পারমিতা” পর্ব-৩৮

0
1247

#পারমিতা
পর্ব ৩৮
_নীলাভ্র জহির

রোদ খালি গায়ে পারমিতাকে জাপটে ধরেছে। উষ্ণ শরীরের স্পর্শ টের পেয়ে পারমিতা লজ্জায় মুখ লুকানোর চেষ্টা করলো। রোদ ওর কাঁধে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল, চলো না একসঙ্গে বাথটাবে নামি।
শিউরে উঠল পারমিতা। লাজুক কণ্ঠে বললো, মাথা খারাপ?
– হুম গো মাথা খারাপ।
– এত তারাতাড়ি মাথা খারাপ করলে তো হবেনা।
– তোমার মতো একজনকে কাছে পেলে মাথা বুঝি ঠিক থাকার কথা?

পারমিতা মুচকি হেসে উত্তর দিলো, অনেক হয়েছে সাহেব। এখন গোসল করে আসুন। একসঙ্গে বাথটাবে নামার সময় জীবনে অনেক আসবে।
– বাকি জীবনটাই তো পরে আছে। তাই না?
– হুম তাই। সবকিছু গুছিয়ে ফেলেন আগে। তারপর একসঙ্গে বাথটাব না, বিছানাতেও শুয়ে থাকা যাবে।
– এই যা, দিলে তো মাথাটা আরও খারাপ করে। এখন তো আমার বিছানায় তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
– এসব ছেলেমানুষী করার সময় নেই রোদ সাহেব। তারাতাড়ি গোসল সেরে আসুন। আমাদের বের হতে হবে।

রোদ মুখ বাঁকা করে ফেলল। আরও কিছুক্ষণ পারমিতার সঙ্গে দুষ্টুমি চালিয়ে গোসল করতে গেল সে। পারমিতা লাজুক লাজুক মুখ নিয়ে বসে রইল। তার মরুভূমির মতো জীবনে হঠাৎ এত প্রেম কেন এলো! এখন যে ভয় করছে তার। হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয়। রোদকে হারিয়ে ফেললে আর কাউকেই কখনো বিশ্বাস করতে পারবে না সে। জীবনটা তিক্ততার কালো ছায়ায় ঢেকে যাবে। এসব সাত পাঁচ ভেবে পারমিতা দুশ্চিন্তা করছিল।
এমন সময় রোদ গোসল সেরে বের হল। পরনে জড়ানো সাদা তোয়ালে। রোদকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। স্নিগ্ধ ও শান্ত একটা ছেলে। গোসলের পর ভেজা চুলে ওর দেহে যেন বেলীফুলের স্নিগ্ধতা এসে ভর করেছে। পারমিতা কয়েক সেকেন্ড সেদিকে হা করে তাকিয়ে রইল। রোদ যখন ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল, গোসলে যাবেন না ম্যাডাম?
পারমিতা জামাকাপড় নিয়ে দ্রুত গোসল করতে ঢুকল। এখন হালকা গরম পানিতে বাথটাবে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো হত। কিন্তু এইমুহুর্তে তা সম্ভব নয়। হাতে সময় নেই একেবারেই। তারাহুরো করে গোসল সেরে বের হয়ে পারমিতা আফসোসের সঙ্গে বলল, আমার আজকেও বাথটাবে নামতে মন চাইছিল।
– নামো নি?
– ধুর। কোনোমত গায়ে পানি দিয়ে আসলাম।
– ওকে ম্যাডাম। শীঘ্রই আপনার জন্য বাথটাবের ব্যবস্থা করা হবে।
– করা হবে মানে কি?
– করা হবে মানে কাছে আসা হবে। এখন কি একটু কাছে আসবেন?
– উহু। এইমুহুর্তে আর কাছে আসাআসি নয়।

পারমিতার বাঁধা তোয়াক্কা করল না রোদ। একটা টান দিয়ে ওকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে আলতো হাতে পারমিতার গালের চুল সরিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে গোসলের পর দারুণ লাগছে। প্রতিদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠেই এই সুন্দর রূপটা দেখতে চাই।
– আর যদি আমি দেরিতে উঠি?
– আমিও দেরিতে উঠবো।
– কাজ কর্ম করতে হবে না?
– ধুর রাখো কাজ। আগে তো প্রেম।

পারমিতার কোমরে হাত রেখে ওকে বুকের ওপর জড়িয়ে কথাগুলো বলল রোদ। তারপর মলিন মুখে বলল, পারমিতা।
– হুম..
– তোমাকে ছেড়ে তো আমি আর থাকতে পারবো না গো।
– কেন?
চমকে উঠলো পারমিতা। রোদের স্বরে একটা নরম নরম প্রেম খুঁজে পেলো ও।
রোদ বলল, তোমাকে দূরে রাখতে ভীষণ কষ্ট হবে। শোনো, আমরা ঢাকায় ফিরে যত তারাতাড়ি সম্ভব আমার মায়ের সঙ্গে তোমাকে দেখা করিয়ে দেবো। মাকে যতটা সম্ভব আমি বোঝাবো। তুমি শুধু চেষ্টা করবে তাকে খুশি করতে। আমার জন্য এইটুকু করতে পারবে না লক্ষিটি?
পারমিতা আশ্বাস দিয়ে বলল, হ্যাঁ পারবো।
– আমার তো এখনো তোমাকে হারানোর ভয় করে।
পারমিতা রোদের বুকে মাথা রেখে বলল, সেই ভয়টা আমিও পাচ্ছি। আপনাকে হারাতে চাইনা আর।
– চলো যত দ্রুত সম্ভব আমরা কাছে চলে আসি। বাসায় রাজি হলেই আমি বিয়ে করতে চাই। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?

হঠাৎ সরে দাঁড়াল পারমিতা। সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে! এত রাতারাতি আবারও বিয়ে? এই বিয়ে নামক বিভীষিকার কথা ভাবলেই ওর কষ্ট হয়। ওর জীবনটা একদম চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে এই সম্পর্ক। আবারও যদি একই প্রতিফলন হয়? রোদ সেরকম মানুষ নয়। কিন্তু এত দ্রুত বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় পারমিতা। তার মানসিক প্রস্তুতির দরকার আছে।
পারমিতা একটা নিশ্বাস ফেলে উত্তর দিল, ভেবে দেখছি।

রোদ এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না। পারমিতার ভালবাসা পেয়েই সে মহাখুশি। ব্যাগপত্র নিয়ে ওরা চেক আউট করে বের হলো। পারমিতা চারপাশে নজর রেখে বলল- জায়গাটা কিন্তু অনেক সুন্দর। আমরা আবার আসবো।
– এ জীবনে বহুবার আসা হবে।
– আমাকে প্লিজ স্বপ্ন দেখাবেন না।
– স্বপ্ন যদি পূর্ণ করে দিতে আমি ভালবাসি তাহলে কেন দেখাবো না?
– হোক পূর্ণ বা অপূর্ণ। যাই হোক না কেন আমি স্বপ্ন দেখতে চাই না। আমার কোনো উচ্চাভিলাস নেই। আপনিও জীবন থেকে উচ্চাকাঙ্খা দূর করে ফেলুন, দেখবেন জীবনটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।
– ঠিক বলেছো।

গাড়ি ছেড়ে দিলো রোদ। পাশের সিটে বসেছে পারমিতা। বিশাল অরণ্য পার হয়ে তাদের গাড়ি হাইওয়েতে এসে উঠল। পারমিতা খেয়াল করে দেখল সেই ফুচকার দোকানে এখন বিশাল ভীড়। সকালের মিষ্টি রোদে ছাতার নিচে রাখা টেবিলে বসে ছেলে মেয়েরা ফুচকা খাচ্ছে। সামান্তার বাসায় আসতে ওদের খুব একটা সময় লাগল না।
প্রীতুল পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মু তুমি এত দেরি করলে কেন?
রোদ প্রীতুলকে কোলে নিলো। প্রীতুল বলল, আমার জন্য কিছু আনোনি?
পারমিতা চোখ রাঙিয়ে বলল, অভদ্রতা করছো কেন প্রীতুল? এসব কাউকে বলতে হয় না।
– রোদ নিজেই তো বলেছে ওকে বলতে।
– চুপ। মা এটা পছন্দ করে না। আর করবে না।

রোদ বলল, আরে তুমিও না। চুপ করো না। প্রীতুল আমার কাছে যা ইচ্ছে আবদার করতে পারে। প্রীতুল বাবা, আসলে তুমি কি খাবে আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমাকে নিয়েই দোকানে যাবো। তখন তোমার যা ভালো লাগে কিনবা।
– এখনই চলো।
পারমিতা আবারও রাগ দেখালো প্রীতুলকে। রোদ বলল, একটু পর যাই। এখন তো বাইরে কড়া রোদ।
– আমি কি দুষ্টুমি করেছি?
– না তো।
– তাহলে তুমি আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে যাবে?
পারমিতা রোদের দিকে তাকালো। রোদ বলল, হুম। খুব দ্রুত নিয়ে যাবো। আর মাত্র কয়েকটা দিন।
এমন সময় সামান্তার স্বামী রাকিব এসে রোদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। বাড়িতে সামান্তার শ্বশুর শাশুড়িও থাকেন। সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলছেন রোদ ও পারমিতার সাথে। সেখানে বিকেল পর্যন্ত সময় কাটিয়ে ওরা রওনা দিলো। ফেরার পথে রোদ প্রীতুলকে হরেক রকম খাবার ও খেলনা কিনে দিলো। প্রীতুল যা-ই স্পর্শ করেছে সেটাই কিনে দিয়েছে রোদ। খুব সম্ভবত এ কারণেই প্রীতুল রোদকে অনেক পছন্দ করতে শুরু করেছে। সারাক্ষণ রোদের সঙ্গে গল্প করছিল প্রীতুল।
রোদ পারমিতাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে বলল,, সব মনে আছে তো?
– হ্যাঁ। থাকবে না কেন?
– আপনি তো দ্রুত মত বদলে ফেলেন।
– আর এরকম হবে না।
– একটা হাগ..
– এখন না। প্রীতুল কি ভাব্বে?
রোদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে প্রীতুলকে বলল, বাবাই আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে বিদায় দাও তো।
প্রীতুল রোদকে জড়িয়ে ধরল। রোদ ওকে কোলে নিয়ে কোলাকুলি করে বলল, আবার আসবো। কাল দেখা হবে। কি কি লাগবে তোমার আমাকে ফোনে জানিয়ো।
প্রীতুলকে কোল নামিয়ে দিয়ে রোদ পারমিতাকে বলল, আমাকে বিদায় দাও।
বলেই জাপটে ধরল পারমিতাকে। পারমিতা বলল, আপনি যে কী!
হাসতে হাসতে বিদায় নিলো রোদ। পারমিতা বাসায় প্রবেশ করে মনে হল এখন আবার রান্না করতে হবে। রাতের খাবার রেডি করা দরকার। কিন্তু বাসায় বাজার নেই। হঠাৎ করে রোদকে মিস করতে শুরু করল পারমিতা। আবারও নিচে নেমে বাজার করতে করতে ওর বিরক্ত লাগল। তারওপর প্রীতুল ওকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। নাহ, জীবনে একটা মানুষের ভালবাসার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনই তার সহযোগীতারও প্রয়োজন আছে। এই কারণেই হয়তো দুজন মিলে একটা সংসার হয়।

সংসারের কথা ভেবে পারমিতার খুব সংসার করতে ইচ্ছে করল। রান্নাঘরে রান্না করতে করতে ওর মনে হল, যদি ওর আশেপাশে রোদ থাকে, বারবার ডাকাডাকি করে তাহলে ওর ভালোই লাগবে। কিংবা ওকে পেছন দিকে থেকে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ঘষবে আর দুষ্টুমি করবে। এইগুলো তো জীবনেরই অংশ, জীবনেরই চাওয়া পাওয়া। তাহলে কেনই বা সে এসব থেকে দূরে রাখবে নিজেকে?
ওর মন থেকে আজকে আবার সংসারের সাধ জাগছে। তিনজনের একটা ছোট্ট সংসার সাজাতে ইচ্ছে করছে। প্রীতুল ঘর জুড়ে হাসবে, খেলবে আর ওরা দুজন প্রীতুলকে লুকিয়ে প্রেম করবে। রোদের জন্য খাবার তৈরি করে পারমিতা নরম গলায় ডাকবে, এই শুনছো, খেতে আসো।
কথাগুলো ভেবে জোরে হেসে উঠল পারমিতা। কিন্তু প্রীতুল কি বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নেবে? ওর আবারও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল।

রাত নয়টায় ফোন করল রোদ। পারমিতা বিছানায় শুয়ে কোমল গলায় বলল, কি গো এতক্ষণ কি করছিলে?
– মা’র সঙ্গে কথা বললাম।
– আমাদের বিষয়ে?
– হুম।
– কি বললেন উনি?
রোদ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, আরও মশলা ঢালতে হবে মনে হচ্ছে। সে এত সহজে গলবে না। তাকে বুঝাতে হবে আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই নিয়ে সুখী হবো না। এই গুলা বুঝলে উনি অবশ্যই তোমাকে নিয়ে আসবেন। তখন আমারও বলতে হবে না।
– কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?
– ভাবতে হবে। এতদূর এসেছি আমরা। তোমার কঠিন মনকে যখন গলাতে পেরেছি, এটাও পারবো।
– আমার মনকে আপনি গলিয়েছেন?
– অবশ্যই। সেটা তো আপনা আপনি গলার মতো নয়।
– যদি বলি আপনার প্রেম আস্তে আস্তে সেটাকে নিজে থেকেই গলিয়েছে। আপনি নন।
– সত্যি! তাহলে তো আমার প্রেমের শক্তি আছে। এই শক্তি থেকেই দেখবে আম্মুও রাজি হয়ে যাবে।
– আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে।
– আরে ধুর। অযথা টেনশন করো না। রিল্যাক্সে থাকো। প্রীতুলকে কার কাছে রেখে অফিসে যাও?
– একটা মেয়ে রেখেছি। সকালে ওকে স্কুলে দিয়ে যাই। মেয়েটা গিয়ে নিয়ে আসে।
– ভালো করেছো। আমার কাছে আসলে আর চিন্তা নেই। বাসায় আমিই ওকে দেখে রাখব। তুমি অফিস করবে।
– সত্যি! আর আপনার অফিস?
– বিয়ে করলে চাকরি ছেড়ে বাবার অফিসে বসবো। সপ্তাহে তিনদিন যাবো। তুমি তো এমনিতেই দুইদিন ছুটি পাও।
– তারমানে আমার ছুটির দিনে আমি আপনাকে পাবো না?
রোদ হাসতে হাসতে বললো, ঠিক আছে বাবা। আমি অর্ধেক বেলা অফিস করবো। চলবে?
– হ্যাঁ এইবার ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যেভাবে বললেন এভাবে কজন পুরুষ তার স্ত্রীর জন্য ভাবে বলুন? কেউ তো চাকরি করার স্বাধীনতাই দিতে চায় না। যাইহোক, আমি অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু আপনাকেও নিয়মিত অফিস করতে হবে। বাসায় কাজের লোক থাকবে, প্রীতুলকে সে দেখে রাখবে। আর আমি বিজনেস শুরু করলে তো সারাদিন বাসাতেই থাকবো।
– তুমি খুব লক্ষী বউ হবে আমার।
– ধন্যবাদ।

অনেক রাত পর্যন্ত দুজনের ফোনালাপ চলল। দীর্ঘ অনেক বছর পর আবারও ফোনে প্রেম করার স্বাদ পেলো পারমিতা। ও অনেক শান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পারমিতা দেখল রোদ মেসেজ দিয়েছে, আজক সারাদিন ফোন দেবো না। অফিসেও যাবো না। আজ আমি শুধু ঘুমাবো। সন্ধ্যা সাতটায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

পারমিতা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এই অদ্ভুত আচরণের অর্থ কি? সারাদিন ঘুমাতে হবেই বা কেন? আর ঘুমালে কি ফোনেও কথা বলা যাবে না? ওকে মিছেমিছি কষ্ট দেয়ার ফন্দি। পারমিতা সারাটাদিন আজকে দুশ্চিন্তা আর মন খারাপ নিয়ে কাটাবে।

চলবে..

আগের পর্ব গুলো

https://www.facebook.com/100029719223370/posts/641896073477694/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here