে একটা আছাড় মারার পৈশাচিক ইচ্ছা জাগলো তার। শালা রাতে তোকে খাইয়ে দেয়াই আমার ভূল হয়েছে। ওখানে বিরিয়ানির প্যাকেটে বিষ দেয়া উচিত ছিলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো-
– তোকে আমার ব্যাগ নিতে হবে না। টাচ করারও দরকার নাই।
মিথিলা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার কিছু একটা বলতে ইচ্ছা হলো। সাধারণত বেশী কথা বলতে ইচ্ছা করেনা তার। শুধু শুনতে ইচ্ছা করে। তাইতো সৌমিত্রের মতো মানুষ তার লাইফে জায়গা করে নিয়েছে। সে অভির দিকে তাকিয়ে বললো-
‘ নেন না ভাইয়া ব্যাগটা। আপনি তো পুরুষ মানুষ। অতঃপর সৌমিত্রর দিকে তাকিয়ে বললো – তুমি তাকিয়ে কি করো? তুমিও তো নিতে পারো। ‘
সৌমিত্র বললো-
– বাব্বাহ, এতক্ষণে মুখ ফুটলো রাজকন্যার। সব সময় মুড অফ করে থাকো কেমনে বলো তো।
সৌমিত্রর থেকে রাজকন্যা ডাক শুনে ভীষণ লজ্জায় পরে গেলো মিথিলা। লজ্জায় আর কিছু বলতেই পারলো না সে। সেখানেই মিইয়ে গেলো।
মিষ্টির রাগ ক্রমশ বাড়ছে। অভির দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো –
-ঐ তোর গার্লফ্রেন্ড এর বাপের রিসোর্ট কই? ফোন কর তোর গার্লফ্রেন্ডরে।
– আমার গার্লফ্রেন্ড আবার কে বাবা? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো -ওহহ তানিয়ার কথা বলছিস? ও তো আমার জাস্টফ্রেন্ড।
– দেখতে চাই কত রুপসী সেই রমণী। যার রুপের অনলে স্বয়ং অভিরাজ জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় থুক্কু প্রেমে পড়ে গেলো।
– কেনো বলতো? তুই কি জেলাস? অবশ্য হওয়ার’ই কথা। মেয়ে মানুষ মানেই হিংসার জাত।
মাহিন কোক খেতে খেতে সবার কথা শুনছিলো। এবার বললো-
– আসলে’ই অভি ভাই। আমার আর একটা প্রাইভেট মেট আছে যে সবসময় হিংসা করে। আমার ভালো কিছু দেখতে’ই পারে না।
মিষ্টির রাগ আকাশ ছুঁলো। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাই পর্যন্ত অভির পক্ষ নিচ্ছে। এই জন্যেই বলে ‘ আপনের থেকে পর ভালো, আর পরের থেকে জঙ্গল ভালো। ‘ অবশ্য এখানে আশেপাশে ছোটখাটো জঙ্গল আছে। একবার জঙ্গের ভীতরে গিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হবে।
অভির ফোন বেজে উঠায় মিষ্টির পাগলামো ভাবনায় ছেদ ঘটলো। ফোন রিসিভ করে অভি একবার মিষ্টির দিকে তাকালো। মিষ্টির রাগ কমছেই না –
– হ্যালো তানিয়া। কেমন আছো?
ফোনের ওপাশ থেকে কি বললো তা শুনা গেলো না। মিষ্টি আরো একটু কাছে এসে কান খাঁড়া করে শুনার চেষ্টা করলো। না! কিছুই শুনা যাচ্ছে না। অভি বললো-
– আলহামদুলিল্লাহ আমরাও ভালো আছি। তোমাকে যে বলেছিলাম রুম বুক করতে। করেছো?
কিছুক্ষণ পর অভি আবারো বললো-
‘ থ্যাংস তানিয়া। আমরা কাছাকাছি’ই আছি। দেখা হচ্ছে, বায়।
কিছুক্ষনের মধ্যে তারা পৌঁছে গেলো জৈন্তিয়া হিল রিসোর্টে। জাফলংয়ের সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ ভিউ পাওয়ার জন্য জৈন্তিয়া হিল রিসোর্ট অনন্য। চারপাশে গাছপালায় ঘেরা আর তার মাঝখানে একটা ফাঁকা যায়গায় রিসোর্টটা অবস্থিত। রিসোর্টে পৌঁছে তাঁর সামনেই তানিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। পড়নে ওয়েস্টার্ন জামা- কাপর। আধুনিকতার ছোঁয়া আছে অনেকটাই। বড়লোকের ছেলে-মেয়ে গুলা বোধহয় এমনই। তানিয়ার সামনে এসে সবাই দাঁড়ালো। অভি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে তার আগেই তানিয়া, মিষ্টির দিকে দৃষ্টি ছুড়ে বললো-
-তুমি তাহলে মিষ্টি তাইনা?
মিষ্টি খানিকটা অবাক হয়ে গেলো। তাকে তো চেনার কথা না। তবে চিনলো কিভাবে সে। মিষ্টি ভদ্রভাবে জবাব দিলো –
– জ্বী আপু। আমি মিষ্টি। ভালো আছেন আপনি?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমাকে আপনি করে বলছো কেনো? আমরা তো প্রায় সমবয়সী। আর তোমাকে চিনলাম কিভাবে সেটা ভাবছো? একসাথে গেম খেলতে খেলতে অভি তোমার সম্পর্কে এত এত বর্ণণা দিয়েছে যে দেখেই আন্দাজ করেছিলাম তুমিই মিষ্টি। যদিও অভি আমাকে ফটো পাঠায় নি। আচ্ছা থাক সেসব কথা। আমার সাথে ভেতরে চলো আগে। বিকালে গল্প করবো অনেক।
মিষ্টি যেতে যেতে ভাবছে আমার সম্পর্কে এত কিছু জানালো কেন অভি। তানিয়া কি ওর সত্যি সত্যি গার্লফ্রেন্ড? হতে কতক্ষণ। হয়তো এই মেয়ে জানতে চাইছিলো আমার সম্পর্কে আর অভি হয়তো সবটা বলে দিয়েছে।
মোট চারটা রুম বুকিং করা হয়েছে শুধু মাহিনের করা হয়নি। মাহিনের এ নিয়ে অবশ্য মাথা ব্যাথা নেই। সে তার আপুর সাথেই থাকলেই খুশি। যদিও কথায় কথায় ঝগড়া হয়। তবুও আপুকে ছাড়া একটা দিন চলে না তার। রিসোর্টে এসে যে যার রুমে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। বিকালের দিকে আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। ঘুম থেকে যখন উঠলো তখন বিকাল চারটা। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে চারটা মানে’ই দিনের প্রায় শেষ প্রহর। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য রিসোর্ট থেকে সামান্য দূরে একটা টেবিলে সবাই জড়ো হলো। টেবিলে কিছু ফলমূল আর নাস্তার ব্যাবস্থা আছে। টেবিলের চারপাশে গুনে গুনে ছয়টা চেয়ার। সবার আড্ডার মাঝে তানিয়াও যখন উপস্থিত হলো, মাহিন নিজের চেয়ার ছেড়ে অভির পাশের চেয়ারে বসলো। মাহিনের কাছে তানিয়া মেয়েটাকে ভালোলাগছে না। তবুও যেহেতু অভি ভাইয়ের ফ্রেন্ড মানে ভালোই হবে হয়তো। অভি সবার আগে তানিয়াকে বলে উঠলো –
– এখানে আড্ডা দিতে আসছি নাকি নাস্তা করতে এসেছি সেটাই বুঝতে পারছি না তানিয়া। তুমি তো দেখছি অতিথি আপ্যায়নে ভীষণ পটু।
তানিয়া ভীষণ খুশি হলো অভির প্রশংসায়। সে ভেবেছিল সবার আড্ডার মাঝে এসে বোধহয় বিরক্ত করে ফেললাম। তবুও সৌজন্যতার খাতিরে বললো-
– এখানে এসে তোমাদের বিরক্ত করে বসলাম বোধহয়। আমি এমনি’ই দেখতে আসছিলাম তোমাদের। আমি তাহলে যাই।
মাহিনের কাছে এসব একদম ন্যাকামো লাগছে। আরে যাইতে চাস যা না তারাতারি। আবার বলতে হবে নাকি? মিষ্টির কাছে তানিয়াকে বেশ ভালোই লাগছে এখন। এদিকে সৌমিত্র তানিয়ার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। তখন রিসোর্টে এসে রুমে ঢুকে ফ্রেস হবে, এমন সময় মিথিলা ঢুকলো রুমে। সৌমিত্র হালকা হেসে বললো-
– এখানে আসলে যে? মিষ্টি দেখলে খারাপ ভাববে তোমাকে।
মিথিলা নিশ্চুপ ভঙ্গিতে হুরহুর করে সৌমিত্রর একদম সামনে এসে ওর শার্টের কলার ধরে চেপে ধরে বললো –
– খুব সাহস বেড়েছে তাইনা? ঐ মেয়ের দিকে কি তাকাও? হ্যাঁ! এত সুন্দর ঐ মেয়ে৷ আমি কি সুন্দর না? আমার দিকে তো একবারো তাকালে না। আসলেই সব ছেলেরা এমন। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বউ – বাচ্চাকে’ও ভূলে যেতে রাজি।
মিথিলার এমন হঠাৎ আচরণে ভরকে গেলো সৌমিত্র। তখন ভূলে কয়েকবার তাকিয়ে ছিলো তানিয়ার দিকে। এটা যে মিথিলা লক্ষ্য করবে সেটা তো জানা ছিলো না। এখন কিভাবে বুঝানো যায়? সে কি করবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইলো-
। মিথিলা আবার বললো-
– কথা বলো না কেনো? অতঃপর হালকা হেসে বললো ‘ কি’বা বলার আছে তোমার? সত্য কথা বলেছি। জবাব তো এখন পাবোই,না।
সৌমিত্রর আরেকটু জ্বালাতে ইচ্ছা করছে মিথিলাকে। সে খোঁচা মেরে বললো-
– আমার তো বউ-বাচ্চা নাই। থাকলে নাহয় তাকাতাম না।
সৌমিত্রর এমন কথায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মিথিলা। আর যাই হোক। সৌমিত্রর থেকে এটা আশা করে নি সে।
চলবে??