#পারমিতা
পর্ব ২৯
_নীলাভ্র জহির
ডিভোর্সের পর যে স্বামী কখনো সন্তানের খোঁজ খবর নেয়নি, স্ত্রী ও সন্তান কোন স্রোতে ভেসে গেলো তার খেয়াল রাখেনি, সেই স্বামীই একটা সময়ে গিয়ে যখন সন্তানের দাবী নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন ডিভোর্সি স্ত্রীর কেমন অনুভূত হয়? এরচেয়ে অপমানজনক ও কষ্টের ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। পারমিতার এখন সেই কষ্টটাই হচ্ছে।
রাসিফ আজকে পারমিতার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। অফিসে যাওয়ার সময় পারমিতা প্রীতুলকে সঙ্গে করে বের হয়েছে, এমন সময় রাস্তায় রাসিফকে দেখে ওর চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। রাসিফ দৌড়ে কাছে এসে বলল, এটা আমার প্রীতুল? আমার সন্তান!
প্রীতুলকে বুকে টেনে নিলো রাসিফ। আচমকা এই আচরণে পারমিতা ভীষণ অবাক হয়ে গেলো। অনেক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে রাসিফের দিকে তাকিয়ে রইলো পারমিতা। প্রীতুল রাসিফের কোল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পারমিতার পেছনে এসে লুকালো। বলল, আম্মু এই লোকটা কে? ওকে যেতে বলো।
পারমিতা স্বস্তি পেলো। প্রীতুল ওর বাবার কথাকে গ্রাহ্য করেনি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পারমিতা বলল, বাবা এই লোকটা একটা খারাপ লোক। এজন্য অন্যের রাজকুমারকে নিজের ছেলে বলে চুরি করতে এসেছে। তুমি একদমই ওর কাছে যাবে না বাবা। চলো আমরা চলে যাই।
– আম্মু এই চোরটাকে পুলিশে দাও। এক্ষুনি পুলিশে ফোন করো।
রাসিফ অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, নিজের ছেলেকে এসব কি বলছো তুমি? আমি চোর?
– হ্যাঁ। তুমি মেরুদণ্ডহীন, কাপুরুষ।
প্রীতুল জিজ্ঞেস করল, আম্মু কাপুরুষ কি?
– এই লোকটাকে দেখ বাবা। এই লোকটা একটা কাপুরুষ। এর চাইতে জঘন্য লোক এই জগতে আর নেই। এই লোকটা তার লক্ষী স্ত্রী আর সন্তানকে মেরে ফেলেছে।
প্রীতুল ভয় পেয়ে আতংকে জড়িয়ে ধরলো পারমিতাকে। পারমিতা প্রীতুলকে শক্ত করে আকড়ে ধরে বলল, বাবা চলো। এই লোকের সঙ্গে আমরা কথা বলবো না।
– চলে যাওয়ার আগে একটা কথা শোনো পারমিতা। আমি সবকিছু আলোচনার মাধ্যমে একটা ফয়সালায় আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সেটাকে নষ্ট করে দিলে।
– কিসের ফায়সালা? কি করবে তুমি? প্রীতুলকে জোর করে নিয়ে যাবে? মামলা করবে? যাও যা ইচ্ছে করো।
– আমি সেসব কিছুই করবো না। চলো আমরা দুজন বসে কথা বলি। আমরা আলোচনার মাধ্যমে একটা সেটেলমেন্টে আসি?
– কখনোই না। তোমার মতো মানুষের সঙ্গে কোনো আলোচনা নেই। যে আমাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আমার ছোট্ট দুধের শিশুটাকে নিয়ে আমি পথে পথে ঘুরেছি।
– আমি সেসবের জন্য অনুতপ্ত।
– সবাই অনুতপ্ত হতে পারে না। তুমি তো কখনোই নও। রাসিফ, আর কখনো আমার বাসার সামনে আসবে না। তাহলেই আমি খুশি হবো।
রাসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ভেবে দেখো। যদি কোনো সমাধানে আসতে চাও তাহলে আমাকে একটা মেসেজ দিও। আমি তোমার সঙ্গে আর সম্পর্ক গড়তে চাই না। কিন্তু নিজের রক্তকে আমি চাইতেই পারি। এ আমার অধিকার।
– কাপুরুষের কোনো অধিকার নেই। চলে যাও এখান থেকে।
– বহুত বড় বড় কথা শোনালে আজকে পারমিতা। মনে রাখিও।
– তুমিও মনে রাখিও। এইসব কথা নয়তো আরও বারবার শুনতে হবে।
রাসিফ চলে যেতে শুরু করলে পারমিতা প্রীতুলকে নিয়ে একটা সিএনজিতে এসে উঠলো। প্রীতুলকে ডে কেয়ারে রেখে পারমিতা অফিসে যাবে। অফিস থেকে আজকে ছুটি নেয়া সম্ভব না। অফিস শেষ করে সামান্তার রিসিপশনে যেতে হবে।
আজ অফিস শেষ করতে দেরী হয়ে গেল। কাজের চাপ ছিল প্রচুর। রোদ আজকে অফিসে আসে নি। গতকাল রাতে পারমিতার পাঠানো মেসেজের রিপ্লাইতে লিখেছে, লোকেশন পাঠিয়ে দিও।
এরপর থেকে আর কোনো কথাই হয়নি দুজনের। পারমিতা লোকেশন জানিয়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই আজকে দেখা হবে। দেখা হলে ওর সঙ্গে অনেক কথা বলার আছে।
অনেক কথা বলার থাকলেও হয়না বলা কিছুই। রোদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে রোদ নিজেই কথা বলে যাচ্ছে। পারমিতা চুপচাপ। তবে প্রতিদিনের মতো আজ রোদের প্রাণচাঞ্চল্য নেই। সে অনেক শান্ত ও নির্জীব। পারমিতার বুক ধুকপুক করছে। রোদ আবার ওকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? পরমুহুর্তেই আবার ভাবল, যে আমার কখনো ছিলোই না, সে আবার চলে যাবে কিভাবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পারমিতা। সামান্তার কাছে ওর শ্বশুরবাড়ি গল্প শুনতে শুনতে পারমিতার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ রোদ এসে পারমিতাকে বলল, আমি আজকে বাসায় চলে যেতে চাই। তোমার যদি কিছু বলার থাকে..
পারমিতা অভিমানের সুরে বলল, যেতে চাইলে চলে যান।
– ঠিক আছে যাচ্ছি।
সামান্তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রোদ প্রীতুলের কাছে গেল। প্রীতুলকে একটা চুমো দিয়ে পারমিতাকে বলল, বাই। ভালো থেকো।
দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল রোদ। পারমিতা ধপ করে চেয়ারেএ ওপর বসে পড়ল। মনে হচ্ছে রোদ ওকে এভোয়েড করছে। রোদের আচরণ কখনোই এমন ছিলো না। পারমিতা পারলো না সহ্য করতে। ওর বুক ফেটে যেতে চাইছে। জীবন বারবার ওর সঙ্গে এমন করে কেন! কেন?
সামান্তা জানতে চাইলো, কি হয়েছে রে?
– রোদ ওর বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সবার সঙ্গে আলাপ করাবে বলে। আমি যেতে চাইনি তাই কষ্ট পেয়েছে।
– স্বাভাবিক। আর কতদিন ঘুরবে তোর পিছনে পিছনে।
পারমিতা অবাক চোখে সামান্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর কি মনে হচ্ছে আমি ওকে ঘুরাচ্ছি?
– অবশ্যই ঘুরাচ্ছিস। সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করার আগে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। তুই নিজেও ওর প্রেমে হাবুডুবু খাইছিস। অথচ ভান করছিস যেন জীবনেও কখনো প্রেমে পড়িস নি।
পারমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, হয়তো তোর কথাই সত্যি। কিন্তু বাস্তবতা যে অনেক কঠিন।
– কঠিন বাস্তবতাকে সহজ করার জন্যই রোদকে মেনে নে।
– কিন্তু আমি নিজের স্বার্থের জন্য ওকে গ্রহণ করতে চাই না। ওর প্রতি যদি কখনো মন থেকে ভালবাসা আসে, তবেই…
পারমিতা সামান্তার সামনে থেকে সরে অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়াল। রোদ চলে যাওয়াতে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নিলো পারমিতা। এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না।
পরেরদিনও অফিসে দেখা হল না রোদের সঙ্গে। পারমিতা ভেবেছে আজকেও রোদ অফিসে আসেনি। দুপুরের আগমুহুর্তে একবার রোদের চেম্বারে উঁকি দিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল রোদের কাছেই। চোখাচোখি হল। রোদ জানতে চাইলো, কিছু বলবে?
পারমিতা লজ্জায় মুখ আড়াল করে দ্রুত সেখান থেকে ফিরে এলো। সে দেখতে গিয়েছিল রোদ এসেছে কী না। কিছু বলতে যায় নি। ডেস্কে ফিরে নিজে ওপরই রাগ হচ্ছিল ওর। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সেই রাগ পরিণত হল প্রেমে। আর অভিমানে। রোদ অফিসে এসেও ওর খোঁজ নিচ্ছে না। একবার দেখতেও আসেনি। তারমানে পারমিতা নিশ্চিত হলো, রোদ ওকে এভোয়েড করছে।
দুনিয়াতে সব ধরনের কষ্টই হয়তো সহ্য করা যায়। কিন্তু কারও অবহেলাটাকে সহ্য করা যায় না। পারমিতা ডেস্কে বসে নখ খুঁটতে লাগল। একটা কাজের মেয়ে জোগাড় করতে হবে। প্রীতুলকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসার জন্য। বাসাতেও প্রীতুলের দেখাশোনা করার লোক দরকার। কিন্তু এত টাকা দিয়ে কাজের মেয়ে রাখবে কিভাবে সে? পৃথিবীটা এত কঠিন কেন?
পারমিতা অফিসের কাছাকাছি পরিচিত সব দোকানে বলে রাখলো যেন একটা পরিচিত মেয়েকে জোগাড় করে দেয়। বাসার নিচের সব পরিচিত দেরকেও বলে রাখলো। দু একজন আশ্বস্ত করেছে। অবশ্য মনে হয়না তারা কাউকে খুঁজে দিতে পারবে।
অবশেষে সমাধান মিলল নিচতলার এক ফ্ল্যাটে। সেখানে এক মহিলা বুয়ার কাজ করে। ফ্ল্যাটের ভাড়াটে জানালো, পারমিতা যদি বুয়ার বিল অর্ধেক কমদেয় তাহলে বুয়া প্রীতুলকে সঙ্গে নিয়ে ওনার বাসায় কাজ করবে। তবে পারমিতার বাসায় কোনো কাজ করবে না। পারমিতা এতেই রাজি হয়ে গেল। বুয়াকে এডভান্স এক মাসের বেতনও দিতে হলো। প্রীতুলকে নিয়ে আপাতত চিন্তার কিছু রইল না। বাসার পাশেই স্কুল। সে সকালবেলা স্কুলে রেখে গেলে বুয়া ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে পারবে।
পরপর চারদিন কেটে গেল। রোদের সঙ্গে পারমিতার নামমাত্র দেখা হলো। যে দেখাটাকে দেখা বলে না ঠিক। দু একবার চোখাচোখি অথবা কাজের সূত্রে একটু হাই হ্যালো। পারমিতার মন খারাপ হয়। বুকের কোণে কোথাও একটু আনচান করে ওঠে। কিন্তু কিছুই বুঝতে দিতে চায় না রোদকে। রোদ নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া চেম্বার থেকে বের হয় না। পারমিতা অপেক্ষায় থাকে যদি হুট করে রোদ ওর ডেস্কে চলে আসে। অথবা হঠাৎ পিয়ন এসে বলবে, রোদ স্যার ডাকছেন।
পিয়ন আসে, কাজের কথা বলেই চলে যায়। পারমিতার বুক ধক করে ওঠে। ভাবে, এই বুঝি পিয়ন কিছু বলবে। কিন্তু না, রোদের কথা কিছুই বলে না পিয়ন।
দিনের বেলা চরম অস্বস্তি নিয়ে কাটলেও কাজের ভীড়ে কেটে যায়। কিন্তু রাত গুলোকে অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিদিন রাতে পারমিতার সীমাহীন কষ্ট হয়। বুকটা হাহাকার করে। রোদের ফোনের অপেক্ষায় থাকে ও। কিন্তু কোনো কল আসে না। পারমিতা একটা মেসেজ লিখে, লিখেও সেটা পাঠায় না। মনকে কন্ট্রোল করে রাখতে চেষ্টা করে। হু হু করে কেঁদে ওঠে ও। কেঁদে বুক ভাসায়। বাকি জীবনটা হয়তো এই কষ্ট নিয়েই কাটবে। একাকীত্ব আর জীবন যুদ্ধের কষ্ট নিয়ে।
এদেশে পারমিতার মতো শত শত মেয়ে আছে, যারা একা যুদ্ধ করছে। যাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। যাদের জীবনে কেউই আলো নিয়ে আসে না। আজীবন এরা অন্ধকারেই কাটায়। পারমিতাও নাহয় তাদের মতো অন্ধকার জীবন নিয়েই পড়ে থাকবে। নিজের সমস্ত শ্রম দিয়ে সন্তানকে মানুষ করবে। একদিন নিশ্চয় প্রীতুল ওকে বুঝবে। প্রীতুল বড় হয়ে মায়ের কষ্টকে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু সেও যদি তার বাবার হাত ধরে চলে যায়? জীবন এত ভয়ংকর কেন? একটা মেয়ের জীবন কি সবসময় এত কঠিন হতে হবে? সমাজে মেয়েরাই আজীবন ধুকে ধুকে মরবে। না, পারমিতা এভাবে মরবে না। সে প্রীতুলকে আগলে রাখবে। সে নিজের জন্য বাঁচবে। আর কারও জন্য না।
পারমিতা চোখ মুছলো। অনেকদিন পর ওর পুরনো ডায়েরি টেনে নিলো। কলম খুঁজে পাচ্ছে না। প্রীতুলের স্কুল ব্যাগ থেকে কলম বের করে ডায়েরিতে লিখতে আরম্ভ করলো।
“আমি জীবনের কাছে হেরে যাবো না। আমাকে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে। সংগ্রামে জয়ী হতে হবে। একা লড়ার এই যুদ্ধে একমাত্র পারমিতার আত্মবিশ্বাস টাই আমার সম্বল। আমাকে আরও স্ট্রং হতে হবে। এ সমাজে দুর্বলদেরকে সবাই ব্যবহার করে। প্রীতুলের কথা চিন্তা করে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের ভাবনা এখন থেকেই ভাবতে হবে।”
এতদূর লিখে পারমিতা ডায়েরি বন্ধ করে রাখলো। আগামীকাল একটা ব্যাংকে সঞ্চয়ী একাউন্ট খুলার কথা ভাবছে ও। চাকরি থেকে যে বেতন পাচ্ছে, খেয়েদেয়ে প্রতি মাসেই মোটা একটা টাকা হাতে থেকে যায়। এটা একাউন্টে রাখতে পারলে তার নিজের ও প্রীতুলের জন্য ভবিষ্যতের বন্ধু হিসেবে জমা থাকবে।
পারমিতা প্রীতুলকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোকে ছাড়া আমি এখন কিছুই ভাবতে পারি না রে। আমার জীবন মরণ সবকিছু জুরেই শুধু তুই। তোকে ছাড়া আমার সত্তাও অপূর্ণ। তুই কোনোদিনও আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাস না বাবা।
পারমিতা কাঁদতে লাগল। শেষ বার চোখে মুছে মনেমনে বললো, আমি আর কাঁদবো না। এখন থেকে শুধু হাসবো। কারণ আমার জীবনে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। নিজের মতো আয় করে জীবনটাকে নতুন করে সাজাবো আমি।
পারমিতা পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো। প্রীতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বুক ভরে শ্বাস নিলো ও।
চলবে..
#পারমিতা
পর্ব ২৯
_নীলাভ্র জহির