পারমিতা” পর্ব-৩০

0
1505

#পারমিতা
পর্বঃ ৩০
নীলাভ্র জহির

অফিসের লিফটের ভেতর আচমকা পারমিতার দেখা হয়ে গেল রোদের সঙ্গে। লিফটে ওরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। পারমিতা এক মুহুর্তের জন্যও রোদের দিকে তাকাচ্ছিল না। ওরা এত কাছের হয়েও যখন একে অপরকে না চেনার ভান করে দাঁড়িয়ে আছে, তখন দুজনেরই মনে একই রকম অনুভূতি। পারমিতা ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। রোদ ওকে এভোয়েড করছে এতে করে ওর জন্য ভালোই হয়েছে। সে চাইলেও কখনো রোদকে এভোয়েড করতে পারতো না। একজনকে তো দূরে সরে যেতেই হবে। রোদের দিক থেকে সেটা হয়েছে, এটাই আনন্দের ব্যাপার। অথচ পারমিতা আনন্দিত হতে পারছে না। ওর ভেতর একটা চাপা কষ্ট ঢেউ তুলতে শুরু করেছে। অফিসে পৌছানোর আগেই একটা ফ্লোরে লিফট থামতেই লিফট থেকে বের হয়ে গেল রোদ। পারমিতা এটা সহ্য করতে পারলো না। রাগে গর্জে উঠল ওর মন। মনে হচ্ছে রোদ শুধু তার, আজীবন তাকেই ভালবাসবে। এভাবে অবহেলায় ফেলে চলে যাবে এটা কখনো ভাবতেও পারেনি পারমিতা।
মুহুর্তের জন্য পারমিতার মনে হয়, সেদিনের মেসেজটা রোদই দিয়েছিল। আবার মুহুর্তেই সেই অবিশ্বাস ভেঙে যায়। দুই মিলিয়ে একটা দোটানা সৃষ্টি করেছে।
এভাবে আরও দুটো দিন কেটে গেল। অস্থিরতা আর দোটানা নিয়ে। তিন দিনের বেলায় ঘটল একটা চমকপ্রদ ঘটনা। পারমিতা মাহতাব স্যারের রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। দরজা খোলা ছিল। দাঁড়িয়ে ভেতরে অনুমতি নিতে যাবে তখন দেখতে পেলো রোদকে। রোদ ও মাহতাব স্যার কথা বলছেন। রোদ উচ্চস্বরে হাসছে। হাসির সঙ্গে ঝলমল করছে ওর চেহারা, ওর কণ্ঠিস্বরম পারমিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রোদকে এভাবে হাসতে দেখেনি কখনো। কি এমন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে ওদের মাঝে?
রোদ বলছে, ভাই তুমি বিশ্বাস করো – আমি লাস্ট কয়েকদিন এত বেশি স্ট্রাগল করতেছি নিজেই নিজের সঙ্গে। আর পারা যাচ্ছে না।
– কাজ তো হয়েছে মিয়া। তুমি এটা ভেবেই আনন্দে থাকো।
– আনন্দ তো বটেই। পারমিতার মুখের দিকে তাকালেই বুঝি ও ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আর কেউ বুঝুক বা না বুঝুক, আমি কেন যেন এই বিষয়টা বুঝতে পারি। এটা আমার একটা পাওয়ার বলতে পারেন। হা হা হা।
– তা সেই পাওয়ার দিয়ে আর কি কি দেখতে পাও?
– এইযে পারমিতা আমাকে ভুলতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আমাকে দেখলেই ওর ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে ভ্যা করে কেঁদে দিতে।

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল পারমিতা। রোদের মনে তাহলে এসব চলছে? সে কি মজা করার জন্য এসব করেছে নাকি পারমিতার ভালবাসার প্রমাণ পাওয়ার জন্য।
উত্তরটা রোদ নিজেই দিলো, ভাই যা বোঝার বুঝছি। আর মেয়েটাকে কষ্ট না দেই। আমি যদি এখন ওকে সবকিছু খুলে না বলি, তাহলে হয়তো এভাবেই সব শেষ হয়ে যাবে। ও জীবনেও মুখ ফুটে আমাকে কিছু বলবে না। মেয়েদের বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। হা হা। আমার ওকে সব বলে দেয়া উচিৎ ভাই।

পারমিতা দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। ওরা দুজনেই অন্যদিকে ফিরে কথা বলছে বিধায় দেখতে পায়নি ওকে। তারমানে রোদ পারমিতাকে সত্যিই ভালবাসে! আর ভালবাসা আদায় করার জন্য সে এমন নাটক করছিল। পারমিতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ওর আনন্দ হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে যে বিষাদের মধ্যে ছিল, আজকে তা হুট করেই মেঘে উড়ে গেলো। প্রিয়জনের মুখ থেকে প্রিয় কিছু শুনতে পাওয়ার আনন্দ সীমাহীন। আচ্ছা, রোদ কি আমার প্রিয়জন?
নিজেকে প্রশ্ন করলো পারমিতা। মুহুর্তেই ওর মনটা ঝলমল করে উঠল। ওর ফুরফুরে লাগছে। রোদ ওর কাছে আসবে। ওকে ভালবাসার কথা বলবে। তারপর! তারপর সে রোদকে কি বলবে? সব ভুলে রোদের ভালবাসার রং গায়ে মাখবে নাকি রোদকে আবারও সরিয়ে দেবে জীবন থেকে? এ এক কঠিন দোটানা শুরু হল পারমিতার। সে কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না? নিজের একাকী যুদ্ধ করার লড়াইটা কি এখানেই শেষ হবে? না। এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায় পারমিতা। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, রোদের মুখে ভালবাসার কথা শুনে ওর এত আনন্দ হচ্ছে কেন। এটা কি রোদকে ভালবাসে বলেই! পারমিতা উত্তর খুঁজতে লাগল। রোদ দূরে চলে যাওয়ায় ওর খুশি হওয়ার কথা। অথচ ওর কষ্ট হতো। আজকে সত্যিটা জানার পর ওর সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে।
সব ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পারমিতা কাজ শুরু করল। হঠাৎ ওর মাথায় আরেকটা চিন্তা এলো। সেদিন প্রজেক্টের কাজে ওকে যুক্ত করার পেছনে তাহলে রোদের হাত ছিল। রোদ নিজেই হয়তো স্যারকে বলেছিলেন ওকে কাজটা দেয়ার জন্য। এ কারণে গাড়িও ঠিক করে দিয়েছিল রোদ। শুধু তাই নয়, পারমিতার জন্য কাজের চাপও কম ছিল। প্রজেক্ট চলাকালীন ওকে এক সপ্তাহের ছুটি দেয়ার জন্যও অবদান রয়েছে রোদের। সবকিছু ভেবে পারমিতার শরীর, হাত, পায়ে কম্পন শুরু হল। আজ ওর নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে না। বরং নিজেকে নিয়ে এক ধরনের আড়াল করা আনন্দ হচ্ছে। রোদ ওকে ভালবেসে দূর থেকে এতকিছু করেছে ওর জন্য। শুধুমাত্র ওকে ভালবেসে! এরচেয়ে সুখের ব্যাপার আর কি হতে পারে?
পারমিতা চিন্তায় ডুবে গেল। সীমাহীন আনন্দের মাঝে অবগাহন করলো। রোদ ওর জন্য এতকিছু করেও কখনো ওকে বুঝতে দেয়নি। এটাই প্রকৃত ভালবাসা। এই ভালবাসার আবেশে পারমিতা আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। ওর দেহমনে প্রেমের আবেশ ছড়িয়ে পড়ল।

বিকেলের দিকে ডেস্কের দিকে রোদকে এগিয়ে আসতে দেখে পারমিতার বুক ধক করে উঠেছিল। ও ভেবেছিল রোদ ওকেই কিছু বলতে আসছে। কিন্তু না, রোদ ওর কাছে আসেনি। রোদ সবার সঙ্গে যথারীতি কুশলাদি বিনিময় করে নিজের কাজ শেষ করে চলে গেল। আজ আর কষ্ট হল না পারমিতার। সেও রোদকে কিছু বুঝতে দিতে চাইলো না। তাই হাসিমুখে বসে রইল।

রোদ কেন কিছু বলছে না, অপেক্ষা করাটা দূরূহ হয়ে উঠেছে এই অপেক্ষা নিয়ে আজকের দিনটা কেটে গেল। রোদ একবার ফোনও করল না। পারমিতা অপেক্ষা করল অনেক রাত অবধি। আগামীকাল বৃহঃস্পতিবার। রোদের কিছু বলার থাকলে সে অবশ্যই কালকেই বলবে। কারণ এরপর দুইদিন অফিস বন্ধ।
পারমিতা আজ ইচ্ছে করেই শাড়ি পরল। হালকা সাজগোজও করে নিলো। শ্যাম্পু করা চুলগুলো মেলে দিলো আজকে। যেন রোজ আজকেই ওকে সেরা প্রপোজাল করে বসে। মনে অনেক উত্তেজনা। বারবার ভাবছে, রোদ যদি ওকে প্রপোজ করে তাহলে কি উত্তর দেবে ও? মিষ্টি হেসে বলবে, আমি রাজি। ধেৎ, এটা একদমই নাটকীয় হয়ে যাবে। তাকে থাকতে হবে স্ট্রং। এতদিনের সব জমিয়ে রাখা কঠোর ব্যক্তিত্ব একদিনেই বিসর্জন দেয়া যাবে না।

প্রীতুলকে স্কুলে দিয়ে পারমিতা অফিসে এলো। দু একজন কলিগ দুষ্টুমি করে জানতেও চাইল, কি ব্যাপার? আজ কোনো স্পেশাল ডেট আছে নাকি?
– অবশ্যই আছে। আমার বান্ধবীদের সঙ্গে আজকে দেখা করবো। ওরা বলল শাড়ি পরে আসবে। তাই আমিও পরলাম।
– তাই নাকি? বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার জন্য এত সাজসজ্জা? তাহলে স্পেশাল পারসন হলে তো একেবারে মাথা খারাপ করা সাজ সাজতেন।

পারমিতা হাসল। মনেমনে বলল, কি করে বলি এটাই আমার স্পেশাল পারসনের জন্য সাজ। এটা তো বলা যাবে না। আমার মানুষটার ভালো লাগলেই আমি সার্থক। তবে সে সাধারণ আমাকেই বেশি ভালবাসে।
মুচকি হাসলো পারমিতা। কাজ শুরু করতে যাবে এমন সময় অফিসে প্রবেশ করল রোদ। পারমিতা চোখ তুলে তাকালো। পারমিতার দিকে এক পলক তাকিয়েই রোদ চমকে উঠলো। যেন আজকে এই সাজটাই আশা করেছিল সে। অথবা এমন কিছু সে আশাই করেনি। পারমিতা মাথা নামিয়ে কাজ করতে লাগল।
রোদ সোজা নিজের চেম্বারে চলে গেল। পারমিতা মনেমনে হাসল। রোদের চাহনিতে কিছু বোঝার উপায় নেই সত্য। তবে মন বলছে, অবাক হয়েছে রোদ।

পারমিতা অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু হতাশ হতে হল। সারাদিন প্রায় শেষ হতে চলল কিন্তু রোদের দিক থেকে কোনো রেসপন্স এলো না। পারমিতার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তারমানে রোদ কি সেদিন স্যারকে যা বলেছে, ভুল বুঝেছে পারমিতা? রোদ আসলেই ওর নয়।
এক ধরনের বিষণ্ণতা ও চাপা টেনশন ভর করল ওর মাঝে। পারমিতা এভাবে অফিস শেষ করলো। আজ কোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার কথা নেই। এখন বাসায় যাওয়া ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই ওর। এত মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে কেঁদে ফেলতে।
পারমিতার মতো শক্ত মেয়েটার যখন কান্না আসে, তখন বুঝতে হবে পারমিতা সত্যিই ব্যথিত, অপমানিত। নিজেই নিজেকে অপমান করেছে ও। খোলা চুল বেঁধে রেখেছে ইতিমধ্যেই। অফিস শেষ করে বাইরে এসে পারমিতা রিকশা নিলো না। বাসেও উঠল না। সন্ধ্যার ছায়া প্রায় নেমে এসেছে। আলো জ্বলছে শহরের সব বিল্ডিংয়ে। পারমিতা ধীরপায়ে হাঁটতে লাগল। মাথা নিচু করে মন খারাপ করে রাখা মেয়েটার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। এক হাত দিয়ে চোখ মুছছে ও।

এমন সময় সামনের ফুটপাতে এক চায়ের দোকানে রোদকে দেখে পারমিতা চমকে উঠল। রোদ চা খাচ্ছে। চোখাচোখিও হল তাদের। কিন্তু রোদ কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না তাতে। পারমিতা কষ্ট পাচ্ছে। তারমানে সত্যিই সেদিন ভুল বুঝেছিল সে।

অনেক কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরে অনেক্ষণ শাওয়ারের নিচে বসে রইল পারমিতা। প্রীতুল নিচতলায় ভাবীর বাসায় আছে। কাজের মেয়েটা দেখাশোনা করছে ওদের। ওকেও নিয়ে আসেনি ঘরে। অনেক্ষণ শাওয়ারে বসে থেকে নিজের মনকে শান্ত করে পারমিতা বেরিয়ে এলো। তোয়ালে গায়ে পেঁচিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল ও। মন ভেঙে গেছে। নিজের সঙ্গে আর কখনো এমন ছলচাতুরী করবে না সে, সিদ্ধান্ত নিলো। ভুলে যাবেই এবার রোদকে।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। পারমিতা ভাবল হয়তো প্রীতুল এসেছে। জামা পরে ভেজা চুল ঝারতে ঝারতে দরজা খুললো পারমিতা। সঙ্গে সঙ্গে বড়সড় ধাক্কা খেয়ে গেল। রোদ এসেছে!

পারমিতা ভেজা চুল এক হাতে সরিয়ে বলল, আপনি!
– প্রীতুলকে দেখতে আসলাম। কোথায় আমার বাবাটা?
– ও বাসায় নেই।

ভেতরে আসার অনুমতি নেবার প্রয়োজন মনে করল না রোদ। দুই হাত ভর্তি খেলনা ও খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে প্রীতুল প্রীতুল বলে ডাকতে লাগল।
পারমিতা দএজা আটকে দিয়ে বলল, বললাম তো বাসায় নেই।
– কোথায় গেছে?
– নীচতলার ভাবীর বাসায় আছে।
– ওহ আচ্ছা। এগুলো এখানে রাখি তাহলে?
– এগুলো কেন এনেছেন?
– প্রীতুলের জন্য।
– দরকার ছিল না। বসুন। আমি ওকে নিয়ে আসছি।
– উহুম, এক গ্লাস পানি খাবো। পিপাসা পেয়েছে।

রোদ হাতের সবকিছু নিচে নামিয়ে রাখল। পারমিতা ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে এলো পানি আনতে। জগ থেকে পানি ঢালতে যাবে এমন সময় রোদ ওর হাত ধরে একটানে পেছনে ঘুরিয়ে নিলো ওকে। জগটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। সামলে নিলো পারমিতা। রোদ পারমিতার চোখে চোখ রাখল। অবাক চোখে পারমিতা রোদকে দেখছে।। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। রোদের অপূর্ব সুঠাম দেহের ওপর হাত রেখে ও অনুভব করল রোদকে। এই মানুষটাকে সে কয়েকদিনে কতটা মিস কিরেছে মানুষটা কি জানে? পারমিতা হাজারও চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। ওর চোখে পানি এসে গেল।

চলবে..

পারমিতা
পর্বঃ ৩০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here