#নীল_অপরাজিতা
#পার্টঃ৬
#Rifat_Amin
ভোররাতে রুমের ভীতর অন্য কাউকে অনুভব করলো অভি। কেউ একজন হয়তো লুকিয়ে রুমের ভীতর প্রবেশ করেছে। অভির পাশে শুয়ে আছে মাহিন আর সৌমিত্র। দুজন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। না হবেই বা কেনো। গত রাত দুটোর দিকে ঘুমাতে হয়েছে সবাইকে। বিয়ের শেষ মহুর্তে বিদায়ের বেলায় কান্নাকাটিতে একেবারে হুলস্থুল কান্ড ঘটে গেলো। অভি সেসব ভাবনা বাদ দিয়ে আন্দাজে বিছানার পাশের বেডসুইচ খুঁজতে লাগলো। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ভুলেই গিয়েছিল এটা তার নিজের রুম নয়। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এমনটা হতো ছোটবেলায় যখন নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম। ফজরের আজান দিতেই ঘুম ভাঙতো আর আজানটা ছিলো একদম অপরিচিত। তখন ভয়ে গলা শুকিয়ে যেতো, না জানি কোথায় চলে এলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারতাম নানু বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।
ফোনটা বিছানার সাইড থেকে নিয়ে ফ্লাশ লাইট জালালো অভি। অভি যা ভেবেছিল তাই, রুমের ভীতর মিষ্টি একটা চেয়ার নিয়ে বসে ফোন টিপছে। অভি, মাহিন আর সৌমিত্রকে একটা রুম, মিথিলা আর মিষ্টিকে একটা রুম দেয়া হয়েছে। যেটা একদম পাশাপাশি আর সাইডে একটা দরজা আছে, এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়ার জন্য। হয়তো ভুল বসত দরজা বন্ধ করা হয়নি। বিয়ে বাড়িতে এই এক ঝামেলা, থাকবার ঠিকমতো যায়গায় পাওয়া যায় না। অভিকে উঠতে দেখে মিষ্টিও চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালো। অভি মিষ্টির একদম সম্মুখে এসে ফিসফিস করে বললো —
‘ এখানে আসছিস কেনো ‘
মিষ্টির কোনো হেলদোল লক্ষ্য করা গেলো না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার চেয়ারে বসে পড়লো। টেবিলের উপরে জগ থেকে একগ্লাস পানি ঢালতে ঢালতে বললো —
‘ ঘুম আসছে না একদম। তাই চলে এলাম তোর রুমে। তোরা তো দেখছি ভালোই ঘুমাচ্ছিস। ‘
অভি রুমের আলো জ্বালিয়ে দিতে দিতে বললো —
‘ আস্তে কথা বল। তোর ঘুৃম নাই জন্য যে অন্যদের ঘুম হারাম করবি এটা ঠিক না। ‘
‘ ভাবতেছি কালকেই চলে যাবো এখান থেকে। মন একদম টিকছে না। ‘
‘ চলে আর যাবি কোথায়। ঠিক সিলেটেই তো ঘুরবি। ‘
অভির কথায় হেসে ফেললো মিষ্টি। সাথে সাথে দুই গালে দুইটা গর্তের সৃষ্টি হলো। সেখানেই চক্ষুজোড়া আবদ্ধ হয়ে গেলো অভির। এর আগে যে এমন টোল পরা হাসি দেখতে নি ঠিক তা নয়। তবে মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি নয়তো বিভিন্ন কথায় উড়িয়ে দিয়েছি। মৌনতা কাটিয়ে অভি জিজ্ঞেস করলো —
‘ মামা – মামি কি যেতে দিবে কাল। আমার তো মনে হচ্ছে না। ‘
‘ আরে মামা – মামির কথা বাদ দে তো। ওদের ম্যানেজ করবো আমি। ‘
‘ আচ্ছা এখন একটু ঘুমিয়ে পর। একটু পর’ই ফজরের আজান দেবে। ‘
মিষ্টি এই কথা বোধ করি শুনতেই পেলো না। অভির হাতটা ধরে বললো–
‘ চল ছাদে যাই। বাতাস পাওয়া যাবে সুন্দর ‘
অভি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এই ভোর রাতে ছাদে যাওয়ার মানে কি। না! এখন এই মেয়ের কথা একদম শোনা যাবে না। নাহলে ঠান্ডায় বরফ হতে হবে একেবারে।
‘ যেতে পারবো না। তুই এই রুমে চলে আসছিস এটাই বেশী। বেশী বকবক না করে এখন
ঘুমোতে যা। কাল সকালের দিকে জাফলং যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু তুই যে না ঘুমোতে পেরে অজ্ঞান হয়ে যাবি তাই বিকালের প্লান করলাম। ‘
মহুর্তেই মিষ্টির দুটি চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। মিষ্টি ভেবেছিল অভি হয়তো যেতেই রাজি হবে না। বা একটু নিয়ে গিয়ে সোজা ঢাকা চলে আসবে। কিন্তু বিকালের প্লান যেহেতু, তাই ওখানে যেতেই সারাটা দিন চলে যাবে। তাহলে রাতে থাকা হবে কোথায়? ভেবে উঠতে পারলো না মিষ্টি। অভিকে প্রশ্ন ছুড়বে তার আগেই অভি বললো —
‘থাকার বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমার এক গেমার ফ্রেন্ডের বাবার হোটেল আছে জাফলং এর কাছাকাছি। ও সব মেনেজ করবে বলেছে। ‘
মিষ্টি খুশিতে বাকুমবাকুম হয়ে গেলো। সাথে সাথেই ভ্রুকুঁচকে সন্দেহাতীত ভাবে জিজ্ঞেস করলো —
‘ ছেলে না মেয়ে ফ্রেন্ড তোর?? ‘
‘মেয়ে ফ্রেন্ড। অনেক সুন্দরী বুঝলি। তাছারা বাপের টাকার কোনো অভাব নেই। ভেবেছিলাম রিলেশনে যাবো কিন্তু পরে ভাবলাম না। আরো কয়েকদিন দেখি। ‘
কথা শুনে মিষ্টির রাগে কান দিয়ে পুরো ধোঁয়া বের হচ্ছে। কিছু না বলেই স্বশব্দে চেয়ার সরিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো সে। এই ভোররাতে সিনক্রিয়েট করা যাবে না। মিষ্টির চলে যাওয়ায় অকস্মাৎ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো সৌমিত্রর। সে বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে অভির দিকে দৃষ্টি ছুড়ে বললো –
‘ কি করিস রে ওখানে। ঘুমাতে দে শান্তি মতো। ‘
বলেই কম্বলপর নিচে ঢুকে গেলো সে। অভি হালকা হেসে বললো ‘ ঘাস কাটি ‘।
—————–
অভির নিদ্রা ভাঙ্গলো সকাল ১০ টার দিকে। আশেপাশে মাহিন আর সৌমিত্রকে দেখা গেলো না। সে বিছানা থেকে নেমে জানালা খুলে দেখলো আজ তেমন রোদ উঠেনি। হালকা কুয়াশায় ঢেকে আছে সব গাছপালা, আর সুর্য উঁকি দিচ্ছে কুয়াশার আড়ালে। বাসায় কালকের সেই আমেজ নেই, বরং সবার মধ্যে কেমন একটা দুঃখী দুঃখী ভাব। তেমন আত্মীয়-স্বজনদেরও চোখে পড়লো না অভির৷ গত রাতেই কি তারা চলে গেছে? যেতেও পারে। শানাজ আপু তো বলেছিল তাদের বেশীরভাগ আত্মীয়রা খুব কাছাকাছি থাকে। এদিকে ভোররাতে ঘুমোবার পরেও
জাফলং যাবার উত্তেজনায় সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে মিষ্টির। তবুও মনে বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে। অভি কোন মেয়ের কথা বলছে সেটা জানতেই হবে। তলে তলে যে অভি প্রেম করে না তাঁর প্রমাণ কী? হঠাত মনে হলো অভি প্রেম করুক তা আমার কী। আমি কেনো তাঁর সব কিছুতে বাধা হয়ে দাঁড়াবো। শত ভাবচিন্তার মাঝে নিজেই নিজেকে উত্তর দিলো ‘ আমি প্রেম করছি না, মানে অভিরও প্রেম নিষিদ্ধ। প্রেম করলেও ভিলেন হয়ে দাঁড়াবো আমি। ‘ হঠাত মনে হলো মাহিনকে দিয়ে অভির ফোনটা নেয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। মিষ্টি ছাদের হালকা রোদে বসেছিল। মাহিনকে বাহিরে খেলতে দেখে ছাদে ডেকে পাঠালো। প্রথমে মাহিন না আসতে চাইলেও বিরক্তিতে ঠিক চলে আসলো উপরে। ছাদে আসতেই মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো –
‘ তোর অভি ভাই কইরে?? ‘
‘ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। কেনো কি সমস্যা? ‘
‘ তোর ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলবি ‘তোমার ফোনটা খুলে দাওতো। একটু গেমের কাজে লাগবে ‘। পারবিনা?? ‘
মাহিনের দুচোখের পাতা ছোট ছোট করে বললো
‘ আমি কেনো করবো এই কাজ?? ‘
‘ এমনিই করবি। যা তোরে অনেকগুলা ডায়মন্ড তুলে দেবো গেমে। ‘
এই কথা শুনে মাহিন এমন ভাব করলো যেনো সে এসবে ইন্টারেস্টেড নয়। বললো–
‘ আমার ডায়মন্ডের জন্য তোমাকে বলতে হবে?? অভি ভাইকে বললেই হাজার হাজার তুলে দেবে। যাই হোক আনতে যাছি ফোনটা। ‘
বলেই স্বশব্দে নিচে নামলো মাহিন। মিনিট দু’য়েক এর মাথায় উপরে এসে ফোনটা দিলো মিষ্টিকে। দিয়ে বললো —
‘ আজকে পাঁচশো টাকা দিয়ো তো। লাগবে আমার। ‘
মিষ্টি হতভম্ব হয়ে গেলো মাহিনের কথায়। বললো
‘ এত টাকা দিয়ে কি করবি? বাচ্চা মানুষের এত টাকা লাগে না। ‘
‘ সে দেখা যাবে। নাহলে অভি ভাইকে বলে দেবো। ‘
বলেই কোন ঝোঁকে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলো মাহিন। মিষ্টি ফোনটা নিয়ে দেখলো খোলা’ই আছে ফোন। প্রথমেই মেসেজ লিষ্ট চেক করলো সে। কিন্তু সেখানে তেমন কোনো মেসেজ চোখে পড়লো না। শুধু কয়েকটা কম্পানির কিসব আলতু ফালতু মেসেজ। সব হয়তো ইউটিউব অথবা ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্যই করেছে। মেসেন্জারে কিছু বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের লোকজন ছাড়া কেউ নাই। তাহলে কি সব গেমের ভীতর আছে?? মাহিন একদিন বলেছিল গেমের ভীতরও বাকি কথা বলা যায় আর মেসেজও করা যায়। কি একটা ঝামেলায় পড়া গেলো। আমিতো গেম খেলতে পারিনা। তখন অভি আর সৌমিত্র ছাদে চলে আসলো। অভিকে দেখেই ফোন লুকিয়ে ফেললো মিষ্টি। অভি সেটা লক্ষ্য করে বললো —
‘ আর লুকোতে হবে না। মাহিন আমাকে বলেছে তুই ফোন চাইছিলি। ‘
অভির কথা শুনে মনে মনে মাহিনের চৌদ্দ গুস্টি উদ্ধার করলো মিষ্টি। বেটা ফাজিলের ফাজিল। আরো পাঁচশো টাকা চাস। দেবো এখন ভালো করে। আগে দেখা পাই একবার তোর। মিষ্টি স্বভয়ে একবার অভির দিকে তাকালো। বললো —
‘ এমনিই নিয়েছিলাম আরকি। ‘
বিনিময়ে আর কিছু বললো না অভি। ক্ষণকাল মৌনতা বিরাজ করে শেষে সৌমিত্র বললো –
‘ আমার মনে হয় জাফলং যাওয়া হবে না দোস্ত। মিথিলাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। একলা একটা মেয়েকে এতদূর আনা একদম ঠিক হয়নি। ‘
সৌমিত্রর কথায় খানিকটা চিন্তিত হয়ে গেলো অভি আর মিষ্টি। অভি বললো –
‘ তুই চিন্তা করিস না। মিথিলার সেফটির জন্যতো শুধু তুই আছিস না। আমিও আছি। ‘ বলেই মিথিলার দিকে দৃষ্টি রেখে বললো – ‘তুই মিথিলার মা’কে ফোন কর। বল আসতে একটু লেট হবে আমাদের। তোকে চিনে তো ভালো করে তাইনা?? ‘
অভির কথায় চিন্তামুক্ত হতে পারলো না সৌমিত্র। বললো–
‘ না দোস্ত। আমরা চলে যাই। তোরা জাফলং এ ঘোরাঘুরি কর। আর সমস্যা নাই বিয়েটা সেরে ফেলেই মিথিলাকে আবার নিয়ে আসবো তোদের সাথে ঘুরতে। ‘
অভি বললো-
‘ আরে ভাই বিয়ে বাড়িতে থাকতে পারলি। ওখানে একটা দিন থাকতে পারবি না! তুই কোথাও যাচ্ছিস না। গোয়াইনঘাটে আমাদের জন্য হোটেলে দুইটা রুম বুক করা হইছে। চটপট রেডি হয়ে নে। বিকালে যাচ্ছি আমরা ‘
চলবে??