পারমিতা” পর্ব-২৭

0
1281

#পারমিতা
পর্ব ২৭
_নীলাভ্র জহির

পারমিতা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। গত রাতে রোদের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে, “সরি। আমি আর সম্পর্কটাকে আগাতে চাই না। আমরা এখানেই সবকিছু শেষ করে দিচ্ছি। ভালো থেকো।” মেসেজটা দেখেই শরীরে আগুন ধরে গেছে পারমিতার। পুরো পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই কেঁপে উঠলো ওর। সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে ঝড়ে পড়ছে। আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে সব। ওর নিজেকে নিষ্প্রাণ লাগছিল। সবকিছু যেন হঠাৎ থমকে গেল।
পারমিতা কোনো রিপ্লাই দিলো না। একদিন ও মনেমনে চেয়েছিল এমনটাই হোক। অথচ আজকে এমনটাই ঘটার পর সবকিছু অসহ্য লাগছে ওর কাছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। রাগে, ক্ষোভে ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে কোথাও চলে যাই। রোদ অনেক বিনয়ী বলেই হয়তো ভদ্রতার সঙ্গে ওর সাথে সবকিছু শেষ করে দিলো। কোনো কটু কথা শোনালো না, কোনো আঘাত করলো না, কোনো অপমান করলো না, কেবল যন্ত্রণা দিয়ে গেল।
পারমিতা একটা নিশ্বাস ফেলে বসে রইল। আজকে প্রীতুলকে নিয়ে বাসায় চলে এসেছে ও। এমন হঠাৎ করে রোদের চলে যাওয়াটা ওর জীবনে অভিশাপের মতো। দিনগুলো কত সুন্দর ভাবেই না কাটছিল। স্বপ্নের মতো। পারমিতা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল রোদকে নিয়ে। মধুর, স্বপ্নীল স্বপ্ন। অথচ রোদ সেই স্বপ্ন নিয়ে মুহুর্তেই মেঘে ঢেকে দিলো পারমিতার জীবন। মেঘে ঢাকা জীবন মেঘে ঢাকাই রইল, শুধু মাঝখান থেকে সামান্য রোদের উঁকিঝুঁকি।

বিকেলে বিছানায় শুয়ে হাউমাউ করে কাঁদল পারমিতা। প্রীতুল বারবার জানতে চাইলো, মা কি হয়েছে?
পারমিতা উত্তর দিলো না। রোদকে একটিবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, সবকিছু আরও আগে শেষ করলেন না কেন? কিন্তু এটা বলার মতো মুখ ওর নেই। নিজেই নিজেকে অপমানিত করতে চায় না পারমিতা।
পারমিতা প্রীতুলকে নিয়ে খেলায়, গল্পে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করলো। কিন্তু তবুও সারাদিন ওর মন খারাপ রইল। সারাটি দিন কান্না পাচ্ছিল। বুক ফেটে যেতে চাইছিল। সন্ধ্যায় কয়েক মিনিট বাইরে হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফিরলো ও। তারপর মনস্থির করল, এখন থেকে জীবনটাকেই সুন্দরভাবে গড়বে। প্রীতুলকে নিয়ে একা বাঁচার চেষ্টা করবে। ভুলে যাবে রোদকে। রাসিফকে ভুলে যেতে পেরেছে সে। রাসিফের সন্তানকে বুকে আগলে রেখেও রাসিফকে হারানোর কষ্টকে সে ভুলে থাকতে পারে। তাহলে রোদকেও ভুলে যেতে পারবে ও।

রাতে ভালো ঘুম হল না। আজ অফিসে যেতে হবে। সকালে নাস্তা খেয়ে প্রীতুলকে ডে কেয়ারে রেখে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো পারমিতা। বেশ কিছুদিন পর অফিসে এসেছে ও। সেজন্য সবকিছু অন্যরকম লাগছে। অফিসের ডেস্কে ধুলো জমে আছে। সবকিছু ঝেড়ে পারমিতা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। প্রীতুল আজ ডে কেয়ারে থাকবে কিনা সেটা নিয়ে টেনশন হচ্ছে। কিছুক্ষণ কাজ করার পর হঠাৎ দেখল রোদ ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। পারমিতা মুহুর্তেই নিজের কাজে মন দিলো। রোদকে অনেক হাসিখুশি দেখাচ্ছে আজ। ফুরফুরে মেজাজে আছে মনে হচ্ছে। যখন পারমিতার পাশের ডেস্কে সবার সঙ্গে কথা বলছিল, পারমিতা খেয়াল করেছে রোদ কতটা প্রাণবন্ত। বাহ, জীবন থেকে পারমিতা নামক স্মৃতিটাকে একেবারেই মুছে দিয়ে বেশ ভালোই আছে সে। পারমিতা মুখ গম্ভীর করে কাজ করছে।
রোদ ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই সেই চিরচেনা রোদের শরীরের গন্ধটা ওর নাকে এসে লাগল। পারমিতা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জিজ্ঞেস করল, গুড মর্নিং। কেমন আছেন?
পারমিতা উত্তর দিলো না। ওর গা জ্বলে যাচ্ছে রাগে। রোদ ধীরেধীরে সরে গেল। খানিক্ষন বাদে ফিরে গেল নিজের চেম্বারে। মিনিট দশেক পর পিয়ন এসে পারমিতাকে বলল, রোদ স্যার রুমে ডাকছেন।

পারমিতার রাগ বেড়ে গেল। তাকে জীবন থেকে মুছে দিয়ে আবার চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, কেমন আছেন? আবার সঙ্গে রুমেও ডাকা হচ্ছে ইনসাল্ট ফিল করানোর জন্য নাকি? যাবে না পারমিতা।

ফোন বেজে উঠল। পারমিতা দেখল রোদ ফোন করেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিলো ও। একটু পর আবার ভাইব্রেট হল। মেসেজ এসেছে। মেসেজ পাঠিয়েছে রোদ। পারমিতা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনের স্ক্রিনে মেসেজে চোখ বুলালো, ki hoyeche tomar? mon kharap keno? etodin por amake dekhe o khushi how ni? room a aso.
পারমিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বড়লোকের কত অদ্ভুত মজা করার ধরন। এসব রং তামাশার মানে হয়না। এটা বলার জন্যই রোদের রুমে যেতে হবে।
পারমিতা ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে বলল, কেন ডেকেছেন?
রোদ উঠে এসে পারমিতার মুখের কাছে এসে দাঁড়াল, কি হয়েছে? এত গম্ভীর কেন আজ?
– আপনার জন্য নয়। ছেলেকে ডে কেয়ারে রেখে এসেছি তাই।
– আমার জন্য মন খারাপ হবে কেন? মন ভালো হবে। এতদিন পর দেখা হল, আনন্দ পাচ্ছ না তুমি? অবশ্য দুইদিন তোমার কাছে তেমন কিছুই না। আমার কাছে দুইটা দিন দুই বছরের মতো কেটেছে।

পারমিতা খানিকটা ভড়কে গেল। রোদের কণ্ঠস্বর ওর কাছে আগের মতোই স্বাভাবিক লাগছে। প্রেমময়, ঝলমলে আর রোমান্টিক। কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়!
রোদ বলল, আমাকে না বললে বুঝবো কিভাবে? আচ্ছা তুমি আমাকে একটাবার ফোন দিতে পারতে। তুমি বলেছিলে সরাসরি অফিসে গিয়ে দেখা হবে। তাই আমি আর ফোন করিনি। এজন্য রাগ করে আছো?
– ফোন করেননি, মেসেজ তো করেছেন।
– মেসেজ করেছি বলে রাগ করেছো? আচ্ছা কতক্ষণ মনকে আটকে রাখা যায় বলো?
পারমিতা অদ্ভুত চোখে রোদকে একবার পরখ করল। রোদের চাহনিতে এখনও সেই প্রেম, সেই আবেগ দেখতে পাচ্ছে ও। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
পারমিতা বলল, আপনি সবকিছু শেষ করে দিয়ে ভালোই করেছেন।
– মানে!
– জানেন না মনে হচ্ছে? এসব ফাজলামোর মানে কি?
– কোন সব?
– আজকে যা করছেন।
– আজকে যা করছি, আগেও তাইই করেছি।
– তাহলে পরশু রাতের সেই মেসেজটা?
– মেসেজে তো লিখেছি, আমি তোমাকে অসম্ভব মিস করছি। অফিসে দেখা হবে। এটা মানতেই পারছি না। তারপর তুমি লিখলে, আমরা এই দুদিন কথা বলবো না। আমি কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছিলাম।
– তখন তো জানতাম না,মুহুর্তেই নিজেকে বদলে ফেলবেন। আর হঠাৎ এমন কিছুর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আপনার লাস্ট মেসেজটার জন্য আমি একদমই…
– লাস্ট মেসেজে কি লিখেছি?
– আপনি আর সম্পর্কটা আগাতে চান না। সেটাই তো লাস্ট মেসেজ। নাকি মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় লিখেছিলেন?
তুচ্ছার্থে হাসি দিলো পারমিতা। রোদ আচমকা পারমিতার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে বলল, পাসওয়ার্ড খোলো।
পারমিতা পাসওয়ার্ড খুলল। রোদ কি করতে চায় সেটা দেখতে চাইছে ও। রোদ ইনবক্সে গিয়ে দেখল পারমিতার ফোনে তার দেয়া শেষ মেসেজটা। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সব লোম শিউরে উঠল রোদের। এসব কী! এই মেসেজ কীভাবে কে পারমিতাকে পাঠিয়েছে তার কিচ্ছু জানে না সে!
রোদ অবাক হয়ে পারমিতার দিকে তাকিয়ে রইল। পারমিতাও তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। রোদের কি হল বুঝতেই পারছে না পারমিতা। রোদ বলল, পারমিতা এটা কে করেছে আমি জানিনা। কসম তোমার।

পারমিতার মাথায় হাত রেখে কথাটা বলল রোদ। রোদকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ খুঁজে পায়না পারমিতা। রোদ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, বিশ্বাস করো আমাকে। আমি তোমাকে আজকেই বিয়ে করবো। আমাকে বিশ্বাস করো। প্লিজ। আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না। এই মেসেজটা কেউ ষড়যন্ত্র করে পাঠিয়েছে আমার ফোন থেকে। মেসেজ করার পর আবার ডিলিটও করে দিয়েছে। আমি দেখতেও পাইনি। পারমিতা, আই এম সরি। আমাকে মাফ করো।

পারমিতা রোদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কেন মাফ চাইছেন? কে করতে পারে এমন? আপনার সঙ্গে সেদিন রাতে এমন কোনো মেয়ের দেখা হয়েছে যে আপনাকে ভালবাসে?
– না। আমাকে ভালবাসে এমন কেউ নেই
– কোনো ছেলে বা বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
– না।
– ফোন কার হাতে দিয়েছিলেন?
– ফোন রুমে ছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দ্রুত। কে ফোনে হাত দিয়েছে জানতাম না।
– পাসওয়ার্ড খুলল কে? কে জানে এই পাসওয়ার্ড?
– কেউই জানে না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না পারমিতা।
– আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।
– আমাকে অবিশ্বাস করো না প্লিজ। আমার মনে হয় কেউ তোমার আমার ব্যাপারে জানে। আর সেই এটা করেছে। সে ছেলে নাকি মেয়ে আমি জানিনা। এটা আমাকে বের করতেই হবে।
– অদ্ভুত না?
– হ্যাঁ অদ্ভুত। তুমি টেনশন করো না। আমি শুধুই তোমার। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে আজকেই বিয়ে করবো। করবে আমাকে বিয়ে?

পারমিতা চমকে উঠলো। বিস্ময় ভরা চোখে রোদের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা হয় না।
– তাহলে কেন কষ্ট পাচ্ছিলে? কেন তোমার চোখে এত রাগ, এত অভিমান ছিল, বলো?
– জানিনা।
– কারণ তুমি আমাকে ভালবাসো।
পারমিতা স্তব্ধ হয়ে রোদকে দেখল। একেই কি ভালবাসা বলে? কিন্তু কে আছে মাঝখানে যে চায় না রোদ পারমিতার হোক!
রোদ পারমিতার হাত ধরে বলল, আমি তোমার বিশ্বাস ধরে রাখতে চাই। করবে আমায় বিয়ে?
পারমিতা উত্তর না দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো। তার সময় দরকার। আরও অনেক সময়। মৃদু স্বরে উত্তর দিলো, এই মেসেজ কে পাঠিয়েছে আগে সেটা খুঁজে বের করুন। তারপর।
রোদকে হতাশ দেখালো। পারমিতা ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল চেম্বার থেকে। বিশ্বাস অবিশ্বাস আর একটা নতুন রহস্যের বেড়াজালে আটকা পড়া পাখির মতো ছটফট করতে লাগল পারমিতা।
কাজে মন বসছে না। ডে কেয়ারে ফোন করে প্রীতুলের খীন নিলো। প্রীতুল ভালোভাবে খেলা করছে। কান্নাকাটি করেনি একটুও। এত অশান্তির ভেতর একটুখানি স্বস্তি পেলো পারমিতা। রোদকে সে অনেক বিশ্বাস করে। রোদ বিশ্বাস করার মতোই একজন। তবুও ওর দুশ্চিন্তা কেন হচ্ছে, কে জানে! রোদের কথা মতো কি তাহলে এখনই বিয়ে করবে রোদকে? বিয়ের কথা ভাবতেই পারমিতার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। সবকিছু হঠাৎ অন্যরকম লাগতে শুরু করল। বিয়ে ব্যাপারটাই হয়তো এমন।

তার জীবনে যখন বিয়ে নামক শব্দটি প্রথম এসেছিল, সেদিন পুরো শরীরে রক্তের ছলকানি টের পেয়েছিল পারমিতা। উত্তেজনায় কাঁপছিল ও। বিয়েতে মন ছিল না তার। দুঃখবোধ নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। তবুও মনের কোণে সুখের একটা অচেনা বর্ষণ সেদিন পারমিতা অনুভব করেছিল। যে বর্ষণে তার ভিজতেও ইচ্ছে হচ্ছিল। আবার একইসাথে ইচ্ছে করেছিল, এই বিয়েটা সে যদি ভেঙে দিতে পারতো। একইরকম দোটানায় এবারও পড়েছে পারমিতা। তাই বিয়ের কথা ওকে শুধু ভয়ই পাইয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় আতংক। যদি কখনো মন থেকে পুরোপুরি স্বস্তির সঙ্গে সাড়া পায়, যদি মন চায় বিয়ে করে সুখের সংসার সাজাতে। সেদিন বিয়ে করবে পারমিতা, তার আগে নয়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here