পাতাঝরার শেষে
©মৌপর্ণা
পর্ব ১৫) ফার্স্ট ডেট!
**************পাঁচ দিন পর**************
অন্বেষা হনহন করে এগিয়ে গেলো মিস্টার রায়ের ক্যাবিনের দিকে!
“অন্বেষা ম্যাডাম আপনি দাঁড়ান, আমি একবার স্যার কে ইন্টারকমে কনফার্ম করে নি….”
দ্রুত কথাটা শেষ করলো অভয় বাবু…
“আপনি ওনাকে ফোন করে বলুন, উনি না বললেও আমি যাচ্ছি….”
“ম্যাডাম…….শুনুন…..ম্যাডাম….”
কোনো নক ছাড়া মিস্টার রায়ের ক্যাবিনের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকলো অন্বেষা, পেছন পেছন ঢুকলো অভয়…..
অন্বেষা মুহূর্তেই গিয়ে বসে পড়লো মিস্টার রায়ের সিটের সামনে…..
অভয় বাবু নীচু গলায় বলে চললেন
“স্যার! উনি জোর করেই….”
“ইটস ওকে অভয়, তুমি যাও…..”
অভয় ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই অন্বেষা বেশ দৃঢ় গম্ভীর গলায় বলে চললো –
“আপনি কি শুরু করেছেন বলুন তো মিস্টার রায়?
নিজে আমার কথা শুনছেন না!
নিজে নিজের মতন থাকবেন, তো থাকুন না, আমাকে কি প্রয়োজন?
কাল সারা রাত ধরে প্রায় একশো টেক্সট করেছেন! তারপর আজ সকালে Sorry
গ্রিটিংস কার্ড, ফুল…..
পুরো অফিস জেনে গিয়েছে!
কেন করছেন এগুলো? এরকম পাগলের মতন কেন করেছেন?”
“কারণ তুমি কথা বলছো না!
তোমার সব কথা তো শুনলাম বলো,
সমস্ত চেকাপ করালাম, ডাক্তার কনসাল্ট করলাম, মেডিসিন নিচ্ছি, ডাক্তার তো বললো সব ঠিক হয়ে যাবে……Minimal Effect !
সেরকম কিছু হয়নি তো!
সব যখন ঠিক হয়েই গিয়েছে কেন এরকম কথা বন্ধ করে দিয়েছো তুমি? প্লিজ অন্বেষা……”
“না মিস্টার রায়, সব ঠিক হয়নি…..
একটা ঝড় কেটে গিয়েছে, ব্যাস!
ওই লোকটার বিরুদ্ধে আপনি কোনো স্টেপ নেবেন না? এখনো আপনি চুপচাপ বসে থাকবেন! তাইতো?
এমনকি আপনাকে সবটা বলার পরও আপনার বিন্দু মাত্র কৌতহল নেই কে এটা করছে সেটা জানার?”
“কে প্ল্যান করবে অন্বেষা? বাড়ির কেউই হবে! কি হবে জেনে? হয়তো এই প্ল্যানটা তে ওরা সবাই মিলিত! মানে জেঠিমা, শঙ্খ, শুভ্র!”
“বাহ্! তাহলে আপনি সবটা জেনেও চুপ করে থাকবেন!
ওরা আবার প্ল্যান করবে মিস্টার রায়, আর বারবার আমি ধরতে পারবোনা সেটা!
স্যাক্রিফাইস, কম্প্রোমাইস করার একটা লিমিট আছে জানেন তো!
ওই টুকু একটা ঘুপটি ঘরে থাকেন, ওরা নিজেদের ইচ্ছে মতন যা খুশি করে, সে করুক!
তবে এটা কি করে করতে পারে কেউ? কি করে? Slow Poisoning
করছিলো ওরা দিনের পর দিন! যাতে কাল দমবন্ধ হয়ে আপনি মারা গেলে সেটা ন্যাচারাল ডেথ মনে হয়! মনে হবে আপনার Respiratory problems
ছিল বলে আপনি মারা গিয়েছেন!
কেউ জানবে না, বুঝবে না এই ষড়যন্ত্রের কথা!”
“অন্বেষা প্লিজ! সেরকম Poisoning
এর ব্যাপার নয় ওকে? সেরকম Poisoning
হলে আমি তো মরেই যেতাম এতো দিনে….তাইনা! দীর্ঘ ছয় বছর আমি আছি ওদের সাথে, মা চলে যাওয়ার পর! এই ছয় বছরেও যখন কিছু হয়নি তখন আজও…..”
“Will you please Shut up Mistar Ray! Don’t try to be smart okay?
আপনি খুব ভালো করে জানেন আপনি খুব কম ইউস করেন পারফিউম, আপনি মেনলি ডিও ইউস করেন যেটাতে কেমিক্যাল টা ছিলোনা কারণ ওটা খুলতে পারেনি উনি!
পাউডার ড্রাই বলে সেটা তেও ছিলোনা…..
ভেজা জিনিস পাউডারে ইউস করলে সমস্যা হতে পারে!
আফটার শেভ Gel – তাতে ওই কেমিক্যাল অনেকটাই ছিল, তবে
হয়তো খুব বেশি হলে মাসে একবার ইউস করেন আপনি সেটা
, কারণ আপনি দাড়ি ট্রিম করেন!
এটাই Exact Reason আপনার একটু হলেও ভালো থাকার!
আপনি এতো বড়ো সত্যি টা জানার পরও………
কেন? মিস্টার রায়? এটা একটা ক্রাইম মিস্টার রায়!
আপনি চুপচাপ মেনে নেবেন! ”
“আমি তো কথা বললাম সুবিনয় বাবুর সাথে, উনি বললেন কোনো Evidence নেই, অন্বেষা আমরা পারবোনা …..”
“আমরা অনেকবার এটা নিয়ে আলোচনা করেছি মিস্টার রায়! Evidence
চাইলেই আপনি বানাতে পারেন, ঘরে একটা হিডেন ক্যামেরা লাগিয়ে নিন, আর মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে দরজা খুলে রাখুন!
বাঘ আবার আসবে রক্তের নেশায়…..শুধু খাঁচাটা খুলে দিন……”
“আমি পারবোনা অন্বেষা!
কেন বুঝতে চাইছো না তুমি!
ছাড়ো না!
প্লিজ অন্বেষা প্লিজ, সব নতুন করে শুরু করি চলো…..
তুমি জানতো বলো, জানতো অনেক কিছু অভিজ্ঞতা আছে এই জীবনে!
অনেক কিছু!
জীবনের বাকি দিন গুলো আমি তোমার সাথে কাটাতে চায়,
কোর্ট, পুলিশ স্টেশন করতে চায়না! তারপর আবার সবাই শুরু করবে Adopted মিস্টার রায় ফ্রেম করেছে এভিডেন্স ফর প্রপার্টি, ওদের কে শেষ করে আমরা কি পাবো বলো?
তারপর এই নিয়ে লেখালেখি হবে কাগজেও কম্পানির একটা নেগেটিভ ইমেজ তৈরী হবে…..
একটু বোঝো তুমি এগুলো…..”
“কিসের কম্পানি মিস্টার রায়? কার কম্পানি? রুদ্রনীল রায় কোথায়?
আজ অবধি তো একটাদিনও লোকটাকে দেখিনি আমি অফিসে!
সারাটাদিন কি করে বেড়ায় সে কে জানে!
আর এদিকে সব দায়িত্ত্ব আপনার ওপর!
আপনার বাকি ভাইয়েরা ও আপনার জেঠিমা! তারা সারাদিন পার্টি করবে, রেসের মাঠে ঘোড়া দৌড় করিয়ে ফুর্তি করবে,
bar এ মদ খেয়ে এনজয় করবে, আর আপনি এখানে রক্ত জল করে দিনের পর দিন খাটবেন…..
আর তার বদলে ওরা আপনাকেই মেরে ফেলতে চাইছে…..
বাহ! বাহ! সুন্দর!
কেন সয্য করছেন আপনি? কেন?
? সেপারেট করে নিন আপনার ও রিরির পঞ্চাশ শতাংশ! তার পর দেখি কত দিন চলে…..”
“তুমি খুব ভালো করে জানো অন্বেষা!
সেটা করলে কম্পানিটা শেষ হয়ে যাবে, তাছাড়া আমাকে অনেকে হেল্প করে তো এখানে, মানে অনেক হেল্পফুল স্টাফ আছে আগে থেকে…..”
“এরকম হেল্পফুল স্টাফ আপনি পরেও পেয়ে যাবেন নতুন কিছু শুরু করলে….
ছেড়ে দিন!
একিই কথা আমরা অনেকবার আলোচনা করে ফেলেছি…..
আর ভালো লাগছে না রোজরোজ একিই কথা!
আপনি নিজের মতন থাকুন! আমাকে নিজের মতন ছেড়ে দিন প্লিজ…..
প্লিজ এরকম বারবার ফোন
করে আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না! প্লিজ!”
বলেই অন্বেষা উঠে দাঁড়ালো চেয়ার থেকে, হনহন করে এগিয়ে গেলো ক্যাবিনের দরজার দিকে……
হঠাৎ এক ঝটকায় অন্বেষার ডান হাত টা ধরে মুহূর্তেই টেনে নিলো মিস্টার রায় অন্বেষা কে বুকের কাছে….
শিহরণ খেলে গেলে অন্বেষার শরীরে, নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো মুহূর্তেই!
কিছু বলতে পারলো না, কথাগুলো জড়িয়ে এলো সব!
চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের সেই দুটো চোখের দিকে…..
চোখের কোলে জমেছে আবার বিন্দু বিন্দু জল, আর খানিকটা ভয়!
বোধহয় সেটা অন্বেষা কে হারিয়ে ফেলার ভয়!
মিস্টার রায় একটা ঢোক গিলে, আলতো আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করলো অন্বেষার কপালের ওপর চুল গুলোকে, যেগুলো ক্যাচারের বাঁধন থেকে আলগা হয়ে উড়ে এসেছিলো কপালে…..
আসতে আসতে সরিয়ে দিলো কপালের ওপর মুক্ত চুল গুলোকে কানের পাশে…..
তারপর খুব মৃদু স্বরে ভাঙা গলায় বলে
চললো –
“প্লিজ অন্বেষা! প্লিজ আমাকে থাকতে দাও তোমার সাথে! প্লিজ….
অনেকদিন পর মনের মধ্যে ভারী বরফের টুকরোটা ভেঙে গোলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েছে দুচোখ বেয়ে!
মনের ঘা টায় সবে একটু একটু করে প্রলেপ পড়তে শুরু করেছে তোমার ভালোবাসার স্পর্শে!
আজকাল আকাশটা কে নীল লাগে অন্বেষা, বাগানের গাছগুলোকে সবুজ মনে হয়, আমি রঙ চিনতে শিখেছি অন্বেষা, শুধু তোমার জন্যে!
চেনা সীমানা গুলো পেরিয়ে তোমায় নিয়ে কোনো এক বহুদূরের অচেনা পথে হাঁটতে ইচ্ছে করে আজকাল!
প্লিজ আমায় তোমার সাথে থাকতে দাও!
প্লিজ!
কথা দিলাম এই কম্পানি আমি ছেড়ে দেবো! একটা অন্য চাকরি খুঁজবো!
আমরা ভালো থাকবো একসাথে! খুব ভালো থাকবো!
ওদের এক্সাক্ট সমস্যা টা আমি বুঝি অন্বেষা,
ওদের সমস্যা আমার শেয়ারটা নিয়ে!
Adopted ছেলে কেন সম্পত্তি পাবে?
আমার পুরো শেয়ার টা ওদের দিয়ে আমরা একটা নতুন জীবন শুরু করবো আবার!
প্লিজ অন্বেষা এই স্বপ্নের দিনগুলোতে আমি কোর্ট থানা, পুলিশ করে সময় নষ্ট করতে পারবোনা!
অনেক দেখেছি, অনেক সয়েছি, অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে এমনিই….
আর আমি লড়াই করতে চাইনা….
প্লিজ অন্বেষা! আমায় ছেড়ে যেওনা, প্লিজ!”
বলতে বলতে মিস্টার রায়ের গলাটা ভাঙতে শুরু করে আবার! দুফোটা জল চোখ বেয়ে নেমে আসে গালে, অন্বেষা আলতো আঙুলের স্পর্শে ভেজা গালটা মুছতে মুছতে ফিসফিস করে বলে –
“আমি যাবোনা কোথাও! আমি তো এমনিই বলেছিলাম মিস্টার রায় যাতে আপনি প্রোটেস্ট করেন, তবে আপনি যদি মন থেকে সেটা করতে না চান, আমি জোর করবোনা! এমনিই অনেক জোর খাটিয়েছি শেষ পাঁচ সাত দিন!”
“এভাবেই সারা জীবন জোর খাটিও, প্রব্লেম নেই, শুধু আর লড়তে বলোনা প্লিজ, আমি যে বড়ো ক্লান্ত অন্বেষা! বড়ো ক্লান্ত আমি!”
“বেশ! বলবোনা! তবে কথাদিন নিজের খেয়াল রাখবেন, সাবধানে থাকবেন যতদিন না আমি আসছি আপনার সাথে থাকতে, ততদিন!”
“তোমায় নিয়ে আমি ও বাড়ি যাবোনা, ওইটুকু ঘুপটি ঘরে ওই ধরণের মানুষগুলোর সাথে তোমায় থাকতে হবেনা!
তুমি জানো অন্বেষা আমি কেন ওই ঘুপটি ঘরটাতে থাকি!
কারণ বড়ো ঘরে একা থাকতে ভয় হয় প্রচন্ড! মা মারা যাওয়ার পর মায়ের ঘরে রিরিও থাকতে চাইতো না!
রাতের বেলায় চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে উঠতো! আমি দৌড়ে যেতাম ওর ঘরে!
তারপর থেকেই মায়ের ঘরটা তে তালা! রিরিকে আমার ঘরটা ছেড়ে দিলাম আর আমি ওই ঘুপটি ঘরটাতে এডজাস্ট করতে শুরু করলাম!
আমিও যে মায়ের ঘরটা তে একা থাকতে পারতাম না!
অনেক কষ্ট করেছি জীবনে আমি আর রিরি দুজনেই জানো!
রিরি সেই নয় কি দশ বছর থেকে একা একা! কতটাই বা সময় দিতে পারি আমি ওকে!
কিন্তু এবারে সব ঠিক হয়ে যাবে!
আমি, তুমি আর রিরি একসাথে থাকবো…অন্য একটা বাড়িতে …..মানে আমাদের বিয়ের পরে! কেমন?”
মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হতে না হতেই অন্বেষার মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি,
তারপরেই বেজে উঠলো টেবিলের ইন্টারকম…..
একহাত দূরত্বে সরে গিয়ে মিস্টার রায় ধরে নিলেন ফোন, তবুও চেয়ে রইলেন নিস্পলক দৃষ্টিতে অন্বেষার দিকে…..
অন্বেষা ভেজা দুটো চোখ মুছে,
হাসি হাসি মুখে হাত দেখিয়ে ইশারা করে বিদায় জানালো মিস্টার রায় কে, তারপর মুখটা রুমালে আবার মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো ক্যাবিন থেকে!
****************************************************
***********দিন কুড়ি পরের কথা************
দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে অন্বেষা গিয়েছিলো দুর্গাপুর,
ট্রেন শিয়ালদাহ তে ঢুকতেই
প্ল্যাটফর্মের ঠাসা ভিড়েও সঙ্গে সঙ্গেই অন্বেষা দেখতে পেলো তার মিস্টার রায় কে…..
উউফ! মানুষটাকে কতবার বললো কাল রাতে একদমই নিতে আসার দরকার নেই, শিয়ালদাহ থেকে চিংড়িঘাটা – একটা অটো ডিস্ট্যান্স! তবু চলে এলো সে, কে কার কথা শোনে……
আজও তার পরণে অফ হোয়াইট ফর্মাল
শার্ট ও ফর্মাল কালো প্যান্ট,
যেন অফিসের কোনো মিটিং Attend করতে এসেছে সে!
অন্বেষা কে দেখেই এগিয়ে এলো মিস্টার রায়, একরকম জোর করেই লাগেজ পত্র সব তুলে নিলো নিজের কাঁধে, তারপর আবার অন্বেষা কে আগলে নিয়ে চললো পার্কিং এর দিকে!
“কিছু খেয়েছো? চলো ব্রেকফাস্ট করি এক সাথে আজ!”
“মিস্টার রায়! বারোটা বাজে, না না পিজি তে গিয়ে একেবারে স্নান করে লাঞ্চ করে নেবো….”
কথাটা শেষ করতেই অন্বেষা দেখলো ফেকাসে মুখ নিয়ে ড্রাইভ করে চলেছে মিস্টার রায়!
“কি হলো? এতে এরকম মুখ বানানোর কি হলো?”
“কি আবার হবে? কিছুইনা! এতদিন ঠিকঠাক করে কথা হয়নি, দেখাও হয়নি, আজ বলছি চলো একসাথে ব্রেকফাস্ট করি, তাও তোমার সময় নেই….”
“আপনি পুরো বাচ্চাদের মতন করেন আজকাল জানেন তো!
বারবার শুধু টেক্সট মেসেজ, ফোন করেই যাচ্ছিলেন, ওরম বাড়ির মধ্যে সবসময় সময় দেওয়া যায় নাকি? আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি মিস্টার রায়, সবাই ভীষণ গল্প করে, সবসময় সারাদিন হৈহুল্লোড়! তারপর বছরে একবার বাড়ি যাই ওদের সময় না দিলে কেমন দেখায় বলুন তো?”
“জানি! খুব বিরক্ত করেছি তোমায়!”
“ব্যাস! বাবুর গোঁসা হয়ে গেলো তাই তো?”
“না রাগ হয়নি আমার,
তবে আজ একটু সময় দাও, আজ কত কাজ ছিল জানো অফিসে…..
তোমার জন্যে গেলাম না! তবুও একটু সময় দিচ্ছনা তুমি….”
“কোথায় সময় দিচ্ছিনা হ্যাঁ? আমি বলেছি এখন ব্রেকফাস্ট করবোনা, এরকম লাঞ্চ টাইমে লাগেজ নিয়ে কে ডেট করতে বেরোয় মিস্টার রায়? তাও আবার ঘেমো গায়ে! ইসস!
তাও আবার প্রপার ফর্মাল ডেট!”
“একদিনও বেরিয়েছ আমার সাথে?”
“বেরোয়নি তো! Sorry! অনেক কাজ ছিল যে পুজোর আগে….”
“আজ তো ফাঁকা, আজও তো বেরোচ্ছো না!
নাও চলে এসেছে তোমার খিটখিটে কাকিমার নীল বাড়ি! এবার একটা বাই বলে নেমে পর….আর কি?”
গাড়িটা কে ঠিক নীল বাড়িটার সামনে দাঁড় করিয়ে মিস্টার রায় গাড়ির ইঞ্জিন টা বন্ধ করে অন্বেষার দিকে চেয়ে বললেন –
“কি হলো?
বসে রইলে যে! চলে এসেছি! চলো লাগেজ
গুলো নামিয়ে দি….”
“মিস্টার রায়!” আদর মাখানো বললো অন্বেষা….
“কি?”
“আমি কিন্তু বলেছি ব্রেকফাস্ট করবোনা…..
আমি কিন্তু বলিনি আজ বিকেলে বেরোবোনা! আজ ডিনার করা যেতেই পারে, আপনার সাথে……
একটু ফ্রেশ হয়ে, লাঞ্চ করে, ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করে নি, বিকেলে বেরোই?”
অন্বেষার কথা শেষ হতেই চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো মিস্টার রায়ের, এক গাল হাসি নিয়ে বলে উঠলো সে –
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি!”
“শোনোনা তাহলে আমি ঘন্টা দুয়েক গাড়িতেই ওয়েট করছি, তুমি যাও…আমি….”
“একদম নয়! লাঞ্চ করেছেন? যত মাথায় উল্টোপাল্টা বুদ্ধি আপনার…
চুপচাপ বাড়ি গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট করুন! আমি রেডি হয়ে কল করবো আপনাকে….
কি হলো….আবার মুখটা ফেকাসে হলো কেন…..”
“নাহ ইটস ওকে! চলো লাগেজ গুলো নামিয়ে দি……”
***************************************************
বিকেলে যখন অন্বেষা ফোন করলো মিস্টার রায় কে তখন ঘড়িতে ঠিক সাড়ে তিনটে…..
মধ্য গগন থেকে সূর্য পাড়ি দিয়েছে পশ্চিম আকাশের দিকে!
ঝকঝকে আকাশ সোনালী রোদে মাখা তখনও!
আজকে গরম থাকলেও হাওয়াও বইছে খুব!
সেই হাওয়াতেই থেকে থেকে দুলে উঠছে গাছের পাতাগুলো!
অন্বেষা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ব্যালকনি তে, একমনে চেয়ে রইলো সামনের গাছটার দিকে, গাছের খানিকটা অংশ মেখেছে সোনালী রোদ, খানিকটা অংশ আবার সামনের বাড়িটার ছাওয়া তে ঢাকা! এই রোদ ছাওয়ার খেলাতেই একিই গাছের পাতার রং আজ দুই রকম…..
আজ সত্যি দুপুরটা বড়োই দীর্ঘ লাগছিলো অন্বেষার!
আজ রিয়া দি ও নেই ঘরে, না থাকারই কথা! আজ যে সোমবার!
এদিকে ঘুমোও এলোনা একটুও!
মনে মনে ভেবেছিলো একটু ঘুমিয়ে বিকেল বা সন্ধ্যে নাগাদ বেরোবো, আজ প্রায় অনেকটাই ভোরে উঠতে হয়েছে তাকে!
অনেক ভেবে চিনতে দেখলো শুধু শুধু একলা থেকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই একটুও!
এদিকে সেই মানুষটাও বোধহয় অধীর অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ!
উফফ বলে কি না গাড়িতেই অপেক্ষা করবে!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অন্বেষা দেখলো লাল গাড়িটা টার্ন নিয়ে দাঁড়ালো ঠিক বাড়ির সদর দরজার সামনে…..
মুহূর্তেই বেজে উঠলো ফোন….
“হ্যাঁ আসছি…আসছি…দেখতে পেয়েছি!”
“ওকে! এসো……”
****************************************************
লালগাড়িতে অন্বেষা উঠতেই গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিলো মিস্টার রায়…..
“আজ আবার মেকআপ? মিস মিত্র মনে আছে তো? প্যারাবেন, লেড, মার্কারি ভেরি হার্মফুল”
খুনসুটির ভঙ্গিতে বেশ সুর করে বললো মিস্টার রায়!
“উউফ! আপনি আবার শুরু করলেন তো! ধুর! ভালো লাগে না!”
মৃদু হাসি নিয়ে কথাটা শেষ করলো অন্বেষা……
“আচ্ছা বাবা – Sorry
আর বলবোনা, বাই দ ওয়ে! আমি কিন্তু জানিনা আমরা কোথায় যাচ্ছি!”
“মানে?”
“মানে আমি সেরম কিছু প্ল্যান করিনি! মানে তুমি বলো কোথায় যাবে?”
“আমি সেরকম কিচ্ছু চিনিনা এখানে, শুধু ওই আপনার বাড়ি আর অফিস…..”
“তাহলে আর কি অফিসেই যাওয়া যাক কি বলো” ভ্রু নাচিয়ে আবার খুনসুটির ভঙ্গিতে বললো মিস্টার রায়!
“কি???
ধুর আপনি ভীষণ বাজে! তখন থেকে আমার ক্লাস নিচ্ছেন!”
“ক্লাস নিচ্ছি মানে? কোন সাবজেক্ট?”
“মিস্টার রায়! খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু!”
“আচ্ছা আচ্ছা Sorry
আর জ্বালাবো না!”
বলেই হাসতে শুরু করলো ওরা দুজনে…
খানিকক্ষণ অন্বেষা চুপচাপ বসে রইলো হাসি মেখে মুখে,
পাশে বসে থাকা মানুষটা সত্যি পাল্টে গিয়েছে কত!
মানুষটা আবার খুনসুটিও করতে শিখেছে ইদানিং!
ভাবতে ভাবতে চেয়ে রইলো অন্বেষা
বাইরের রোদ মাখা নীল আকাশটার দিকে চেয়ে!
মিস্টার রায়ের কথাতে মৌনতা কাটলো আবার –
“অন্বেষা! Sorry
আজ জানালার কাঁচটা এখন লাগিয়ে রেখেছি কারণ বাইরেটা একটু গরম বুঝলে তো! রোদ একটু কমলেই AC
টা বন্ধ করে খুলে দিচ্ছি জানালা টা! ওকে?”
অন্বেষা একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে, তারপর বললো –
“আপনার কেন মনে হলো বন্ধ গাড়ির থেকে খোলা গাড়ি বেশি পছন্দ হবে আমার?”
“কারণ আকাশটা তোমার
খালি চোখে দেখতেই ভালো লাগে, কাঁচের ভেতর দিয়ে নয়!”
“আপনি কি ভাবে…….?”
“কারণ আমি তোমাকে বুঝি আজকাল……
একটু……একটু……….”
অন্বেষা আবার কিছুক্ষণ হাসি মুখে চেয়ে রইলো বাইরে
তারপর হঠাৎই আবার মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে বললো –
“মিস্টার রায়! সিরিয়াসলি আমরা কোথায় যাচ্ছি? উফফ! আপনি গন্তব্য জানেন না অথচ ড্রাইভ করেই যাচ্ছেন!”
“গন্তব্য তো বসে আমার পাশে! ড্রাইভিং, ঘুরতে যাওয়া, এগুলোতো শুধুই একটা উপায় গন্তব্যের সাথে সময় কাটানোর!”
অন্বেষা আবারো চুপচাপ বসে রইলো সিটে হাসি মুখে!
“শোনো না অন্বেষা…..”
“বলুন!”
“তুমি তো কিছুই বললে না, এদিকে আমরা এখন উল্টোডাঙা ক্রসিং! ভাবছিলাম ক্যানাল ইস্ট হয়ে BT
রোড নিয়ে নি, তারপর চলো দক্ষিনেশ্বর চলে যাই!
একবার মায়ের দর্শন করে গঙ্গার ঘাটে বসবো সন্ধ্যে অবধি!
তারপর সন্ধ্যে আরতি!
তারপরে ডিনার করবো ওপেন টেরাস রেস্টুরেন্টে! চলবে?”
“এই যে বললেন কিচ্ছু প্ল্যান করেননি?”
**************************************************
ঘড়িতে তখন ঠিক পাঁচটা কুড়ি…..
অন্বেষাকে গঙ্গার ঘাটের ওপরের একটা সিঁড়ি তে বসিয়ে রেখে মিস্টার রায় ওয়াশরুমের দিকে এগোলেন তখন……..
পশ্চিম আকাশের সূর্য লালচে হয়ে আসছে একটু একটু করে, সেই লালচে সূর্যের আভা এসে পড়েছে গঙ্গার জলে!
আকাশ জুড়ে উড়ে চলেছে পাখিদের দল দিনের শেষ দানার জোগাড়ের তাগিদে….
একটা ট্রেন এগিয়ে চললো whistle
দিয়ে নিজের গন্ত্যেবের দিকে!
মাঝেমাঝে একটু আধটু জল ছিটছে অন্বেষার চোখে মুখে মায়ের মন্দিরে আসা ভক্তদের ঘট থেকে, ভক্তদের ভেজা শাড়ি থেকে যারা পায়ে পায়ে গঙ্গার জল ঘটে ভোরে, স্নান সেরে ফিরছেন গঙ্গার ঘাট থেকে মন্দির চত্বরের দিকে!
সত্যি এই গঙ্গার ঘাট – কত মানুষের কষ্ট, দুঃখ, হাসি, খুশি, প্রেমের কত কথা লুকিয়ে রেখেছে নিজের মধ্যে জন্ম জন্মান্তর!
অন্বেষা আজ মায়াবী আকাশটা ছেড়ে
চেয়ে রয়েছে মন্দির চত্বর থেকে কেনা হাতের সোনালী ঘটটা আর ফুল ও প্রসাদের টোকরির দিকে, আজ লালচে আকাশের থেকেও যে বেশি মুগ্ধ করেছে মিস্টার রায়!
বারবার আজ মনে পড়ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুপুর থেকে বিকেলের স্মৃতি গুলো, খুব ইচ্ছে করছে মনেমনে আবার ঘন্টা দেড়েক আগে ফিরে গিয়ে সেই সময় টাকে উপভোগ করতে আরও একটাবার!
অন্বেষা শুনেছে বান্ধবীদের মুখে তাদের ফার্স্ট ডেটের কথা!
শুনেছে প্যাশনেট চুম্বন ও প্যাশনেট স্পর্শের কথা!
শুনেছে নিকোটিনের গন্ধে তার বান্ধবীরা কেমন বিভোর হয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো তাদের প্রেমিক কে! শুনেছিলো দামি গিফটের কথা!
তবে এখনো অবধি তার ফার্স্ট ডেটটা সত্যি অন্যরকম!
তাতে ছিলোনা আজ কোনো প্যাশনেট চুম্বন! ছিলোনা কোনো দামি উপহার!
ছিলোনা তাতে নারী পুরুষের প্যাশনেট সেই স্পর্শ,
শুধু একটা আলগা ভালোবাসায় মোড়া হাত স্পর্শ করেছে বারবার তার মাথায়, কখনো বা কাঁধে!
সেই আগলে রাখার যত্নে মোড়া স্পর্শ!
মন্দির চত্বরে ঢোকার সময় থেকে নিজে রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে অন্বেষা কে মিস্টার রায় দাঁড় করিয়েছিলো ছায়াতে…………..
লাইনের সামনে এলেই ধমক খেয়েছে অন্বেষা বারবার!
কথাগুলো এখনো বাজছে অন্বেষার কানে
“উফফফ! তোমাকে বারবার বলছি ওখানে গিয়ে দাঁড়াও, কেন এদিকে আসছো? গরম লাগছে তো পায়ে…….
অন্বেষা আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা…….
আমি তোমার সব কথা শুনি, এখন তুমি আমার কথা শুনবে! একদম জেদ করবেনা তুমি! যাও ওখানে গিয়ে দাঁড়াও!”
তারপর আর কোনো কথা বলেনি মিস্টার রায়!
মন্দিরের লাইন খুললে অন্বেষার কাঁধ টা আলতো স্পর্শ করে আগলে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে মায়ের মন্দিরের দিকে!
তারপর মায়ের দর্শনের সময় কেমন যেন কাঁপছিলো তার বন্ধ চোখের পাতা, ঠোঁট! বিন্দুবিন্দু জল গড়িয়ে পড়েছিল চোখের কোল বেয়ে!
ওতো ভিড়ের মাঝেই মায়ের পায়ের ছোয়ানো ফুলটা দুহাতে নিয়ে সাথেসাথে ঠেকিয়ে দিলো অন্বেষার মাথায়! ভেজা দুটো চোখ তখন আবার বন্ধ করেছে মায়ের সামনে কোনো এক কাতর প্রার্থনায়!
হাতদুটো বেশ খানিকক্ষণ ছুঁয়ে ছিল অন্বেষার মাথা টাকে!
অন্বেষা জানেনা কি ছিলো সেই কাতর প্রার্থনা, তবে অজান্তেই তারও দুটো চোখের পাতা ভিজে এসেছিলো তখন ওই ভেজা দুটো বন্ধ চোখ থেকে!
দর্শন পর্ব শেষ হলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে
অন্বেষা দাঁড়িয়ে ছিল মিস্টার রায়ের পাশে,
টোকরি থেকে ধুপ দুটো বের করে, সেটা কে জ্বালিয়ে একটা ধূপকাঠি অন্বেষার হাতে দিয়ে মিস্টার রায় ইশারা করছিলো মন্দিরের দিকে দেখাতে, তারপর মুহূর্তেই ভেজা চোখদুটো আবার বুজে গিয়েছিলো হয়তো সেই একিই কাতর প্রার্থনায়!
অন্বেষা চোখ বন্ধ করেনি তখন, বিভোর হয়েছিল তখন!
নাহ নিকোটিনের গন্ধে নয়, মন্দিরের ফুল, প্রসাদ, ও ধুপকাঠির গন্ধে বিভোর হয়ে সে চেয়ে ছিল তার মিস্টার রায়ের দিকে!
তারপর আবার মিস্টার রায় অন্বেষা কে খানিক দাঁড় করিয়ে রেখে,
ঘটে গঙ্গার জল ভোরে নিয়ে এনে প্রতিটা শিবের মাথায় জল ঢেলেছে অন্বেষার সাথে!
ধাগা বেঁধেছে একটা গাছের ডালে!
এসব উনি মানেন? অন্বেষার জানা ছিলোনা তা এতদিন!
সবশেষে সাদা রুমাল দিয়ে গঙ্গার ঘাটের ওপরের একটা সিঁড়ির কোণ টা শুকনো করে মুছে দেন উনি, অন্বেষা কে সেখানে বসিয়ে, অন্বেষার হাতে ঘট ও শালপাতায় মোড়া ফুল প্রসাদের টোকরি দিয়ে এগিয়ে যান ওয়াশরুমের দিকে!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখের সামনেটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায় অন্বেষার, কেমন যেন একটা পুরোনো ব্যাথা মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতরে! এই মানুষটা কে না বুঝেই কতই না কষ্ট দিয়েছে সে, অথচ সে….
“অন্বেষা!”
মৃদু একটা আওয়াজে মগ্নতা কাটে অন্বেষার!
মিস্টার রায় মুহূর্তেই পাশে বসে পড়েন অন্বেষার!
আজ সাদা ফর্মাল শার্ট ইনফর্মাল ভাবে গোটানো হাতের কুনুই অবধি, কালো ট্রাউসার গোটানো দুফোল্ড করে গোড়ালির খানিকটা ওপর অবধি….
পায়ের পাতা ভেজা এখনো!
মাথার চুলটাও খানিক ভিজে, তবে
বড়োই বাধ্য হয়ে তারা রয়েছে নিজের জায়গায়!
ঠোঁটে একটা সরলতার হাসির রেখা! যেন
জীবনের সব টুকু ফিরে পেয়েছে আজ মন!
চোখদুটো জ্বলজ্বল করে একদৃষ্টি তে চেয়ে রয়েছে অন্বেষার দিকে!
অন্বেষার চোখথেকে গড়িয়ে পড়া জলটা দেখে ফেকাসে একটা মুখে প্রশ্ন করে মিস্টার রায় –
“কি হয়েছে অন্বেষা? তুমি কাঁদছো?”
“নাহ! মিস্টার রায়, আজকে আপনার মতন আমার দুচোখের জল টাও দুঃখের নয় একেবারেই! এতো ভালোলাগার কান্না!”
কথাটা শেষ হতেই অন্বেষা ডান হাত টা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মিস্টার রায়ের বাঁ হাতটা, তারপর আলতো করে মাথাটা রাখলো মিস্টার রায়ের কাঁধে!
“অন্বেষা! সবাই দেখছে!”
ফিসফিস করে বললো মিস্টার রায়!
“দেখুক! আপনি প্লিজ চুপচাপ বসুন তো!
কিচ্ছু বলবেন না আর! আমি বিশ্রাম নিচ্ছি এখন! জোর করে আনলেন আজ, জানেন আজকে আমি কত টায়ার্ড ছিলাম! এখন চুপচাপ বসুন!” আদুরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে চললো অন্বেষা…..
“মিস্টার রায়….”
“কি?”
“আপনি আমায় কতটা ভালোবাসেন?
আবার সেই আদুরে সুরে প্রশ্ন করলো অন্বেষা…..
মিস্টার রায় খানিক চেয়ে রইলো পড়ন্ত বিকেলের আকাশটার দিকে, তারপর খুব মৃদু স্বরে বললো –
“জানিনা অন্বেষা কতটা! ভালোবাসা মাপার তো কোনো যন্ত্র নেই!
থাকলে হয়তো মেপে বলতে পারতাম…..তবে!”
“তবে কি?”
“তবে তোমায় নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে হয় আজকাল!”
অন্বেষা মাথাটা তুলে নিলো মিস্টার রায়ের কাঁধ থেকে, হাসি হাসি মুখে তাকালো মিস্টার রায়ের দিকে, তারপর বললো –
“উপন্যাস! আমায় নিয়ে! আর কি লিখবেন তাতে শুনি? কি নাম হবে সেই উপন্যাসের?”
“ঝরাপাতার মরশুমের শেষে তুমি এসে আমায় বদলে দিলে কি ভাবে সেই কথা লিখবো, কি ভাবে তুমি এক অন্য বসন্ত এনে দিলে আমার জীবনে সে কথা লিখবো….
আআরররর উপন্যাসের নাম হবে – ঝরাপাতার শেষে!”
“ঝরাপাতার শেষে না পাতাঝরার শেষে?”
“তুমি যাহা বলিবে তাহাই হইবে প্রিয়!”
“আচ্ছা?”
“হমম! এবারে তুমি বলো…..”
“কি?”
“কতটা ভালোবাসো আমাকে?”
“জানিনা কতটা!
মমমমমম ওকে!
ফাও ফুচকা টা……আপনাকে দিতে পারি এতটা!”
“কি ওই ড্রেনের জল দিয়ে যেটা বানায় সেই ফাও ফুচকা?”
“মিস্টার রায়! প্লিজ –
মোটেই ড্রেনের জল থাকেনা ওতে!”
অন্বেষার বলার ভঙ্গিটা শুনে হেসে উঠলো মিস্টার রায়!
মিস্টার রায়ের হাসিটা দেখে, একটা হালকা ঘুষি বসিয়ে দিলো অন্বেষা মিস্টার রায়ের বুকের ওপর!
তারপর দুজনেই হেসে উঠলো আবার!
পশ্চিম আকাশের সূর্য তখন একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে গঙ্গার জলে,
জায়গায় জায়গায় কেমন লালচে দেখাচ্ছে গঙ্গার জল!
ব্রিজের ওপর আবার এক ট্রেন হুইসেল দিয়ে এগিয়ে চললো গন্ত্যবের পথে!
****************************************************
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো…..
রাস্তার বড়োবড়ো স্ট্রিট লাইটের পাশাপাশি জ্বলে উঠেছে বৃহৎ আকাশ জুড়ে অগুণতি তারা….
লাল গাড়ি মন্দির চত্বর ছেড়ে এগিয়ে চলেছে অজানা অন্য এক পথে,
গুগল ম্যাপের ডেস্টিনেশনে – এক ওপেন টেরাস রেস্তোরার ঠিকানা,
মিস্টার রায় আগে কখনো যায়নি সেখানে, আগে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি সে,
একদিন জীবন তাকে টেনে নিয়ে যাবে এরকম অচেনা এক রঙিন পথে, তার পাশেও থাকবে তার ভালোবাসার মানুষটি! তার কাঁধেও আলতো করে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সে কখনো!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একবার বাঁ দিকে ঘাড়টা অল্প ঘুরিয়ে চেয়ে দেখে সে – তার অন্বেষার দিকে!
আজ মেয়েটা সত্যি ক্লান্ত!
অন্বেষার মাথাটা আলতো ভাবে স্পর্শ করে আছে মিস্টার রায়ের বাঁ কাঁধ টাকে…..
চোখদুটো বন্ধ,
স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় ও বন্ধ চোখদুটোর সাথে মুখটা যেন আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে আজ!
মিস্টার রায় স্টিয়ারিং ডান দিক বাঁ দিক করে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে গুগল ম্যাপের ডেস্টিনেশনের দিকে!
হঠাৎ অন্বেষার কোলে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো, মিস্টার রায় আলতো গলায় ডাকলো অন্বেষা কে –
“অন্বেষা…..অন্বেষা…..”
অন্বেষা তখনও গভীর ঘুমের মাঝে! কোনো উত্তর দিলোনা সে, একই ভাবে ঘুমিয়ে রইলো মিস্টার রায়ের কাঁধে মাথা রেখে!
মেয়েটাকে ডাকতেও ভারী মায়া হলো মিস্টার রায়ের, এখনও তো পথ অনেকটাই বাকি,
এদিকে সমানে বেজে চলেছে কোলে রাখা ফোনটা……..
কারোর আর্জেন্ট দরকারও হতে পারে আবার সার্ভিস প্রোভাইডার বা কোনো কল সেন্টারের অপ্রয়োজনীয় কল ও হতে পারে!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে গাড়িটা কে রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে দিলো
মিস্টার রায়!
খুব আসতে আসতে অন্বেষার কোল থেকে তুলে নিলো ফোন, তারপর স্ক্রিনের ওপরে
চোখ পড়তেই হতবম্ব হয়ে বসে রইলো সে,
বিদ্যুৎ খেলে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে!
স্ক্রিনের ওপরে – শুভ্রনীল রায়ের নাম!
শুভ্রনীল রায় –
শুভ্রনীল রায় কে? কোন শুভ্রনীল রায়?
রুদ্রনীল রায়ের বড়ো ছেলে? শঙ্খনীল রায়ের বড়দা?
নাকি সে অন্য কোনো শুভ্রনীল রায়!
মাথায় সব প্রশ্ন গুলো গুলিয়ে গেলো
মিস্টার রায়ের!
শুভ্র – যার সাথে
বাড়িতে তার কোনোদিনও সেরকম
কথা হয়না, তার অন্বেষার সাথে আলাপ হলো কি ভাবে? অন্বেষা সব ষড়যন্ত্রের কথা জেনেও কেন কথা বলে শুভ্রর সাথে?
অন্বেষায়ই বা তার কাছে এতো বড়ো ব্যাপারটা লুকোলো কেন?
ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো আবার কপালের ভাঁজে!
বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠলো আবার!
চেয়ে দেখলো সে তার অন্বেষার দিকে আরও একবার!
তার অন্বেষা তখনও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তার কাঁধে মাথা রেখে!
ওই মায়াবী মুখটা কিছুতেই ঠকাতে পারেনা তাকে, কিছুতেই না!
অন্বেষার ফোনে এতক্ষণে পাঁচটা মিস কল রেজিস্টার্ড – শুভ্রনীল রায়ের নামে!
(চলবে)