পাতাঝরার শেষে
©মৌপর্ণা
পর্ব ১২) #TimeToReinventYou
আরও মাসখানেক পরের কথা…..
শেষ একমাসে অন্বেষা ও মিস্টার রায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা নীরব বন্ধুক্তের সম্পর্ক, একটা স্বচ্ছ বিশ্বাসের সম্পর্ক!
অদ্ভুত একটা বিশ্বাস যেখানে দুজনেই একটু একটু করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল দুজনকে!
অফিসে সেরকম কথা হতোনা দুজনের…..
দুজনের ডিপার্টমেন্ট, ডোমেন একেবারেই যে আলাদা!
তবে অফিসে চোখে চোখ পড়লে যে মিস্টার রায়ের মুখে একটা অনাবিল হাসির রেখা ফুটে ওঠে এটা নজর এরাইনি বাকিদের!
ইন ফ্যাক্ট যে লোকটা প্রয়োজন ছাড়া কারোর দিকে তাকায়না সে একজন অন্য সাধারণ এম্পলয়ীর দিকে চেয়ে হাসে, এটা সত্যি নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতন ব্যাপারও নয়!
প্রতি রবিবার করে নিয়মিত অন্বেষা পিজি তে ফেরে মিস্টার রায়ের গাড়িতে,
রিতিকা কে পরিয়ে বেড়োনোর পরেই অন্বেষা দেখে মিস্টার রায় নিয়মিত বসে থাকে ডাইনিংয়ে, তারপর অন্বেষা কে দেখতেই উঠে পরে চাবি নিয়ে, অন্বেষাও তাতে বাঁধা দেয়নি কোনোদিন!
তবে গাড়িতে একসাথে ফিরলেও খুব বেশি কথা হতোনা ওদের….
বা এটা বলা ভালো যে অন্বেষার একতরফা গল্প শুনতো মিস্টার রায়!
তবে অন্বেষা যে কথা গুলো জোর করে শোনাতো, ব্যাপারটা একেবারেই সেরকম নয়!
অন্বেষার একতরফা গল্প গুলো বেশ উপভোগ করতো মিস্টার রায়!
নিজে নিজেই অন্বেষা বলে যেত অফিসের কাজকর্মর কথা, কলকাতার ট্রাফিক, অন্বেষার দুর্গাপুরের বাড়ি ও ফ্যামিলির কথা, ইত্যাদি! ইত্যাদি!
শেষ এক মাসে অন্বেষা দেখেছে আসতে আসতে পাল্টে যাচ্ছে মিস্টার রায়!
এখন অন্বেষার সাথে বেশির ভাগই তিনি হাসি মুখেই কথা বলেন!
*****************************************************
বাকি আর দশটা দিনের মতন অফিসে পৌঁছলো মিস্টার রায়, তবে আজ অফিসে পৌঁছতেই একটা
কথোপকথন কানে এলো ……
অন্বেষার ডিপার্টমেন্টের সৌগত আর রুশা দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক লিফটের সামনেই, বোধহয় ওরা দুজন তখনও লক্ষ্য করেনি মিস্টার রায় কে,
সৌগত রুশা কে বলে চলেছে –
“অন্বেষার ক্যাপা আছে, নয়তো ওরম Detailed
খবর জোগাড় করা নট এ ম্যাটার অফ জোক..
…………….সবচেয়ে বড়ো কথা ও জিনিসটাতে কিন্তু লেগে আছে………….আমার সত্যি ব্যাপারটা ভীষণ অবাক লাগছে! মানুষের মনে জমে থাকা কষ্টগুলোর কথা মানুষ হয়তো কাউকেই বলতে পারেনা তবে তার মানে এটা তো নয় যে সে কষ্টটা ফিল করেনা…..এই সেন্টিমেন্টটা বোঝা খুব ডিফিকাল্ট……সব চেয়ে বড়ো কথা…”
সৌগতর কথাটা শেষ হওয়ার আগেই লিফটের দরজা গেল খুলে, সৌগত মিস্টার রায় কে দেখে একটা গুড মর্নিং জানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো লিফটের কোণায়!
তারপর বন্ধ হয়ে গেলো ওদের কথোপকথন, উল্টে মিস্টার রায় বোধ করলো ওরা যেন কেমন আজ অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে মিস্টার রায়ের দিকে…….
শুধু এইটুকুই নয় অফিসের করিডোরে ঢুকতেই মনে হলো অনেকেই আজ তাকিয়ে দেখছে তার দিকে!
বুকের মধ্যেটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো,
কেবিনে পৌঁছে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো মিস্টার রায়!
AC-র বোতামটা টিপে কমিয়ে দিলো AC-র টেম্পারেচার…..বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল কপালের ভাঁজে, তখন সৌগত ও রুশা কি নিয়ে কথা বলছিলো?
আজ চেয়েও কিছুতেই মনে বসছিলো না কাজে……
বারেবারে ঘুরেফিরে একিই কথা মনে আসছিলো কেন সবাই ওরকম ভাবে ঘুরেফিরে তাকাচ্ছিলো ওনার দিকে…….
আর কোন সেন্টিমেন্টের কথা বলছিলো সৌগত রুশা কে!
মুহূর্তেই সে শুনতে পেলো গেটে একটা নকের আওয়াজ!
“Come In”
“স্যার, আপনার ঘরের ইন্টারকমটা কাজ করছেনা অন্বেষা ম্যাডাম দেখা করবে বলছে, একটা জরুরি কথা আছে বললো, পাঠিয়ে দেব?”
মিস্টার রায়ের PA এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলো….
“হ্যাঁ পাঠিয়ে দাও!”
অন্বেষার কি বলার থাকতে পারে? তাও অফিসে?
মিস্টার রায়ের মনে জমেছিলো একটা অভিমান!
বারবার মনে হচ্ছিলো সেদিন রাতের আবেগে বলে ফেলা কথাগুলো অন্বেষা সবই বলে দিয়েছে বাকিদের…..এটা পারলো ও করতে, সে তো বিশ্বাস করেছিল অন্বেষা কে!
নিজের ওপর মনে মনে খুব রাগ হতে লাগলো,
মোটেই সে ঠিক করেনি সবটা অন্বেষা কে বলে, আজ সবাই করুণার চোখে তাকিয়ে তাই তার দিকে!
“মিস্টার রায়…..” এক মুখ হাসি নিয়ে কেবিনে ঢুকলো অন্বেষা…..
তারপর চেয়ারে বসে বলে চললো
“বলছিলাম….আজ আমরা ওপরের অডিটোরিয়াম টা নিচ্ছি…… ঘন্টা দুয়েকের জন্যে কেবল……
actually…….”
“কার Approval নিয়েছো?” আবারো সেই খাটখোট্টা গলায় প্রশ্নটা মিস্টার রায় ছুঁড়ে দিলো অন্বেষার দিকে….
এই সুরটা অন্বেষা অনেক দিন পর শুনলো মিস্টার রায়ের গলায়….
এবারে তাই খুব নীচু স্বরে বললো
“আমি ভেবেছিলাম আজকে সকালেই আপনাকে জানাবো….তাই এখন….”
“আমি জানানোর কথা বলিনি মিস মিত্র! আমি Approval বা Permission এর কথা বলছি!”
“আগেরদিন তো দেখলাম অনিরুদ্ধ দা জাস্ট আপনাকে ইনফর্ম করে……”
“Are you comparing yourself with Anirudhha? Don’t you even dare to that….okay? অনিরুদ্ধ আর তোমার জায়গাটা এক নয়! ক্লিয়ার? অনিরুদ্ধ কে পাঠাও! যাও…..”
অন্বেষার আবার খুব অচেনা লাগছিলো সামনের মানুষটাকে! না চেয়েও চোখদুটো জলে ভোরে এলো, কাঁপা কাঁপা গলায় একটা Sorry বলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে…….
মিস্টার রায় বসে রইলো ফেকাসে মুখটা নিয়ে!
বিশ্বাস ভাঙার পুরোনো যন্ত্রনাটায় আবার চিনচিন করে উঠলো বুকের বাঁপাশ টা…….
হয়তো তার জীবনের অনেকটাই অনেকে জানে,
সবটা জেনে গেলেও বা কি হবে? তবে মানুষ নিজের কষ্টের কথাটা সবার সাথে ভাগ করতে চায়না! তার চায়না সবার করুণা!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনেই ফাইল গুলো পাল্টে চলছিল তখন মিস্টার রায়, হঠাৎ গেটে আবার একটা নকের আওয়াজ শুনলো সে…..
“Come In…..
বারবার আমার ঘরে নক করার দরকার নেই অভয়, যে আসছে তাকে আসতে দাও…..”
“ওকে স্যার”
মুহূর্তেই বেরিয়ে গেলো অভয় – মিস্টার রায়ের পিএ, সাথেসাথেই ঘরে ঢুকলো অনিরুদ্ধ রায়, কেমিকাল এনালিস্ট ডিপার্টমেন্টের হেড, সে বেশ হাসি মুখে বলে চললো
“সরি, মিস্টার রায়, আমি একটু busy ছিলাম……একটা প্রেসেন্টেশনে! তাই অন্বেষাকেই বললাম আপনাকে গিয়ে জানাতে…..আসলে ঘন্টা দুয়েকের জন্যে একটা Slot দরকার ছিল, পুরো মার্কেটিং টিমও ইনভাইটেড, আর আপনিও বোধহয় ফাঁকা আছেন কারণ আউটলুক ক্যালেন্ডারে ওই সময়টা ফাঁকাই দেখাচ্ছে….তাই আমি আপনাকেও রাখলাম মিটিংয়ে…..
বেশিক্ষণ নেবোনা সময়, তবে মিস্টার রায় আজ আপনার একটু সময় দরকার ছিল! প্লিজ! আপনি সেরকম ব্যস্ত থাকলে আপনি নিজেই বলুন কোন সময়টা তে আপনি ফাঁকা থাকবেন?”
মিস্টার রায় কিচ্ছু বুঝলোনা কি হচ্ছে, একটা শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলো
“আপনারা মার্কেটিং টিম ও আমাকেও রেখেছেন আপনাদের মিটিং এ!”
“রাইট স্যার!”
“কখন ভেবেছেন slot?”
“বিকেল চারটে স্যার!”
“ফাইন….আমি Approval মেল্ সেন্ড করে দিচ্ছি…”
“আর স্যার ইনভিটেশন মেল্ টা যদি একসেপ্ট করে নিতেন….”
“ফাইন…..সিওর…..”
অনিরুদ্ধ বেরিয়ে গেলে আনমনা হয়ে আবার বসে থাকে মিস্টার রায় নিজের কেবিনে!
আসলে এই প্রথম কেমিক্যাল এনালিস্টের টিম মিটিং রেখেছে মার্কেটিং টিম ও তার সাথে,
তবে কেন?
মিস্টার রায়ের রোলটা ঠিক manufactured
প্রোডাক্টের কেমিক্যাল কম্পোসিশন বোঝা নয়, বা কোয়ালিটি চেকও নয়!
আর এসব জিনিস কতটাই বা বোঝে সে!
মিস্টার রায়ের রোলটা শুধু কম্পানির প্রফিট, লস ও রেভিনিউ টা বোঝা!
হ্যাঁ মার্কেটিং টিমের সাথে অবশ্যই তাকে বসতে হয় মার্কেট ট্রেন্ডস টা বোঝার জন্যে!
মিস্টার রায়ের Approval ছাড়া তো মার্কেটিং টিম কোনো ডিসিশন নিতে পারবেনা!
আফটার অল মিস্টার রায় কম্পানির শেয়ার হোল্ডার ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর…..
তবে কেমিক্যাল এনালিস্টের টিমের সাথে বসে সে কতটাই বা কি বুঝবে?
******************************************************
ঘড়িতে ঠিক বিকেল চারটে হতেনা হতেই মিস্টার রায় পৌঁছলো অডিটোরিয়ামে……..
বসলো গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায়……..
এনালিস্ট টিমের হেড প্রেসেন্টেশন slideshow শুরু করতেই আলো এসে পড়লো প্রজেক্টরে…
সব আলো বন্ধ হলো অডিটোরিয়ামের……
অনিরুদ্ধ বলে চললো –
“আমি অন্বেষাকে প্রেসেন্টেশন দেওয়ার জন্যে ডেকে নেওয়ার আগে দুএকটা কথা বলতে চাই….
আমরা সবাই জানি আমাদের টিমের রোলটা কি?
মূলত আমাদের দিনের বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায় ল্যাবে…….
কেমিক্যাল কম্পোনেন্টস বুঝতে, রিপোর্টস বানাতে, বিভিন্ন Analysis! ইত্যাদি ইত্যাদি…….!
গত সোমবার ল্যাবে অন্বেষা হঠাৎ একটা কথা বলে আমায়, তখন আমাদের টিমের অলমোস্ট সবাই ল্যাব রিপোর্টস, স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে ব্যস্ত!
অন্বেষা বলে অনিরুদ্ধ দা, আমরা একটা প্রোডাক্ট যখন বানাই তাতে কেন শুধু পিওর ফর্মটা আমরা মার্কেটে আন্তে পারিনা……
আমি একটু অবাক হই ওর কথাটা শুনে….
মানে একটা কসমেটিক প্রোডাক্ট….
Sorry টিম তার আগে একটা ছোট্ট কথা বলি, অন্বেষা এন্ড সৌগত টিম মেনলি এখন কাজ করছে ওভার কসমেটিক প্রোডাক্ট, সো সেখান থেকেই অন্বেষার মনে হয় একটা unadulterated পিওর ফর্ম অফ কসমেটিকের কথা!
unadulterated – কথাটা শুনেই প্রথম যেটা মাথায় আসে আমার মানে একটা প্রোডাক্ট প্যারাবেন ছাড়া, মার্কারি ছাড়া, লেড ছাড়া, স্টেরয়েড ছাড়া, হাইড্রোকুইনোন ছাড়া…..রাইট?
এমনকি যাতে কোনোরকম সিনথেটিক বা আর্টিফিশিয়াল ফ্র্যাগনান্স, কালার কিছু ইউস হবেনা এক্সসেপ্ট সাম হার্মলেস ন্যাচারাল Preservatives……
আমি ওকে প্রশ্ন করি অন্বেষা লোকে কেন কিনবে আমাদের প্রোডাক্ট?
মানে টেম্পোরারি ওর পার্মানেন্ট ওয়ে তে
এই প্রোডাক্ট কোনোভাবেই ফর্সা করবেনা মানুষকে! এমনকি স্কিন ব্রাইট ও হবেনা ইন্সট্যান্টলি!
তবে এই প্রোডাক্টের মানেটা কি?
অন্য সব কম্পিটিটর কম্পানি গুলো দাবি করছে পাঁচমিনিটেই স্কিন ব্রাইট ও ফেয়ার করার!
আমাদের প্রোডাক্ট দাঁড়াতে পারবে সেইজায়গা তে! ধোপে টিকবে!
অন্বেষা আমাকে বলে মানুষ সব সময় একটা ইউনিক জিনিস চায়, ডিফারেন্ট, নতুন কিছু!
ইন্ডিয়ার মতন দেশে সবাই ফেয়ারনেস Obsessed…..এই নিয়ে কত লেখালেখি হয়,
অনেক মডেল ও এর এগেইনস্ট অনেক কিছু বলেছে!
তবে এটা মন থেকে মেনেছে কজন!
এনালাইসিস ওয়াইস প্রতি দশজন মানুষকে দেখলে আপনি বুঝবেন খুব বেশি হলে সেই দশজনে একজন বা দুজন মানুষ ফর্সা, পাঁচ বা ছয় জন মাঝারি যারা মেকাপ করে ফর্সা, দুজন যারা ফর্সা নয় একদম এবং একজন যে লিস্ট bothered About her/his skin color..
একোর্ডিং টু অন্বেষা, আমরা কেন বারবার ৭০ পার্সেন্ট লোক যারা ফর্সা নয় বা যারা ডার্ক, তাদের আমরা কেন মোটিভেট করছি যে আপনারা আমাদের প্রোডাক্ট ইউস করুন ও ফর্সা হয়ে যান, রাতারাতি ব্রাইট স্কিন!
কেন আমরা তাদের এটা বলছিনা যে আপনাদের চেঞ্জ হওয়ার প্রয়োজন নেই!
আপনারা যেমন আপনারা সেই ভাবেই সুন্দর! দরকার নেই ফেক ব্রাইটনেস, ফেক ফেয়ারনেস,
A Glowing Skin Within One মিনিটের….
প্রয়োজন নেই আজ সেগুলোর!
থাকুন না আপনি আপনার মতন, নিজের মতন! একটু যত্ন করুন নিজের তাহলেই হবে!
Be the real you, don’t be the fake you!
হান্ডেড ওভার টু ইউ অন্বেষা!
I know Mistar Ray, This is not our job! I know it’s not okay to suggest you what company should manufacture, but we think this change is going to impact a lot of people! It’s about sentiment, it’s about a feeling! We don’t understand about profit but we care for those who use our product!
Instant fairness and brightness cream has lot of side effects! It causes itching to cancer! Hormonal Imbalance to Skin Damage!
We should stop playing with people and should make them understand that leopard can’t remove his spots! Skin color can’t be changed but skin can be pampered by care!
স্কিন – যার রং আপনি চেঞ্জ করতে পারবেন না, তবে তাকে আগলে রাখতে পারবেন তার মতন করে একটু খানি ভালোবাসার সাথে!
Sorry অন্বেষা তোমার লেখা লাইন গুলোর অনেকটাই বলে দিলাম প্রেসেন্টেশনের আগেই!
Please come forward and make them understand about harmful effects of fairness and brightness chemical components and your analysis about fairness obsession…..হ্যাশ ট্যাগ
#Time to reinvent you!
Please come…..the stage is all yours!”
অনিরুদ্ধ স্টেজ থেকে নেমে যেতেই স্টেজে উঠে এলো অন্বেষা…..
পরণের লাল স্ট্রেট এক রঙা কুর্তাটা নেমে এসেছে হাটু অবধি, লাল স্ট্রেট কুর্তাটা জুটি বেঁধেছে একটা শঙ্খসাদা কটন লেগিংসের সাথে, চুলটা কোনোরকমে ওপর দিকে নট করে একটা ক্যাচার দিয়ে আটকানো, তবুও কিছু অবাধ্য চুল উড়ছে কানের পাশে, চোখে হালকা একটা কাজলের রেখার সাথে ভেসে উঠেছে সরলতা ও সততা, গোলাপি ঠোঁঠে লিপস্টিকের ছোঁয়া নেই একেবারেই, শুধু লেগে রয়েছে একটা সরল হাসির রেখা….
একটা সামান্য মেয়েকে বড়োই অসামান্য দেখাচ্ছিলো আজ!
প্রজেক্টরের নীলচে আলোয় মায়াবী দুটো চোখের দিকে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়!
সেই দুটো চোখ যা কখনো বিশ্বাস ভাঙতে পারেনা!
অথচ একটু আগেই মেয়েটাকে কতকিছুই না বললো সে!
তখন তবে মানুষের এই সেন্টিমেন্ট, এই কষ্টগুলোর গুলোর কথা আলোচনা করছিলো সৌগত ও রুশা……
অন্বেষা বলে চললো….
…….সামাজিক চিন্তা ভাবনার কথা, ফেয়ারনেস অবসেশনের কথা, কেমিক্যাল কম্পোনেন্টস এর
সাইড এফেক্টের কথা, মানুষকে ঠিকটা ঠিক আর ভুলটা ভুল বোঝানোর কথা, মানুষকে আসল ভাবে খুশি রাখার কথা!
প্রেসেন্টেশন চলাকালীন অন্বেষা বারবার দেখেছে স্থির শান্ত দুটো চোখ নিস্পলকে চেয়ে আছে তার দিকে!
তবু সে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে বারবার!
ওই শান্ত দুটো স্থির চোখ দেখলে যে মনটা বড়োই অশান্ত হয়ে যায় অন্বেষার আর তাতেই গুলিয়ে যায় সব….
*******************************************************
প্রেসেন্টেশনের শেষে হাততালির আওয়াজে মগ্নতা কাটলো মিস্টার রায়ের!
বেশ খানিকক্ষণ হলো প্রজেক্টরের নীল আলো নিভে গিয়ে জলে উঠেছে অডিটোরিয়ামের সাদা আলো, তবে এইসব লক্ষই করেনি মিস্টার রায়!
আজ সারাক্ষণ সে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিল দুটো মায়াবী চোখের দিকে, কেমন যেন আসতে আসতে বেড়ে চলেছে এই মুগ্ধতা! জড়িয়ে পড়ছে সে এই বন্ধনে একটু একটু করে!
রোজ যেন আরও একটু বেশি ভালো লাগে অন্বেষা কে!
সত্যি! আজ যে কথাগুলো নিয়ে আলোচনা হলো, সেরকম কজন মানুষিই বা ভাবতে পারে!
কতটা স্বচ্ছতা থাকলে এইরকম একটা কথা আসে মাথায়!
“মিস্টার রায়! আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে কনসেপ্ট এন্ড থিংকিং টা……
এবারে আপনার Approval টা দরকার! তার আগে একবার বাকি ডিপার্টমেন্ট গুলোকে ইনভল্ভ করলে ভালো ছিল, যেমন স্ট্রাটেজিক ডিপার্টমেন্ট, ফিনান্সিয়াল ডিপার্টমেন্ট, মানে প্রোডাক্ট প্রাইস টাও ফিক্স করা দরকার!”
কথাটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন হেড অফ মার্কেট রিসার্চ Analyst টীম মিস্টার শুভঙ্কর দাসগুপ্ত……
“আমরাও ভীষণ পছন্দ হয়েছে, আই গেস বাকি পুরো ম্যানেজমেন্ট এন্ড আদার ডিপার্টমেন্টের সবার ভালো লাগবে…..
Approval নিয়ে আপনারা ভাববেননা, ওদিকটা আমি সামলে নেবো!
অন্বেষা Analysis রিপোর্ট এন্ড প্রেসেন্টেশন দুটোই মেল্ করে দাও…..
আই নিড টু ক্রস চেক এভরিথিং…..
এন্ড Congratulations……….
মার্কেটিং টিম স্টার্ট ওয়ার্কিং অন দিস……..
পুজোর আগেই হোর্ডিং পরে যাওয়া উচিত পুরো শহরে উইথ – #ReinventYouWithTheWayYouAre
……………কোনো মডেল প্রয়োজন নেই আমার!
কিছু ইনোভেটিভ ডিসাইন করো যেটা মানুষকে এখানে স্পর্শ করবে, ঠিক এখানে!”
বলেই নিজের বুকের বাঁ দিকটা স্পর্শ করলো ডানহাতের তর্জনী দিয়ে মিস্টার রায়!
“সৌন্দর্যতা, যোগ্যতার ডেফিনেশন টাই বদলে দেওয়া যাক আজ! ”
অনেকদিন পর আজ সবাই দেখলো মিস্টার রায়ের হাসি মুখটা…..
অনিরুদ্ধ আবার গলাটা পরিষ্কার করে বললো –
“মিস্টার রায়! আমাদের প্রেসেন্টেশন টা আজকেই দেওয়ার আরও একটা বড়ো কারণ আছে, মানে এটা গত পরশুদিন রাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো তারপর অন্বেষা বললো আজকের দিনটা বেটার হবে কারণ আজকের দিনটা স্পেশাল…..”
খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে মিস্টার রায় চেয়ে রইলো অনিরুদ্ধ ও বাকিদের দিকে……
সকালের মতন আবার যেন বাকিরা চেয়ে আছে তার দিকে……
সকলের মুখে একটা হাসির রেখা……
ভ্রু কুঁচকে মিস্টার রায় তাকালো অনিরুদ্ধর দিকে…..
বললো
“Sorry আমি এখনো কিছু বুঝলাম না! আজ তো কম্পানি ফাউন্ডেশন ডে নয়! তবে কি? আমি কিছু মিস করছি কি?”
“হ্যাপি বার্থডে মিস্টার রায়……”
অনিরুদ্ধের কথা শেষ হতেনা হতেই চারপাশ থেকে অসংখ্য আওয়াজ ভেসে এলো কানে “হ্যাপি বার্থডে স্যার” “হ্যাপি বার্থডে মিস্টার রায়…..”
কোনটা কার আওয়াজ বুঝলোনা মিস্টার রায়, তাতে অন্বেষার আওয়াজ ছিল কিনা সেটাও বুঝলো না সে!
অজান্তেই বুকের মধ্যেটা কেমন যেন করে উঠলো, সেটাকি চেপে রাখা না পাওয়ার ব্যাথা গুলোর অবসান?
নাকি একটা নতুন ফিরে পাওয়ার সুর যেটা নিমেষেই মুছে দেয় জমে থাকা সব ব্যাথা?
অস্থির হৃদয়টা তখন গতিটা বাড়িয়ে বেশ জোরেজোরে ধুকপুক করছে, শেষ কবে এরকম গতিতে সে ধুকপুক করেছিল মনে নেই মিস্টার রায়ের……
গলার কাছে আটকে রাখা একটা সুখের ফিরে পাওয়ার কান্না কোনোমতে চেপে সামনে রাখা কাঁচের গ্লাস থেকে একটু ভিজিয়ে নিলো গলাটা…..
তারপর ভেজা গলাটা পরিষ্কার করে বললো –
“থ্যাংক ইউ সো মাচ অল অফ ইউ…..”
“স্যার! একটা ছোট্ট আয়োজন করা হয়েছে ক্যাফেটেরিয়া তে, নরমাল একটা সাধারণ কেক জাস্ট! আপনি প্লিজ না বলবেন না!”
একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো কানে, খুব সম্ভবত এটা সৌগতর আওয়াজ!….”
হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও চোখের জলে নীচে রাখা ফাইলের লেখা অস্পষ্ট হয়ে এলো……
ভাঙা ভাঙা গলায় মুখ থেকে বেরিয়ে এলো
“চলো…..ক্যাফেটেরিয়া তে….”
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই অন্বেষার চোখে চোখ পড়লো মিস্টার রায়ের…..
ভিড়ের মধ্যেও তখন দু জোড়া চোখ চেয়ে রয়েছে একে ওপরের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে……
আজ মনের মধ্যে ওঠা ঝড়টা একতরফা নয়, আজ সেটা দুতরফা!
কোনোমতে চোখ ফিরিয়ে এগিয়ে চললো ওরা ক্যাফেটেরিয়ার দিকে!
সারাজীবনে কোনোদিন একটা কেক জোটেনি কখনো, কেউ কখনো মনেই রাখেনি আজকের দিনটা!
আর ওরা বলে কিনা একটা সামান্য কেক!
একটা বছর, শুধু একটা বছর মা একবার পায়েস বানিয়েছিলো…..
কে জানে সেবার কি ভাবে মনে ছিল তার!
শঙ্খ, শুভ্র কে অনেকবার দেখেছে সে কেক কাটতে……..
কখনো মুখ ফুটে বলেনি কিছু! বলেনি – তারও ইচ্ছে করে খুব ইচ্ছে করে একটা কেক কাটতে….
কেক কাটার সময় কানে আসছিলো বার্থডে song
কখনো কেউ তার জন্যে গান গাইতে পারে হাততালি বাজিয়ে সেসব সত্যি একটা স্বপ্ন!
সেই আওয়াজে বারবার খুঁজছিলো সে অন্বেষার আওয়াজ!
হার্টশেপের লাল কেকটা অনেকগুলো টুকরো হয়ে পরে রইলো সামনে,
গুছিয়ে সেগুলো সামনের কিছু এমপ্লয়ী একটা একটা করে তুলে দিচ্ছে কাগজের চতুষ্কোণ ছোট প্লেটে….
তারপর তুলে দিচ্ছে সেগুলো বাকিদের হাতে…..
অন্বেষা দাঁড়িয়ে রইলো টেবিলের এক কোণে …..
ওপর কোণে মিস্টার রায়!
আজ বড়ো ইচ্ছে করছিলো অন্বেষার সামনে গিয়ে এক টুকরো কেক খায়িয়ে দিক অন্বেষা কে!
জিজ্ঞেস করতে আরও একবার অন্বেষাকে –
……..সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে ভালোলাগার কথাটা!
এখনো কি বেঁচে আছে সেই ভালোলাগা?
(চলবে….)