পার্থক্য পর্ব-৫

0
1008

পার্থক্য

৫ পর্ব।

#রিফাত_হোসেন।

তারিন চলে গেলো। আর রিফাত দোকান থেকে বন্ধুদের ফোন করে ঠিকানা নিয়ে নিলো।
তারপর রিফাত বন্ধুদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী যেতে শুরু করলো।
কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পেলো আরিয়ান রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।
রিফাত ও সেখানে চলে গেলো। তারপর বলল – ‘কি রে তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

আরিয়ান বলল – ‘তোর জন্যই দাঁড়িয়ে আছি।’
– ‘ওহ্।আচ্ছা চল ভিতরে যাই।
– ‘হুম চল।’

রিফাত আর আরিয়ান ভিতরে এসে গেলো। রিফাত বাড়ির আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, বাড়িটা খুব সুন্দর আর বেশ বড়। মনে হয় বাড়ির মালিক খুব বড়লোক। দু’তলা বাড়ি কিন্তু ভিতরটা খুব সুন্দর । যতই ভিতরে যাচ্ছে ততই সুন্দর দেখা যাচ্ছে।
আরিয়ান রিফাত কে ঘরে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে দেখে সব ফ্রেন্ডরা বসে আছে। আরিয়ান রিফাত কে বসতে বলল।
তারপর জিজ্ঞেস করলো – ‘এবার বল তো সারারাত কোথায় ছিলি।’

– ‘আগে বল এই বাড়িটা কার।’
– ‘এই এলাকার চেয়ারম্যান এর বাড়ি।’

চেয়াম্যানের কথা বলতেই রিফাতের মনে পড়ে গেলো রাস্তায় চেয়াম্যান এর ছেলের বন্ধুদের সাথে ঝগড়া হওয়ার কথা।
রিফাত আরিয়ান কে জিজ্ঞেস করলো – ‘আচ্ছা তোদের এই বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা কে করেছে।’

– ‘চেয়ারম্যান আর তার ছেলে।’
– ‘ওহ্।’
– ‘কেন কিছু হয়েছে নাকি।’
– ‘রাস্তায় কিছু বখাটে ছেলেদের সাথে ঝগড়া হয়েছে। একজন বলল ওদের লিডার নাকি চেয়ারম্যান এর ছেলে। ‘
– ‘বলিস কী? কীভাবে ঝগড়া হয়েছে।’
– ‘পড়ে সব বলব।’
– ‘আচ্ছা তুই এখন রেস্ট নে। আমি একটু আরিফ সাহেবের সাথে কথা বলে আসি।’

রিফাত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো – ‘আরিফ কে?’
– ‘চেয়ারম্যান এর ছেলে।’
– ‘ওহ্।’
– ‘হ্যাঁ তুই রেস্ট নে।’

রিফাত রাফি কে বলল – ‘সবাই রেডি হয়ে থাকিস। বিকেলে ঘুরতে বের হবো।’

রনি বলল – ‘কোথায় যাবি আবার।’
– ‘নতুন একটা এলাকায় এসেছি। এলাকাটা একবার ঘুরে দেখবো না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

তারপর আর কোন কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়লো রিফাত।

৭.
তারিন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে আফজাল সাহেব আর ওনার স্ত্রী আমেনা বেগম। আফজাল সাহেব আর আমেনা বেগম তারিনের বাবা- মা। চারদিকে সব কিছু চুপচাপ হয়ে আছে। সবাই খুব গম্ভীরমুখে বসে আছে। তারিন বুঝতে পারছে না সবাই এভাবে চুপচাপ বসে আছে কেন? মনে মনে এক অজানা ভয় কাজ করছে তারিনের। তবে কী বাবা-মা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে নাকি। এই কথাটা মনে পরতেই তারিন কেঁপে উঠলো। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে তারিনের। কপালে গাম এসে গেছে। তবুও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল – ‘কী হয়েছে বাবা, তোমরা এভাবে চুপ করে বসে আছো কেন?

আফজাল সাহেব কিছু না বলেই চুপ করে বসে আছে। আমেনা বেগম একবার আফজাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমেনা বেগম খুব ভাল করেই জানে আফজাল সাহেব এখন খুব রেগে আছে। তাই তিনি কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
তারিন চোখে ভয় আর মুখে মিথ্যে হাসি নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হলো তোমরা চুপ করে আছো কেন?’

আফজাল সাহেব আর চুপ করে না থেকে সমস্ত গম্ভীরতা কাটিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল – ‘ কাল সারাদিন আর সারারাত কোথায় ছিলে?’

বাবার এরূপ কথা শুনে তারিন শিউরে উঠলো। অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো তারিন। তারপর বলল – ‘আমি তো কালকে বলেছিলাম যে তিশাদের বাড়িতে কিছু নোটস্ আনতে যাবো। তারপর হঠাৎ করেই দেখি তিশার খুব শরীর খারাপ, তাই সেখানেই রাত থেকে যাই। সকালে তিশা বলল, না খেয়ে যেতে দিবে না। সকালের খাবার খাওয়ার পর তিশার মা বলল একটু তিশার কাছে থাকতে তিনি একটু বাহিরে কাজে যাবে। তাই আমার বাড়িতে আসতে দেরি হয়ে গেছে।

আফজাল সাহেব খুব রাগি হলেও মেয়ের সাথে কখনও রাগ দেখায় না। একমাত্র মেয়ে তারিন কে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসে। তাই আফজাল সাহেব খুব শান্ত কন্ঠে পাশের ঘরে তিশা বলে ডাক দিলো।
তিশা পাশের ঘরেই বসে ছিলো। আফজাল সাহেব ডাক দেওয়াতে এই ঘরে সবার সামনে আসে।
তিশাকে এখানে দেখে তারিন আচমকা একটা ধাক্কা খেলো। তারিনের মাথায় মনে হয় আকাশ ভেঙে পড়েছে। এখানে যে তিশা কে দেখবে, এটা আশা করেনি তারিন। মাথার মধ্যে শত শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তারিনের। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারিন। তারিন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল – ‘তিশা তুই এখানে।’

তিশা কিছু বলছে না। শুধু করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তারিনের দিকে। তিশার ও এখানে কিছুই করার ছিলো না। কারণ তিশা আগে থেকে এইসব এর কিছুই জানতো না। তিশার মনেও প্রশ্ন জেগেছে তারিন কে নিয়ে। কেননা তারিন যেখানে যায়, যা করে সব কিছু তিশার কাছে শেয়ার করে। কোথাও যাওয়ার হলে তিশা কে সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু কী এমন হলো যে তারিন আমাকেও না বলে একদিন, একরাত বাড়ির বাইরে ছিলো। আবার আঙ্কেল – আন্টি কে ও মিথ্যে কথা বলে গেছে। তিশা যখন এইসব কথা ভাবছিল। তখন তারিন আবার তিশা কে জিজ্ঞেস করলো – ‘কী হলো চুপ করে আছিস কেন?’

তিশা উত্তর দেওয়ার আগেই আমেনা বেগম বলে উঠলো – ‘সকাল পেড়িয়ে দুপুর হয়ে আসছিল। তবুও তুই বাড়িতে আসছিলি না, আর তোকে ফোনে ও পাচ্ছিলাম না। তাই তোর বাবা নিজে তিশাদের বাড়িতে যায়। আর সেখানে গিয়ে দেখে তিশা একদম সুস্থ। আর তুই সেখানে নেই। এমনকি তুই কালকে ও ওদের বাড়িতে যাস নি। তারপর তিশা আমাদের বাড়িতে এসে বসে আছে তোর অপেক্ষায়।

তারিন মায়ের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেললো। নিজেকে সব থেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে তারিনের। তারিন কখনও ভাবেনি বাবা-মায়ের বিশ্বাস নিয়ে এভাবে খেলা করতে হবে।

আফজাল সাহেব এখনও মাথা নিচু করে আছে। মেয়ের দিকে তাকাতে পারছে না সে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। শান্ত কন্ঠে মেয়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো
আফজাল সাহেব – ‘কেন করলি এমন?’

তারিন কোন কথা বলছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তারিনের কাছে।

আফজাল সাহেব আবার বলল – ‘কী অপরাধ ছিল আমার? কেন আমার সম্মান টা এভাবে শেষ করলি? তোর তো কোন অভাব রাখিনি আমি। যখন যা চেয়েছিস তাই পেয়েছিস। কখনও তোকে কোন কাজে বাধা দেইনি আমি। খুব বিশ্বাস করতাম তোকে। একমাত্র মেয়ে বলে কখনও তোকে কষ্ট পেতে দেইনি আমরা। দিন-রাত পরিশ্রম করে তোকে বড় করে তুলেছি। তার এই প্রতিদান দিলি। দিনে সময় না পেলেও রাতে তোকে ছাড়া আমি খাবার খেতে বসতাম না। কালকে রাতে যখন তোর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। তারপর যখন ফোন করে বললি তুই তিশাদের বাড়িতে আছিস, তখন মনে একটু শান্তি ফিরে এসেছিলো। আমিও তোর এক কথাতে বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ তোর উপর আমার অনেক ভরসা ছিল। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করতাম, আর যাই হোক না কেন? অন্তত তুই আমাকে কখনও মিথ্যে কথা বলবি না। কিন্তু তুই কী করলি? আমাকে মিথ্যে কথা বলে একদিন, একরাত বাড়ির বাহিরে কাঁটালি।
এই কথা বলেই আফজাল সাহেব হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

বাবা-মা’র কান্ন কোন সন্তানের সহ্য হয় না। তেমনি আফজাল সাহেবের কান্না ও তারিনের সহ্য হয়নি। তাই দৌড়ে গিয়ে বাবা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো তারিন। বাবা আর মেয়ের কান্না দেখে আমেনা বেগম আর তিশার চোখে ও জল চলে এলো।

তারিন আফজাল সাহেব কে জড়িয়ে ধরেই বলল – ‘ঠিক বলেছো বাবা, আমি সত্যিই অনেক খারাপ। আমি তোমাদের বিশ্বাস ভেঙেছি। আমি তোমাদের মিথ্যে কথা বলেছি। তোমাদের সম্মান নষ্ট করেছি আমি। আমার মতো মেয়ের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

এই কথা শোনার পর আফজাল সাহেবের বুকটা কেঁপে উঠলো। বুকের ভিতর একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো। নিজের হাত দিয়ে মেয়ের মুখ আটকে দিলো।
তারপর বলল – ‘এই কথা আর কখনও মুখে আনবি না। তুই আমার মেয়ে এটাই তোর বড় পরিচয়।’

তারিনের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরেই যাচ্ছে। আমেনা বেগম আফজাল সাহেবের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন আগে যেই লোকটাত পুরো শরীর জুড়ে রাগ ছিল। আর এখন কতটা শান্ত হয়ে আছে। মেয়েকে দেখার পর সব রাগ শেষ হয়ে গেছে। সত্যি অসম্ভব রকম ভালবাসে মেয়েকে।

আফজাল সাহেব তারিন কে বিছানায় বসিয়ে নিজ হাতে চোখের জল মুছিয়ে দিলো। তারপর বলল – ‘আমি জানিনা তুই কোথায় ছিলি কালকে। তবুও আমি তোকে ছোট থেকে বড় করেছি। কিছুটা হলেও তোকে চিনি। আর যাই হোক আমার বিশ্বাস তুই কখনও খারাপ কোন কাজ করবি না।

তারিন বাবার বিশ্বাস আর ভালবাসার কাছে হার মেনে গেলো। তারপর বলল – ‘এটা সত্যি আমি একটা খুব বড় অন্যায় করেছি। তা হলো তোমাদের মিথ্যে কথা বলেছি। কিন্তু তোমাদের সম্মান যেন নষ্ট না হয়, তাই আমি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছি। কোন মানুষ রূপে হিংস্র পশুর কাছে নিজেকে ছেড়ে দেইনি। তোমাদের ভালবাসায় আজ আমি এখনও বেঁচে আছি। এমন ও হতে পারতো আজ আমার মৃত দেহ কোন রাস্তায় বা রেললাইন এ পড়ে থাকতো। কিংবা তুমি একটক ধর্ষিতা মেয়ের বাবা হিসেবে পরিচয় পেতে। কিন্তু তোমাদের ভালবাসা আর অজানা অচেনা এক বন্ধুর সাহায্যে আমি এখন সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছি।

তারিনের দিকে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে আছে। সবাই মনে মনে ভাবছে তারিন এইসব কী বলছে। কী বোঝাতে চাচ্ছে তারিন। বেঁচে থাকতো না, ধর্ষিতা মেয়ে, এইসব কী বলছে তারিন। আর কেন বলছে এগুলো।

আমেনা বেগম বলল – ‘এইসব কী বলছিস তুই?’

তারিন বলল – ‘হ্যাঁ আমি একটা খারাপ লোকের মিথ্যে ভালবাসার ফাঁদে পড়েছিলাম।

আফজাল সাহেব বলল – ‘মানে?’

তারপর তারিন সবাই কে সব কিছু খুলে বলল। কার ভালবাসার ফাঁদে পড়েছে। কীভাবে সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছে। আর কোন অপরিচিত বন্ধুর সাহায্য এই বাড়ি পর্যন্ত আসতে পেরেছে।

সব কিছু শুনে আফজাল সাহেব এবং বাকিরা স্তব্ধ হয়ে গেলো। আফজাল সাহেব মনে মনে ভাবছে, মেয়ের এইরকম অবস্থায় তার পাশে দাঁড়িয়ে সাপোর্ট না করে তাকে কত কথা শোনালাম। কত কিছু বলে মেয়েকে দোষারোপ করলাম। নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে আফজাল সাহেব।

আফজাল সাহেব আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছে। আর অজানা অচেনা ছেলে রিফাত কে অসংখ্য ধন্যবাদ দিচ্ছে।

চলবে…………?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here