পাতাঝরার শেষে……পর্ব ১৪

0
1339

পাতাঝরার শেষে
©মৌপর্ণা

পর্ব ১৪) Slow Poisoning!

“বাই মিস গুড নাইট…..”

“গুড নাইট রিরি!”

রিরিকে ড্রপ করেই লাল গাড়ি এগিয়ে চললো অন্বেষার গন্তব্যের নীল বাড়ির দিকে…..

“বলো অন্বেষা কি বলবে বলছিলে?”
হাসি মুখে প্রশ্ন করলো মিস্টার রায়…..

“মিস্টার রায়… ড্রাইভ করতে করতে আজকের কথাগুলো শুনবেন না! আজকের কথাগুলো খুব ইম্পরট্যান্ট! পারলে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা দাঁড় করান……”
খুব গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো অন্বেষা……

“ওকে!”
কথাটা শেষ হতেনা হতেই টার্নিং থেকে ডান দিক নিয়ে মিস্টার রায় গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিলো ফুটপাতের ধার ঘেঁষে….
গলাটা টা খানিক পরিষ্কার করে বললো –

“বলো অন্বেষা…..”

অন্বেষা কোনো কথার উত্তর দিলোনা, ভ্যানিটি ব্যাগের চেন খুলে বের করলো একটা সোনালী গিফট বক্স,
মিস্টার রায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো –

“এটা আপনার জন্যে কিনেছিলাম! অফিসের সবার সামনে দেওয়া হয়নি…..
আজও সবার সামনে দিতে পারলাম না”
কথাটা বলতে বলতে অন্বেষার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো নিমেষে…..

মিস্টার রায় এক দৃষ্টিতে চেয়ে তখনও অন্বেষার দিকে, একবার বলতে ভীষণ ইচ্ছে করলো যে কেন এনেছো, উপহারের কি দরকার ছিল ইত্যাদি,
তবুও বলে উঠতে পারলোনা সেটা, গলাটা শুকিয়ে এলো আবার!
গলার কাছে একটা খুশির কান্না আবার ভিড় করে আসছিলো একটু একটু করে…….
এর আগে কারণে অকারণে এরম উপহার দেয়নি কখনো কেউ, শুধু একটা সেতার ছাড়া – সেটাও ছিল এক বিজনেস ডিল……..

পূর্ণিমার আলোয় অন্বেষার দুটো চোখ আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে, তবে মুখের হাসিটা আজ কেন ফেকাসে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলোনা মিস্টার রায়,
কোনোরকমে নিজের আবেগ সামলে গলাটা পরিষ্কার করে মিস্টার রায় বলে উঠলো –

“আমি নেবো এটা, কেন এনেছো জিজ্ঞেস করবোনা,
কখনো কেউ এর আগে দেয়নি তো!
তবে তার আগে এটা বলো আজ তোমার কি হয়েছে? সত্যি করে বলো কি হয়েছে অন্বেষা! আজ তুমি কিছু একটা ব্যাপারে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ! কি হয়েছে?”

“মিস্টার রায়, একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?”

“বলো কি অনুরোধ?”

“না আগে কথা দিন আপনি রাখবেন!”

মিস্টার রায় কিছু বললোনা….
অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আবার অন্বেষার দিকে…..

“এতো অবাক হবেন না মিস্টার রায়! আমি বিজনেস ম্যান নই, এই উপহারের বদলে কোনো ডিল সাইন করবোনা! শুধু একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?”

“রাখবো! বলো!”

“আগামী সাতদিন আমি আপনাকে যখন যেটা বলবো আপনি তখন সেটা করবেন, তবে কোনো প্রশ্ন করবেন না! আমি যেটা করবো, সেটা আমি আপনাকে বলবো, আপনি শুধু শুনবেন আমি কি করছি, আপনি প্রশ্ন করবেন না”

“আমি কিচ্ছু বুঝলাম না অন্বেষা!”

“বোঝাচ্ছি!” বলেই অন্বেষা সিট্ বেল্টটা খুলে, অর্ধেক দাঁড়িয়ে পেছনে রাখা রিরির ব্যাগটা নিয়ে এলো সামনে, তারপর ব্যাগ থেকে একে একে বের করলো মিস্টার রায়ের কসমেটিক – পারফিউম, ডিও, পাউডার, আফটার শেভিং Gel…..
রাখলো ওগুলো নিজের কোলে….

মিস্টার রায় বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অন্বেষার দিকে…..

“অন্বেষা এগুলো তো….”

“হ্যাঁ! এগুলো আপনার…..
আমি এগুলো রিরির দেওয়া বইয়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম!
যখন আপনাদের গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম তখন!
আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেননি তখন, যে একটা ব্যাগ ব্যাক সিটে রেখে আমি সামনে বসেছিলাম……”

“কিন্তু কেন?”

“আমার কিছু জিনিস চেক করার আছে, এগুলোতে কিছু মেশানো আছে মিস্টার রায়, তবে আমি আপনাকে আজই কিছু বলতে পারবোনা, আপনি বাজার থেকে এগুলো আবার কিনে নেবেন, আর অতি অবশ্যই ঘরের দরজা ও আলমারি সবসময় বন্ধ করে বেরোবেন! এর চেয়ে বেশি কিছু আপনাকে এই মুহূর্তে বলতে পারবোনা আমি!”

“কি মেশানো আছে? অন্বেষা? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা!”

“আপনি আমাকে এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না আগামী পাঁচ সাত দিন! কথা দিন…….
প্লিজ মিস্টার রায় কথা দিন আমাকে…..
আগামী পাঁচ সাত দিন আমি যা বলবো আপনি কোনো প্রশ্ন ছাড়া আমার কথা শুনবেন!”

“কিন্তু অন্বেষা হঠাৎ ……”

“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন মিস্টার রায়?
একটা বিশ্বাস ছাড়া একটা বন্ধুক্ত গড়ে ওঠেনা, একটা বন্ধুক্ত ছাড়া ভালোবাসা গড়ে ওঠেনা মিস্টার রায়!”

“ভালোবাসা” শব্দটা শুনেই মিস্টার রায়ের বুকের ভেতরের হৃদযন্ত্র টা আবার দ্বিগুন গতিতে ঢিপঢিপ করতে শুরু করলো!
একটুকরো ভালোবাসা হোক বা বন্ধুক্ত কোনোটাই তার পক্ষে আর
হারানো সম্ভব ছিলোনা…..
তাই মুহূর্তেই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো –
“বিশ্বাস করি আমি তোমাকে! তুমি যা বলবে তাই হবে, শুধু আগামী সাত দিন নয়, জীবনের প্রতিটা দিন……”

মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হতেই অন্বেষার মুখে ফুটে উঠলো স্বস্তির হাসি….
স্বস্তির একরাশ হাসি মুখ নিয়ে বলে উঠলো সে – “Thank You!”

“খুশি তো এবার?” আলতো ভেজা গলায় প্রশ্ন করলো মিস্টার রায়…..

“হমম….খুব খুশি!”

“এবারে গাড়িটা স্টার্ট দি? এগারোটা বাজতে দশ! কাকিমা আজ আবার ধুলাই করবে তোমার!”

“না আজ বলে এসেছি, ফিরতে দেরি হবে!”

“ওকে! তাও ভালো!”

“মিস্টার রয় আপনার কাছে প্লাষ্টিক হবে একটা?”

“হ্যাঁ আছে তো! সিটের পেছনের চেনে আছে, দেব?”

“না এখন নয়, নামার সময় দেবেন! আসলে রিরির কিছু বই এনেছিলাম ব্যাগে! মানে বই না নিয়ে খালি ব্যাগ তো চাইতে পারছিলাম না তখন! তাই ওই বাচ্চা মেয়েটাকে মিথ্যে বলে ব্যাগ আর বই দুটোই নিলাম! কাল ওর স্কুল আছে তো! আপনি আমাকে প্লাস্টিক দিলে আমি ওর মধ্যেই সব ভোরে নেবো…..”

“বুঝলাম! স্মার্ট! তবে আমাকে কি একটুও বলা যাবেনা আজকে হঠাৎ করে তুমি কেন….”

“আপনি কিন্তু রুলস ভাঙছেন মিস্টার রায়!”

“Oops Sorry!”

***************************************************

রাত দেড়টা….

অন্বেষার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না আজ! কাল অফিস ম্যানেজ করে একবার সবার নজর এড়িয়ে স্যাম্পেল নিজে হাতে টেস্ট করতে হবে ল্যাবে….
ক্রস চেকিং এর জন্যে একবার সৌগত কে বলতে হবে! একা একা টেস্ট করে কিছু কনক্লুড না করাই ভালো!

ঘুম না আসার কারণেই অন্বেষা আবার তুলে নিলো ফোন, আনমনেই ফেসবুকের পাতা স্ক্রল করে চললো,
আজকে অফিসের সবাই ভুরিভুরি ছবি আপলোড করেছে ফেসবুকে, রুশার প্রোফাইলে একটা ছবি দেখে বন্ধ হলো স্ক্রল করা!

ছবিটা তে ওরা তিন জন – অন্বেষা, রিরি ও মিস্টার রায়,
ছবিটা তোলার সময়
হাসাহাসি করছিলো ওরা নিজেদের মধ্যে, কেউ কোনো Pose দেয়নি, সে চিজ বলে নি, অথচ ছবিটা অন্বেষার জীবনের সেরা ছবি হয়ে রইলো অন্বেষার মনেমনে!

মুহূর্তেই ছবিটা ডাউনলোড করে নিলো অন্বেষা গ্যালারি তে! তারপর ছবিটা জুম করে একবার স্পর্শ করলো মিস্টার রায় কে স্ক্রিনের ওপর থেকেই! অজান্তেই ফুটে উঠলো হাসি…..
হঠাৎই বেজে উঠলো ফোন – একিই এতো রাতে মিস্টার রায়!

অকারণ খুশিতে হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে, হাতটাও কাঁপছে একটু একটু!

কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে খুব নীচু গলায় অন্বেষা বললো –
“হ্যালো মিস্টার রায়! এতো রাতে…”

“এই অন্বেষা স্কাইপ আছে ফোনে?”

“হ্যাঁ কেন?”

“ভিডিও কল করবো!”

“মিস্টার রায় এতো রাতে?”
ফিসফিস করে বলে উঠলো অন্বেষা…..

“কেন…..কটা বাজে…..ওহঃ! দেড়টা বাজে নাকি এখন? ওহ! Sorry …..তুমি ঘুমোচ্ছিলে না? Sorry Sorry
ইসস ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম, আচ্ছা রাখছি কাল কথা হবে…..”

“মিস্টার রায়! ওয়েট? উউফ আজকাল আপনি এক নিঃশ্বাসে কত কথা বলেন! ওয়েট!”

“Ok Sorry Sorry”

“ওঃ! আবার Sorry বলার কি হলো, কি বলছিলেন বলুন? স্কাইপ আছে আমার ফোনে….. ”

“ভিডিও চ্যাট করতাম!”

“এখন?”

“হমম”

“খুব দরকার?”
ফিসফিস করে বলে চললো অন্বেষা……

“নাহ! খুব দরকার ছিলোনা….তবে…”

“কল করছি! তবে আমার ঘরে লাইট অফ কিন্তু! এখন লাইট জ্বালালে রিয়া দির ঘুমে ডিস্টার্ব হবে, চলবে?”

“দৌড়োবে! কল করি? আইডি টা বলবে?”

“সেম ইমেল….”

“কল করছি এক্ষুণি…..”

“ওকে আমি ইয়ারফোন কানেক্ট করছি!”

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ভিডিও কল রিকোয়েস্ট এলো অন্বেষার ফোনে, রিকোয়েস্ট Accept করতেই অন্বেষা দেখলো মিস্টার রায়ের হাতে মাউথঅর্গান টা – যেটা আজ নিজে হাতে সে সোনালী গিফট wrapper এ মুড়ে দিয়েছিলো মিস্টার রায় কে!

“হ্যাঁ শুনতে পারছো? স্ক্রিন দেখতে পারছো? ”

“হ্যাঁ! পারছি!”
কথাটা বলতে বলতে অন্বেষা মগ্ন হয়ে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে! মিস্টার রায়ের ফোনটা টেবিলে একটা বইয়ের সাপোর্টে দাঁড় করানো খুব সম্ভত, মিস্টার রায় বসে দেওয়ালে সাঁটানো চেয়ারে!
ভিডিও চ্যাটের নীচের দিকে একটা ছোট্ট চৌকো বাক্সে, একটা ক্ষীণ আলোয় অন্বেষা নিজের অস্পষ্ট মুখটা দেখতে পাচ্ছিলো……

“অন্বেষা! Thank You শব্দটা আজ খুব ছোট পড়ছে…..
আজ জানো ভীষণ নস্টালজিক লাগছিলো এটা দেখার পর!”

অন্বেষা দেখলো মিস্টার রায়ের চোখের কোলে জমেছে বিন্দু বিন্দু জল!
ভাঙা ভাঙা গলায় বলে চললো মিস্টার রায় –
“ছাড়ো এসব নস্টালজিক কথা বলে সময় নষ্ট হবে! একটা কভার শোনো…..”

গলাটা একটু পরিষ্কার করে, একটা ঢোক চিপে মিস্টার রায় বলে চললো –
“যেটার জন্যে কল করেছি! আজ অনেকদিন বাদে বাজালাম জানো! দাঁড়াও ফ্যান টা অফ করি, নয়তো ক্লিয়ার শুনতে পাবেনা…..”

“ফ্যান অফ করলে গরম লাগবে তো!”

“কোনো ব্যাপার নয়!”
বলেই মিস্টার রায় ফ্যান টা বন্ধ করে মুহূর্তেই দুহাতে ধরে থাকা মাউথঅর্গান টা ছুঁইয়ে দিলো গোলাপি দুটো ঠোঁটে!

তারপর বেজে উঠলো সুর……
বেজে উঠলো “Aaoge Jab Tum Sajna”
গানটার প্রিলিউড…..

অন্বেষা মুগ্ধ হয়ে হারিয়ে গেলো সুরে…..
গরমের কারণে মিস্টার রায়ের কপালে জমছিল বিন্দু বিন্দু ঘাম…..
বিন্দুবিন্দু ঘামে কপালের সামনের দিকের চুলগুলো ভিজে যাচ্ছিলো,
তবুও সে তখন সব ভুলে মত্ত মাউথঅর্গান টাতে!

সাধারণ মাউথঅর্গান টা তখন অসাধারণত্ব
লাভ করেছে মিস্টার রায়ের ঠোঁট ও হাতের স্পর্শে……..
মিস্টার রায়ের সুরে এক অদ্ভুত মায়া আছে!
এক অদ্ভুত পবিত্রতা!

কেমন যেন করে ওঠে অন্বেষার মনের ভেতরটা মিস্টার রায়ের বাজানো সুর শুনলে –
তা সেতার হোক বা মাউথঅর্গান!

***************************************************

ঠিক ছয় দিন পরের কথা…….
আজ দিনটা শনিবার…..

ছয় দিন হয়ে গেলো অন্বেষা এখনো কিছু বলেনি মিস্টার রায় কে সেই আগের দিনের বিষয়ে…..
মিস্টার রায় ও জিজ্ঞেস করেনি অন্বেষা কে কিছু!
সে যে কথা দিয়েছে সে অন্বেষার সব কথা শুনবে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই…..

আজ সকাল থেকে কথা হয়নি একবারও অন্বেষার সাথে, আর বোধহয় সেই কারণেই মনটা বেশি ছটফট করছিলো মিস্টার রায়ের!

ঘন্টা দুয়েক আগে সকাল নটা নাগাদ একবার ফোন করেছিল সে অন্বেষা কে,
অন্বেষা বললো ব্যস্ত তাই একেবারেই কথা বলতে পারবেনা ….
আজ তো অফিস ছুটি!
আজকে কি ব্যস্ততা কে জানে?
অন্য ছুটির দিন গুলোতে তো কথা বলে আজকাল! তবে আজ কি হলো?

শনিবারের দুপুরটা বড্ডো দীর্ঘ লাগে আজকাল মিস্টার রায়ের!
রিরিও ব্যস্ত থাকে পুরো শনিবার – ফিটজির ক্লাসে…….
আজকাল আর ডাইরি লিখতে, চুপচাপ একলা ঘরে বসে থাকতেও ভালো লাগে না মিস্টার রায়ের!
গত এক দেড় মাসে পাল্টে গিয়েছে এই অভ্যেস, যবে থেকে অন্বেষা তার জীবনে এসেছে, পাল্টে গিয়েছে তার জীবনের অনেকটা…..

তাই অন্বেষার কথা মতন নিজের ঘুপটি ঘরে তালা লাগিয়ে সে
এগিয়ে গেলো বাগানের দিকে!

হঠাৎই বেজে উঠলো পাঞ্জাবির পকেটে রাখা ফোন টা….
স্ক্রিনে অন্বেষার নম্বর…..
ফোনটা তুলে কানে দিতেই অন্বেষা বলে উঠলো –
“মিস্টার রায় আপনি এক্ষুণি অফিসের কেমিস্ট্রি ল্যাবে আসুন! রাইট নাও….”

“কি হয়েছে অন্বেষা? তুমি কাঁদছো? কি হয়েছে?

“আপনি এক্ষুণি আসুন না!” কাঁদোকাঁদো গলায় বলে চললো অন্বেষা…….

মিস্টার রায় মুহূর্তেই বেরিয়ে গেলো গাড়ি নিয়ে অফিসের দিকে……
রাস্তাতে আরও দুবার ফোন এলো অন্বেষার……

অন্বেষার অধৈর্য্য গলার আওয়াজ আরও অস্থির করে তুলছিলো মিস্টার রায় কে…..

যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ড্রাইভ করে মিস্টার রায় পৌঁছলো অফিস, তারপর গাড়ি পার্ক করে হনহন করে এগিয়ে গেলো ল্যাবের দিকে…….

ল্যাবে ঢুকতেই দেখলো অন্বেষার দুটো চোখ কেমন যেন ছলছল করছে,
সৌগত কিছু একটা বুঝিয়ে চলেছে অন্বেষা কে!

মিস্টার রায় কে দেখেই সৌগত উঠে দাঁড়ালো সিট্ থেকে!

অন্বেষা তখনও চোখ ফিরিয়ে বসে আছে টেবিলে…..

“অন্বেষা কি হয়েছে?”

“আপনার শরীরে সমস্যা হয়না মিস্টার রায়? খেতে গিয়ে গলায় আটকে আসে মাঝে মাঝে, বুকে ব্যাথা করে, দম বন্ধ হয়ে আসে? মাঝেমাঝে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়?”

“হ্যাঁ!!! হয় এগুলো!!!!
তুমি কি করে জানলে? সব একসাথে হয়না! কখনো কখনো সমস্যাটা বাড়ে….
আবার কমে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হয় কখনো কখনো! আবার কখনো কখনো সব একসাথে হয়……”

“আর সেটা আমাকে আজকে বলছেন? এতো ক্যাজুয়াল কি করে হতে পারেন আপনি? কি করে?”
বিভীৎস্য
জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকলো অন্বেষা!

মিস্টার রায় কিছু বলার আগেই চিৎকার
আরও বেড়ে চললো অন্বেষার….
সৌগতর ক্ষীণ একটা আওয়াজ ভেসে আসছিলো মিস্টার রায়ের
কানে……
“অন্বেষা! এতে মিস্টার রায়ের কি দোষ? প্লিজ রিয়াক্ট করিসনা….”

অন্বেষা তখনও বলে চলেছে চিৎকার করে –
“আমায় সবটা বলা যায়, রাতে ভিডিও কলে মাউথঅর্গান বাজিয়ে শোনানো যায় আর এটা বলা যায়না শরীরে অস্বস্তি হয় মাঝেমাঝে!
এই তোমার রিরির প্রতি ভালোবাসা, তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে কে দেখবে রিরি কে!
আর কি বলেছিলে তুমি abnormally
হাই IQ…………….হ্যাঁ!
You Have No IQ at all! 0 IQ…..
মিস্টার রয়!

অন্বেষা কে ওরম অস্থির দেখে মিস্টার রায়ের দুচোখ বেয়ে নেমে আসে জল! খুব আলতো হাতে স্পর্শ করে অন্বেষার দুটো কাঁধ! তারপর খুব মৃদু স্বরে বলে –

“কি হয়েছে? এরম পাগলের মতন কেন করছো তুমি? হমমম…..”

অন্বেষা একটু শান্ত হয়ে চেয়ে থাকে মিস্টার রায়ের চোখ দুটোর দিকে…..
তারপর কাঁধ থেকে মিস্টার রায়ের হাতটা সরিয়ে বসে পরে চেয়ারে……
এবারে নীচু গলায় বলে – “সৌগত! তুই বল সবটা! আমার ভালো লাগছেনা কিছু!”

এদিকে ক্রমাগত মিস্টার রায়ের হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে, অন্বেষা কেন এতো React
করছে, তবে কি মারাত্ত্বক কিছু হয়েছে…..

সৌগত খুব শান্ত গলায় বলে চলে –
“মিস্টার রায় বসুন! প্লিজ বসুন!
অন্বেষা একটু বেশি React করছে, অবশ্য করারই কথা, ও আপনাকে একটু বেশিই ভালোবাসে!”

মিস্টার রায় অবাক চোখে চেয়ে দেখে অন্বেষার দিকে!
ভালোবাসে! কই বলেনি তো!
শেষ দিন তো ভালোলাগার কথা বলেছিলো! দুটো কি এক?
যে মেয়েটা একটু আগে বিভৎস্য রকমের চিৎকার করছিলো, সে এখন শান্ত হয়ে চোখের জল মুছছে হাতের তালু দিয়ে….
এতো ভালোবাসে? কবে থেকে?

সৌগতর আওয়াজে আবার মগ্নতা কাটলো মিস্টার রায়ের….
“মিস্টার রায়, তো যেটা বলছিলাম, গত সোমবার অন্বেষা আমাকে এসে বলে কিছু সাম্পেলের টেস্ট করতে হবে, অবশ্যই সেটা আমাদের অফিস ওয়ার্ক নয়, ও নিজে আপনার আলমারি থেকে আনা কিছু কসমেটিকের টেস্ট করতে চায়,
ও কাউকে একটা দেখেছে, লুকিয়ে দেখেছে, আর খানিকটা প্রেডিক্ট করেছে যে কেউ আপনার কস্মেটিকে কিছু মেশায়……

প্রথমে আমার মনে হচ্ছিলো সবটাই ওর মনের ভুল!
এদিকে আমাকে রোজ বলে একদিন সময় বের কর!
লাস্ট ছয় দিন কিছু টেস্টিং কীট ছিলোনা ল্যাবে, ইনফ্যাক্ট বাইরের মার্কেটেও
পাওয়া যাচ্ছিলোনা…….
কাল রাতে আমি জোগাড় করি টেস্টিং মেটেরিয়াল…
আর তারপর আজ সকালে যেটা পাই….
সেটা হলো……
কেউ আপনার কিছু জিনিসে
একটা হার্মফুল কেমিক্যাল মেশাচ্ছে নিয়মিত…..
কেমিক্যাল টা কালারলেস, জলেও গোলে, তবে গন্ধ থাকে প্রচন্ড……..
একটা ভ্যাপসা মতন গন্ধ পচা ডিমের মতন……
তবে অন্য কেমিক্যালের সাথে মিলিয়ে তার গন্ধ অনেকটাই কমানো যায়!
এবারে সেই মেশানো কেমিক্যাল টা ডাইরেক্ট আপনাকে দিলে আপনি হয়তো বুঝতে পারতেন কিন্তু যদি আমি কেমিক্যাল টা আপনার পারফিউমে মেশাই…..
তাহলে আপনি ধরতেও পারবেন না!”

“ধরতে পারতেন যদি ওনার মাথায় বুদ্ধি থাকতো সৌগত!” অন্বেষা আবার বলে উঠলো রুক্ষ গলায়……

“আঃ! অন্বেষা তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই কেমিস্ট! উনি নন!”

“তাতে কি? ওই ঘরে মাঝে মাঝে Raw কেমিক্যাল টা পড়তো মেশানোর সময়….. ১০০ পার্সেন্ট পড়তো! তাই তো ওরম ভ্যাপসা গন্ধ বেরোতো…..
আমি দু চার দিন ঢুকেই ওই গন্ধ পেয়েছি…..আর উনি রোজ থাকেন….ওনার সেন্স নেই? ছাড়….. তুই বল সবটা….” অন্বেষার গলাটা ভেঙে আসে আবার

“মিস্টার রায় যেটা বলছিলাম আপনাকে….
অন্বেষার কথা আমি বিশ্বাস করিনি আগে….
আসলে অন্বেষাও ভেবেছিলো হয়তো মাইল্ড ইউস করা হয়েছে কেমিক্যাল বা হয়তো ওর মনের ভুল!
আসলে মিস্টার রায় যতটা পার্সেন্ট আমরা পেয়েছি বিশেষ করে পারফিউমে, সেটার একটা মারাত্মক Effect
থাকতে পারে আপনার শরীরের ওপর, আপনার Organs এর ওপর, বিশেষ করে রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট হেভিলি ইমপ্যাক্ট হয়, তবে এটা মোস্টলি Curable!
…….
এমনকি কেমিক্যাল টা আফটার শেভ Gel
এও আছে অনেকখানি…..
ডিও তে নেই – প্রবাবলী ডিওর ঢাকনা টা খুলতে পারেনি খুব সম্ভবত!
পাউডার টা শুকনো তাই তরল পদার্থ ওতে মেশানো একটু শক্ত!
মিস্টার রায়, অন্বেষা আমাকে বলেছে আপনার নাকি মনে হয় মানসিক চাপের কারণে আপনার এই বুকে ব্যাথা, নিঃশ্বাসে কষ্ট হওয়া এগুলো হয়, কিন্তু ব্যাপার টা মানসিক নয়, শারীরিক!
শুধুশুধু কাউন্সিলিং না করিয়ে একটা ভালো ডাক্তার দেখান! আপনি এরকম নিজে থেকে কি ভাবে ভাবলেন সমস্যা টা মানসিক?”

“না না! আমি ভাবিনি এটা মানসিক! প্রথমে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, ইমেজিং, এক্সরে আরও অনেক ধরণের ওরা টেস্ট করিয়েছিলো, তখন তো রিপোর্ট ক্লিন ছিল! তারপর সমস্যাটা রেগুলার নয় জানতো…
মানে মাঝেমাঝে বাড়তো…”

“হমম…. যখন আপনি পারফিউম বা আফটার শেভ টা ফ্রিকোয়েন্ট ইউস করতেন তখন……শীতকালে অন্য কোনো তরল পদার্থ ইউস করেন?”

“নাঃ মানে আমি ক্রিম বেসড জিনিস ইউস করি, মানে সেটা তরল নয়…..”

“গুড! খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো, আপনার কি মনে হয়, কবে থেকে এসব চলছে? বা আপনার এই মাঝেমাঝে Symptoms গুলো?”

“বছর খানেক হবে গো সৌগত!”

মিস্টার রায় কথাটা শেষ করতেই অন্বেষার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো
আবার চাপা কান্নার আওয়াজ…..

“অন্বেষা! এই অন্বেষা! আরে বাবা রোজ হয়না তো সমস্যা টা…..
আমি দেখিয়ে ছিলাম বিশ্বাস করো, ENT
হার্ট স্পেশালিস্ট!
সব ধরণের টেস্ট, স্ক্যান করে বললো ঠিক আছি…
বললো মানসিক কারণে হয়, গ্যাস্ট্রিক থেকে হয়, বা ঠান্ডা লেগে ওরম নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধে হয়!
তারপর ENT তো কতবার গলা চেক করলো, টেস্ট করাতে দিলো,
বললো সব চেক করে নেওয়াই ভালো….. কোনো খারাপ কিছু হয়েছে কিনা….

কিন্তু সব রিপোর্টস ক্লিন! ট্রাস্ট মি!
তবে হ্যাঁ আজ একটা বড়ো সমস্যার সমাধান করলে তোমরা!
আমি মাঝেমাঝেই ভাবতাম কি না কি হয়েছে, অথচ দেখো সামান্য একটা কেমিক্যাল Effect!

“সামান্য? আপনার কোনো আইডিয়া আছে মিস্টার রায়…..
ল্যাবে সেরকম কোনো স্পেশাল দরকার ছাড়া ওই কেমিক্যাল আমরা ইউস করিনা! আপনি জানেন এটা?
কতদিন আগে করিয়েছিলেন টেস্ট গুলো?
আর আমি অবাক হচ্ছি একটা ব্যাপার ভেবে আপনার কোনো হেলদোল নেই এটা ভেবে যে কে করছে আপনার সাথে এটা?

“না আসলে এর আগেও তো ভুল ওষুধ…মানে হতে পারে…..মানে ……আমি ভাবছি…..তবে…..”

“প্লিজ! ছাড়ুন মিস্টার রায়! প্লিজ বাদ দিন! কতদিন আগে করিয়েছিলেন টেস্ট গুলো?”

“তাও মাস ছয়েক হবে……”

সৌগত খুব ঠান্ডা গলায় বললো –
“মিস্টার রায়, অন্বেষা রিলাক্স ওকে?
আমি বলি কি এতো ডাউট না করে আজ একটা এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কনসাল্ট করে নে! তাহলেই তো ঝামেলা শেষ!
অন্বেষা প্লিজ মন খারাপ করিস না, কিছু
হবেনা!
সেরকম মেজর ইমপ্যাক্ট থাকলে আরও শরীর খারাপ থাকতো, আমি যদি খুব ভুল না হই মিস্টার রায় খুব বেশি ওই পারফিউম বা আফটার শেভ
ইউস করেনা, আর তাতেই খানিকটা বেঁচে গিয়েছে……”

“জানিরে সৌগত! তবে পুরো ব্যাপারটা তো slow poisoning
যেকোনো দিন একটা মেজর attack
হলে আর বাঁচানো যাবেনা!”

“হমম সে তো নিশ্চই……
কিন্তু এখন তুই আছিস তো? মিস্টার রায়ের সাথে! শোন না, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, এবারে তোরা দুজনে একটা appointment
নিয়ে একবার ওভারঅল সব কিছু চেকাপ করে নে, বেশি নেগেটিভ ভাবিস না, অল্প কিছু ইমপ্যাক্ট থাকলেও ঠিক হয়ে যাবে সব…..
আর আগে ট্রিটমেন্ট টা শুরু হোক, এসব কে করছে না করছে সেসব না হয় পরে ভাবা যাবে!
আমি পুরো সিওর সেরকম ইমপ্যাক্ট থাকলে অনেক রকমের অস্বস্তি হতো শরীরে! Symptoms যখন খুব Occasional
, তখন বেশি নেগেটিভ ভাবিস না এন্ড মিস্টার রায় প্লিজ কেয়ারফুল থাকবেন!

“হমম থাকবো!”

“Thank you সৌগত! তুই হেল্প না করলে ভাই…..”

“ইটস ওকে অন্বেষা! এসব বলে আমাকে ছোট করিস না প্লিজ…..
চল এবারে আমি বেরোই কেমন! সব ঠিক থাকবে, ডোন্ট ওয়ারি ……
মিস্টার রায় বাই…..”

“বাই…”

সৌগত ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেলে, মিস্টার রায় অন্য একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো অন্বেষার পাশে……
তারপর তার বাঁ হাতের কনিষ্ট আঙ্গুল
দিয়ে খুব আলতো একটা ছোট্ট স্পর্শ করলো অন্বেষার ডান হাতের কনিষ্ট আঙ্গুল কে!
আলগা একটা আঙুলের ছোট্ট স্পর্শ তেই এক মুহূর্তের জন্যে বিদ্যুৎ খেলে গেলো অন্বেষার শরীরে, অন্বেষা চেয়ে দেখলো মিস্টার রায়ের দিকে,
এতক্ষণে অন্বেষা দেখলো মিস্টার রায়ের ভেজা চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করছে আজ……
যেন আজকের চোখের জলটা শুধু
দুঃখের নয়, একরাশ ভালোলাগারও!

“সৌগত যা যা বললো, সব সত্যি বললো বলো? মানে সব যা যা বললো!”
আদুরে গলায় প্রশ্ন করলো মিস্টার রায়…..

অন্বেষার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো নিমেষেই,
সে খুব ভালো করে জানে মিস্টার রায় এক্সাক্টলি কি জিজ্ঞেস করছে তাকে!

কোনো উত্তর দিলো না অন্বেষা, ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে খুব ভালো করে মুছে নিলো পুরো মুখটা একবার, তারপর খোলা চুলগুলো কে শক্ত করে জড়িয়ে, ব্যাগ থেকে ক্যাচার বের করে লাগিয়ে দিলো চুলে…..

মিস্টার রায় তখনও এক দৃষ্টিতে চেয়ে অন্বেষার দিকে! খুব আলতো মৃদু স্বরে সে আবার বলে উঠলো
“বলো না অন্বেষা সৌগত তখন যে কথাটা…”

“এসব আলোচনা পরেও করা যাবে মিস্টার রায়!
এখন আমি যেটা বলবো আপনি সেটা করবেন, আজকেই বিকেলের একটা এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিচ্ছি, একবার ওভারঅল চেকআপ না করলে পুরো ইমপ্যাক্ট বোঝা যাবেনা……
এখন ওভাবে আমার দিকে চেয়ে না থেকে চলুন, আমাকে খিটখিটে কাকিমার বাড়ি ছেড়ে দেবেন…….
অনেকটা দেরি হয়ে গেলো…..
ভালো লাগছে না!
স্নান হয়নি….উউফ! আবার গিয়ে স্নান করতে হবে!”

“কিছু খেয়েছো সকাল থেকে?”

“না! সেরকম কিছু খাইনি….”

“দুপুর সাড়ে বারোটা অবধি না খেয়ে আছো, চলো আজকে দুজনে বাইরে কোথাও লাঞ্চ করি, বা ব্রেকফাস্ট, বা…..”

“আজ নয়, অন্য কোনোদিন, আজ সত্যি অনেক কাজ!”

“বেশ তাহলে চলো বাইরের ক্যাফে টাতে, চা, বিস্কিট, কেক খেয়ে নাও, প্লিজ না বলোনা! দশ মিনিট তো লাগবে….
চলোনা……”

“ওকে…..বাবা ……চলুন…..যাচ্ছি ….”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here