পাতাঝরার শেষে……পর্ব ১৩

0
1332

পাতাঝরার শেষে
©মৌপর্ণা

পর্ব ১৩) ভ্যাপসা গন্ধটা আজ চেনা গেলো!

ক্যাফেটেরিয়া থেকে যখন মিস্টার রায় ক্যাবিনে ফিরে এলো তখন ঘড়িতে ঠিক ছটা বেজে পনেরো মিনিট…..
ক্যাবিনে ঢুকতেই আজ যেন মনটা কেমন ছটফট করে উঠলো!
বেশতো লাগছিলো ওদের সাথে ক্যাফেটেরিয়া তে, আজ কিছুতেই ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিলোনা একদম!

এদিকে কাজ অনেকটাই বাকি পরে, অন্বেষার দেওয়া প্রেসেন্টেশনটা বোধহয় তক্ষুণি সে অডিটোরিয়ামেই সেন্ড করে দিয়েছিলো, সেগুলো নিয়েও বসতে হবে একবার!

বারবার অন্বেষার মুখটা ভেসে উঠছিলো দুটো চোখের সামনে!
অস্থির হয়ে পড়ছিলো মনটা বারবার অন্বেষাকে দেখার জন্যে, আরও একটাবার!
হঠাৎ মনে হলো একবার অন্বেষা কে ডাকা দরকার এক্ষুণিই…….
সকালে ওরকম খারাপ ব্যবহার কেন
করলো সেটা জানাতে হবে……..

আজকেই ইন্টারকম টা খারাপ, তাই ফোন ঘুরিয়ে ডাকা যাবেনা তাকে!
অগত্যা নিজেই বেরিয়ে এলো মিস্টার রায় ক্যাবিন থেকে তারপর সোজা এগিয়ে গেলেন অন্বেষার ডিপার্টমেন্টের দিকে…..

মিস্টার রায় কে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই, মিস্টার রায় ইশারা করলেন সবাই কে বসার জন্যে..
গলাটা পরিষ্কার করে খুব ঠান্ডা গলায় মিস্টার রায় বললো –
“আজকের দিনটাকে এতটা স্পেশাল বানানোর জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ! আপনারা সবাই ইনভাইটেড সানডে ডিনারে, আমার আইডিয়া খুব কম কোন রেস্টুরেন্ট ভালো আর কোনটা ভালো নয়, তাই পুরো দায়িত্ব টা আমি আপনাদেরই দিলাম! সৌগত…”

“হ্যাঁ স্যার….”

“নো ……..স্যার….. প্লিজ!” বেশ সুর করে বলে উঠলো মিস্টার রায়…..

“Sorry! ইয়েস মিস্টার রয়…” হাসি মুখে বলে উঠলো সৌগত…..

“ওকে, সো আমি তোমাকে দিলাম দায়িত্ব টা, সবার সাথে একবার চেক করে কালকের মধ্যে জানাও আমাকে কোন রেস্তোঁরা ফাইনাল করলে! দেয়ার ইজ নো বাজেট লিমিট! তবে কালকেই আমায় জানিও….কেমন? নয়তো এতগুলো সিট্ একসাথে বুক করা একটু চাপের…..”

সবাই অদ্ভুত নজরে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে! লোকটা রাতারাতি এতো পাল্টে গেলো কি করে?

মিস্টার রায় একটু থেমে আবার বললো –
” Thank you once more to all of you! Anwesha have something to discuss with you, Can you come to my cabin please?”

“সিওর মিস্টার রয়….”

মিস্টার রায়ের কথা শেষ হতেই মিস্টার রায় এগিয়ে চললো নিজের ক্যাবিনের দিকে, পেছন পেছন চললো অন্বেষা……

ক্যাবিনে ঢুকেই অন্বেষা অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো রাস্তার দিকে কাঁচের জানালাটার দিকে, আজ ভার্টিকাল ব্লাইন্ড কার্টেন পুরো সরানো, স্বচ্ছ কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খোলা বাইরের ঝকঝকে আকাশ! নীলচে আকাশ তখন শেষ গোধূলির স্পর্শে মাখা, জায়গায় জায়গায় লালচে আভা দেখা যাচ্ছিলো সামনের ব্লকের বিল্ডিং এর ফাঁক দিয়ে!
একটা একলা তারা টিমটিম করে জ্বলছিল আকাশের বুকের মাঝে…..
যেন সে একটু আগেই তার সাথীদের ছেড়ে পৌঁছে গিয়েছে আকাশের বুকে, আকাশের টানে…..
এই আকাশটা বড়ো মায়াবী লাগে অন্বেষার! বারবার এই আকাশ মুগ্ধ করে তাকে!

“অন্বেষা..”

মিস্টার রায়ের আলতো গলার স্পর্শে মগ্নতা কাটলো অন্বেষার….
“হ্যাঁ মিস্টার রায়..বলুন….”
অন্বেষার মুখে আবার সেই অনাবিল হাসির স্পর্শ…..

“কি দেখছো ওদিকে?”

“আজ কার্টেন টা সরিয়েছেন ভালো লাগছে….”

মিস্টার রায় একবার ঘুরে দেখলো কাঁচের জানালার বাইরে দিয়ে, কখন আনমনে সে সরিয়ে ফেলেছে কার্টেন নিজেও লক্ষ্য করেনি ঠিক!

“আকাশটা আমায় অদ্ভুত ভাবে মুগ্ধ করে জানেন মিস্টার রায়….”
খোলা কাঁচের জানালার দিকে চেয়েই বলতে থাকে অন্বেষা……

“অন্বেষা!”

“হমম”

“সকালে ওরকম খারাপ ভাবে কথা বললাম! তার জন্যে প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিও…..আসলে আমি…”

“আসলে আপনি ভেবেছেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে…..হয়তো আমি কিছু একটা গোলমাল করেছি, নয়তো সবাই ওভাবে কেন চেয়ে দেখছে আপনার দিকে, তাইতো?”

“তুমি কি ভাবে……?”

“জানিনা কি ভাবে তবে আমি বুঝতে পারি আপনাকে আজকাল….কখনো কখনো!”
খুব মৃদু স্বরে উত্তর দিলো অন্বেষা তারপর
স্মিত মুখে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে……

মিস্টার রায় ভাবতেই পারেনি ব্যাপারটা মিটে যাবে এতো সহজেই…….

********************************************************

রবিবারের বিকেলে অন্বেষা পৌঁছলো রয় ম্যানশন…….

আজ প্ল্যান মাফিক অন্বেষার পড়ানো শেষ হলে সে আর মিস্টার রায় একসাথেই যাবে ওয়েস্টিন!
সেখানেই তো ফাইনাল করা হয়েছে মিস্টার রায়ের জন্মদিনের ট্রিট…..

আজ রয় ম্যানশন ঢুকতেই অন্বেষার দুটো চোখ খুঁজছিলো মিস্টার রায় কে,
কারণটা – সেরম বিশেষ কিছুই না – ভালোলাগার মানুষটাকে সাজটা না দেখালে সাজটা অসম্পূর্ণই থেকে যায়…….

শেষ বিকেলে দেখা হবে জেনেও অন্বেষার মনটা কেমন যেন ছটফট করে উঠলো মিস্টার রায় কে একবার দেখার জন্যে!

বাইরের ঘরের সোফাটা আজ ফাঁকা,
তাই আজ সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়ার আগে, সে একবার এগিয়ে গেলো মিস্টার রায়ের ঘরের দিকে,
একবার তো বলা যেতেই পারে যে সে একেবারেই রেডি হয়ে এসেছে!
এই ফাঁকে একবার সাজগোজ টাও দেখানো হয়ে যাবে!

ঘরের দশ ফিটের দূরত্বের মধ্যেই যেতেই মুখটা শুকনো হয়ে গেলো অন্বেষার!

দুটো দরজার মধ্যে রয়েছে একটু ফাঁক, মানে দরজাটা আধখোলা….
আধখোলা দরজা দিয়েই দেখা যাচ্ছিলো
ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরটা!
মানে মিস্টার রায় নেই ঘরে!
ধুর! কপালটাই খারাপ!
মনেমনে কথাটা ভাবতে ভাবতে যেমনি সে এগোতো গেলো সিঁড়ির দিকে,
একটা ভীষণ তীব্র গন্ধ নাকে এলো অন্বেষার…..
ভীষণ স্ট্রং একটা গন্ধ……

কেন এই অসহ্যকর তীব্র গন্ধটা এতটা চেনা আজ, পচে যাওয়া মাছের গন্ধ, গা গুলিয়ে উঠলো আবার!

তবু একপা একপা করে আসতে আসতে অন্বেষা এগিয়ে যেতে থাকলো ঘরের দিকে!
আজ জানতেই হবে সবটা!

যে মানুষটা কে নিয়ে অজান্তেই মন স্বপ্ন দেখে রোজ রাতে তার ঘরে উঁকিঝুঁকি করার জন্যে কারোর পারমিশন লাগে না!

রিরি নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে রয়েছে, হারাধন দা ভেতর থেকে কোনোদিনই বেড়োয় না এই সময়…..
তাই আজ এই রহস্য উদ্ঘাটন করার
পুরো সুযোগ রয়েছে তার কাছে!

কোনোমতে ওড়নাটা নাকে চেপে ধরে অন্বেষা এগোতে থাকলো অন্ধকার ঘরের দিকে……….

আলতো পায়ে চলতে চলতে অন্বেষা দরজার আরও একটু কাছে যেতেই গন্ধটা আরও গাঢ় হতে থাকলো!
হ্যাঁ এখন থেকেই বেরোচ্ছে গন্ধটা! কিন্তু কি ভাবে?

বুকের মধ্যে হৃদযন্ত্রটা তখন তখন প্রায় তিনগুণ গতিতে ধুকপুক করে চলেছে, এদিকে নাকটা চাপা, দম বন্ধ হয়ে আসছে, গা টা ভীষণ গুলিয়ে উঠছে বারবার……

2-Mercaptoethanol
না কি অন্য কিছু!
না তবে কি এটা organic সালফার?

অজান্তেই মনে মনে বলে উঠলো অন্বেষা, হ্যাঁ ঠিক গন্ধটা এবার মেলাতে পারছে অন্বেষা!
এটা কোনো ভ্যাপসা ড্যাম্প ঘরের গন্ধ নয়! এটা কোনো কেমিক্যাল এর গন্ধ!
ল্যাবে এরকম গন্ধ সে পেয়েছে অনেকবার, তবে কেমিক্যাল টা কি?

পচা মাছ বা ডিমের একটা গন্ধর মতন! আবার কখনো মনে হলো এটা পোড়া রাবারের গন্ধ…….

পা টিপে টিপে ঘরের সামনে এগোতেই আঁতকে উঠলো সে, দমবন্ধ হয়ে এলো অন্বেষার!

ঘরে কেউ একজন মাস্ক পরে এদিকওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘরে একটা হালকা আলোর আভা ও রয়েছে, খুব সম্ভব সেটা মোবাইল থেকে বেরোনো একটা ক্ষীণ আলো, সেই ক্ষীণ আলোতেই দরজার একটু ফাঁকা হওয়া অংশটা দিয়ে দেখতো পেলো অন্বেষা লোকটির ছায়ামূর্তি! ছায়ামূর্তির হাতে কি? ওরম একটা কৌটোর মতন!

নাহ! কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা ছোট্ট এইটুকু ফাঁক দিয়ে, তবে ছায়ামূর্তি যে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কৌটোতে হাত দিচ্ছে সেটা পরিষ্কার খুব!
কে এই ছায়ামূর্তি, কি করছে সে এরম একটা অন্ধকার ঘরে!

মুহূর্তেই অন্বেষা দেখলো ছায়ামূর্তি সব জিনিস পত্র গোছাতে শুরু করলো,
নিজের কাঁধে ঝোলানো Sling ব্যাগে,
দ্রুত ঢুকিয়ে নিলো কিছু জিনিস ওই ব্যাগটা তে!

আর তারপর এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে, আলমারির খোলার একটা ক্ষীণ শব্দ পেলো অন্বেষা, খুব আলতো স্পর্শে ছায়ামূর্তি খুব আসতে আসতে খুললো আলমারি…..
খানিকক্ষণ কেন আলমারি খোলা রইলো কিছুই বুঝলো না অন্বেষা!

তবে ছায়ামূর্তিকে আলমারির দরজা বন্ধ করতে দেখেই, অন্বেষা পা টিপে দ্রুত এগিয়ে চললো ডাইনিং এর বাঁকানো সিঁড়ির দিকে, একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এলো বোধহয়, বোধহয় এতক্ষণে বন্ধ হলো আলমারি,
অন্বেষা এবারে নাক থেকে ওড়না সরিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো সিঁড়ি বেয়ে রিতিকার(রিরির) ঘরের দিকে….

হঠাৎ নজরে এলো কেউ খুব দ্রুত গতিতে হুড়হুড় করে এগিয়ে গেলো ডাইনিং এর উল্টো প্রান্তর দিকে, ব্যক্তি টির মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস, পরণে একটা লাল টি শার্ট, ছিপছিপে চেহারা, কে উনি?
দোতলার করিডোর থেকে কিছুই বুঝলো না অন্বেষা….
খানিকক্ষণ রিতিকার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকলো অন্বেষা, গা টা এখনো গোলাচ্ছে খুব!

হৃদযন্ত্রটা একটু শান্ত হলে করিডোরে দাঁড়িয়েই গলাটা ভিজিয়ে নিলো ব্যাগে রাখা জলের বোতল বের করে!
ওড়নাটা দিয়ে কপালে জমে থাকা বিন্দুবিন্দু ঘামটা মুছে একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে!

আজ কিছুটা আঁচ করা গেলো, ঘরে কেন ভ্যাপসা গন্ধ বেরোয় এতো, তবে পুরো জিনিষটা বোঝা গেলো না পরিষ্কার করে..!
পুরো জিনিষটা বুঝতেই হবে – যেটা সে ভাবছে মনেমনে,, সেটা সত্যি হলেতো……..
……………………………………………………..
নাহ এতো ভেঙে পড়লে চলবে না, অনেক কাজ বাকি যে!

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রিতিকার ঘরের নবটা ঘুরিয়ে ঢুকে পড়লো অন্বেষা, রিতিকার ঘরে…..

ঠান্ডা ঘরে ঢুকতেই নাকে লেগে থাকা ভ্যাপসা গন্ধটা অনেকটাই কমে এলো,

রিতিকার দিক চোখ পড়তেই মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো কপালের ভাঁজটা!
ফুটে উঠলো ঠোঁটে একটা হালকা হাসির রেখা!

বাচ্চা মেয়েটা কে আজ কি মিষ্টিই না লাগছে!
একটা ঢলঢলে ফ্লোরাল টপ আর একটা কালো জিন্স!
পাতলা দুটো ঠোঁটে একটা হালকা গোলাপি
আভা! টানাটানা দুটো চোখে কাজল!

“রিতিকা! আজ এতো সেজেগুজে? আজ কিছু স্পেশাল বুঝি?”

“হ্যাঁ মিস! আজ ক্লাস শেষে আমিও যাবো তোমাদের সাথে…..”

“ওয়েস্টিন?”

“আমি তো জানিনা মিস দাদা বললো আমরা সবাই যাবো! ওখানে আরো অনেকে থাকবে না মিস?”

“হমম….থাকবে তো! আরও অনেকে থাকবে!”

“তুমি আমার সাথে বসবে মিস? দাদাভাই, আমি আর তুমি? আমি তো কাউকে চিনিনা…..”

অন্বেষার ঠোঁটে ফুটে উঠলো একটা ভালোলাগার হাসি…..
হাসি মুখেই আদর মাখানো সুরে বললো
“বেশ! ডান!”

“সত্যি?”

“সত্যি!”

“আজকে কিন্তু তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মিস!”

সত্যি এতকিছুর মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিলো আজ সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সেজে এসেছিলো মিস্টার রায় কে একবার সাজ দেখাবে বলে…..
“রিতিকা…..”

“হ্যাঁ মিস!”

“দাদাভাই কোথায়?”

“ও বললো একবার যেখানে খাওয়া হবে সেখানে গিয়ে সব একবার দেখে আসবে, অনেকগুলো টেবিল তো তাই একটু আগে থেকে গিয়ে বলে না আসলে যদি প্রব্লেম হয় তাই!
জানো মিস! এখন দাদাভাই আমার সাথে অনেক কথা বলে, আর এখন ওতো রেগেও থাকেনা আগের মতন!
তোমার সাথে বন্ধুক্ত হওয়ার পর দাদাভাই অনেক পাল্টে গিয়েছে মিস!”

অন্বেষা কিছু উত্তর দিলোনা রিতিকা কে! মনের মধ্যে একটা ভালোলাগার হাওয়া বয়ে গেলো আবার, তবে আজ যেটা দেখলো সেটা মনের মধ্যের ভালোলাগা টাকে উপভোগ করতে দিলোনা পুরোপুরি…..

“রিতিকা…..”

“হ্যাঁ মিস…বলো!” খাতা থেকে মুখ তুলে রিতিকা উত্তর দিলো…..

“বলছিলাম, আজকে তোমার একটা টেক্সট বুক আর রেফারেন্স বুক, ও স্কুলের খাতা আমি সব নিয়ে যাবো বাড়িতে…..
তুমি সব গুলো একটু ব্যাগে ভোরে তোমার ব্যাগ টা দিয়ে দিও আমাকে…….
আসলে আমার ভ্যানিটি ব্যাগে ওতো মোটা বই ঢুকবেনা…..

“কিন্তু মিস! কাল কে তো স্কুল আছে!”

“স্কুল শুরু হওয়ার আগেই দাদাভাই আবার সব পৌঁছে দেবে কেমন? আজকে তো এসে আর পড়তে বসবে না, পড়লেও অন্য কোনো সাবজেক্ট পড়বে কেমন?”

“ওকে মিস!”
***************************************************

ক্লাস শেষে ওরা দুজনেই দেখে নিলো নিজেদের রিতিকার ঘরের বিলাসবহুল
ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়….

রিতিকার ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে অন্বেষা ও রিতিকা নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে নীচে, কথা মতন মিস্টার রায় অপেক্ষা করছিলেন ডাইনিং এর সোফায়……

অন্বেষার দিকে চোখে
চোখ পড়তেই মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো সে, অন্বেষার পরণে আজ সিল্কের কালো কুর্তা ট্রাউসার সেট, কাঁধে একটা রানী কালারের সিল্কের ওড়না যার ওপর নিখুঁত সুক্ষ কাজ করেছে কারিগর সোনালী জরি দিয়ে….
চুলগুলো আজ পরিপাটি করে পাফ করে একটা পনিটেল করা পেছনে, টানাটানা দুচোখ আজ মেখেছে কাজল, লাইনার, ঠোঁটে বেশ গাঢ় লাল লিপস্টিক…..

“দাদাভাই! আমরা রেডি!” একগাল হাসি হেসে কথাটা শেষ করলো রিরি……

রিরির কথাতে মগ্নতা কাটলো মিস্টার রায়ের…..
এতক্ষণে অন্বেষার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে দেখলো সে রিরির দিকে, মৃদু হাসি হেসে বললো
“চল!”

গাড়ির চাবিটা নিয়ে দরজার দিকে এগোতেই অন্বেষা বলে উঠলো –
“মিস্টার রায়! Sorry, Sorry
আপনি প্লিজ গাড়িতে গিয়ে একটু ওয়েট করবেন, আমি আসলে…..
আসলে….
ওড়নার সেফটি পিনটা আসলে…..
মানে……”

অন্বেষার অসস্থি টা বুঝতে পেরে মিস্টার রায় বললো –
“নো প্রব্লেম অন্বেষা! আমরা গাড়িতে ওয়েট করছি…..তুমি এসো……”

মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হতেই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো অন্বেষার! একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে!

ওরা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেই দ্রুত পায়ে অন্বেষা ছুটে গেলো মিস্টার রায়ের ঘরের দিকে,
মুহূর্তেই লাগেই দিলো স্টোর রুমের ছিটকিনি, তারপর খুব আসতে খুলে ফেললো আলমারি,
আলমারির ডান দিকের রডে ঝোলানো ঠিক দুটো কোর্ট, বাঁ দিকের পোর্শানে বিভিন্ন সাদা শেডস এর ফর্মাল টি শার্ট রাখা ফর্মাল ব্লক কালো ট্রাউসারের ওপর, আর সাদা শার্টের ওপর ডিও, পাউডার, আফটার শেভ জেল, পারফিউম!
ঠিক এগুলোই খুঁজছিলো অন্বেষা…..

অন্বেষা কিচ্ছু ভাবনা চিন্তা না করেই মুহূর্তেই সমস্ত কসমেটিক দুহাত দিয়ে তুলে রাখলো সোফার ওপর, লাগিয়ে দিলো আলমারির দরজা, তারপর সেগুলো সব গুছিয়ে নিলো রিরির দেওয়া বইয়ের ব্যাগের ভেতর…….
তারপর আলো নিভিয়ে এগিয়ে গেলো সদর দরজার দিকে!

ঘর ছোট হওয়ার একটা বড়ো Advantage
হলো সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় জিনিস পত্র, মিস্টার রায়ের ঘরে কসমেটিক রাখার অন্য কোনো জায়গা নেই,
তাই সব কসমেটিক রাখা থাকে আলমারিতেই, গুছিয়ে রাখা শার্টের ওপর!
এমনিও মোটমাট পাঁচ সাতটা শার্টের ওপর কসমেটিক রাখার পরও আলমারির বেশির ভাগ অংশটাই ফাঁকা পরে……

আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে অন্বেষা এগিয়ে গেলো লাল গাড়িটার দিকে,
এগিয়ে যেতেই দেখলো আজও খালি তার সিট্, রিরি বসেছে গাড়ির ব্যাকসিটে……
একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণায়……

***************************************************

লাল গাড়ি সল্টলেকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো গন্তব্যের দিকে,
আজ গাড়ির কাঁচটা খোলা,
ফুরফুরে ঠান্ডা হওয়া বারবার স্পর্শ করছিলো ওদের!
ফুরফুরে হাওয়ায় মিস্টার রায়ের চুল আজ আবার অবাধ্য হয়ে নেমে এসেছে কপালে, মুখে একটা মৃদু হাসির রেখা…..

হাতদুটো রাখা স্টিয়ারিংয়ে,
হঠাৎ নীরবতা কাটাতে মিস্টার রায় বাঁ হাতে চালিয়ে দিলো FM, গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে তখন প্রেমের গানের প্রিলিউড বাজছে,
খানিকক্ষণের মধ্যেই সাউন্ড সিস্টেমে শোনা গেলো অরিজিৎ সিংয়ের আওয়াজ –

Tujhko… main rakh loon wahaan
Jahaan pe kahin
Hai mera yaqeen
Main jo… tera naa huaa
Kisi ka nahin…
Kisi ka nahin..
Le jaayein jaane kahaan
Hawayein, hawayein…
………………… ………… ……… ……

অন্বেষা গাড়ির লুকিং গ্লাসে দেখলো রিরির মুখের দুষ্টুমির হাসিটা, বিস্মিত চোখে সে চেয়ে আছে তার “অন্য” দাদাভাইয়ের দিকে!
সত্যি আজকের মিস্টার রায় তো একজন নতুন মানুষ……

“তাহলে! অন্বেষা…..
আজ তোমার সব মেকাপ unadulterated পিওর ফর্ম অফ কসমেটিক তো? নাঃ মানে প্যারাবেন, মার্কারি, লেড এসব লাগানোর কি দরকার? বি দা রিয়েল ইউ! ডোন্ট বি দা ফেক ইউ…..তাইনা?”
হাসি হাসি মুখে টিজ করে কথাটা শোনালো মিস্টার রায়…..

তবে অন্বেষাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় মোটেই, সেও বেশ খুনসুটির ভঙ্গিতে
বলে চললো –
“আপনি জানেন না মিস্টার রায়, আমি বানিয়েছি নিজের সব কসমেটিক, বাড়িতেই! এগুলো তে ওসব নেই তো!”

“তাই নাকি? তা আপনার ল্যাব টা কোথায়? কাকিমার পিজিতেই?”

“হ্যাঁ! কাকিমার পিজিতেই!”

“ওহঃ আচ্ছা আচ্ছা, তা বিছানার ওপর বসে বসে কসমেটিক বানানো হয় নাকি?”

মিস্টার রায়ের প্রশ্নের পাল্টা উত্তর দিতে না পারে এবারে তাই বেশ জেদি গলায় অন্বেষা বলে উঠলো –
“বেশ করেছি লাগিয়েছি! মাঝেমাঝে ঠিক আছে! হ্যাঁ প্রতিদিন ওসব লাগানো ঠিক নয়, তবে কখনো সখনো Okay!
নয়তো আপনার মতন নাকি শুধু সাদা জামা আর কালো প্যান্ট রোজ, পুরো আলমারি ভর্তি দুটোই রং, সাদা ও কালো!
এ ছাড়াও অনেক রং হয় পৃথিবীতে মিস্টার রায়!
ইভেন আজকেও আপনি সেই সাদা ……”

“এক সেকেন্ড!
আপনি কি ভাবে জানলেন এটা, যে আলমারিতে সাদা ও কালো রঙ ছাড়া অন্য কোনো রঙ নেই!”
বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন টা জিজ্ঞেস করলো মিস্টার রায়…..

ওহ! মুখ ফস্কে এটা কি ভাবে বেরিয়ে এলো, মনে মনেই ভাবলো অন্বেষা, আজ রাতে সে সবটা না হলেও কিছুটা বলবে মিস্টার রায় কে, তবে ব্যাপারটা কনফার্ম না হয়ে রিরির সামনে এসব আলোচনা করা একদম ঠিক নয়……

“মিস – সত্যি তো তুমি কি করে জানলে এটা?”

“এটার মধ্যে জানার কি আছে? আজ প্রায় বছর খানেক হতে চললো আমি চিনি তোমার দাদাভাই কে রিতিকা, আজ অবধি অন্য কোনো রঙ পড়তে দেখিনি তাকে! তাই অফ কোর্স আলমারিতেও শুধু সাদা কালো রঙের জামা কাপড়ই থাকবে তাই না?”

“গুড Analysis Madam!” হাসি হাসি মুখে বললো মিস্টার রায়….

*********************************************************

ওয়েস্টিনের ভেতরে ঢুকতেই অন্বেষা ও রিরির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো! বাইরে সিকিউরিটি ও ব্যাগ চেকিং সেরে ওরা উঠে গেলো হোটেলের দশ তলায়! দশ তলাতেই হোটেলের রেস্টুরেন্ট….
এই প্রথম ওরা কোনো পাঁচতারা রেস্তোরায় ডিনার করতে এসেছে, তাই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত খুশি!

রেস্তোরার কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ইকোপার্কের মাঠ……
ফাইন polished মার্বেলের মেঝে…..
সিলিং থেকে দেওয়াল নানা ভাবে ডেকোরেট করা……

সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত Ambience!
তারপর বুফেতে নানান রকমের খাবার সাজানো, নানান লাইভ কাউন্টার……
স্টার্টার, মেন্ কোর্স, ডেসার্ট Section!

অফিসের লোকজনের সাথে খানিক গল্প সেরে অন্বেষা ও তার স্টুডেন্ট বসলো গিয়ে এক টেবিলে, মিস্টার রায় যদিও বসবে একটু পরে, তখনও সে ব্যস্ত সবার সাথে কথাবার্তায়!

ইদানিং অন্বেষার সাথে মিস্টার রায়ের বেড়ে ওঠা বন্ধুক্তটা নজর এড়ায়নি কারোর,
নজর এড়ায়নি মিস্টার রায়ের একটু একটু করে বদলে যাওয়াটা!
ভালোই শুনতে হয় অন্বেষাকে এই বিষয়ে, তবে অন্বেষার বেশ ভালোই লাগে এইসব কথা!
মিস্টার রায়ের মনে কি আছে সম্পূর্ণ টা না জানলেও অন্বেষা এটা বোঝে – সে নিজে মানুষটার জীবনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একজন!
গুরুত্বপূর্ণ না হলে কি ঝড়বৃষ্টির রাতে মিস্টার রায় নিজের সবকথা গুলো বলতেন সেদিন!

মিনিট পনেরো পর প্লেটে একটু খাবার নিয়ে মিস্টার রায় বসলেন অন্বেষার পাশে….

“কি হয়েছে বলতো অন্বেষা তোমার?”

“কই কিছুনা তো মিস্টার রায়!”

“না অন্বেষা আজ তুমি একটু অন্যমনস্ক…..কি হয়েছে, ক্লামসি লাগছে, আমি এই জন্যে চেয়েছিলাম ওপেন টেরাসের রেস্তোরা তে….”

“একদমই ক্লামসি নয় এটা মিস্টার রায়! আমি ঠিক আছি তবে……”

“তবে কি?”

“আপনার সাথে দরকার ছিল একটু, আজকে রিরি কে….সরি রিতিকা কে…..”

“ইটস Ok! তুমি ওকে রিরি বলে ডাকতে পারো…..” একটা অনাবিল হাসির রেখা ফুটে উঠলো মিস্টার রায়ের ঠোঁটের কোণে…..
“সরি, টু ইন্টারাপ্ট, কি বলছিলে….আজকে রিরি কে…..”

“আজকে রিরি কে ছেড়ে আমায় ড্রপ দেবেন, কিছু পার্সোনাল দরকার ছিল!”

অন্বেষার কথা শেষ হতেনা হতেই ওরা দেখলো রিরির ঠোঁটে আবার সেই মুখ টিপে হাসার দুষ্টুমির হাসি…….

মিস্টার রায়েরও হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো খানিক রিরির মুখের হাসিটা দেখার পর!

“তবে রিরিরও মনে হয় তাহলে,
রিরির ও মনে হয় ব্যাপারটা শুধু আর আটকে নেই নিছক ভালোলাগায়…..
অহেতুক মিথ্যে স্বপ্ন দেখিনা আমি…..”
মনে মনেই কথাগুলো নিজেকে বললো মিস্টার রায়…..

অন্বেষার মনের মধ্যে তখন একটা অন্য ঝড় উঠেছে, সেই ঝড় কেটে না যাওয়া অবধি কিছুতেই বলা যাবেনা অন্য কোনো কথা…….
ভালোলাগার, ভালোবাসার কথাগুলোর থেকেও জরুরি আজকের কথাগুলো বলা!

ভাবতে ভাবতেই অন্বেষা আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো……

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here