পাতাঝরার শেষে….
©মৌপর্ণা
অন্তিম পর্ব – দ্বিতীয় ও শেষ খন্ড!
পর্ব ১৯) তোর হয়ে গেলাম……….
ঘন্টা দুয়েক হলো মিস্টার রায় রা মুখ হাত ধুয়ে এসে বসেছে বাড়ির বসবার ঘরে,
রিরির থাকার আয়োজন করা হয়েছে অন্বেষার ঘরে ও
মিস্টার রায়, শুভ্র ও রুদ্রনীল বাবুর জন্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে দোতলার মাস্টার বেডরুম……
অবশ্য বেডরুমটা কাদের, তা এখনো জেনে উঠতে পারেনি মিস্টার রায়!
অন্বেষাদের বাড়িটা বেশ বড়ো হলেও, বাড়িতে সদস্যও অনেক বেশি…….
কাজেই তাদের আজ ওপরের ঘর ছেড়ে দিতে গিয়ে কেউ অবশ্যই ঘর ছাড়া হয়েছে,
শুভ্র ও রুদ্রনীল বাবুর মাথায় এসব প্রশ্ন আদেও এসেছে কি না তা জানেনা মিস্টার রায়…
শেষ দুঘন্টায় খাতির যত্নর কোনো অভাব রাখেনি অন্বেষাদের পরিবার,
বাড়ির মোটামোটি সবার সাথেই কথা হয়েছে মিস্টার রায় দেড়,
এই অল্প সময়েই রিরির সাথে বন্ধুক্ত হয়ে গিয়েছিলো অন্বেষার কাকার মেয়ে ওলির…
ওরা দুজনেই প্রায় সমবয়েসী যে!
অন্বেষার জ্যাঠা ও কাকার
দুজনেরই এক ছেলে ও এক মেয়ে,
সবাই এবাড়িতেই থাকে শুধু জ্যাঠার বড়মেয়ে বাদে,
তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে বহুদিন, তাই সে শশুরবাড়ি থাকে, যদিও অন্বেষার মুখে মিস্টার রায় শুনেছে সেও আসবে একবার মিস্টার রায়েদের সাথে দেখা করতে….
অন্বেষার বাবা ও মায়ের একমাত্র সন্তান – অন্বেষা……
এতক্ষণে শুভ্র গল্প জুড়ে বসেছিল
বাকিদের সাথে,
শুভ্র যে কবে থেকে এত গুছিয়ে কথা
বলতে শিখলো কে জানে!
মিস্টার রায় ও রুদ্রনীল বাবু – মাঝেমাঝে টুকটাক কথা বলছিলো বাকিদের সাথে….
সবার সাথে হাসি মুখে কথা বললেও
মিস্টার রায়ের মনটা পড়েছিল অন্বেষার কাছে, এ বাড়ি আসার পর থেকে অন্বেষা কে একবারও দেখেনি সে!
এখন সে কোথায় কে জানে!
অথচ বাড়ির বাকিরা সবাই তো এ ঘরেই আছে এই মুহূর্তে,
শুধু তিন জন ছাড়া, অন্বেষার বাবা ও জ্যাঠামশাই – যারা এখনো ফেরে নি দোকান থেকে আর অন্বেষা…….
আরও খানিকক্ষণ মিস্টার রায় বসে রইলেন নিজের জায়গাতে,
ঘড়ির কাটার টিকটিকির সাথে মনের মধ্যে হওয়া ছটফটানি টা এদিকে বেড়ে চললো একটু একটু করে!
অগত্যা পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা টেক্সট মেসেজ করে দিলো সে অন্বেষা কে –
“কোথায় তুমি?”
মিনিট দশেক পরও কোনো উত্তর এলোনা অন্বেষার, সে নিজেও এলোনা বসবার ঘরে….
মিস্টার রায়ের ব্যাকুলতা বেড়ে চললো একটু একটু করে!
এদিকে এরই মধ্যে রাতের খাবার আয়োজন করা শুরু হয়ে গিয়েছে,
মিস্টার রায় বারবার না না করলেও খানিক জোর করেই ওদের বসিয়ে দেওয়া হলো ডাইনিং টেবিলে…….
মিস্টার রায়ের ইচ্ছে ছিল অন্বেষার বাবা ও জ্যাঠামশাই ফিরলে তারপর খেতে বসবার, কিন্তু বাড়ির বাকিরা এতো জোর করলো শেষমেশ শুভ্র, রুদ্রনীল বাবু, ও রিরির সাথে বসেই পড়লো ওরা রাতের খাবার খেতে,
ওলি ছাড়া মিত্র বাড়ির কেউ ওদের সাথে বসলো না খেতে…..
খাবার পরিবেশনের সময় ফাইনালি শুভ্র নিজে থেকেই প্রশ্নটা করলো নীল(অন্বেষার কাকার ছেলে) কে….
“নীল! অন্বেষা কোথায়?”
নীল কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই নীলের মা বলে উঠলো –
“আজ সে হেঁশেলে, জীবনে প্রথম বার ঢুকেছে সে রান্না করতে…….
গরমে হিমশিম খাচ্ছে……
অভ্যাস নেই তো!”
তারপর অন্বেষা কে নিয়ে শুরু হলো খুচরো কথাবার্তা,
অন্বেষা একেবারেই সংসারী নয়,
রান্নাবান্না তেও একফোঁটাও মন নেই তার,
তার বাবা সমরেশ বাবু আস্কারা দিয়ে দিয়ে মেয়েকে এরকম উড়নচন্ডী বানিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি,
কথাগুলো খুব মজা করে বলা হলেও মিস্টার রায়ের মোটেই শুনতে ভালো লাগছিলোনা সেসব কথা…..
মুখে একটা ফেকাসে হাসি হাসলেও মনের ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছিলো অন্বেষার জন্যে, এতগুলোর লোকের খাবার বানানো কি মুখের কথা…..
আরও মিনিট দশেক পর দেখা মিললো তার অন্বেষার!
অন্বেষা কে দেখতেই অদ্ভুত একটা স্বস্তির হাওয়া বয়ে গেলো মিস্টার রায়ের মনে,
সবার সামনেই এক নজর সে
চেয়ে রইলো অন্বেষার দিকে,
আজ অন্বেষার চুল পুরো খোলা,
নেমে এসেছে ঘন কালো চুল কোমর অবধি, চোখে হালকা কাজলের রেখা, নাকে একদম ছোট্ট একটা নাকফুল, কপালের ভাঁজে জমেছে বিন্দুবিন্দু ঘাম, আজ পরণে একটা সুতির লাল হলুদ
সালোয়ার, গুছিয়ে হলুদ ওড়না ফেলা হয়েছে দুই কাঁধের ওপরে, ওড়নার নীচে লাগানো ছোট্ট ছোট্ট পুঁথি কারণে অকারণে মৃদু আওয়াজ করে চলেছিল অন্বেষার আসার পর থেকে!
মিস্টার রায় আবারও চেয়ে রইলো অন্বেষার দিকে, আজ সত্যি অন্যরকম লাগছিলো তার অন্বেষা কে, আজ কোনো মেকাপ নেই মুখে, অত্যন্ত সাধারণ ছিল আজ তার সাজ পোশাক,
অন্যদের নজরে আজ সে খুব সাধারণ হলেও মিস্টার রায়ের চোখে সে হয়ে উঠেছিল অসামান্য!
শুভ্রর কুনুইয়ের এক টোকা তে মগ্নতা কাটলো মিস্টার রায়ের,
সত্যি এতগুলো লোকের সামনে ওভাবে অন্বেষার দিকে চেয়ে থাকাটা মোটেই উচিত হয়নি মিস্টার রায়ের!
মাথা নীচু করে বসে রইলো সে আবার! থালা ভর্তি লুচিগুলো ডাইনিং টেবিলের মাঝামাঝি জায়গায় বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে অন্বেষা আবার এগিয়ে গেলো রান্না ঘরের দিকে,
মিস্টার রায় এতক্ষণে ভালোই বুঝতে পেরেছিলো বেশ কনসারভেটিভ ফ্যামিলি অন্বেষাদের…
নয়তো মিস্টার রায় এতক্ষণ চেয়ে রইলো অন্বেষার দিকে, তবে অন্বেষা একটাবারের জন্যেও চোখে চোখ রাখলো না মিস্টার রায়ের দিকে!
এদিকে রিরির ও শুভ্রর বুদ্ধিতে আজ মিস্টার রায়ের পরণে ছিল ফেডেড ব্লু জিন্স ও তার ওপর খয়েরি কুর্তা, কুর্তার হাত গোটানো ছিল কুনুই অবধি….
আজ বহু বছর পর মিস্টার রায় নিজেকে রঙেতে সাজিয়েছিল,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনেমনে ভেবেছিলো আজ অন্বেষা নিশ্চই চেয়ে দেখবে একবার, আজ তো সে চেনা সাজে সজ্জিত নয়!
তাই অন্বেষার ওভাবে চলে যাওয়া তে একটু একটু অভিমান হলো তার মনে, একটাবার, শুধু একটাবার তার দিকে চেয়ে দেখলে কি এমন বড়ো ক্ষতি হতো অন্বেষার!
**************************************************
রাতের খাবার সেরে,
সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো ওরা,
একটা ব্যাপার মিস্টার রায়ের খুব অদ্ভুত লাগলো, প্রায় দশটা বাজতে চললো তবুও সমরেশ বাবু ও পৃথ্বীশ বাবু এখনো দোকান থেকে ফিরলেন না, ছোট শহরে স্টেশনারি গুডস এর দোকান এত রাত অবধি খোলা থাকে?
এদিকে মিস্টার রায় বারবার অপেক্ষা করবে বললেও অন্বেষার ছোট কাকা – অনিমেষ বাবু প্রায় একরকম জোর করেই পাঠিয়ে দিলো ওদের তিনজনকে ওপরের ঘরে!
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নীল এলো ওপরের ঘরে, তারপর মিস্টার রায়কে বারান্দায় অস্থির ভাবে এদিক ওদিক ঘুরতে দেখে বললো
“অরুণ দা, তোমার কিছু লাগবে? মানে এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক করছো!”
ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই স্যার ডাকটা পাল্টে সেটা অরুণ দা হয়ে গিয়েছিলো…….
“হ্যাঁ নীল! একবার অন্বেষার সাথে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে, জাস্ট দুমিনিটের জন্যে! আমি সত্যি বলছি বেশি সময় নেবোনা, আসলে ….”
“কাল দেখা করো, ভোর বেলায়! ও ছাদে আসবে সাড়েপাঁচটা নাগাদ, ঠাকুরের পুজোর ফুল তুলতে…..
তখন ওয়েট করো ছাদে! এই যে এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেই ছাদে যেতে পারবে!
আজ তোমরা ক্লান্ত, এমনিই এতটা পথ এসেছো, এখন বিশ্রাম করো….
আসছি গুড নাইট!”
মনে মনে একটু রাগ হলো মিস্টার রায়ের নীলের ওপর,
দুটো মিনিট দেখা করার জন্যে কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করতে হবে!
এমনি গত দুদিন থেকে অন্বেষার সাথে কথা হয়নি বললেই চলে….
এই বাড়ি এলে অন্বেষা এমনিও সেরকম কথা বলেনা….
তবে আজ ব্যাপারটা অন্যরকম!
শুধু অন্বেষা মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে দেখেনি বলে যে মিস্টার রায়ের মনটা এতো ছটপট করছিলো সেটা নয়, আজ অন্বেষার মুখটা বড়োই শুকনো দেখাচ্ছিল,
এদিকে সমরেশ বাবু ও পৃথ্বীশ বাবু তাদের সাথে একবারও এসে দেখা করলো না!
এই জিনিসটাই মনে বড়ো বিঁধছিলো মিস্টার রায়ের,
রুদ্রনীল বাবুর তো এদিকে কোনো হেলদোল নেই!
এখানে এসেও সে তার গল্পের শেষটা হাতড়ে বেড়াচ্ছে,
শুভ্র স্বর্ণালীর সাথে ব্যস্ত ফোনে!
আরও খানিকক্ষণ বারান্দায় এদিক ওদিক করতে থাকলো মিস্টার রায়….
তারপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সদর দরজার বাইরের লোহার গ্রীলটা খোলার আওয়াজ পেলো সে, বারান্দা থেকে উঁকি মেরেই দেখলো দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক ঢুকে এলেন ঘরের উঠোনে, একজন এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে, ওপর জন নারকেল গাছের গায়ে সাইকেল টা কাত করে রাখলেন….
“অন্বেষার বাবা!”
মনে মনেই বললেন মিস্টার রায়!
একবার তার সাথে দেখা হলেই খানিক শান্ত হবে তার মনটা!
তাই সাতপাঁচ না ভেবেই মিস্টার রায় গিয়ে দাঁড়ালো সমরেশ বাবুর সামনে…..
বারান্দার দেওয়ালে লাগানো টিমটিমে আলোতেও মিস্টার রায় দেখতে পেলো সমরেশ বাবুর কপালের ভাঁজটা…..
চোখে মুখে পরিষ্কার একটা বিরক্তির ভাব!
সবটা গুলিয়ে গেলো মিস্টার রায়ের!
কিছু না বুঝতে পেরে মিস্টার রায় নিমেষেই ঝুঁকে প্রণাম করলো সমরেশ বাবুর পা ছুঁয়ে!
“স্যার! আপনি ভালো আছেন? আমি নিচেই ছিলাম এতক্ষণ আপনার সাথে দেখা করবো বলে!”
চেয়েও কাকু বলে ডাকতে পারলোনা মিস্টার রায়, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে স্যার ডাকটা বেরিয়েই পড়লো….
“তোমরা এখনও ঘুমোও নি?
যাও বিশ্রাম করো এখন, এতটা পথ এসেছো, তাও আবার ট্রেনে, তোমাদের তো আবার এসবের অভ্যেস নেই!
তোমরা বড়ো মানুষ, বড়বড় ব্যাপার! যাই হোক এখন যাও, ক্লান্ত হবে নিশ্চই!”
কথাটা দ্রুত শেষ করেই সমরেশ বাবু এগিয়ে গেলেন, বারান্দার দিকে!
তারপর দ্রুত গামছা নিয়ে এগিয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে!
মিস্টার রায় কে উঠোনের এক
কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও উনি কিচ্ছু বললেন না এবার!
পাশ কাটিয়ে খানিক উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেলেন……
এতক্ষণে আবার নীল এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে
“অরুণদা! তোমাকে বললাম তো আজকে ঘুমোও প্লিজ! কেন নীচে এলে! তোমাকে এতবার বলে এলাম, আজকে বিশ্রাম করো, চলো আমি তোমাকে ওপরের ঘরে পৌঁছে …..”
“ইটস ওকে! আমি চলে যাবো একা!”
হুড়হুড় করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে মিস্টার রায় শুয়ে পড়লো বিছানায়…..
“দাদাভাই, চেঞ্জ করবি না? দাদাভাই….”
“গুড নাইট শুভ্র….”
**************************************************
সকালে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই মিস্টার রায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন ছাদে,
ভোরের আলো তখনও ঠিক করে ফোটেনি,
ছাদ তখনও শিশিরে ভেজা,
ভেজা ছাদের ওপর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে পরে ছিল!
ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় মিস্টার রায়ের অবাধ্য চুল নেমে এসেছিলো কপালে!
খানিক ক্লান্তি টা কাটছিলো আসতে আসতে….
রাতে এমনিই বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো তার,
মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ব্যাকুলতা,
অথচ কাল চেয়েও সে কথাখানা বলতে পারেনি শুভ্র কে, রুদ্রনীল বাবু কে!
অস্থির মনে এদিক ওদিক করতে থাকলো মিস্টার রায়!
গত রাতে সমরেশ বাবুর ওভাবে কথা বলা, উপেক্ষা করা, অন্বেষার ফেকাসে শুকনো মুখটা দেখে সবটা আসতে আসতে পরিষ্কার হয়ে আসছিলো!
সমরেশ বাবু মন থেকে এই সম্পর্কটা মেনে নেন নি এখনো, তাইতো সে মিস্টার রায়ের সাথে কথা বলতে চায়না!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই মিস্টার রায় শুনতে পেলো পায়ের আওয়াজ, কেউ বুঝি সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ছাদে!
“অন্বেষা…. নিশ্চই …..অন্বেষা ……আসছে….
মনে মনে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে,
মুহূর্তেই তিনি এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে,
মুখোমুখি দাঁড়ালো এসে অন্বেষা!
এতক্ষণে অন্বেষা চেয়ে দেখলো তার মিস্টার রায় কে!
অন্বেষার চোখদুটো দেখে বুকের ভেতর টা কেমন করে উঠলো মিস্টার রায়ের!
ভেজা দুটো চোখের তলায় কালী!
“কি হয়েছে অন্বেষা? হ্যাঁ! অন্বেষা! কি হয়েছে?”
“মিস্টার রায়! আমি একটা অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি! আমি….আমি….আআআম…”
অন্বেষার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট আর কোনো আওয়াজ করলো না!
গলার কাছটা আবার লাল হয়ে এলো, দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে চললো সে, চাপা কান্নায়
নিঃশ্বাস টা আটকে আসছিলো এবার!
কাঁপা কাঁপা চোখের পাতা ভিজে এলো চোখের জলে!
“কি হয়েছে বলো আমাকে! আমাকে সবটা বলো অন্বেষা! আমি জানি তুমি কিছু লুকোচ্ছ! কি লুকোচ্ছ! এই অন্বেষা! কি হয়েছে তোমার?”
অন্বেষা এবারে ফেটে পড়লো কান্নায়, কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে চললো –
“আপনি কলকাতা ফিরে যান মিস্টার রয়!
আপনি আমাকে ভুলে যান, আমি আর ফিরবোনা কলকাতা!
আমি বাবাকে এতো কষ্ট দিতে পারবোনা মিস্টার রায়! আমি…
আমি….. বাবাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমি ….আআমি….আআআ…..
থাকতে পারবোনা সত্যি আপনার সাথে!
আজই আপনি সবাই কে নিয়ে ফিরে যান! আমি আপনাকে দুটো হাত জোর করে বলছি আজ দুপুরের ট্রেনেই আপনি ফিরে যান!
আমি সত্যি আপনাকে ভালোবেসেছিলাম, আজও …..আজও…বাসি…..খুব ভালোবাসি…..মিস্টার রায়…..খুব ভালোবাসি….কিন্তু আমি বাবাকে কষ্ট দিতে পারবোনা …….”
মিস্টার রায় কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না, হাত পা টা কেমন যেন অসার মনে হলো….
একবার মনে হলো বুঝি সে আর শরীরের ভরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে!
একদৃষ্টি চেয়ে রইলো সে অন্বেষার দিকে!
অন্বেষা নাকটা টেনে এবারে
খুব দৃঢ় গলায় বললো –
“আমায় ক্ষমা করে দেবেন, নিজের বাড়ির লোককে চিনতে ভুল হয়েছিল আমার! আমি ভেবেছিলাম আপনাকে সামনে সামনি দেখলে বাবা মেনে যাবে,
আপনাকে কোনোদিনও আমি মিথ্যে বলিনি,
বাবা সত্যি আগে বলেছিলো –
পরে দেখা যাবে,
আমি তো বাড়ির বাইরে থাকি, আমি সত্যি বুঝতে পারিনি বাবা ঠিক এতটা কষ্ট পেয়েছে!
যবে থেকে আমি এখানে এসেছি তবে থেকে দেখছি লোকটা খাচ্ছে না, ঘুমোচ্ছে না! আমার সাথে একটুও কথা বলছে না!
পরশুদিন রাতে আমি যখন বললাম বাবা খেয়ে নাও…
আমাকে বললো সে বেঁচে না থাকলেও আমার কি এসে যায়, এখন তো আমি নিজের জীবনের সাথী খুঁজে নিয়েছি!
অথচ মিস্টার রায় আপনি বিশ্বাস করুন উনি নিজেই বলেছিলেন, বলেছিলেন…
আপনি ফোন করলে দেখা যাবে, মানে নিজে মুখে আমাকে বলেছিলো যে ঠিক আছে আগে তো ফোন করুক, তারপর দেখা যাবে!
অথচ আজ সে ভেঙে পড়েছে একদম!
খাওয়া, দাওয়া, ঘুম সব বন্ধ!
এরকম চলতে থাকলে উনি মারা যাবেন!
কাল রাতে হঠাৎ বুকে যন্ত্রনা শুরু হয়েছিল, আপনি জানেন না সেটা, আপনার জানার কথাও নয়, আপনি ওপরের ঘরে ছিলেন!
সারারাত মা আর আমি জেগে ছিলাম!
আপনাদের দেখে যে এতটা ………
………
মিস্টার রায়!
আমার কাছে আমার কেরিয়ার, চাকরি, ও আপনার ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি দামি আমার বাবা!
আপনি আজই দুপুরের ট্রেন ধরে সবাই কে নিয়ে কলকাতা ফিরে যান!
যদি এক মুহূর্তের জন্যে আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন না করেই আপনি ফিরে যান!
এটা বোধহয় আপনার সাথে আমার শেষ দেখা! আপনার সামনে আমি আর কোনোদিনও আসবোনা!
পারলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন
আর আমাদের সব স্মৃতি গুলো ভুলে যাবেন!”
অন্বেষার গলটা আবার ভেঙে এলো!
চোখ থেকে দুফোটা জল আবার গড়িয়ে পড়ার আগেই অন্বেষা হুড়হুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলো!
***************************************************
“দাদাভাই তুই কারণ টা তো বল….
হঠাৎ কি হলো? কাল রাত অবধি তো সব ঠিক ছিল, এভাবে এতো ভোরে আমরা….
দাদাভাই…..প্লিজ……প্লিজ….
বাবা প্লিজ ওকে জিজ্ঞেস করো ও কেন এরকম করছে……”
“অরুণ! কি হয়েছে…
তুই যদি পুরো ব্যাপারটা আমাদের খুলে না বলিস তাহলে আমরা কি ভাবে বুঝবো বলতো!
এভাবে হঠাৎ আমাদের এতো ভোরে তুলে দিয়ে বলছিস এক্ষুণি কলকাতা ফিরবি!…..
কিছু তো বল! কেউ তোকে কিছু …..”
মিস্টার রয় একমনে শুভ্র ও তার ব্যাগ গুছিয়ে চললেন,
তারপর হুড়হুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে দাঁড়ালেন উঠোনে,
অন্বেষা তখন মেনকা দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলো,
তুলসী মঞ্চটার সামনে দাঁড়িয়ে…..
মেনকা দেবী মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিলেন…..
হঠাৎ মিস্টার রায় কে নামতে দেখে থমকে দাঁড়ালো দুজনেই!
অন্বেষার দিকে তাকিয়ে খুব দৃঢ় গলায় বললো সে –
“মিস মিত্র …….
একটা শেষ উপকার করে দিন…. রিরিকে গিয়ে ডেকে দিন…….”
অন্বেষা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মিস্টার রায়ের দিকে!
অস্ফুট স্বরে বললো –
“এখন, সবে ৬:০০ মিস্টার রায়…..”
“আপনার ঘরটা কোন দিকে? কি হলো কি…. আপনার ঘরটা কোন দিকে??”
ভাঙা গলায় বেশ চিৎকার করে প্রশ্ন টা করলো মিস্টার রায়!
“মিস্টার রায়! আপনি এরকম কেন করছেন? এতো সকালে আপনি …..”
“আমি তোমার কাছে হাত জোর করছি অন্বেষা! প্লিজ! সাতসকালে সিন ক্রিয়েট করতে ইচ্ছে করছেনা জানতো! যাও গিয়ে রিরি কে ডেকে দাও…প্লিজ…..
আমরা এক্ষুণি বেরোবো….”
এতক্ষণে অন্বেষা দেখলো শুভ্র ও রুদ্রনীল বাবু হাতের লাগেজ নিয়ে নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে……
শুভ্র এবারে একটু এগিয়ে এসে অন্বেষার দিকে চেয়ে বললো –
“তুমি কিছু জানো অন্বেষা……দাদাভাই….কেন….”
শুভ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার রায় এবারে বেশ জোর গলায় চিৎকার করে বললো –
“মিস মিত্র! প্লিজ…..প্লিজ ……. প্লিজ……….
আমি অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে বলছি আমার বোন কে আপনি ডেকে দিন! অনেকক্ষণ থেকে আমি বলছি…..রিরি কে ডেকে দিতে…..
রিরিকে কে বলুন আমি ডাকছি…..”
কথাটা শেষ হতে হতেই মিস্টার রায়ের গলা টা ভেঙে এলো আবার!
অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলো এবারে নিজের ঘরের দিকে…
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই রিরি সামনে এসে দাঁড়ালো মিস্টার রায়ের….
“দাদাভাই….কি হয়েছে….” ঘুম জড়ানো চোখে প্রশ্ন করলো সে……
“রিরি! আমার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ এসেছে গিয়েছে ওকে?
তাই আমাদের এক্ষুণি বেরোতে হবে, এক্ষুণি! আমরা এখানেই দাঁড়িয়ে আছি, তুমি তৈরী হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে এসো…..
কেমন?”
খুব স্থির গলায় কথাটা শেষ করলো মিস্টার রায়!
“কিন্তু দাদাভাই….আমরা..তো…”
“কোনো প্রশ্ন করবেনা তুমি রিরি! যথেষ্ট ধৈর্য্য নিয়ে আমি তোমায় বুঝিয়েছি…..
যাও রেডি হয়ে নাও…”
স্থির গলাটা এবারে কেমন যেন কর্কশ হয়ে এলো মিস্টার রায়ের…..
মেনকা দেবী এতক্ষণে খুব মৃদু ভাঙা ভাঙা
স্বরে বললেন – “এতো সকালে না বেরিয়ে দুপুরে কিছু খাওয়াদাওয়া করে না হয়…..”
মিস্টার রায় চেয়ে দেখলেন মেনকা দেবীর দিকে……
একটা ঢোক গিলে বললেন –
“মাসিমা, আপনি বোধহয় সবটা জানেন!আমার এমনিই মাথাটা কাজ করছে না জানেন তো!
এত সকালে আপনাকে দুটো খারাপ কথা বলে দিলে আপনারাও ভালো লাগবে না, আমারও ভালো লাগবে না!
তাই আপনি ঘরে গিয়ে বসুন! আমরা এক্ষুণি বেরিয়ে যাবো!”
মিস্টার রায়ের কথাটা শেষ হতে না হতেই
শুভ্র ব্যাপারটা খানিকটা হলেও আঁচ করতে পারছিলো! কিছু একটা বড়োসড়ো সমস্যা হয়েছে, তবে তার দাদাভাই কিছুতেই সবটা বলতে রাজি নয়!
এখন এখানে দাঁড়িয়ে কিছু না জিজ্ঞেস করে বাড়িতে ফিরে সবটা শোনাই ভালো!
অন্বেষা এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে……
খাটের একটা কোণায় চুপচাপ বসে রইলো, বিন্দু বিন্দু জল চোখের কোল বেয়ে আবার নেমে এলো গালে….
“কি হয়েছে মিস?”
রিরি একটু থমকে দাঁড়িয়েছে এতক্ষণে………
অন্বেষা কোনোমতে চোখের জলটা মুছতে মুছতে বললো –
“দাদাভাই ওয়েট করছে রিরি, এখন তুমি যাও, Bye!”
রিরি তখনও ব্যাগ নিয়ে বেরোয়নি ঘর থেকে,
হঠাৎ অন্বেষার কানে এলো মিস্টার রায়ের আওয়াজ!
বেশ উঁচু গলায় মিস্টার রায় কাকে যেন বলে চলেছে –
“……..হ্যাঁ আপনার বাড়িটা ভদ্র লোকের
বাড়ি, তাই এরকম অনেক ভদ্র নিয়ম থাকবে আপনার বাড়িতে, কিন্তু কি করবো বলুন? আমরা তো ভদ্র মানুষ নই! তাই আপনাদের মতন ভদ্র মানুষের নিয়ম আমাদের মতন অভদ্র মানুষ মানে না….”
অন্বেষা মুহূর্তে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, ছুটতে ছুটতে গিয়ে পৌঁছলে মিস্টার রায়ের সামনে,
ঠিক! যেটা সে ঘরে বসে আন্দাজ করেছিল সেটাই ঘটে গিয়েছে এতক্ষণে!
এরই মধ্যে কথাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে মিস্টার রায়ের ও সমরেশ বাবুর….
“মিস্টার রায়! আপনি আমার বাবার সাথে একদম এরকম ভাবে কথা বলবেন না”
“একশো বার বলবো….
আমার যেরকম ইচ্ছে, আমি সেই ভাবে কথা বলবো,
আর তুমি আমাকে শেখাবে না আমি কি ভাবে কথা বলবো না বলবো, ওকে?
কি ভাব কি তোমরা নিজেদের? হ্যাঁ!
একবার তুমি বলবে তোমার জীবন থেকে সরে যেতে, তোমার বাবা চান না সেটা, আবার তোমার বাবা বলবে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরোতে, আমরা এখানে খেতে এসেছি? সব কিছু মজা মনে হয় তোমাদের!
হ্যাঁ…..”
সমরেশ বাবু কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আবার গলা চড়িয়ে মিস্টার রায় বলে চললেন….
“ভদ্রতা শেখাচ্ছে উনি আমাকে! আর আমাদের সাথে তোমরা যেটা করলে সেটা ঠিক?
আরে নিজের বাবার জন্যে এতই চিন্তা ছিল তো বাবা কে জিজ্ঞেস করে প্রেম করতে পারতে…..
তুমি নিজে এসেছিলে অন্বেষা আমার জীবনে! আমি আসিনি ওকে?
খানিকটা আমায় টেনে নিয়ে এসেছিলে তুমি তোমার জীবনে, আর যখন…..”
কথাগুলো আবার জড়িয়ে এলো মিস্টার রায়ের! আর কোনো কথা বলতে পারলেন না…
গলার কাছে একটা চাপা কান্না আটকে এলো আবার!
সমরেশ বাবু আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন…
“আমাকে কেউ বলো…..”
সমরেশ বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্বেষা আবার বলে উঠলো –
“বেশ! আমি ভুল করেছি আপনার সাথে,
যা বলার আপনি আমায় বলুন!
এর মাঝে আপনি আমার বাবা কে টেনে আনবেন না! সব দোষ আমার! আমি ভুল করেছি, তাই কিছু বলতে হলে আপনি আমায় বলবেন….”
“দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমি যেচে তোমার বাবার সাথে ঝগড়া করিনি ওকে? তখন থেকে উনি আমাকে বলছেন বাসি মুখে না বেরোতে…….এই সেই…..
তুমি যে কথাটা আমায় বললে একটু আগে তারপর আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে? বলো চুপ করে রইলো কেন? এটা আগে বলো….
কি ভাব তুমি………
………. আমার বাবা নেই, মা নেই বলে যা খুশি তাই করবে?”
“মিস্টার রায় ইউ আর জাস্ট গোয়িং টু ফার”
“ওহ! রিয়েলি অন্বেষা! আই …”
মিস্টার রায়ের গলাটা একটু নীচু হতেই সমরেশ বাবু বললেন
“কেউ এবারে আমাকে বলবে কি হয়েছে ব্যাপার টা? অন্বেষা কি হয়েছে? কি বলেছিস তুই? অন্বেষা…..
….বেশ! আমাকে বলবি না তাইতো? তাহলে তুমি বলো অরুণ….”
মিস্টার রায় খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন অন্বেষার দিকে চেয়ে তারপর খুব নীচু গলায় বলে চললেন –
“ও একটু আগে ছাদে এসেছিলো,
…….আমাকে বললো চলে যেতে আজকেই ………
ও আমার সাথে থাকতে পারবে না কারণ আপনি সেটা পছন্দ করছেন না……. ইনফ্যাক্ট আমাদের সমর্কটা আপনি মেনে নিতে পারছেন না মন থেকে…..
…..আপনার শরীর খারাপ হচ্ছে,
….ওর কাছে আমাদের ভালোবাসাটা ততটা ইম্পরট্যান্ট নয় যতটা আপনার ভালো থাকাটা…….”
কথাটা শেষ করে মিস্টার রায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ……
তারপর আবার বলে চললেন –
“ইটস ওকে স্যার, আমার সমস্যা এটা নয়
যে ও আপনাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে,
আমার সমস্যা এটা যে আপনার সাথে পুরো ব্যাপারটা আলোচনা না করে, ও নিজে সিওর না হয়েই, আমাকে অনেক মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়েছে!”
না চেয়েও মিস্টার রায়ের গলাটা ভেঙে এলো এবারে!
“বুঝলাম! তা …..অন্বেষা বললো ….আর তুমি অমনি ব্যাগপত্র গুছিয়ে কলকাতা যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে গেলে!
মানে কোনো প্রয়োজন নেই আমার সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করার, আমাকে অন্তত একবার পুরোটা জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না তুমি, তাইতো?”
“আমি বুঝতে পারছিলাম না স্যার, কি বলবো!
মানে একবার মনে হলো বলি যে – অন্বেষার ….সাথে …..সারাজীবন থাকার….জন্যে….আমি সব ….করতে পারি….এটা একবার বলি আপনাকে..
তারপর মনে হলো…..
হয়তো আমি ওর যোগ্য নয়…
অনেক ভাবনা চিন্তা করেই….হয়তো…
আপনি ব্যাপারটা তে না বলেছেন…..
মানে চেয়েও…আমাকে মেনে নিতে পারছেন না…… কিছুতেই……..
ভাবলাম থাক…..
আমার জন্যে আপনাদের সম্পর্ক কেন খারাপ হবে? তার চেয়ে আমি ….ফিরে যাই….এর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন পরিস্থিতি দেখেছি জীবনে……
মানিয়ে নেব আবার……আবার আসতে আসতে …..সব…..হয়তো …..”
ভাঙা ভাঙা গলায় খুব কেটে কেটে কথাগুলো বলে দাঁড়িয়ে রইলেন মিস্টার রায়….
চোখের সামনে টা আবারো ঝাপসা হয়ে এলো…..মিস্টার রায়ের…..
সমরেশ বাবু গলা টা পরিষ্কার করে বললেন –
“বসো, এখানে বসো……
চোখের জলটা আগে মোছো……
দেখো অরুণ আমি কিন্তু একটাবারের জন্যেও চাইনি যে তোমরা আলাদা হয়ে যাও…..
বরঞ্চ আমার শুরুর দিকে মত ছিলোনা, তবে এখন আমি পুরোপুরিই রাজি…..
অন্বেষার ওপর অভিমান হয়েছে আমার, তোমার ওপরেও হয়েছে একটু, তবে সেটা এই জন্যে নয় যে তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসো!”
অন্বেষা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সমরেশ বাবুর দিকে!
সব কিছু কেমন গুলিয়ে আসছিলো….
এবারে সমরেশ বাবু অন্বেষার দিকে চেয়ে বললো –
“তুই অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছিস দেখেছি! তুই থাকতে চাস তো অরুণের সাথে? নাকি নিজেদের বনিবনা হচ্ছেনা বলে বাবার নামটা ঢুকিয়ে দিয়ে…..”
“নাহ! বাবা….
আমিও খুব…ভালো… ভালোবাসি…..ওকে…..কিন্তু আমার মনে হয়েছিল তুমি খুশি নয়….”
“খুশি নয় তো! তবে সেটা অন্য একটা ব্যাপার! তোর আর আমার ব্যাপার! সেটা থেকে নিজে নিজে একটা কিছু বুঝে সাতসকালে ছেলেটা কে বলে দিলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে! হ্যাঁ?
কি রে……
…….দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদিস না …..
উত্তর দে…..খুব বড়ো হয়ে গিয়েছিস দেখছি…..
হ্যাঁ…….”
“এই ব্যাপার নয় তো কি ব্যাপার তবে….”
কাঁদোকাঁদো গলায় প্রশ্ন করলো অন্বেষা…..
“সেটা এক্ষুণি বলতে হবে? সবার সামনে? সবার সামনে বললে তোদের ভালো লাগবে তো?”
“স্যার! বলুন না! পুর সত্যি টা না শুনলে আমার মনের মধ্যে …..
……আসলে শুধু অন্বেষা বলেছে বলে নয়….কাল রাতে ……আপনি সেরকম ভালো করে কথা বললেন না…..”
“কাল আমি তোমাকে কিছুই বলিনি….বললাম রাত হয়ে গিয়েছে ….বিশ্রাম করো….এইবার এইটা যদি তোমার খারাপ লেগে থাকে….”
“না না খারাপ লাগেনি….ব্যাস……আপনি কি বলছিলেন বলুন না…..”
“এটা একটা ছোট্ট ব্যাপার! এতটাই ছোট্ট যে বাকিরা শুনলে হয়তো হাসবে……
তবে আমার জন্যে এটা অনেক বড়ো ব্যাপার…..
আমার ব্যাপারটা তে খারাপ লেগেছে তাই!
…..অরুণ একটু পরিষ্কার করে বলি….
তোমার, অন্বেষার দুজনেরই বুঝতে সুবিধে হবে…..”
“হ্যাঁ স্যার!”
“আচ্ছা….তো…অক্টোবর নাগাদ ….
অন্বেষা আমাকে বললো সবটা…..
সব মানে ও যা যা জানতো পুরো ঘটনা টা…
আমার কাছে ও কোনোদিনও কিচ্ছু লুকোয়নি ….কোনোদিনও আজ অবধি একটা মিথ্যে বলেনি…..
যাই হোক ও তো বলে চলে গেলো ওর কথা…
একরকম জেদ করেই বললো …..
আমি বিয়ে করলে মিস্টার রায় কেই করবো….
হলো…মেয়ে বড়ো হয়েছে…..
ভালোবেসেছে…..সব ঠিক আছে… তো আমি একটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করি তোমার ব্যাপারে খোঁজখবর লাগানোর জন্যে…..আমার বিশ্বাস এটার জন্যে তুমি নিশ্চয় আমায় ভুল বুঝবেনা……”
“না! স্যার একেবারেই…না ….আপনার জীবনের চেয়ে বেশি
মূল্যবান জিনিষটা কাউকে দেওয়ার আগে …আপনি তো দশবার ভাববেন এটাই স্বাভাবিক!”
“হমম! সেই ….যাই হোক…তারপর তুমিও জানো…অক্টোবরের পর অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে….
যাই হোক সেই এজেন্সি তোমার ব্যাপারে একটাও খারাপ কিছু বলেনি…..
সব ঠিক…সব ভালো…..আমিও খুব খুশি….
ওর জন্মদিনের দিন বললাম বলিস অরুণ কে ফোন করতে….
তুমি ফোন করলে না……
তোমার জেঠ্যামশাই প্রথম ফোন করলো একদম ঠিক ছিল এই অবধি….
কিন্তু তুমি তারপরেও ফোন করলে না….
যাইহোক তুমি ব্যস্ত মানুষ….
আমাদের মতন ছোটোখাটো ব্যবসাদার……
”
“স্যার….প্লিজ…..স্যার….স্যার….”
“বসো অরুণ….. বসো….. পুরোটা শোনো আগে…..
হমম তো কোথায় ছিলাম….তুমি আমায় একটাও ফোন করলে না…..
ব্যাপারটা একটু মনে লাগলো…..জানো…ভাবলাম বুঝি….তোমার কাছে আমরা বড়ো তুচ্ছ…..”
“নাহ স্যার! এটা একদমই ঠিক নয়….”
“তবু আমি কিচ্ছু বলি নি….
তারপর এজেন্সির লোকটা আমাকে ফোন করে বলে, ছেলেটা একটা মেয়ের সাথে বেরোচ্ছে, ওরা হঠাৎ করেই দেখতে পেয়েছে, এমনিও ওরা Randomly
ফলো করে!
ওদের তো অনেক টার্গেট!
আমি অন্বেষা কে ফোন করছি, ফোন টা বলছে সুইচ অফ, সুইচ অফ!
সেদিন রাতে পুরো পাগল পাগল লাগছে…..
রাতে দশটা নাগাদ ফোন করে বলছে….অফিসের কাজ ছিল… তাই
ফোন বন্ধ ছিল…,..
মেয়ের ওপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি আমি!
ও যখন বলছে ও ছিলোনা…..তাহলে ছিলোনা….
এদিকে রাতের ঘুম বন্ধ ….
রুদ্রনীল বাবু বললেন সামনের মাসেই আসছি….
অথচ ছেলেটা কার সাথে ঘুরছে………
লোকটাকে বারবার বলছি আপনি ঠিক দেখছেন তো দাদা,
লোকটা বলে হ্যাঁ…..বিশেষ করে শনিবার গুলোতে বেরোচ্ছে…..
তারপর কথায় কথায় আমি লোকটা কে একদিন পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করলাম, যে ছেলেটাকে আপনি দুটো মেয়ের সাথে দেখছেন, কারণ আমি জানি মাঝেমাঝে অন্বেষা ফেরে তোমার গাড়িতে!
তো লোকটা আমাকে বলে যে তারা কনফার্ম একটাই মেয়ে আছে! যে অফিস থেকে ফিরে চিংড়িঘাটা ড্রপ হচ্ছে, সেই মেয়েটি শনিবার করে বেরোচ্ছে…..
তারপর প্রতি শনিবার তোমার অন্বেষা তোমারই সামনে বসে রোজরোজ আমায় মিথ্যে বলে গিয়েছে আর তাতে তুমিও ওকে বাঁধা দাওনি…….
তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছিনা অরুণ….
দোষ আমার মেয়েরই ……
তবু তুমি তো ওর ক্লাসমেট নও….ওর চেয়ে বয়েসে অনেকটাই বড়ো ……
রেস্তোরাঁ তে বসে তোমার সাথে ডিনার করছে, লাঞ্চ করছে, আমি ফোন করলেই বলছে ল্যাবে আছি…….
আমাকে সত্যিটা বললে আমি দুচার মিনিট কথা বললে তোমাদের পার্সোনাল টাইম নষ্ট হবে, তাই সব চেয়ে ভালো বলে দাও অফিসে আছি……
বাবা তো ফালতু লোক, ফালতু সময়ে ফোন করে অকারণে ডিস্টার্ব করবে…..
কত দামি রেস্তোরা, দামি গাড়ি, তার মাঝে বাবার ফোন বড্ডো বেমানান! তাইনা অরুণ….”
মিস্টার রায় সবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো কি অন্বেষা এসে জাপ্টে ধরলো সমরেশ বাবু কে!
তারপর অঝোরে কাঁদতে শুরু করে সমরেশ বাবু কে জড়িয়ে ধরে
কাঁদতে কাঁদতে বলে চললো
“…..না বাবা …প্লিজ এরকম বলোনা! প্লিজ এরকম বলোনা ….আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা!
খুব কষ্ট হচ্ছে…..আমি ভয় পেতাম তোমায় বলতে! ভাবতাম তুমি কি মনে করবে ….না করবে! আর কখনো হবেনা….”
তারপর বাবা ও মেয়ের দুজনেরই অভিমান শেষ হলো চোখের জল দিয়ে……
খানিক বাদে মেয়ের চোখের জলটা মুছিয়ে দিতে দিতে সমরেশ বাবু বললেন –
“আর আজ তুই কি করলি? হ্যাঁ ? কি ভেবে তুই এতো বড় একটা কথা বললি? বাবা চায়না….হমম….আর তোর সেও তাই! তুই একবার বললি কি বললি না, সে একদম ব্যাগ গুছিয়ে রেডি!”
আর রুদ্রনীল বাবু আপনিই বা কি মনে করে বেরোচ্ছিলেন? গতকাল তো আপনাকে আমি বললাম ফোনে মাসের প্রথমে একটু ভিড় হয়ে দোকানে,
সেদিন দোকান বন্ধ থাকলে ক্ষতি বেশি হয় ব্যবসার, আজকে আপনার সাথে আমার বসার কথা……
আপনি আমার মতামত না নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন!”
“আসলে অরুণ এমন করছিলো তখন…..”
“যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে! দুপুরের স্নান খাওয়া সেরে তার পর না হয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে? কেমন?”
“একদম!”
“আর অরুণ……”
“হ্যাঁ স্যার!”
“বলছিলাম আর একটা তথ্য পেয়েছি তোমার ব্যাপারে!
তুমি নাকি দারুণ মাউথঅর্গান বাজাতে পারো! আবার এটাও শুনলাম ব্যাগে করে এনেছো সেটা এখানে! তাহলে কখন শোনাচ্ছ?”
মুহূর্তেই অন্বেষার মুখে একটা স্বচ্ছ হাসির রেখা ফুটে উঠলো!
**************************************************
(আট বছর পর………)
রয় ম্যানশনের চেহারা পুরোপুরি বদলে গিয়েছিলো এই আট বছরে!
বাইরের সাদা মার্বেলের প্লেটটায় বাংলা হরফে লেখা “প্রেম কুঠির!”
লোহার গেট সরিয়ে বসানো হয়েছিল গ্রিলের গেট….
গ্রিলের গেটের ফাঁক দিয়েই দেখা যেত প্রেম কুঠিরের সাজানো গোছানো বাগান!
বাগানের টবে ছিল মরশুমি সবজি,
ও নানান রঙের ফুলের গাছ….
প্রেম কুঠিরের বসার ঘরটাও ছিল বেশ অন্যরকম!
দেওয়াল গুলো খানিক ভেঙে, বাড়ানো হয়েছিল জানালার দৈর্ঘ!
জানালা বেয়ে নেমে আসা রোদ পড়তো বসার ঘরের মেঝেতে!
ডাইনিং থেকে ডান দিকে এগিয়ে গেলেই পরে বেশ সুন্দর গোছানো একটা ছোট্ট ঘর!
ছোট্ট ঘরের দেওয়াল কেটে ঘরের তিনদিকে বসানো হয়েছিল কাঁচের জানালা, জানালার পাশেই লাগানো কাঁচের Shelves!
Shelves এর ওপর নানান রঙের কাঁচের বোতলে সাজানো ছিল পাতাবাহারি গাছ!
ঘরের রংচটা আলমারি ও সোফা টা বহুদিন আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল এক্সচেঞ্জ অফারে!
সোফাটার জায়গাতে একটা ছোট্ট লোহার খাট ও রংচটা আলমারির জায়গায় একটা ওয়াল ফিটিং কাপবোর্ড!
এই ছোট্ট ঘরটাতে বসবাস করেন
হারাধন জেঠু…..
তাকে আর এখন রান্নাঘরের মেঝেতে ঘুমোতে হয়না….
ঘরের তানপুরা থুড়ি সেতার টা, আরও একটা সেতারের পাশে শোয়ানো রুদ্রনীল বাবুর সংগীত চর্চার ঘরে,
সেই ঘরে অবশ্য এখন সংগীত চর্চার লোক একজন নয় দুজন –
রুদ্রনীল রায় ও অরুণজিৎ রায়!
সেই ঘরেই ইদানিং একটা মিউজিক স্কুলও খুলেছেন রুদ্রনীল বাবু!
মিউজিক স্কুলের ঠিক পাশেই তার নিরিবিলি ঘর, যেখানে সে সারাটাদিন আজও মত্য – কোনো এক অজানা প্রেম উপন্যাসের খোঁজে!
সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতেই প্রথম ডানদিকের ঘরটা এবাড়ির সবচেয়ে গোছানো ও সুন্দর ঘর!
ঘরে ঢুকতেই দেখা যায় বৃহৎ একটা ড্রেসিং টেবিল!
ড্রেসিং টেবিলে সাজানো বিভিন্ন মেকআপ! কিছু ইমপোর্টেড, কিছু দেশি, কিছু আবার নিজেদের কম্পানির!
ড্রেসিং টেবিলের পাশেই একটা বিশাল Wardrobe, ওয়ার্ডরোবে সাজানো একশোরও বেশি পোশাক,
না! এই পোশাক গুলো এই ঘরে থাকা মেয়েটির নয়! এই পোশাক গুলো তার নিজের তৈরী করা!
পোশাক গুলোর গায়ে কালো ট্যাগের ওপর সোনালী অক্ষরে লেখা – “Ritika’$”
সে এখন একজন নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার!
দোতলার সব চেয়ে বাঁ দিকের ঘরটায় দেওয়াল জুড়ে লাগানো নবদম্পতির ছবি!
নতুন খাট, বিছানা, আসবাবপত্র!
ঘরের খাটে এখনো পরে একটা শুকনো
রজনীগন্ধার কুঁড়ি!
গতকাল ফুলশয্যা সেরে তারা এখন মধুচন্দ্রিমায় ফিফি আইল্যান্ড!
যদিও পুরো প্ল্যানটাই ছিল তার দাদাভাই ও তার বৌদি – অন্বেষার!
এ-বাড়ির শেষ ঘরটা
সব চেয়ে বেশি অগোছালো!
সিনিয়ার Analytical কেমিস্ট যতই এই ঘরটা গুছিয়ে রাখে…..
জুনিয়র মিস্টার রায় ততই অগোছালো করে দেয় সেটা বারবার!
জুনিয়র মিস্টার রায় – নাম অরণ্য! বয়েস ফোর প্লাস! তার স্বপ্ন – সে বাবার মতন মাউথঅর্গান বাজাবে!
মাউথঅর্গান না শুনলে রাতের খাবার প্লেট থেকে ওঠে না পেটে….
রয় এন্ড রয় এর ফাইল পত্র মোটেই পছন্দ নয় অরণ্যের…
বিছানায় একটা ফাইল কোনোদিন মিস্টার রায় রাখলে সেটা আর পরের দিন একটুকরো হয়ে ফেরেনি অফিসে!
অগত্যা অন্বেষাদের ঘরে অফিস ফাইল আনা বারণ!
ওই অগোছালো ঘরটা ভর্তি ভালোবাসায়,. সুরে ও দুষ্টুমি তে!
****************************************************
সকাল ৮:০০!
অরণ্য কে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে, স্নান সেরে, ভেজা চুলে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসলো অন্বেষা!
আজ দিনটা বিশেষ!
আজ সাত বছর পূর্ণ হলো ওদের বিয়ের!
ভেজা চুলের ফাঁকে মুহূর্তেই কেটে দিলো সিঁথি, তারপর আঙুলে সিঁদুর নিয়ে ঠেকিয়ে দিলো মাথায়,
তারপর ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা ঠাকুরের ফটোর দিকে চেয়ে, হাত জোর করে, চোখ দুটো বন্ধ করে বসে রইলো খানিকক্ষণ….
চোখ দুটো খোলার আগেই একটা পরিচিত হাতের আদুরে স্পর্শে মগ্নতা কাটলো অন্বেষার!
কানে কানে, চেনা ভালোবাসায় মাখা আওয়াজ টা ফিসফিস করে বলে উঠলো –
“শুভ বিবাহ বার্ষিকী!”
চোখ দুটো খুলতেই অন্বেষা
আয়নায় দেখলো মিস্টার রায়ের ঘুম জড়ানো দুটো চোখ!
সেই দুটো চোখ – যার চাহুনি কোনোদিনও পুরনো হলোনা!
সেই দুটো চোখ – যেখানে অন্বেষা বারবার খুঁজে পেয়েছি নিজেকে!
“আয়েই আজ একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্যে! আর আই প্রমিস আজকের সারপ্রাইজ টা তোমার খুব ভালো লাগবে!”
“বুঝলাম! তার আগে আমিও একবার বলি – শুভ বিবাহবার্ষিকী”
আদুরে আওয়াজে কথাটা শেষ করলো অন্বেষা!
মিস্টার রায় এবারে দুটো হাত রাখলো অন্বেষার কাঁধে! তারপর আবার ফিসফিস করে বললো – “আগে চোখ বন্ধ করো!”
“ওকে! করলাম!”
“নো চিটিং ওকে?”
“ওকে! মিস্টার রায়! আর কতক্ষণ?”
“জাস্ট ৫ কাউন্ট করো ….!”
“ওকে! ১ ……২…….৩……৪……….”
“ওকে! ওকে! চোখ খোলো এবারে!”
অন্বেষা চোখ খুলে চেয়ে রইলো অবাক হয়ে!
মিস্টার রায়ের হাতে একটা বই……
বইটার নাম “পাতাঝরার শেষে!”
বিন্দুবিন্দু জল চোখের কোল বেয়ে নেমে এলো গালে, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এলো অস্ফুট স্বর –
“মিস্টার রায়! এটা সেই বইটা? এই বইটা তুমি….”
“হমম তোমায় নিয়ে লিখেছি……
সত্যি বলছি সোনা! এতো দেরি হতোনা….তুমি জানতো বাংলা লিখতে, সমস্যা হয়!
তারপর কাজের চাপ, শুভ্রদের বিয়ে, রিরির চাকরি…..এন্ড ফাইনালি আমাদের বিচ্ছু টা…….
সবাই কে ম্যানেজ করতে করতে বড্ডো দেরি হয়ে গেল …….
উউফ আমাদের বিচ্ছুটা থাকলেই দেখতে, মুহূর্তেই কেমন এটা কে দু-আধখানা করে দেখিয়ে দিতো!”
“অন্বেষার ভেজা দুটো গালে ফুটে উঠলো অনাবিল হাসির রেখা!”
জড়িয়ে ধরলো সে তার মিস্টার রায় কে….
ফিসফিস করে বলে উঠলো –
“তুমি সত্যি এটা আমাকে নিয়ে লিখেছো?”
“হমম তো! বিশ্বাস না হলে পরেই দেখো!……
ও ভালো কথা সোনা…..
আমি ওবাড়ি তে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি, ওরা কিন্তু দুপুর দুপুর এসে পড়বে……
আজ তোমাকে রান্না করতে দেবোনা!
আজ আমি আর হারাধন জেঠু মিলে রান্না করবো! তোমার বাবা যদিও তোমার হাতের রান্না খেতেই বেশি পছন্দ করেন, তাও একদিন না হয় জামাইয়ের হাতে রান্না খেলো! আবার এখন বাজার যেতে হবে…..তুমি বরং একটা ফর্দে…..”
“মিস্টার রায়!”
“কি মিসেস রায়?”
“এসব বাজার, রান্না ছেড়ে একটু আদর করোনা…..এখন…….প্লিজ ……. ”
অন্বেষার কথাটা শেষ হতেই মিস্টার রায় আরও একটু কাছে টেনে নিলো অন্বেষা কে!
অন্বেষাও আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মিস্টার রায় কে! তারপর
নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিলো সে
মিস্টার রায়ের বুকে!
সমাপ্ত!!