পারমিতা” পর্ব-২৮

0
1312

#পারমিতা
পর্ব ২৮
_নীলাভ্র জহির

কাজ করার সময় রোদ নিজে এসে উপস্থিত হল পারমিতার সামনে। পারমিতা ওকে এক পলক দেখেই তড়িঘড়ি করে বলল, আপনি এখানে কি করছেন? আমাকে বললেই তো আমি যেতাম।
– আমি একটা এনাউন্সমেন্ট করতে চাই।
– মানে? কিসের এনাউন্সমেন্ট?
– আমি সবার সামনে জানিয়ে দিতে চাই, আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
– আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
অবাক হয়ে কথাটা বলে ফেলল পারমিতা। রোদ পারমিতার ডেস্ক থেকে সরে দাঁড়াল। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সবার এটেনশন নেবে এমন সময় পারমিতা উঠে এসে বলল, আমার সঙ্গে আসুন তো আপনি। যতসব পাগলামো শুরু করেছেন।

পারমিতার পিছুপিছু রোদ বেরিয়ে এলো। অফিসে বাইরে এসে পারমিতা বলল, এসব কি? আমার বিশ্বাস অর্জনের জন্য আপনাকে নিজের মানসম্মান খোয়াতে হবে না।
– আমি মানসম্মান খোয়াচ্ছি না। আমি শুধু সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই, তুমি আমার।
– এটা সবাইকে জানানোর মতো কিছু নয়। তাছাড়া আমি আপনার হয়ে যাই নি। আপনি মাথা ঠাণ্ডা করুন। এরকম করলে তো আমাকে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
– পারমিতা।আমার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। আমি জানিনা কে এই অদ্ভুত কাজটা করেছে। আমার ফোন থেকে তোমাকে এত খারাপ একটা টেক্সট কে পাঠিয়েছে। নিজের ওপর অনেক রাগ হচ্ছে আমার।
– আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। আপনি জানার চেষ্টা করুন এই কাজটা কে করেছে। তাহলেই হবে।
– আমি কালকের মধ্যেই তোমাকে এটা জানাবো, প্রমিস করছি। যেভাবেই হোক এটা আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
– করুন। কিন্তু সবাইকে জানিয়ে এনাউন্সমেন্ট দেয়ার মতো পাগলামি একদম করতে যাবেন না। আপনার পায়ে পড়ি। আমি অফিসে মাথা উঁচু করে অফিস করি। আমাকে যেন সবাই হাসির পাত্র বা তুচ্ছ করে না দেখে। এই দিকটা সবসময় সবকিছুর আগে ভেবে দেখবেন। এটা আপনার কাছে আমার অনুরোধ।

পারমিতা কথা শেষ করে অফিসের ভেতরে চলে এলো। এখন মনে হচ্ছে তার জীবনে নতুন করে ভালবাসার অধ্যায়টা না আসলেই পারতো। জীবন তো ভালোই চলে যাচ্ছিল, খারাপ না। এই অধ্যায়ের অনুপ্রবেশ ওর সবকিছুকে আরও জটিল করে তুলছে।

অফিস থেকে বাসায় ফিরে পারমিতা প্রীতুলকে নিয়ে শুয়ে আছে। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। পারমিতা অবাক হল। এই সময়ে আবার কে? সামান্তা নয়তো? কিন্তু সামান্তা নতুন বউ। শ্বশুরবাড়ি ফেলে সে এখানে আসবে না। পারমিতা দরজার গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকাতেই চমকে উঠলো। রাসিফ এসেছে! হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল ওর। রাসিফ তো বাসা চেনার কথা নয়। সে যাই হোক, যেভাবেই হোক বাসা চিনেছে। এখন ওকে কিভাবে এখান থেকে বের করা যায়?

পারমিতা দরজা না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই প্রীতুলকে জড়িয়ে ধরে ঘরে বসে রইল ও। রাসিফ আরও কয়েকবার বেল বাজালো। ওর বেলের শব্দে এবার অতিষ্ঠ হয়ে যেতে হয়। তবুও পারমিতা উঠলো না। কিছুক্ষণ পর বেল বাজার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। পারমিতা লুকিং গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো রাসিফ নেই। তারমানে চলে গেছে। অনেক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইল পারমিতা। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নিশ্চিত হলো আসলেই রাসিফ চলে গেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে এলো পারমিতা।

পরেরদিন সকালে দাড়োয়ানকে অনেক রাগ দেখিয়ে পারমিতা বলল, আপনি কেন অজানা অচেনা একটা লোককে বাসায় ঢুকতে দিলেন?
– সে বলেছে আপনি ওনার স্ত্রী।
– স্ত্রী বললেই আপনি ঢুকতে দেবেন?
– সে আমাকে ছবি দেখিয়েছে। ওনার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি আর কিভাবে আটকাবো বলেন?
– আপনার সমস্যা আছে। আপনি টাকা খেয়ে ওনাকে ঢুকতে দিয়েছেন। এরকম কেন আপনি? একটা লোক বললো আর আপনি ওনার কাছে দুইশো টাকা খেয়ে বাসার ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দিলেন?
– আমি টাকা খেয়েছি কে বলল আপনাকে?
– চুপ থাকেন মামা। আপনাকে আমার চেনা আছে। আমি আপনাকে পাঁচশো দেবো। আজকে পারবো না। কিন্তু দেবো। কথা দিলাম। আর কখনো ওই লোককে বাসার ভেতর ঢুকতে দিবেন না। গেট ও খুলবেন না। ওনার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়েছে সেটা তো জানেন। এত বছর উনি আমাদের খোঁজ নেননি। এখন উনি প্রীতুলকে নিতে এসেছেন। আমি এটা কিভাবে সহ্য করি আপনি বলেন? আমি এত কষ্ট করে ছেলে মানুষ করে ওনাকে দিয়ে দেবো?

দাড়োয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, না আপনি ঠিক। আপনি ঠিক করেছেন। আমি আর ওনাকে বাসার ভেতর ঢুকতে দেবো না।
– ধন্যবাদ মামা। আমি কোথায় যাই, কখন যাই এসবও বলবেন না। আমি কখন বাসায় আসি এসব কোনো তথ্যই ওনাকে দেবেন না।
– আরেকজন এসেছিল একদিন। সামান্তা আপার নাম্বার নিয়ে গেছে।
– ওনার ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। উনি ক্ষতিকর কিছু করবেন না।
– উনি আপনাকে পছন্দ করেন।

হাত কচলাতে কচলাতে কথাটা বললো দাড়োয়ান। পারমিতা বলল, হ্যাঁ মামা। ওনার ফ্যামিলি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।
– লোকটা ভালো। ভালো মানুষ দেখলেই চেনা যায়। টাকা পয়সাও আছে। দুইদিন দুই রকম গাড়ি নিয়ে এসেছে। আপনি ওনাকে বিয়ে করে ফেলেন।
– টাকা পয়সার ওপর আমার কোনো লোভ নেই মামা। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। নিজের মতো থাকতে চাই। এখন ভালো আছি।

পারমিতা প্রীতুলকে ডে কেয়ারে রেখে অফিসে গেলো। এখনো অফিসে তেমন কেউ আসেনি। সে নিজের ডেস্কে বসে কম্পিউটার চেক করল। ইমেইল দেখে চমকে গেল পারমিতা। তার একাউন্টে টাকা এসেছে। টাকার এমাউন্ট দেখে মনে হচ্ছে এটা প্রজেক্টের সম্মানীর টাকা। সে তো পুরো কাজটা করেনি ঠিকমতো, তারপরও পুরো টাকাই পেয়েছে। স্যারকে ধন্যবাদ জানাতে হবে।

পারমিতা রোদকে আসতে দেখে চমকে উঠল। এত সকালে রোদ অফিসে এসেছে! গম্ভীর মুখে রোদ পারমিতার সামনে এসে দাঁড়াল। পারমিতা জানতে চাইলো, কি হয়েছে?
– আমি সরি পারমিতা। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি কাজটা কে করেছে। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। যে করেছে সে কাজটা ঠিক করেনি।
– কে করেছে?
– সেটা আমি তোমাকে বলতে পারবো না। কিন্তু তুমি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। আমি কখনো তোমার কোনো অসম্মান হতে দেবো না।
– সেটা আমি জানি। কিন্তু আপনি বলুন কে এটা করেছে? আমি শুনতে চাই। আপনাকে কে এত ভালবাসে?
রোদ বলল, আমি সেটা তোমাকে বলতে পারবো না। পারমিতা, তুমি আজকে একটু সময় বের করতে পারবে?
– কেন?
– তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো।
– কিন্তু কেন!
অবাক হল পারমিতা। রোদ বলল, আমার পরিবারের সবার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো।
– আমি আপনার প্রেমিকা নই।

রোদ চমকে উঠলো। অনেক্ষণ পলক না ফেলে পারমিতার দিকে তাকিয়ে রইলো রোদ। তারপর ধীরপায়ে নিজের চেম্বারে চলে গেল। পারমিতা রোদের ব্যথাটা অনুভব করতে পেরে দুঃখবোধ করলো। ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে। ওকে এভাবে হার্ট করাটা উচিৎ হয়নি।
কয়েক মিনিট পরেই রোদ অফিস থেকে বের হয়ে গেল। তখন সবাই সবেমাত্র অফিসে প্রবেশ করছে। পারমিতা কাজে মন দিলো। একাউন্টে বেশ ভালো অংকের টাকা এসেছে। আগামীকাল সামান্তারবর রিসিপশনে গিয়ে একটা সুন্দর গিফট দিতে পারবে ও, সেই আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠল। কিন্তু এরমধ্যে আবার রোদকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রোদ কাছে এলে ওর ইচ্ছে করে রোদকে দূরে পাঠিয়ে দিতে। আবার দূরে চলে গেলে রোদের শুন্যতা ওকে পোড়াতে শুরু করে। এমন হওয়ার কারণ আজও বুঝতে পারলো না পারমিতা।
রোদ সারাদিন আর অফিসে এলো না। পারমিতা সামান্তাকে ফোন করে জানালো, রোদকে তোর রিসেপশনে আসতে বল।
সামান্তা জানালো, রোদ সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে সে আসতে পারবে না। তার একটা সমস্যা হয়েছে। রোদকে তো জোর করে নিয়ে আসা সম্ভব না।
পারমিতা গম্ভীর মনে ভাবলো, তার কথাতেই কষ্ট পেয়েছে রোদ। তাকে একবার সরি বলা দরকার। কিন্তু পারমিতার “ইগো” ওকে দমিয়ে রাখল। সরি বলতে দিলো না।
বাসায় ফিরে পারমিতা গোসল সেরে শুয়ে রইলো। আজকে নাকি ডে কেয়ারে কান্নাকাটি করেছে প্রীতুল। ওকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসার জন্য কাউকে দরকার। এভাবে আর পারছে না সে। ক্লান্ত হয়ে পড়ছে পারমিতা।

রাতে অনেক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাঁদল ও। নিজেকে বড্ড একা লাগছে। মনে হচ্ছে মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে সে। জীবনকে একা টেনে নিয়ে যাওয়াটা আসলেই যুদ্ধের। নিজের একাকীত্ব আর রোদের জন্য অনুভূতি কোনটা এই মুহুর্তে ওর কাছে বড়? সেই প্রশ্নে দ্বিধান্বিত পারমিতা। নিজের স্বার্থের জন্য কাউকে বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। বিয়ে তো তখনই করতে হবে, যখন কাউকে ভালবেসে জীবনে প্রয়োজন হবে। কারও ভালবাসার প্রয়োজন হবে।

পারমিতার কান্না দেখে প্রীতুল জানতে চাইলো, আম্মু কি হয়েছে তোমার?
– কিছু না বাবা।
– তোমার কষ্ট হচ্ছে আব্বুর জন্য?
– না।
– কষ্ট হলে রোদকে আসতে বলো। ও বলেছে তুমি কষ্টে থাকলে ওকে জানাতে।
– রোদ আমাদের কেউ না বাবা।
– রোদ ভলেছে ও আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে যাবে।
পারমিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রোদ তো বাবা বলতে তার নিজেকেই বুঝিয়েছে। তাও এমন একটা সময়ে, যখন রাসিফও এই বাসার ঠিকানা জোগাড় করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। পারমিতা যদি রাসিফের পরিচয় প্রীতুলকে জানিয়ে দেয়, তারপর রোদকে কখনো তার বিয়ে করা সম্ভব হবে না। জীবনে চলার পথে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার চেয়ে বড় কথা, শত শত মুহুর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখা। পারমিতা অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইল।

মাঝরাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে তুলে নিলো পারমিতা।তারপর টাইপ করলো, আপনি আগামীকাল সামান্তার রিসিপশনে আসুন। আমি আপনার বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলবো।

মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে পারমিতা একটা নিশ্বাস ফেললো। রোদ কি এবার কথা বলবে তার সঙ্গে?

চলবে, তবে গল্পটি আর বেশি বড় করবো না। ব্যক্তিগত কারণে মাঝখানে একটা গ্যাপ হয়ে যায়। ইদানিং ১৪০০-১৮০০ শব্দের একটি গল্প লিখে পাঠক অনুভূতি পাওয়া যায়না। হয়তো পাঠকের মনের মতো হচ্ছেনা গল্পটি তাই সময় নষ্ট করে লাইক অথবা লাভ রিয়্যাক্ট দিতে কষ্ট হয়। তাই এ কষ্ট থেকে পাঠকদের মুক্তি দিতে দ্রুত গল্প শেষ করে দেবো।

আর কিছু সময় পাশে থাকুন ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here