পর্ব_০৮ #অসমাপ্ত_প্রনয় #মিঃনাহিদ_হাসান

0
65

#পর্ব_০৮
#অসমাপ্ত_প্রনয়
#মিঃনাহিদ_হাসান

নির্জন প্রহরে বায়জিদ বলতে শুরু করলো,তার জীবনের গল্প…

জীবনে কখনো কাউকে ভালোবাসি নাই,বাবা মা পছন্দ করে ঈশাকে বউ করে আনছিলো,ঈশাকে পেয়ে বুঝেছিলাম ভালোবাসার মানে_ ভালোবাসা কারে কয়,ওই আমার জীবনের সব কিছু হয়ে গেলো,ওরে আদর কইরা পাগলি ডাকতাম,যেই দিন শুনলাম আমার পাগলিটা মা হইবো, আমি বাবা হমু, ওইদিন আমার খুশি কে দেখে, খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছিলো।

কয়েক মাস পর…

যেদিন বউটার ডেলিভারি পেইন শুরু হইছে,আমি ওরে বুকে জড়িয়ে ধরে আছি। খুব ছটফট করছিল আর কান্না করতাছিলো আমার পাগলীটা।

আমি আমার পাগলীটার কষ্ট একদমই সহ্য করতে পারি না। ওর সামান্য খারাপ লাগা টুকু আমার কাছে মৃত্যুের চেয়ে ভয়াবহ। এককথায় নিজের জান নিজের দেহে আছে তা কখনোই মনে করিনা।

ওকে বিয়ে করার পর কোনো কিছুর অভাব এবং কষ্ট কি জিনিষ কখনো ওকে বুঝতে দেই নাই।
কোনো চাওয়া অপূর্ন রাখি নাই…
সে খুব অভিমানী ছিল,অল্পতেই অভিমান করতো আর কাঁদতো। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে ওর কান্না থামাতাম।

কিন্তুু আজ আর ওর কষ্টের কান্না থামানোর মত কোনো উপায় জানা নেই!
(চোখের পানিটুকু আটকাইতে পারলাম না)

দেরী না করে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম!
গ্রামের ভালো হাসপাতাল ছিলো না,তাই শহরে নিয়া গেলাম….. সময় যতই যাচ্ছিলো, পাগলীটার যন্ত্রনার পরিমাণ ততই বাড়ছিলো, চিৎকার করে কাঁদছিল।

ওর কান্নায় আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো।
আজ একটা কথাও বলে নাই আমার সাথে,কারন অসহ্য যন্ত্রনায় তার জানটা বেরিয়ে যাচ্ছিল।

আসলে মা হতে হলে একটা মেয়েকে কতটা কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়,
সেদিন আমি আমার জানটা”কে দেখে বুঝছি।
.
ডাক্তার তাকে ডেলীভারি রুমে নিয়ে যাচ্ছে,সাথে সাথে আমিও যাচ্ছিলাম।……
কিন্তুু ডাক্তার আমাকে রুমে ডুকতে দিলো না।
ডাক্তার”কে অনেকবার অনুরোধ করলাম!….
ডাক্তার আমার জানটা খুবই ভিতু……
আমার ওর সাথে থাকা খুব দরকার,দয়া কইরা আমারে সাথে নেন।

ডাক্তার কোনো কথায় শুনলো না।
এই দিকে আমার জান’টা চোখ বন্ধ করে যন্ত্রনায় ছটফট করছিল।
….
আমাকে বাইরে রাইখা ওরা আমার জান’টা কে ভিতরে নিয়ে গেল।
যাওয়ার সময় আমার লক্ষি সোনাটা চোখ মেলে একবার আমার দিকে তাকালো……………”কি মায়া যে ওর চোখে বলে বুঝাতে পারবো না।

আমি বাইরে অপেক্ষা করছি,আল্লাহ’কে ডাকছি আর কাদছি!…
আধা ঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে আসলো।
এসে বললো;
– আপনি একটু আমার চেম্বারে আসেন….

ডাক্তারঃ- আপনার স্ত্রীর অবস্থা খুব একটা ভাল না, দুঃখের সাথে বলছি আমরা যেকোনো একজন’কে
বাচাতে পারবো!…হয় মা অথবা সন্তান!!

এখন আপনিই বলুন কাকে চান…….?
আমি কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।কারন আমি পাগলীটাকে ছাড়াও থাকতে পারবোনা,

আবার…………….
ডাক্তারের হাত ধরে বলেছিলাম ডাক্তার আমি দু’জনকেই চাই।
যত টাকা লাগে ডাক্তার আমি আপনাকে দিমু!,
দরকার হয় আমার ঘর বাড়ি,জায়গাজমি এমনকি আমার দুটো কিডনী সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে
আপনাকে টাকা দেমু!….প্লিজ ডাক্তার…
.
– আচ্ছা আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না,আমরা দেখছি, আল্লাহ’কে ডাকুন….ডাক্তার আবার ডেলীভারি রুমে ঢুকলেন।বাইরে আমি, আমার জানা সবগুলো দোয়া কালেমা পড়ছিলাম,আর আল্লাহকে ডাকছিলাম।
প্রায় ১ ঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে আসলেন……

আমি উঠে দাড়িয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম ডাক্তার আমার জান’টার এখন কি অবস্থা,আর আমার সন্তান কেমন আছে…?
আমি কি এখন একটু আমার জান’টার সাথে দেখা করতে পারি!,
কেবল একনজর আমার সন্তান’কে দেখতে পারি…..?
ডাক্তার নীরব………
দু’চোখে দু’ফোটা বেদনার জল নিয়ে বলতে লাগলো,
– আপনার স্ত্রীর কন্যা সন্তান হয়েছে, কিন্তুু………..
– কিন্তু কি ডক্টর…. ?
.
– আমরা খুব দুঃখিত, আমরা মা মেয়ে কাউ’কেই বাচাতে পারিনি…………

ডাক্তারের মুখে কথাটা শোনার পর আমার কেন জানি মনে হলো!…..
আকাশ তার নিজের জায়গা”য় নেই,মাটিও আমার পায়ের নিচ থাইকা সইরা গেছে।চারিদিকে অন্ধকার হতে শুরু করছে,নিশ্বাস’টা বন্ধ হয়ে এলো।

শেষবারের মত একটাবার নি:শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম।কিন্তুুু পারলাম না, মনে হচ্ছে আমিও মরে
যাচ্ছি!…….জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম……

জ্ঞান ফিরে আসার পর চাচা চাচিকে পাশে পাইলাম;
সবাই কাদতেছিল তখন…….
আর একটা অন্ধকার ঘরে আমার নিষ্পাপ মেয়ে আর আমার জানটাকে রাখা আছে।

আমি আমার জানটার কাছে গিয়ে দেখি একটা সাদা চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে রেখেছে,পাশেই আমার নিষ্পাপ সন্তানও।
চাদর’টা সরালাম,আমার জানটা, মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে।আমার মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর,একবারে মায়ের মতো।আস্তে করে ডাক দিলাম,জান ……
জান ওঠ আমি আইছি,,

কিরে,মেয়ে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলি নাকি….?
ওঠ না, ওঠ না পাগলি, একটু কথা বল আমার সাথে!,
দেখ,আমি কিন্তুু কেঁদে ফেলবো ওঠ বলছি।
আচ্ছা না উঠলি,এখন থেকে আমি আবার রোজ অনেক রাত করে বাড়ী ফিরবো।
তখন বুঝবি কেমন লাগে!…

আমাকে দেখে,আমার চাচি হাউ মাউ করে কেদে উঠলো। বাবা’রে বউ’ মা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে,
ও আর কোনোদিন উঠবে না।

এইটা কি করে হয় চাচি…আমি জান ছাড়া বাচতে পারবো নাকি?
পাগলী’টা কথা দিছিলো আমাকে ছাইড়া কোথাও যাইবো না কোনদিন।

আমি আবার ডাকলাম,কিন্তুু আমার জানটা আজ আর কিছুতেই উঠছে না,
একটাবারও আমাকে দেখলো না।
একটা’বার আমার সাথে কথা বললো’না।
বলবো কি কইরা,আমার জানটা যে সত্যি সত্যিই তার কথা ভঙ্গ কইরা আমাকে ছাইড়া চইলা গেছে অনেক
দূরে!………..

যেখান থেকে পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে কাউকে আবার ফেরানোর অপশন নেই!
আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ছিলাম।
একটু পর খবর পাইলাম,ঢাকা আসার সময় গাড়ি এক্সিডেন্টে আমার আব্বা আম্মা মারা গেছে, আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম..!
আজ থেকে আমি একা,আমি বড়ই একা হয়ে গেলাম।আমার আপনজন রা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে খুব বহু দূরে,
কাঁদতে কাঁদতে আবার জ্ঞান হারাইলাম।
।।
জ্ঞান ফিরে নিজেকে বাড়িতে আবিষ্কার করলাম।
আমার আব্বা আম্মা, মেয়ে আর আমার জানটাকে সবাই গোসল করাচ্ছে।…………………(এটাই শেষ গোসল)
.
এইদিকে সবাই আমাকে বোঝাচ্ছিল!..
বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর,বড়ই পাষান, কেঁদে আর কি হবে, নিজেকে একটু শক্ত কর…কারন বেঁচে থাকতে হবে যে।
নিজেকে আমি কিভাবে শক্ত করবো……..?
নিজেকে শক্ত করার কোনো কিছু জানা নেই তো আমার।

জীবনের শেষবারের মত একবার দু’চোখ ভরে প্রিয়জনদের দেখলাম।
কথা বলার বাকশক্তি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি,
কথা বলার কোনো শক্তিই নাই!…
আছে শুধু দু’চোখের ক্ষীণ দৃষ্টি…….
সন্ধ্যা হয়ে এলো, আম্মা, আব্বা_আমার মেয়েকে আর পাগলি টাকে পাশাপাশি কবর দিলাম আমাদের বাড়ীর আমবাগানে….

স্বার্থপরের মত আমার পুরো পরিবারকে একাকি অন্ধকার ঘরে রেখে আসলাম।
ওদের ছেড়ে আসতে মন চাইছিলো না।
মন চাইছিলো ওদের সাথেই থেকে যাই।
সবাই আমাকে জোর করে টেনে হেচড়ে ঘরে নিয়ে আসলো!…
.
অনেক রাত হয়ে গেছে…
কাল তো আম্মা আব্বা ছিলো, কতো সুন্দর ছিলো সময়টা, আব্বা আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে।
গতকাল রাতে আমার পাশে আমার জান ছিল।

সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল……
-কিন্তুু আমার পাশে আজ পাগলীটা নেই,আজ আমি একা!…

চোখে ঘুম নামের কোনো অস্তিত্বই আমার নেই।
লাইট’টা অন করলাম,সারা ঘর জুড়ে জড়িয়ে ছিল পাগলীটার স্মৃতি।
.
যেদিকেই তাকাচ্ছি কেবল ওকেই দেখতে পাচ্ছি!
– এই সেই আয়না যে আয়নার সামনে পাগলীটা সাজতো,আর আমি ওকে জ্বালিয়ে মারতাম।
মাথা আচড়ানোর সময় কতবার যে চুল
এলোমেলো করে দিয়েছি!..
কিন্তুু আজ থেকে পাগলী’টাকে আর জ্বালাতে পারবোনা আর কোনদিন।

শত ইচ্ছে করলেও তাকে আর দেখতে পাবোনা,তাকে ছুতে পারব না কিছুতেই।
হাজার ইচ্ছে করলেও তাকে বুকে জড়িয়ে একটু আদর করতে পারব না।
আমার সব কিছু এলোমেলো করে দিয়ে স্বার্থপরের মতো সবাই আমাকে একা ফেলে চলে গেছে।…

মনে মনে আল্লাহ্ কে বলতেছিলাম,
নিজেকে এখন আমি কি দিয়ে সান্ত্বনা দেব তুমিই বলো শুনি।আমি এখন কি নিয়ে বেঁচে থাকবো এই পৃথিবীতে যেখানে আমার আপন মানুষ গুলোই আজ আর নেই..?
এত বড় শাস্তি কেন দিলা আমারে,কি অপরাধ ছিলো আমার…?

পরের দিন চাচার সাথে দাদার বাড়িতে চলে আসলাম, আমি আর ওই বাড়িতে থাকতে পারছিলাম না, আমার দম বন্ধ লাগছিলো, এইখানে আইসা কবীরকে পাইলাম, আমার ছোট ভাই, ওইদিন আব্বা আম্মার সাথে যায় নাই, দাদার কাছে ছিলো, সবকিছু হারিয়ে আমি যখন বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম, যখন কবীর আমার মনে আশার প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠলো,ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট ভুলে হাসতাম,বাবা মা হারানোর কষ্ট ওরে বুঝতে দিতাম না…!
বলছিলাম না আমার মন আকাশের তারা গুলো অনেক আগেই খসে পড়ে গেছে, শুধু একটা তারা এখনো মিটমিট করে জ্বলছে,এই তারাটাই হলো কবীর, আমি এখনো ওর জন্য বেঁচে আছি….!

বায়জিদ হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো, নাহিদ কী বলবে বুঝতে পারছে, তার চোখেও জল জমে গেছে, কথা বলার ভাষা হারিয়ে গেছে, সবকিছু হারিয়েও মানুষ বুকে পাথর বেঁধে বাঁচে, তাঁকে বাঁচতে হয়, কিছু কিছু মানুষের জীবন কতো কঠিন…

মেঘ যখন পানির ভার বইতে পারে না,তখন সেই পানি গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে..!
মানুষ যখন কষ্টের ভার সইতে না,তখন সেই কষ্ট গুলো কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ে..!

রাত তখন গভীর, চাঁদ টাও মেঘের চাদরে ঢেকে গেছে, দুইজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, খোলা আকাশের নিচে, একজন অশ্রু বিসর্জন দিতেছে,অন্যজন শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজতে ব্যাস্ত….

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here