নীল অপরাজিতা পার্টঃ১২

0
604

#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ১২
#Rifat_Amin

সূর্য লালচে বর্ণ ধারণ করে ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে গেলো। অতঃপর অভিরা আড্ডার মঞ্চ সমাপ্ত করে রিসোর্টের দিকে এগিয়ে চললো। আড্ডা দেয়ার পর সবার মন এখন ফুরফুরে। প্রকৃতি কন্যার ছায়াতলে এসে সবাই যেনো প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যে মিশে যেতে চাইলো। এখন মিথিলার রাগের ছিটেফোঁটাও নেই। সেই রাগ থেকে ক্রমশ ধারণ করেছে লজ্জায়। মিথিলা মনে মনে ভেবে নিয়েছে সৌমিত্র আর অভিদের সামনে যাওয়া যাবে না। সৌমিত্র আসলেই একটা খাটাশ। সবার সামনে কোলে তুলে নেয়ার কোনো মানে হয়?
মিষ্টি রিসোর্টে ফিরে এসে সোজা বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়লো। মাহিন বিষয়টা লক্ষ্য করে বিরক্ত হলো। যেভাবে শুয়ে আছে তাতে আমার শোয়ার জায়গাটুকুও নেই। মাহিন ক্লান্তস্বরে বললো-
-সাইড হয়ে শুয়ে পড়ো আপু। আমি এখন গেম খেলবো।
-পারবো না। তুই গিয়ে তোর অভি ভাইয়ের রুমে গেম খেল।
-পারবো না।
-তাহলে দাঁড়িয়ে’ই থাক। শুয়ে থাকতে হবে না। শুয়ে থাকলে মানুষের শরীরে রোগ বাসা বাঁধে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বলেই বেশ আরাম করে শুয়ে পরলো মিষ্টি। কথাটা শুনে মাহিনের রাগে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। শুতে দিবে না তো শুবো কোথায়? আশ্চর্য! অতঃপর রুমের কোনে টি-টেবিলে একজগ পানি দেখতে পেয়ে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো মাহিনের। ভেবেছিলো পুরো জগের পানি তার গায়ে ঢালবে কিন্তু বিছানা নষ্ট হবে ভেবে মাহিন শুধু গ্লাসে পানি ভর্তি করে নিঃশব্দে মিষ্টির মাথার কাছাকাছি গেলো আর আস্তে আস্তে করে পানি ঢালতে লাগলো মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত। হঠাৎ শরীরে ঠান্ডা পানি অনুভব করায় মিষ্টি ছিটকে সরে গেলো বিছানা থেকে। মিষ্টি রাগে কাঁপতে কাঁপতে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহিন নম্রস্বরে বললো-
-শুয়ে থাকলে মানুষের শরীরে রোগ বাসা বাঁধে।ল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
মিষ্টি কথাটা শুনা মাত্রই মাহিনকে ধরার জন্য উদ্যোত হলো। কিন্তু চঞ্চল মাহিন কথাটা বলেই রুম থেকে হাওয়া হয়ে গেলো।

ঘড়িতে রাত ১০ বেজে ৪৫। ডিনার অনেক আগেই হয়ে গেছে সবার। অভি একা ক্লান্ত ভঙ্গিতে রিসোর্টের মাঠে শুয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাসে অভির সারা শরীর কাঁপছে। তবুও উঠে যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। শুয়ে শুয়ে সে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। রিসোর্টের বাইরে রঙ্গিন আলোয় আলোকিত হলেও আশেপাশে খুব কম আলো দেখা যাচ্ছে। দূরে কোথাও কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে যা রাতের এই সৌন্দর্যকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে তুলছে। অভি হঠাৎ করে নূপুরের আওয়াজ শুনলো। নূপর পায়ে কেউ হয়তো এদিকেই আসছে। কিন্তু এই রাতে কে নূপুর পরে হাটবে? নূপুরের এই তীক্ষ্ণ আওয়াজ চারপাশের গোমট ভাবটাকে কেমন ভূতুরে করে তুলছে। অভি শোয়া থেকে উঠে বললো-
-কে ওখানে?
-আমি
অভির কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আস্তে আস্তে অভির নিকটে আসলো মিষ্টি। অভি ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টি ছুড়ে বললো-
-রাতের বেলা নূপুর পরে কোথায় যাস? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম
-কই এতো রাত? মাত্র এগারোটা বাজে।
-এগারোটা কি রাত মনে হয় না?
অভি ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে মিষ্টির পায়েট দিকে ধরে দেখলো দু পায়ে নূপুর। সালোয়ার কামিজ পরে গায়ে একটা শাল জড়িয়ে হাটছে। কিন্তু পায়ে কোনো কেটস্ না দেখতে পেয়ে বললো-
-ঠান্ডা লাগে না পায়ে?
-না
-বাহ! তোরে তো নোবেল দেয়া উচিত। এই ঠান্ডার সময়ে খালি পায়ে হাটছিস অথচ ঠান্ডা লাগছে না। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এ নাম লেখানো দরকার।
-শোন না। বাবা ফোন করে ছিলো। শরীর না’কি একটু খারাপ। এখন তো আমার চলে যেতে ইচ্ছা করছে। এখানে মন বসছে না।
-তো চলে যাবি নাকি? এখনো তো কিছুই ঘুরে দেখলাম না।
-কাল সারাদিনে যা পারবো ঘুরবো। রাতেই চলে যেতে হবে ঢাকা। যদিও বাবা বলেছে তেমন গুরুতর অসুস্থ না। কিন্তু আমি জানি বাবা মিথ্যা বলছে। সহজে তো অসুস্থতার তিনি কথা বলেন না। মাহিন এখনো জানে’ই না যে বাবা অসুস্থ ।
-থাক, ওরে জানানোর দরকার নাই।
-বাবা বলেছে এখান থেকে ফিরলে আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।
বলেই অভির দিকে তাকিয়ে রইলো মিষ্টি। অন্ধকারে মূখটা একদম অস্পষ্ট। তবুও যেনো বুঝতে চেষ্টা করলো অভির মনের অবস্থা। অভি স্বাভাবিক স্বরে বললো-
-ছেলে ঠিক হয়ে গেছে না’কি?
-জানি না। আর কিছুই বলে নাই।
-তো তুই কি বিয়ে করতে চাস না? বয়স তো হয়েছে। বিয়ে তো করাই লাগবে।
– কি জানি। এতোদিন বাবার মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনিনি। কিন্তু আজ হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে বুঝলাম বিষয়টা সিরিয়াস। এখন আমি না করলে যদি বাবার কিছু হয়ে যায়? মা মারা যাবার পর থেকে বাবা আদর-ভালোবাসার কমতি রাখে নি আমার। সব থেকে বড় কথা আমার নিজস্ব কোনো পছন্দ’ই নাই। বিয়েতে অমত দিয়ে লাভ আছে?
অভি মাথা নাড়ালো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন বাজতে লাগলো তার। বাবা ফোন করেছে। তাও আবার এতো রাতে! অভি সালাম দিয়ে বললো-
-কেমন আছো বাবা?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই কেমন আছিস? ওখানে সবাই ভালো আছে?
-হ্যা আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। এতো রাতে ফোন করলে যে। কিছু বলবে?
-হ্যা। তুই ফিরবি কবে? আমার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে। আমার অফিসে তোকে যে জয়েন করতে বলছিলাম সেটা বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নিলি?
-দেখি বাবা কি করা যায়। চিন্তা করিও না। ফিরে এসেই বলবো। আমরা হয়তো পরশু ফিরবো। কাল রাতে এখান থেকে রওনা হতে হবে।
-মিষ্টির বাবা একটু অসুস্থ। তারাতারি ফিরিস। তোর মায়ের সাথে কথা বলবি?
-না থাক। ফিরে এসে কথা বলবো। আম্মুর খেয়াল রেখো।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অভির সাথে সৌমিত্রের দেখা হলো। ব্রাশ হাতে নিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ব্যাস্ত সে। অভি সৌমিত্রের কাছাকাছি এসে সে’ও চারপাশ দেখতে লাগলো। সৌমিত্র একবার অভির দিকে তাকিয়ে আবার চারপাশ দেখতে লাগলো মন দিয়ে। বললো-
-কিছু বলবি?
-আমরা আজ চলে যাচ্ছি দোস্ত।
-মানে!
বিষ্ময়ে কথাটা বললেও দু সেকেন্ড মৌনতা বজায় রেখে বললো-
-ভালোই হবে। মিথিলাকে নিয়ে এখানে মন টিকছে না একদম৷ ভয় লাগছে খুব।
-আরে এতো চিন্তা করিস না। আজকে জাফলং এ গিয়ে একটু ঘুরেই ঢাকা রওনা হবো। মিষ্টির বাবা না’কি একটু অসুস্থ। তাই এই সিদ্ধান্ত। আর ভয় পাওয়ার কি আছে বুঝলাম না।
-আরে গাধা ভয় কি নিজের জন্য পাচ্ছি। মেয়ে মানুষ আছে দুইটা সেটাতো জানিস।
-তো আমরা ছেলে মানুষও তো দুইটা আছি। ওসব বাদ দিয়ে এখন ফ্রেস হয়ে খেতে আয়। একটু পর রওনা হবো।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ করে তানিয়া’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাফলং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো সবাই। জৈন্তিয়া হিল রিসোর্ট থেকে জাফলং পাঁচ কিলোমিটার। সেখানে পৌছে আবার কিছু খেয়ে নিয়ে জাফলং এর স্বচ্ছ পানিতে গোসল করতে প্রস্তুত হলো সবাই। শীতকালে বেশী পানি না থাকায় গোসল করা একটু কঠিন হয়ে যাবে। আর পানিগুলো যেনো বরফের মতো ঠান্ডা। তবুও
সবাই গোসল সেড়ে নিয়ে কাছাকাছি ছোটো একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে বাকি সারাটা দিন জাফলং এর আশে পাশে ঘুরলো আর ছবি তুললো।
সারাটা দিন ঘোরাঘুরি করার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে মামার বাজার বাসস্ট্যান্ডে আসলো তারা। রাত ৮ টার দিকে সেখান থেকে রওনা হলো সিলেটে। ইচ্ছা ছিলো রিশিতার বাবা মা’য়ের সাথে একবার দেখা করে যাওয়ার। কিন্তু এতো তারাহুরোর মাঝে আর দেখা করা হলো না। তাছারা তাদের নাম্বারও নেয়া হয়নি। তাই সেই ইচ্ছা বাদ দিয়ে সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো তারা। মিথিলা আর মিষ্টি পায়ের ব্যাথায় অস্থির হয়ে পরেছে। এই জীবনে এতো হাটাহাটি হয়তো করা হয় নি। টিকেট কেটে বাসে ওঠার পর সবাই বাসের মধ্যেই ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুৃম কারো চোখেই আসছে না। মাহিনের পা প্রচন্ড ব্যাথা করলেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছে। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে তবুও কাউকে কিছু বলছে না সে কারণ তার অভি ভাই একবার তাকে বলছিলো পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। সিটে হেলান দিয়ে অভি গেম খেলতে চেষ্টা করলো। নেট খুব খারাপ আসছে বলে গেম খেলাও অফ করে দিলো সে। মিষ্টি পা’য়ের ব্যাথা চেপে রাখতে না পেরে অভিকে বললো-
-দোস্ত একটু পা টিপে দে না।
অভি বিষ্ময় দৃষ্টিতে মিষ্টির দিকে তাকালো৷ বললো
-তুই আমাকে তোর পা টিপে দিতে বলছিস? আমাকে কি তোর চাকর মনে হয়?
-চাকর কেন হবি দোস্ত। তুই তো আমার একমাত্র দোস্ত। প্রচন্ড ব্যাথা করছে নাহলে তো বলতাম না।
বলেই ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে ফেললো মিষ্টি। অভি একবার মিষ্টির দিকে তাকায় আরেকবার ওর পায়ের দিকে তাকালো। অতঃপর বললো-
-পারবো না আমি। বিয়ের পর তোর বর কে বলিস।
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here