# নীল চিরকুট পাঠ-১০

# নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১০.

দুপুরের খাবার শেষ করে নম্রতাদের ঘরেই আড্ডা বসিয়েছে বন্ধুরা। বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি। পরিষ্কার কাঁচের জানালায় জমে আছে ফোঁটা ফোঁটা জল। উত্তাল সমুদ্রের গর্জন আর বৃষ্টির শব্দ মিলেমিশে তৈরি হয়েছে নতুন এক সুর। সেই সুরে মাতোয়ারা হয়েই প্রলংয়কারী নৃত্যে মত্ত হয়েছে ঝাউগাছের সারি আর নারিকেল গাছের বহর। কাল শেষ রাতের দিকেও তিন নম্বর বিপদ সংকেত ছিল সৈকতে। সকালের দিকেও আবহাওয়া ছিল চলনসই। কিন্তু দুপুর দিকে হঠাৎই কোথা থেকে উড়ে এলো এক আকাশ কালো মেঘ। শুরু হলো ভয়ানক বর্ষণ। সমুদ্র সৈকতে জারি করা হলো সাত নম্বর বিপদ সংকেত। দুপুরের পর পরই বাসের টিকেট কাটা হয়েছিল নম্রতাদের। পরশু থিওরি পরীক্ষা।রাতের মাঝে ঢাকায় ফেরা যখন চাই-ই চাই ঠিক তখনই শুরু হলো বৃষ্টিকন্যার ইচ্ছেবিলাস। বৃষ্টিকন্যার এহেন ন্যাকামোতে টিকেটগুলোর সাথে সাথে ধরা বাঁধা সময়টাও ভেস্তে গেল। নম্রতা, নীরা কফি হাতে বিছানার হেড বোর্ডে ঠেস দিয়ে বসে আছে। নাদিম বিছানার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। একটু পর পর হাতে থাকা গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলছে। ডানপাশের ধবধবে সাদা সোফায় বসে আছে রঞ্জন। এক হাতে কফি কাপ, অন্যহাতে ফোন। অন্তু কার্পেটের ওপর পা গুটিয়ে বসেছে। কোলের ওপর ল্যাপটপ। কোলের পাশেই ধোঁয়া উঠা কফি কাপ। ছোঁয়া বসে আছে বিছানার এক কোণায়। চশমাটা নাকের ডগায় এসে ঠেকেছে। গায়ে ভারী কম্বল জড়ানো। ছোঁয়া কফি কাপটি পাশের টেবিলে রেখে ঠোঁট উলটালো। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ আচ্ছা? ওই লোকটা নমুর ওই পত্র প্রেমিক হতে পারে না? আই মিন, কো-ইন্সিডেন্সলি। পৃথিবীতে কতশত কাকতালীয় ব্যাপার ঘটছে। এটা কী তাদের মধ্যে একটা হতে পারে না?’

ছোঁয়ার বোকা কন্ঠে বলা কথায় পাঁচজোড়া চোখ তার উপর এসে নিবদ্ধ হলো। প্রতি জোড়া চোখ পলকহীন তাকিয়ে আছে তার চেহারায়। ছোঁয়া অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,

‘ সরি! আসলে নমু সেদিন বলছিল, লোকটির নামের প্রথম অক্ষর ‘এন’ হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। আবার তোরা যে লোকটির কথা বলছিস, কী যেন নাম? নিরব-নিষাদ হোয়াটএভার সেই নামটাও ‘এন’ দিয়েই শুরু। তিনি ভার্সিটির লেকচারার। দেট’স মিন ব্রাইট স্টুডেন্ট। নমুর ভাষ্যমতে নমুর পত্রপ্রেমিকও ব্রাইড স্টুডেন্ট ছিল। বর্ণণাটা মিলে যায়। ওই হিসেবে, ভুল করেই বলে ফেলেছি কথাটা। আই থিংক, আই ওয়াজ রং। সরি!’

কেউ কোনো জবাব দিল না। আগের মতোই তাকিয়ে রইল চুপচাপ। তারপর হঠাৎ-ই সটান উঠে বসলো নাদিম। অতিরিক্ত উত্তেজনায় ছোঁয়াকে একটা শক্ত ধাক্কা দিয়ে সবার চোখে চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘ হোয়াট আ থিংকিং! এভাবে তো ভাইবা দেখি নাই।’

ছোঁয়া উলটে পড়তে পড়তে সামলে নিল। নাদিমের দিকে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানা থেকে সরে সোফায় গিয়ে বসল। রঞ্জন নম্রতার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভ্রু নাচাল। কৌতুক মাখা কন্ঠে বলল,

‘ কি রে? হতে পারে নাকি এমন কো-ইন্সিডেন্স? কাল তো কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিল। ফিল টিল পাসনি কিছু?’

নম্রতা বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘এটা কি কোনো সিনেমা নাকি যে পাশে দাঁড়ালেই লায়লীর মতো ফিল টিল চলে আসবে? আমি তাকে কখনই দেখিনি। পাশে দাঁড়ায়নি। কাছে যাইনি। তার বাহ্যিক কিছুই জানা নেই আমার। জানার মধ্যে জানি শুধু মন। তার মন পড়া ব্যতীত অন্যকিছু জানার সুযোগই হয়ে উঠেনি কখনও।’

নাদিম মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ ছাতার মাথা প্রেমে করো তোমরা। এই যুগে এসে এমন রঙিলা প্রেম কাহিনি দ্বিতীয়টি দেখার সুভাগ্য কারো হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’

নম্রতা প্রত্যিত্তুরে কিছু বলল না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরের দিকটায়। সাদা সাদা বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে এসেছে প্রকৃতি। সমুদ্রের উচ্ছ্বাসটা হয়ে উঠেছে লাগামহীন পাগলা ঘোড়া। অন্তু ল্যাপটপটা পাশে রেখে হাত-পা ছড়িয়ে বসল। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ নিষাদ নামক লোকটিই যদি নম্রতার প্রেমিক হয়ে থাকে তাহলে ব্যাটা চূড়ান্ত ধুরন্ধর। সে নিশ্চয় লুকিয়ে চুরিয়ে নমুকে দেখেছে। হয়তো ফলোও করেছে।’

নীরা কপাল কুঁচকে বলল,

‘লোকটা যদি নমুকে দেখেই থাকে তাহলে এই তিন-চারবছরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না কেন? স্ট্রেঞ্জ!’

নাদিম আবারও বিছানায় হাত-পা মেলে শুয়ে পড়ল। গিটারে একটা বিরহী টুন বাজিয়ে নিয়ে বলল,

‘ সবচেয়ে বড় কথা এই দুইটা আবালের ব্রেকআপ কেমনে হইল? ওই বলদ? তোগো ব্রেকআপ কেমনে হইলো রে?’

‘ ব্রেকআপ হয়নি।’

নাদিম সরু চোখে তাকাল। আরেক দফা ওঠে বসে বিস্মিত কন্ঠে বলল,

‘ হয়নি?’

নম্রতা সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দুই দিকে মাথা নেড়ে জানাল, ‘না, হয়নি।’ নাদিম মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবারও বিছানায় গা এলালো। চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল,

‘ একেই বলে পিরিত!’

ছোঁয়া অত্যন্ত ঘৃণাভরা চাহনি দিয়ে বলল,

‘ ভাষার কি ছিঁড়ি! ছিঃ!’

অন্তু অধৈর্য্য কন্ঠে বলল,

‘ তাহলে তোদের সম্পর্কের সমাপ্তিটা কোথায়?’

‘ সমাপ্তি!’

শব্দটা উচ্চারণ করেই উদাস ভঙ্গিতে বসে রইল নম্রতা। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,

‘ সমাপ্তি তো হয়নি কখনও। এভাবে কী সমাপ্তি হয়? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলছিল তখন। এদিকে দেখা করার জন্য মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল ‘সে’। সেইসাথে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলাম আমিও। আমাদের দেখা হবে, কথা হবে, সম্পর্কটা নতুন এক রূপ পাবে এসব আলোচনায় চলছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। দু’জনই দু’জনের জন্য বিরাট এক সারপ্রাইজ হিসেবে অপেক্ষা করছিলাম। সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলে দেখা করার দিন-তারিখ ঠিক করব আমরা। রবীন্দ্র সরোবরেই দেখা হবে আমাদের। আমার পরনে থাকবে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর ওর গায়ে নীল পাঞ্জাবি। হাতে থাকবে বেলীফুলের মালা। সেই মালা নিজ হাতে বানাবে সে। নিজ হাতেই পরিয়ে দেবে আমার খোঁপায়। খুশিতে আত্মহারা আমরা অপেক্ষার প্রহর গুণছিলাম। কবে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হবে? কবে? এক সময় ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলো। আমি তাকে চিঠি দিলাম কিন্তু চিঠির জবাব এলো না। একদিন, দু’দিন করে সপ্তাহ পেরুলো। মাস পেরুলো। আজ তিনটা বছর পেরিয়ে গেল, চিঠির জবাব এলো না।’

এটুকু বলে থেমে গেল নম্রতা। ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল ছয়টি মানুষের দীর্ঘশ্বাস। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর প্রশ্ন করল রঞ্জন,

‘ আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। তোদের চিঠি দেওয়া-নেওয়াটা এতো সময় চলল কী করে? লাইব্রেরিতে অনেক মানুষ যায়। অন্যকারো হাতে কেন পড়ল না চিঠিটা? তাছাড়া, বই পরিষ্কার করতে গিয়েও কি বইয়ের জায়গা পরিবর্তন হতো না? সেইসব চিঠি কারো চোখে পড়ত না? ব্যাপারটা কেমন সিনেম্যাটিক!’

নম্রতা ম্লান হাসল। সোজা হয়ে বসে, বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘ তুই বোধহয় গ্রন্থগারের বর্তমান অবস্থা জানিস না রঞ্জন। গ্রন্থগারের বই এখন হাতেগুনা কয়েকজন ছাড়া কেউ পড়ে না বললেই চলে। সবাই গ্রন্থগারে বসে নিজেদের নোট বুক, গাইড বুক মুখস্থ করে চাকরী বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত। পড়াশোনার জন্য গ্রন্থগারের পরিবেশ অতিরিক্ত ভালো বলেই গ্রন্থগারে এতো ভীর। সাহিত্যচর্চার জন্য নয়। তারওপর দর্শনের ওই পেটমোটা বই? কে পড়বে? আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলেই হয়তো চিঠিটা তার হাতে পৌঁছেছিল। নয়তো চিঠি বাবাজি সেখানেই ইতিহাস হয়ে রয়ে যেত। তাছাড়া, গ্রন্থগারে প্রত্যেক ক্যাটাগরির আলাদা আলাদা সেল্ফ থাকে। আমাদের চিরপরিচিত বইটা মাঝে মাঝে স্থান পরিবর্তন করলেও ঘুরেফিরে ওই একই সেল্ফের মাঝেই ঘোরাফেরা করত। খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হতো না।’

রঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ বাপরে!’

ছোঁয়া হঠাৎই আর্তনাদ করে উঠে বলল,

‘ পরশু যে আমাদের সিটি আছে, মনে আছে তোদের? এই বৃষ্টিতে ফিরব কিভাবে আমরা? প্রিপারেশনও নেই একদম।’

নাদিম দায়সারা কন্ঠে বলল,

‘ সিটির কথা আপাতত ভুলে যা। আজ আবহাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। আর কাল বিকেলের আগে আমরা বাসে উঠছি বলেও মনে হচ্ছে না।’

ছোঁয়া চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ মানে! কিন্তু কেন?’

রঞ্জন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

‘ ওই ব্যাটা কোন হোটেলে উঠেছে জানি না। আশেপাশের কোনো হোটেলে উঠার সম্ভাবনাই বেশি। কাল সারাদিন হোটেলে হোটেলে ঘুরে ব্যাটাকে খুঁজে বের করব। রহস্যাদ্ধার করব। তারপর বিকেলের গাড়ি ধরে ঢাকা।’

পড়াশোনায় অতিরিক্ত সিরিয়াস ছোঁয়া বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। নাদিম গিটারে রোমান্টিক টুন বাজিয়ে বেসুরে কন্ঠে তাল মেলাল। ছোঁয়ার রাগ তখন সপ্তম আকাশে। নাদিমকে জাস্ট সহ্য হচ্ছে না তার। এমন বেয়ারা ছেলে সে দ্বিতীয়টি দেখেনি। রঞ্জন ফোন হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘ এই ভেজা ভেজা আবহাওয়ায় আমার রেজিস্ট্রি ছাড়া বউটাকে ভীষণ মনে পড়ছে। আমি প্রেম করতে যাচ্ছি। খবরদার ডিস্টার্ব করবি না।’

রঞ্জনের পিছু পিছু গিটার হাতে উঠে গেল নাদিমও। ছোঁয়া হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ ইয়া মাবুদ! সিটির কী হবে তাহলে?’

অন্তু এক গাল হেসে বলল,

‘ এতো বেশি পকপক করিস কেন বল তো? সিটি নিয়ে টেনশন নিস না। স্যারকে ম্যানেজ করে নেব কোনোভাবে। পানিশমেন্ট হিসেবে এক্সট্রা এসাইনমেন্ট করতে দিতে পারে। তাতেই বা কী? লাইব্রেরি তো আছেই। সবাই মিলে কমপ্লিট করে ফটোকপি করে নেব। কাহিনী খতম।’

অন্তু যত তাড়াতাড়ি খতম করে ফেলল তত তাড়াতাড়ি খতম হলো না ব্যাপারটা। ছোঁয়ার গলায় মাছের কাঁটার মতো আটকে রইল। কিছুক্ষণ পর পর পরীক্ষার চিন্তায় ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে পড়তে লাগল। সবচেয়ে বড় কথা বাবা-মাকে কী অজুহাত দেবে সে? ছোঁয়ার মাথা ঘুরছে। এই লম্পট বন্ধুবান্ধবের চক্করে তার ছোট্ট বোকা বোকা মাথাটা প্রায়ই ঘোরাঘুরি করে। কখনও কখনও ভয়ে জ্ঞানও হারায়। তবুও বন্ধুদের ছাড়া যায় না। আর না তাদের থেকে গড়পরতার পাত্তাটুকু পাওয়া যায়। নম্রতা সেই কখন থেকেই নিশ্চুপ বসে আছে। শরীরটা মৃদু কাঁপছেও। গা জুড়ে জ্বর জ্বর বোধ হচ্ছে। সত্যিই কি ওই লোকটাই সে? আর যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে তাকে কী করে চিনে? আর যদি চিনেও থাকে তাহলে এত লুকোচুরি কিসের? এমন অপরিচিতের মতো ব্যবহারই বা কেন? আর কেন-ই বা এই হারিয়ে যাওয়ার খেলা? কষ্ট হয় না তার? নম্রতা আর ভাবতে পারে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সারা শরীর ঝিমঝিম করে আসে। আচ্ছা? সে কি মারা যাচ্ছে? ভয়ানক কালমৃত্যু কি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে তাকে? না, তার তো মরে গেলে চলবে না। ওই মানুষটির মুখ থেকে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর না শুনে মরণের কথাটাও যে ভাবা যায় না। কিছুতেই না।

পরের দিন সকালের খাবার শেষ করেই নিষাদকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল সবাই। আকাশে তখন উজ্জ্বল সূর্য। আগের দিনের বৃষ্টির দাপটে চারপাশটা ঝকঝক করছে। আকাশও পরিষ্কার। গাছের পাতাগুলোও হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ, সুন্দর। দশটা নাগাদ বেরিয়ে দু-তিনটা হোটেলে চক্কর কেটে দুপুর দুটোর দিকে নিষাদের সন্ধান পেল তারা। রিসেপশনিস্টকে জিগ্যেস করতেই বিনীত কন্ঠে উত্তর দিল, ‘ নিষাদ আহমেদ নীরব নামের লোকটি আজ সকালেই চেইক আউট করেছেন।’ কথাটা শুনেই মাথায় বাজ পড়ল তাদের। যোগাযোগের জন্য নাম্বার চাইতেই উত্তর এলো, ‘ সরি, কারো নাম্বার দেওয়াটা হোটেলের নিয়ম বহির্ভূত।’ রিসেপশনিস্ট মেয়েকে ইনিয়েবিনিয়ে উচ্চ মাপের প্রসংশা করেও নাম্বার পাওয়া গেল না। নাদিম রাগ নিয়ে বিরবির করে বলল,

‘ বালের রুলস। থাকুনের হোটেলে এতো কিসের রুলস! ন্যাকামোর একশ্যাষ। এই নর্তকী গো দিন-রাইতে চড়ানো উচিত। বেদ্দপ।’

ব্যর্থ প্রতিপন্ন নম্রতারা আশেপাশের হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে চারটার দিকে গাড়িতে উঠল। ঢাকায় ফিরতে ফিরতে হলো গভীর রাত। নীরা-নম্রতা পড়ল বিপাকে। এতোরাতে হলে ঢুকতে দেবে না। রঞ্জন-নাদিমের জন্য সমস্যা না হলেও নীরা-নম্রতা থাকবে কোথায়? এদিকে ছোঁয়ার অবস্থাও বেকাহিল। বাবা-মা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে তার। মেয়ে যে বাজে বন্ধুদের সাথে মিশে রসাতলে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করতে পেরে উভয়ই চিন্তিত এবং ক্ষুব্ধ। সেই ক্ষুব্ধ বাবা-মায়ের সামনে দিয়ে এতো রাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘরে উঠা আর ছাঁদ থেকে লাফ দেওয়া দুটোই সমান। বাকি রইল অন্তু। এতোরাতে তিনজন মেয়ে বন্ধু নিয়ে বাসায় উঠলে তার মা যে পিঠে কয়টা ঝাঁড়ু ভাঙবে তারও কোনো ইয়াত্তা নেই। এখন যাবে তো যাবে কোথায়? টেনশনে ছয় জনেরই মাথায় হাত। এতোরাতে ছয়জন তরুন-তরুনী মিলে রাস্তায় বসে থাকাও যায় না, পুলিশের ভয়। অবশেষে, সমস্যার সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হলো পূজা। পরিস্থিতি সামলানোর অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে এই মেয়ে। নম্রতাদের পরিস্থিটাও চট করেই সামলে নিল। বাসায় কিছু একটা বুঝিয়ে রঞ্জনের তিন বান্ধবীকে রাত কাটানোর জায়গা করে দিল তার নিজস্ব শোবার ঘরে। রাত বলতে তখন এক-দুই ঘন্টা বাকি। ফ্রেশ হয়ে ঘুমুতে যেতে যেতে পূর্ব আকাশে লাল রঙ ফুটে উঠেছে। সারাদিনের ক্লান্তি বিছানায় যেতেই ডানা মেলল। চোখে ভর করল রাজ্যের ঘুম। সেই ঘুম যখন ছুটল তখন বেলা হয়েছে প্রচুর। ঘড়িতে নয়টা কি দশটা বাজে। তাদের উঠে বসতে দেখেই অস্থির ভঙ্গিতে বলে উঠল পূজা,

‘ তোমরা উঠেছ? ঠাকুর রক্ষা করল তবে। রঞ্জন ফোন দিতে দিতে অস্থির করে ফেলছে। তোমাদের নাকি সাড়ে দশটায় সিটি আছে?’

ক্লাস টেস্টের কথা শুনতেই স্প্রিং এর মতো উঠে দাঁড়াল নম্রতা আর ছোঁয়া। নীরাকে লাথি-গুঁতো দিয়ে তুলে তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হলো। পূজা তাদের খাবারটা শোবার ঘরের টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

‘ রঞ্জন আর নাদিম নিচে সিএনজি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তোমরা খাবে কখন? দশটা পনেরো বাজে।’

নম্রতাদের খাওয়া-দাওয়া আর হলো না। খাবার ফেলে রেখেই দৌঁড়ে নিচে নামল তারা। ওদের দেখেই গালির বহর ছুটল নাদিমের মুখে। কোন আলালের ঘরে দুলাল হয়েছে যে দশটা পর্যন্ত ঘুমোনো লাগে? এই সব মেয়েকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দেওয়া উচিত। এদের যন্ত্রণায় এদের জামাইরা বাসর রাতেই হার্ট অ্যাটাক করবে। যুব সমাজ ধ্বংস হবে। এরা সর্বনাশা, ঝঞ্জাটময় মেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি শুনেই চল্লিশ মিনিটের রাস্তা এক ঘন্টায় অতিক্রম করল তারা। অফিস টাইম। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। সিএনজি ছেড়ে নিজেদের ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতেই এক ঘন্টার পরীক্ষার পয়তাল্লিশ মিনিট শেষ। অন্তুকে ডিপার্টমেন্টের সামনে মাঠে বসে ঘাস চিবোতে দেখা গেল। ক্লান্ত বন্ধুদের ছুটে আসতে দেখেই চমৎকার হাসি উপহার দিল সে। মুখের সামনে আঙ্গুল মেলে দিয়ে বলল,

‘ আট নাম্বার পানিশমেন্টের জন্য তৈরি হও মামা। স্যারের কাছে টাইম চাইবা আর পানিশমেন্ট খাইবা।’

রঞ্জন ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ শালা! তুই পরীক্ষা না দিয়ে এখানে বসে আছিস কেন?’

অন্তু হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। এক গাল হেসে বলল,

‘ একা পরীক্ষা দিয়ে মজা আছে নাকি মামা? পরীক্ষা, পানিশমেন্ট সব বন্ধুদের নিয়ে করতে হয়। পরীক্ষা তো হলোই না। তার থেকে বরং পানিশমেন্টটাই খাওয়া যাক। এই চশমারে দিয়া এসাইনমেন্ট করাব সব।’

সবার মুখেই হাসি ফুটে উঠল। পরীক্ষার চিন্তা মুহূর্তেই মাথা থেকে উবে গেল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগে ক্লাস রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। অত্যন্ত ইনোসেন্ট মুখে একশো একটা বাহানাও শুনাল। শক্ত স্যার গললেন না। ছয়জনকে আলাদা পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে এই তিনবছরের আট নাম্বার পানিশমেন্টটা দিয়েই দিলেন। টপিক ‘ম্যান্টাল সিকনেস’। হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রতিদিন গড়ে কতজন মানসিক অসুস্থতায় শিকার রোগীর সাথে ডিল করেন তার এক সাধারণ জরিপ। নম্রতাদের কাজ হলো দু’জন দু’জন করে গ্রুপ তৈরি করে মোট ছয়জন ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং এই বিষয়ে তাদের মতামত জেনে এসাইনমেন্ট তৈরি করা। স্যার ভীষণ উৎসাহ নিয়ে তাদের ছয় জনকে তিনটি দলে ভাগ করে দিলেন। কে, কোন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করবে তার নাম, ঠিকানাও ধরিয়ে দিলেন হাতে। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসেই ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠল ছোঁয়া,

‘ এটা কিন্তু স্যারের কাজ ছিল। স্যার সবসময় আমাদের ব্ল্যাকমেইল করে নিজের কাজ আদায় করে নেয়।’

নাদিম এই প্রথম ছোঁয়ার কথার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করল। বিরসমুখে বলল,

‘ এই ফাউলডা অতিশীঘ্রই টাক হবে দেখিস। শালার আবার সুন্দরী একটা বউ আছে। আমি বুঝি না এই খাইচ্চরডারে কি দেইখ্যা বিয়া করল এই সুন্দরী? তার থেকে আমাকে বিয়া করলেও পারত। আমি না করতাম না। ব্যাটারে বদদোয়া, বউ ভাগবো হালার।’

নাদিমের কথাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উচ্ছল কন্ঠে বলে উঠল অন্তু,

‘ নমু? দোস্ত? তোর তো ফাটবে রে।’

নম্রতা কপাল কুঁচকে বলল,

‘ মানে?’

‘ তোকে দেওয়া নাম দুটির মধ্যে একটা ডক্টর আরফান আলমের নাম।’

নম্রতা-নীরা বিষয়টা ধরতে না পেরে বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ তো?’

নাদিম হু হা করে হেসে উঠে বলল,

‘ চিনতাছো না মামা? এটা কোনো সাধারণ আরফান না বইন। এইটা লঞ্চের ধাক্কা আরফান।’

নাদিমের কথায় বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল নম্রতার। নীরার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই আক্রোশ নিয়ে বলল,

‘ তুই একা যা। আমি যাবো না।’

নীরা অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। বন্ধুদের ঠোঁটে তখন চাপা হাসির রেখা।

#চলবে….

( রি-চেইক করা হয় নি। বাক্যের গঠন ও বানানের ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আজকের পর্ব ২২৫০ শব্দে লিখা হয়েছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here