#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ১৪
#Rifat_Amin
বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছেন মাহবুব সাহেব। সুস্থসবল মানুষটা হঠাৎ কেমন রোগা হয়ে গেছেন এ ক’দিনেই। তার পাশের টি-টেবিলে খাবার আর ঔষধপত্রে ভরপুর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে নিয়ম করে ঔষধ খেতে হয়। আর তার পরিচর্চার জন্য আলাদা করে একজন নার্স নিযুক্ত করে দিয়েছেন অভির বাবা। বিছানার আরেক পাশে বসে আছে মিষ্টি আর অভি। দুজনকে একসাথে দেখতে পেয়ে মাহবুব সাহেবের চোখেমুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছে। সকালে সিলেট থেকে এসে একবার দেখা করে গিয়েছিলো অভি। আবার মিষ্টিকে নিয়ে এসেছে গল্প করার জন্য যাতে তার একাকিত্ব একটু দূর হয়। অভি সালাম দিয়ে বললো-
– এখন কেমন আছেন আঙ্কেল?
মাহবুব সাহেব হাসলেন। হাসি দেখে মনে হলো না তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে আছেন। তিনি বিনয়ের সাথে বললেন-
– আলহামদুলিল্লাহ বাবা। শুনলাম শানাজের বিয়ের পর না’কি হঠাৎ তুমি নিজেই মিষ্টিকে নিয়ে সিলেট ঘুরিয়েছো?
অভি এই কথা শুনে আকাশ থেকে পরলো। আমি কখন ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইলাম। মিষ্টি তো নিজেই বায়না করলো সিলেট ঘুরে দেখার। অতঃপর অভি কটমট দৃষ্টিতে একবার মিষ্টির দিকে চাইলো। তাতে মিষ্টির কোনো ভাবাবেগ হলো না । সে একদৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানকার কিছু যেনো তার মাথায় ঢুকছে না। শুধু মাথায় একটা জিনিসেই ঘুরছে, আমার বাবা অসুস্থ। তাকে সুস্থ হতে হবে। অভি বললো-
– না মানে আঙ্কেল। মিষ্টি নিজেই ঘুরতে চাইছিলো। আমিও ভাবলাম, সিলেট যখন এসেই পরেছি আর এখন তো ভার্সিটিতেও তেমন কোনো চাপ নেই। তাই ঘুরে আসা যাক একটু।
অভি কথায় সম্ভিত ফিরে পেলো মিষ্টি। সে বললো-
-না বাবা। অভি নিজেই আমাকে ঘুরতে বলেছে। আমিতো ঘুরতে’ই চাইনি। কিন্তু তখন ও থ্রেট করলো, যদি না যাই তো একা যেনো ঢাকা ফিরে আসি। তুমিই বলো এটা কি সম্ভব?
– দেখেছেন আঙ্কেল, দেখেছেন? মিথ্যা বলার ধরণ দেখেছেন একবার ?
– আমি মিথ্যা বলছি না। তুই বলছিস।
মাহবুব সাহেবের বুঝতে বাকি রইলো না কে মিথ্যা বলছে। বাকিদিনগুলো এই ঝগরা দেখলে তিনি বিরক্ত হলেও আজ মনে হচ্ছে এই ঝগরা অনন্তকাল ধরে চলুক। তিনি চোখ বন্ধ করে হাসলেন। অভি সেই হাসি লক্ষ্য করে সম্ভিত ফিরে পেয়ে লজ্জা পেয়ে গেলো । অসুস্থ মানুষের সামনে যে এভাবে ঝগরা করতে পারে সে আর যাই হোক ভালো ছেলে হতে পারেনা। কথা বলার মাঝখানেই মাহিনের উদয় হলো। মাহিন এসে অভির হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো-
– ফোন ডাইনিংয়ে রেখে এসেছিলে। মামনি কল করেছে। তোমাকে দিতে বললো।
অভি ফোনটা হাতে নিয়ে সালাম দিয়ে বললো-
– হ্যা মা বলো।
– তোকে যে সকালে ফোন করেছিলাম দেখিস নি?
– উফফ সরি আম্মু। আমার আর কি দোষ বলো? এই যে বাড়ির আরেকটা অবুঝ মেয়ে আছেনা। অকারণে আমার সাথে ঝগরা লাগিয়ে মুডের তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো। তাই ফোন ব্যাক করতেই ভুলে গেছি।
মিষ্টি ফোনে তার নামে এমন প্রশংসা শুনে অভির থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো-
– আপনি কি ওর কথা বিশ্বাস করেন আন্টি? কি মিথ্যা কথা বলছে একবার ভেবে দেখেছেন? জীবনে একটাও মিষ্টি কথা বলতে শিখেনি। এইযে দেখুন আমার নামটা যেমন মিষ্টি। কথাগুলোও যেনো মিষ্টির মতো। তাইনা?
অভির মা মিষ্টির কথা শুনে হাসবে না’কি কাঁদবে বুঝতে পারলেন না। বললেন-
– আমি জানিতো মা। ওর কথা বাদ দাও। আমরা ফিরতেছি বাসায়। সকালে তো ফোন করেছিলাম জানাতে। কিন্তু ফোনেই ধরলো না। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে মনে হচ্ছে।
মহুর্তেই মিষ্টির মন ফুরফুরে হয়ে গেলো। রইলোনা তার কোনো অভির প্রতি রাগ আর বাবার অসুস্থতার কথা। মাহবুব সাহেব মিষ্টির পাগলামো দেখে নীরব দর্শকের মতো হাসছেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন কাটলো মিষ্টি। মাহবুব সাহেব মিষ্টির দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন –
– মা তুই আমার অফিসে জয়েন করতে পারবি? এমনিতেই আমি অসুস্থ আর অভির বাবা না থাকায় অফিসে অনেক কাজ জমে আছে।
মিষ্টি মনে মনে খুশি হলো। এটাই বিয়ে থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। সে বললো-
– এক শর্তে রাজি হতে পারি, তুমি যদি আমার বিয়ের ভাবনা মাথা থেকে বের করে দাও।
– তা কি করে হয়? বিয়ে তো একদিন করতেই হবে মা।
বলেই অকারণে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন তিনি। মিষ্টি আড় চোখে একবার তার বাবাকে দেখে নিলো। আশ্চর্য! এখানে হাসার কি আছে!
বিকালে অভি ছাদে বসে বই পড়ছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর আরণ্যক উপন্যাস। এই বইটা উপহার পেয়েছিলো সে তার গত জন্মদিনে। তাও আবার মিস রণচণ্ডী মিষ্টির থেকে। ভাবা যায়? বইয়ের ভীতরে আবার একটা চিঠিও ছিলো। চিঠিটা নীল কাগজে লেখা।
প্রিয় খাটাশ,
গেম বাদ দিয়ে অন্তত একটু বইটই পড়িস। যাতে মাথাটা একটু ভালো থাকে। এই বইটার দাম দু’শো টাকা বুঝলি? রকমারি থেকে অর্ডার করেছি। সুদে আসলে এক হাজার টাকা ফেরত দিবি বলে দিলাম। কিপ্টামি করিস না।
ইতি
মিষ্টির মতো মিষ্টি
শেষ। চিঠি শেষ। এমন সুন্দর চিঠি তো নোবেল পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। চিঠিতে নোবেল দেয়ার সুযোগ থাকলে নিসন্দেহে এটাই নোবেল পেয়ে যেতো। আজ কয়েকমাস পর বইটা ধরে বসলো অভি। বইয়ের শুরুতেই সাধুভাষা দেখে আর পড়া হয়নি। যদিও তেমন উপন্যাসের বই পড়া’ই হয় না। তবে তার আগের জন্ম দিনে মিষ্টি দিয়েছিলো একটা সুন্দর ডায়েরি। দেখেই বোঝা যায় দাম মোটামুটি আছে। তবে তার জন্যও গুনে গুনে পাঁচ হাজার টাকা মানি ব্যাগ উধাও হয়েছে অভির। সেই ডায়েরীটা ড্রয়ারে তুলে রাখা আছে। এত দামি ডায়েরীতে আর যাই হোক কলমের কালির দাগ বসানো যাবে না। অভি ভেবে রেখেছে সে যেদিন বিয়ে করবে তখন বিয়ের ডেট টা এই ডায়েরীতে লিখে রাখবে৷ ইন্টারেস্টিং! ভীষণ ইন্টারেস্টিং! আর বই পড়া হলো না অভির। হঠাৎ ছাদে উদিত হলো সৌমিত্র।
অভিকে বই পড়তে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো সৌমিত্র। যেনো বই পরে খুব হাসির ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে অভি। সবার উচিত হাসতে হাসতে ছাদ থেকে লাফিয়ে পরা। অভি ভ্রু কুটি করে সৌমিত্রর দিকে তাকিয়ে বললো-
– মাথায় কি সমস্যা আছে না’কি?
– বিয়ে খাবো দোস্ত।
– তো খা গিয়ে। আমাকে বলছিস কেন? দাওয়াত দেয়ার হলে দিয়ে যাবি। ভেবে দেখবো যাবো কি যাবে না।
সৌমিত্র হাসি থামিয়ে কঠিন গলায় বললো-
– শালা দাওয়াত আমি নিজেই এখনো পাইনি। দাওয়াত তো তুই দিবি। অবশ্য না দিলেও সমস্যা নাই। কাপ প্রিচের টাকা বেঁচে যাবে। আমি এসে ফাও ফাও খেয়ে যাবো।
– মাথাটা কি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে নাকি এখনো হালকা পাতলা ঠিক আছে?
সৌমিত্র অভির সামনে দোলনায় বসে পরলো। ছ্যাকা খাওয়ার টাইপ করে বললো-
– আমায় ছেড়ে বিয়ে করছিস দোস্ত। এটা কি মানা যায়? ইচ্ছা ছিলো একসাথে বিয়ে করবো। তারপর গো টু মধুমুন।
– আমার বিয়ে হচ্ছে মানে কি? আমার বিয়ে আর আমি’ই জানি না।
– আরে ভাই শোন। আমি বাসায় ঢুকলাম। তোর দাদিও এসেছে দেখেছিস তো?
– হু জানি। আসল কথা বল।
– তোর দাদির সাথে একটু মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলতে’ই হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম এই অসুস্থ শরীর নিয়ে জার্নি করে আসলেন যে এতোদূর? তো কি বলে জানিস?
– জানি না। তোর কাছে শুনতেছি।
– আরে ভাই বলতে দে। বললো এখন তো একটু সুস্থ হয়েছি। বেঁচেই বা থাকবো কতদিন। এবার অন্তত নাতীপুতির মুখ দেখি। তাই অভির বিয়ে দেয়ার জন্য’ই এলাম।
– কি বললি? দাদি এই কথা বলেছে? সর্বনাশ! দাদির কথা মানে বাড়ির সবার এক মত। এবার তো দেখছি মিষ্টির মতো আমাকেও বাড়ি ছারা হতে হবে।
– আরে শালা তুই কই যাবি? তোর বউ এখানে এসে থাকবে।
– আমিতো এসব জানি না বাবু। তোমার কাছে শিখতেছি। এখন যেভাবেই হোক বিয়ে ভাঙ্গার ব্যাবস্থা কর। তাহলে তোর ব্রেকাপ করার ব্যাবস্থা করছি।
সৌমিত্র দোলনা থেকে উঠে ডন্ট কেয়ার ভাব মেরে অভির সামনে থেকে চলে গেলো। যাওয়ার আগে বললো-
– অনেকদিন বিয়ে খাইনা দোস্ত। ঝামেলা করিস না।
অভি উঠে মারতে এগিয়ে আসতে আসতে বললো-
– শালা দশদিন আগে শানাজ আপুর বিয়ে কে খাইলো তাহলে।
চলবে?