#পারমিতা
পর্ব ৩৭
_নীলাভ্র জহির
১৮+ সতর্কতা
পারমিতাকে কোলে নিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে রোদ। পারমিতার লজ্জা পাওয়ার কথা। কিন্তু ওর একটুও লজ্জা করছে না। বরং রোদের চোখে ওর জন্য প্রেম আর ওকে পাওয়ার আনন্দে আনন্দিত হতে দেখেই পারমিতার বুক ভরে যাচ্ছে। রোদের গলা পেঁচিয়ে হা করে রোদকে দেখছে ও। দূর থেকে আসছে হলুদ আলো। সেই আলোয় রোদের মুখটাকে ওর স্বর্গীয় মনে হচ্ছে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা তাতে রোদের কিচ্ছু যায় আসে না। ও নির্দ্বিধায় পারমিতাকে কোলে নিয়ে রুমে এলো।
পারমিতার জন্য এই রুম। বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে রোদ বিছানার ওপর বসে হা হা করে হাসতে লাগল। পারমিতা জানতে চাইলো, এত হাসছেন কেন?
– হাসবো না? এত যুদ্ধ করে অবশেষে নায়িকাকে জয় করেছি। আজ তো আমার জীবনের সেরা আনন্দের দিন।
– দরজাটা হা করে খোলা। আটকে দিয়ে আসুন।
রোদ দরজা লাগাতে গিয়ে আরও উচ্চস্বরে হেসে উঠল। পারমিতা জানতে চাইলো, কি হল?
– দরজা খোলা থাকুক।
– কেন?
– বন্ধ করলে যদি কিছু হয়ে যায়?
পারমিতা এতক্ষণে লজ্জা পেলো। লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল ও। যেই রোদের গলা ধরে রুমে এসেছে, সেই রোদের কথা শুনেই ওর এখন লজ্জা লাগছে। পারমিতা মুখ টিপে হাসলো।
রোদ দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলো। ততক্ষণে উঠে বসেছে পারমিতা। বলল, দরজা খোলা রাখলেন না যে?
– না রাখাই ভালো। কিছু হবার সম্ভাবনা নেই।
– কী করে বুঝলেন নেই?
প্রশ্ন করে লজ্জায় পড়ে গেল পারমিতা। রোদ ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, সম্ভাবনা থাকার প্রশ্নই আসে না। যে ঘটাবে, সেই যদি কোনো অঘটন না ঘটায়।
– যে ঘটাবে, তার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।
– বিশ্বাস আছে শুধু? ভালবাসা নেই?
– ভালবাসা আছে কিনা সে জানেনা?
– যেখানে ভালবাসা আছে, সেখানে কিছু ঘটতেই পারে। এতে কি কিছু যায় আসে? সেখানে বিশ্বাসের প্রশ্নও অনেক পরে।
– যায় আসে না হয়তো। যদি বিশ্বাসটা পরে ভেঙে দেয়?
– সেটা আবার কেমন বিশ্বাস হল? যে মানুষ বিশ্বাস ভাংবে, তাকে বিশ্বাস না করলেই তো হয়।
পারমিতা রোদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কথায় কথায় অনেক কথাই বলা যায়। আর নয়। ভালবাসার ক্ষেত্রে এত তর্ক বিতর্ক করা যায় না।
রোদ বলল, কিছু খাবে?
– মাত্রই বারবিকিউ খেয়ে আসলাম।
– কোল্ড ড্রিংস?
– ওদেরকে নিয়ে আসতে বলবেন?
– দাড়াও দেখছি।
রোদ দরজার পাশে রাখা ছোট সাইজের ফ্রিজের কাছে গেল। পারমিতা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি এখানে ছোটখাটো একটা ফ্রিজ আছে। ফ্রিজ খুলতেই দেখল বেশ কিছু ড্রিংক্স আছে সেখানে। পারমিতা ছুটে গেল ওর কাছে। রোদ একটা ক্যান বের করে ওর হাতে দিলো। দুজনে ‘চিয়ার্স’ করে হাসতে হাসতে কোমল পানীয়তে গলা ভেজায় তারপর রোদ গিয়ে সোফার ওপর বসে পড়ল। জানতে চাইলো, তোমার নিজের কথা বলো পারমিতা? তুমি কি ভালবাসো?
পারমিতা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কতদিন কেউ জানতে চায়নি ওর ভালোলাগা, ভালবাসার কথা। অবশ্য আগেও এরকম কেউ ছিল না ওর। পারমিতা কি পছন্দ করে, সেটা সে নিজেই ভুলে গেছে।
রোদ জিজ্ঞেস করল, কোথায় হারিয়ে গেলে?
– আমি এক সময় ছবি আঁকতে খুব ভালবাসতাম।
– সত্যি! তুমি ছবি আঁকতে জানো?
– সে তো বহু আগের কথা। ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি। প্রচুর আঁকাআকি করতাম। এত ভালো লাগত আঁকতে। মনে হত ওই ছবি আঁকার সময়টাতেই আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম।
– তারপর? আঁকা বন্ধ হল কেন?
– বন্ধ হয়েছে কারণ বাবা পছন্দ করতেন না। আমার বাবার কেউই চাইত না আমি ছবি আঁকি। গাছ ঘরবাড়ির ছবিও কেউ পছন্দ করত না। একদিন রাগ করে সব রং তুলি পুকুরে ফেলে দিয়েছিলাম।
– এখন আঁকতে পারো?
– না। অনেক বছর আঁকাআকি করিনা। ভুলে গেছি কিভাবে সেই জগতে আবার প্রবেশ করতে হয়। ক্রিয়েটিভ কাজের সঙ্গে থাকলে আলাদা একটা জগত তৈরি করতে হয়। ওই জগত থেকে একবার কেউ বের হয়ে গেলে আর ঢুকতে পারে না।
– সত্যি? আমি তো ভাবছি তোমাকে আবার রং তুলি কিনে দেবো।
– লাভ নেই। যেটা হারিয়ে গেছে, সেটা একেবারেই পতন হয়ে গেছে। এত বছর না আঁকলে, ওই জগতে প্রবেশ না করলে মানুষ কি আর কখনো সেখানে যেতে পারে নাকি? বাদ দিন। আপনার কথা বলুন।
– আমার এরকম কোনো ভালো লাগা নেই। কিন্তু গান শুনতে খুব পছন্দ করি। আর মাঝেমাঝে সবকিছু ছেড়ে নির্জনতায় গিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সেটাকে আমার খুব ভালো লাগে। যেখানে কোনো শব্দ নেই, আশেপাশে মানুষ নেই। এরকম নির্জনতা।
– এখন তো আশেপাশে আমি আছি।
– তুমি তো আমারই অংশ। তোমাকে আলাদা করে দেখি না। যাই হোক, এখন তোমার ভালো লাগার সেরকম কোনো বিষয় নেই?
– না নেই। এখন প্রীতুলের জন্য কিছু করতে পারলেই ভালো লাগে। প্রীতুল আনন্দে থাকলেই ভালো লাগে। এর বাইরে কিছু নেই।
– বুঝেছি। আমার সম্প্রতি একটা নতুন ভালো লাগা যুক্ত হয়েছে জানো?
– না তো। কি সেটা?
– তুমি যখন খুশি হও, আমার সেটা দেখতে খুব ভালো লাগে। তোমাকে খুশি করতে আমি সবকিছু করতে পারবো এরকম ফিল করি।
পারমিতা উঠে এসে রোদের মুখোমুখি বসলো। কথাটা শুনেই রোদের প্রেমে ও আরও একবার পড়েছে। এত সুন্দর করে কে-ই বা কখন ভেবেছে ওকে নিয়ে?
পারমিতা বলল, আমার জন্য আর পাগলামি করবেন না প্লিজ। সবকিছু স্বাভাবিক থাকুক।
– তোমাকে খুশি করতে আমি একটু পাগলামি করতেই পারি। সেটাকে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে?
রোদ উপুড় হয়ে পারমিতার সামনে ঝুঁকল। পারমিতার শরীর কেঁপে উঠল। রোদ ওর একদম মুখোমুখি। ভীষণ কাছাকাছি। রোদ আরও কাছে এগিয়ে এসে পারমিতার মুখ উঁচু করে ধরতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল পারমিতা। রোদ আলতো করে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। পারমিতা খামচে ধরল রোদের গলা। রোদকে কাছে টেনে নিতে লাগল। পারমিতার সাড়া পেয়ে রোদ আরও কাছে চলে এলো ওর। দুজন দুজনকে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগল। উষ্ণ আদরে একে অপরকে ভরিয়ে দিতে লাগল। রোদ পারমিতার গলায়, কাঁধে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। পারমিতা প্রতিটা স্পন্দনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্পর্শ গুলো ওর কাছে ফুলের মতো কোমল হয়ে ধরা দিচ্ছে যেন।
পারমিতা রোদের মাথাটা বুকে চেপে ধরল। অনেক্ষণ রোদকে বুকে জড়িয়ে রেখে শান্ত হল পারমিতা। রোদকে বাঁধা দিয়ে বলল, প্লিজ, আর না।
পারমিতা ‘না’ করার কারণে রোদ আর এগোলো না। ওকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে রইলো। কেউ কোনো কথা বললো না পরবর্তী আধা ঘন্টা। শুধুই নিরবতা।
একসময় নিরবতা কেটে গেল। রোদ পারমিতাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি ঘুমাও। অনেক রাত হয়েছে।
– আপনি ঘুমাবেন না?
– আমি রুমে যাচ্ছি।
রোদ উঠে যাওয়ার সময় পারমিতার ইচ্ছে করল রোদের কলার টেনে ধরে রাখতে। কিন্তু মনে হচ্ছে হাতটা অসাড় হয়ে আছে। পারল না ও। কারণ রোদকে টেনে কাছে রাখলে আজ রাতে ওরা আর নিয়ন্ত্রণের ভেতর থাকবে না। এতটা পাগলামি করার সময় হয়নি এখন। পারমিতা সময়কে তার মত বয়ে যেতে দিলো।
রোদ আরেকটা কোল্ড ড্রিংক্স বের করে খাচ্ছে। পারমিতা নিষ্পলক চেয়ে আছে সেদিকে। রোদ বলল, কি? খাবে?
– একটু দাও।
রোদ ওর দিকে এগিয়ে দিলো। কয়েক চুমুক খেয়ে পারমিতা শান্ত হয়ে বসলো।
রোদ বলল, দরজা আটকে দিয়ে ঘুমাও। সকালে আমরা একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমার ঘুম না ভাংলে ডেকে দিবেন।
– ওকে।
রোদ বেরিয়ে যাওয়ার সময় আরেকবার পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো। পারমিতা দরজা বন্ধ করে দিলো। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে মনে হল, রোদ ওকে পূর্ণ করে দিতে এসেছে। ওর জীবনের একাকীত্ব, বেদনা, দুঃখগুলোকে দূর করে দিতে এসেছে রোদ।
সকালে ঘুম ভাংলে পারমিতা সবার আগে মোবাইল টেনে নিয়ে ঘড়ি দেখল। চমকে উঠলো ও। প্রায় আট টা বাজে। রোদ বলেছিল সকালে একসঙ্গে সূর্যোদয় দেখবে, হাঁটবে। ধেৎ। সবকিছু গুবলেট করে দিয়েছে ও। নিশ্চয়ই রোদ ঘুম থেকে উঠে ওর দরজায় এসে ফিরে গেছে।
পারমিতা তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। হাতমুখ ধুয়ে ভালো একটা জামা পরে চুল আচড়ে সেজেগুজে নিলো। তারপর গেল রোদের দরজায়। কয়েকবার শব্দ করেও সাড়া পেলো না। নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। পারমিতা হাল ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে এসে বসল।
রোদের দরজা খুলে গেল একটু পরেই। ও হাই তুলে বলল, পারমিতা তুমি ডাকছিলে? আমি ঘুমের মধ্যে টের পাচ্ছিলাম। মনে হল ডাকলে। তারপর দেখি আর শব্দ নেই।
পারমিতা হাসলো। রোদ এগিয়ে এসে পারমিতাকে জড়িয়ে ধরল। খালি গা রোদের। পরনে একটা ট্রাউজার। পারমিতা লজ্জা পেলো। রোদের উষ্ণ শরীর জড়িয়ে ধরে ভালও লাগল ওর।
রোদ বলল, গুড মর্নিং।
– মর্নিং।
– এসো। আমার ঘরে এসো। তোমাকে চা করে খাওয়াই।
টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম। রোদ চা বানাতে লেগে প্ড়ল। পারমিতা বলল, ঘরটার কি হাল করে রেখেছেন।
নিজ দায়িত্বে জামাকাপড় ও বিছানা গুছাতে লেগে গেল পারমিতা। রোদ হাসতে হাসতে বললো, এত টাকা দিয়ে থাকবো একটা রাত। একটু এলোমেলো করবো না?
– ওরা কি বলবে?
– কিচ্ছু বলবে না। আমরা চলে যাওয়ার পর ওরা এটা গোছাবে। সেজন্য টাকাও নিচ্ছে মোটা অংকের। এমনি এমনি তো না।
দুই কাপ চা নিয়ে এসে এক কাপ পারমিতাকে দিলো রোদ। পারমিতার ইচ্ছে করছে বাইরে বসে চা খেতে। রোদ একটা টি শার্ট পরে বারান্দায় এসে বসল।
ততক্ষণে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সোনালী রোদ ঝলমল করছে চারপাশে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পারমিতার মুখে পড়েছে।
রোদ বলল, তোমার গালে আমি লেগে আছি
চমকে উঠে পারমিতা গালে হাত দিলো। রোদ উচ্চ স্বরে হেসে বলল, আরে আমি মানে রোদ। ওই রোদ।
সূর্যের দিকে ইশারা করলো রোদ। পারমিতাও হেসে উঠল। চা শেষ করতে করতে একটা মিষ্টি সকাল উপভোগ করলো ওরা।
সকালের নাস্তা খেতে রেস্টুরেন্টে এসে পারমিতা মহা খুশি। ওর সব পছন্দের খাবার আলাদা আলাদা করে সাজানো। মনেমনে রোদকে ধন্যবাদ দিলো ও। খুশিতে রোদের হাত চেপে ধরে রইলো।
রোদ আজকে নাস্তা খাইয়ে দিলো ওকে। একটুও সংকোচ বা দ্বিধা করল না। পারমিতা রোদের আদর ও কেয়ারে একেবারে টইটুম্বুর। এই মানুষটাকে ছেড়ে আর থাকতেই পারবে না ও।
নাস্তা শেষ করে কিছুক্ষণ চারপাশে ঘোরাঘুরির পালা। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে বলে ফেলল শত কথা। যেন কথা ফুরোতেই চায় না।
সামান্তা ফোন করে তারাতাড়ি ওর বাসায় যেতে অনুরোধ করলো। পারমিতা রোদকে বলল, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।
– আমাদের এখনই রওনা দেয়া উচিৎ।
পারমিতা রুমের দিকে হাঁটতে লাগল। ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হতে হবে। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে রোদের হাত ধরে বলল, আমার না একদমই যেতে ইচ্ছে করছে না।
রোদ পারমিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল, আবার আসবো লক্ষিটি। আজকে তো যেতেই হবে। সামান্তা অপেক্ষা করছে।
পারমিতা রুমে এসে বলল, আমি আরেকবার বাথটাবে গোসল করতে চাই।
– আমার রুমে শালার বাথটাবও নেই।
– নেই! কী বলেন? আমি তো ভেবেছি আছে।
– নাহ নেই। দুইটা রুমেই নিশ্চয়ই বাথটাব দেবে না।
– তাহলে আমার রুমে গোসল করুন।
রোদ কয়েক সেকেন্ড পারমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর লাজুক হেসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। পারমিতা জানে কেন হাসছে রোদ।
পারমিতার বাথরুমে ঢুকে রোদ আগে গোসল করতে চলে গেল। পারমিতা বসে রইল রুমে। এমন সময় রোদ দৌড়ে এসে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরল ওকে।
চলবে..